ব্লকচেইনে নিরাপত্তার সুবিধা

বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর দুনিয়ায় নিরাপত্তা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তথ্য চুরি, হ্যাকিং, ফিশিং, ওয়েব অ্যাটাক ইত্যাদি প্রতিনিয়ত আমাদের ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক তথ্যকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্লকচেইন প্রযুক্তি একটি বৈপ্লবিক সমাধান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা কেবল ডিজিটাল লেনদেনের স্বচ্ছতা নয়, বরং অসাধারণ নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতিও দেয়।
ব্লকচেইন কী?
ব্লকচেইন হলো একটি বিকেন্দ্রীকৃত (decentralized) ডিজিটাল খাতা বা রেকর্ডবুক, যেখানে তথ্য সংরক্ষণ করা হয় ব্লকের মাধ্যমে, এবং প্রতিটি ব্লক পূর্ববর্তী ব্লকের সঙ্গে ক্রিপ্টোগ্রাফিকভাবে সংযুক্ত থাকে। অর্থাৎ একবার কোনো তথ্য ব্লকচেইনে যুক্ত হলে, তা পরিবর্তন বা মুছে ফেলা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই অটুট শৃঙ্খলই ব্লকচেইনের প্রধান শক্তি।
কেন ব্লকচেইন নিরাপদ?
১. ডেটা ইমিউটেবিলিটি (পরিবর্তন অযোগ্যতা)
একবার কোনো তথ্য ব্লকচেইনে সংযুক্ত হলে তা পরিবর্তন করা যায় না। এটি নিশ্চিত করে যে, কেউ ইচ্ছেমতো রেকর্ড পাল্টাতে পারবে না। এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক লেনদেন, চুক্তি এবং পরিচয় যাচাইয়ের ক্ষেত্রে।
২. ডিস্ট্রিবিউটেড নেটওয়ার্ক (বিকেন্দ্রীকৃত কাঠামো)
ব্লকচেইন কোনো একক সার্ভার বা প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করে না। বরং এটি শতশত বা হাজারো কম্পিউটারে ছড়িয়ে থাকে। ফলে, একটি কম্পিউটার আক্রান্ত হলেও পুরো নেটওয়ার্ক আক্রান্ত হয় না। এটি ব্লকচেইনকে সাইবার আক্রমণ থেকে অনেক বেশি সুরক্ষিত করে।
৩. ক্রিপ্টোগ্রাফিক নিরাপত্তা
ব্লকচেইনের প্রতিটি তথ্য ব্লক একটি জটিল ক্রিপ্টোগ্রাফিক হ্যাশ দ্বারা সুরক্ষিত থাকে। হ্যাশ এমন একরকম কোড, যা তথ্যের একপ্রকার "ফিঙ্গারপ্রিন্ট" তৈরি করে। যদি কেউ সামান্য পরিমাণেও কোনো তথ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করে, তাহলে সম্পূর্ণ হ্যাশ বদলে যায়, ফলে সেটা সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়ে।
৪. স্মার্ট কন্ট্রাক্ট
ব্লকচেইন প্রযুক্তির মাধ্যমে স্মার্ট কন্ট্রাক্ট তৈরি করা যায়, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ হলে কার্যকর হয়। এতে মানুষের হস্তক্ষেপ কমে, এবং প্রতারণার সম্ভাবনা হ্রাস পায়। এতে লেনদেনের স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তা আরও বৃদ্ধি পায়।
বাস্তব জীবনে ব্লকচেইনের নিরাপত্তা সুবিধা
ব্যাংকিং ও ফিনটেক: ব্লকচেইন লেনদেনকে স্বচ্ছ ও নিরাপদ করে তোলে। প্রতিটি ট্রানজেকশন ট্রেসযোগ্য এবং চিরস্থায়ীভাবে সংরক্ষিত থাকে।
স্বাস্থ্যসেবা: রোগীর চিকিৎসা ইতিহাস ব্লকচেইনে সংরক্ষণ করলে তা নির্ভরযোগ্য, নিরবচ্ছিন্ন ও সুরক্ষিত থাকে। ফলে ভুল চিকিৎসা বা তথ্য গোপনের সুযোগ থাকে না।
সরবরাহ চেইন: কোনো পণ্যের উৎপাদন থেকে গ্রাহকের হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত প্রতিটি ধাপ ব্লকচেইনে ট্র্যাক করা যায়। এটি নকল পণ্য শনাক্তকরণ ও প্রতারণা রোধে সহায়তা করে।
পরিচয় যাচাইকরণ: ব্যক্তিগত পরিচয় সংক্রান্ত তথ্য ব্লকচেইনে সংরক্ষণ করলে তা জালিয়াতি ও তথ্যচুরি থেকে অনেক বেশি নিরাপদ থাকে।
ব্লকচেইন নিরাপত্তা দিলেও কিছু বিষয় মনে রাখা জরুরি
যদিও ব্লকচেইন স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি নিরাপদ প্রযুক্তি, তবে এটি পুরোপুরি অবিনাশী নয়। সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো মানবিক ভুল ও পাসওয়ার্ড ব্যবস্থাপনা। আপনি যদি আপনার ক্রিপ্টো ওয়ালেটের পাসওয়ার্ড বা প্রাইভেট কী হারিয়ে ফেলেন, তাহলে সেই অ্যাক্সেস ফিরে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কারণ ব্লকচেইনে কোনো "পাসওয়ার্ড রিসেট" নেই।
তাই ব্লকচেইনের নিরাপত্তা কার্যকর রাখতে হলে আপনাকে অবশ্যই আপনার লগইন তথ্য, পাসওয়ার্ড, ওয়ালেট কী এবং ব্যাকআপ সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।