মঙ্গলবার ০১ এপ্রিল ২০২৫, চৈত্র ১৮ ১৪৩১, ০২ শাওয়াল ১৪৪৬

প্রযুক্তি

‘শামীম হুসাইন ফ্রিল্যান্সার গড়ার কারিগর’- যুদ্ধ ও যোদ্ধাদের গল্প

মোহাম্মদ খাইরুল আমিন

 আপডেট: ১৪:২১, ২৭ মার্চ ২০২৫

‘শামীম হুসাইন ফ্রিল্যান্সার গড়ার কারিগর’- যুদ্ধ ও যোদ্ধাদের গল্প

মেঘের ভেলায় ভাসতে শুধু নয় প্রয়োজনে মেঘমালায় হাঁটতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই উচ্চতায় পৌঁছেও শামীম হুসাইন আবিস্কার করেন অন্তহীন আঁধার। অতৃপ্তি। অপ্রাপ্তীর অপূর্ণতা। মনে প্রশ্ন জাগে, তিনি আসলে কার জীবন যাপন করছেন? এই যাপিত জীবন তো তাঁর আকাঙ্খিত জীবন নয়। তিনি তো চেয়েছিলেন অন্য জীবন। জীবনানন্দ দাশ বলে যান, জীবন বদলের নেশায় অস্থির হয়ে ওঠা শামীম যেন শুনতে পান-

আলো-অন্ধকারে যাই—মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে;
স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে,
সব কাজ তুচ্ছ হয়—পণ্ড মনে হয়,
সব চিন্তা—প্রার্থনার সকল সময়
শূন্য মনে হয়,
শূন্য মনে হয়।

সেই শূন্যতা থেকেই মুক্তি পেতে আকাশ থেকে সরাসরি মাটিতে নেমে আসেন শামীম। স্বেচ্ছায়। দায়বদ্ধতা তাকে এমন আকুল করে তুলেছিল যে মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির ৬ ডিজিটের বেতনের বড় চেয়ারের চাকরিটা ছাড়তে মুহূর্তকাল দ্বীধা করেননি। তার যে দ্বিতীয়বার সফল হতেই হবে। দেশ বদলের সংগ্রাম, লাখো তরুণ-তরুণীর জীবন বদলের স্বপ্নের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে স্বপ্নের শহর ঢাকা ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্তে পৌঁছান। এক সিদ্ধান্তেই জীবনযাত্রার মান যায় নেমে। লেখকের ভাষায়, মার্লবোরো থেকে গোল্ডলিফে নেমে আসা জীবন তখন শামীমের।

হ্যাঁ, লেখক রাহিতুল ইসলাম লিখেছেন এই অন্যরকম এক বই। এক অদম্য যুবকের আগ্রাসী স্বপ্নের উপাখ্যানের বইয়ের নাম দিয়েছেন তিনি ‘শামীম হুসাইন ফ্রিল্যান্সার গড়ার কারিগর’। বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সিংয়ে ডিজিটাল বিপণন জগতে মেন্টর হিসেবে শামীম এক ট্রেডমার্ক নাম। ‘বস’। এই বস শব্দটাও তাকে ভিন্ন করে অন্যদের চেয়ে। সত্যিকারের বস হিসেবেই। শিক্ষক হিসেবে। মানবিক মানুষ হিসেবে।

লেখক দেশের বড় এক সংবাদপত্রের প্রযুক্তি বিষয়ক সাংবাদিক। প্রথম আলোতে প্রযুক্তি নিয়ে লিখতে লিখতে ৬৪ জেলায় ঘোরাফেরার সূত্রে মিশেছেন ফ্রিল্যান্সিং নামের মুক্তপেশার অনেক পেশাজীবির সঙ্গে। যারা আসলে রেমিট্যান্স যোদ্ধা। দেশের জন্য বৈশ্বিক মানব হয়ে রাতের পর রাত জেগে সীমান্তের বেড়াজাল ভেঙে নিয়ে আসছেন লাখ লাখ ডলার। এই যোদ্ধাদের মধ্যে রাহিতুলের বইয়ের মূল চরিত্র শামীমের ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। বলতে গেলে তার প্রতিষ্ঠান ‘স্কিলআপার’ থেকে শামীমের দেওয়া ট্রেনিং নিয়ে আন্তর্জাতিক মার্কেটপ্লেস বা কাজ দেওয়া নেওয়ার প্ল্যাটফর্মে রাজত্ব করছেন শিষ্যরা। 

বইটা উপন্যাসের আদলে লেখা। শেষে আছে শামীমের খুব সফল ১২ ছাত্রের সংগ্রামভরা ফ্রিল্যান্সিং জীবনের আনন্দময় ও অনুপ্রেরণার গল্প। যে গল্পগুলো আর্টিকল হিসেবে রাহিতুলের সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। আছে শামীমের ওপরও লেখা একটি আর্টিকল। বইটা অবশ্য উপন্যাস  হয়ে ওঠেনি। বোধ করি লেখকের উদ্দেশ্যও তা ছিল না। ওটা হয়ে উঠেছে বড় গল্প। শেষে আছে ছোট গল্পের মতো শেষ হইয়াও হইলো না শেষের মতো আভাস। সে প্রসঙ্গে পরে আসা যাক। 

কালের অধ্যায় পার হতে গল্পে সময়কাল উল্লেখ করেননি রাহিতুল। না আছে শামীমের বয়সের কথা। তবে ধারণা করে নেওয়া যায়, ৩৩ থেকে ৩৬ এমন হতে পারে চরিত্রের বয়স। তিনি ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। লোভে পাপ, পাপে ইঞ্জিনিয়ার। নিজেই বলেন এমনটা। ছেলেবেলাটা দুরন্ত। পড়ালেখার বাইরে নদীর এপার ওপার সাতরে বেড়ানো, লুঙ্গি কাছা মেরে মাছ ধরা, অসংখ্য গানের ভান্ডার তার, মেতে ওঠা তাতে। ভিসিআরে টিকিট কেটে সিনেমার পর সিনেমা দেখা। এসবই ছিল দুরন্ত কৈশরের অনুসঙ্গ।

কিন্তু মেধা তো ছিলই। এক শিক্ষকের সান্নিধ্য তাকে ভালো রেজাল্ট করার প্রেরণা দেয়। বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলে ডাক্তার হবে। কিন্তু ছেলে তা চায়নি বলে এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে থাকলেও বায়োলজি নেয়নি। সূতরাং এইচএসসিতেও বিজ্ঞান থাকলেও ডাক্তার হওয়ার পথ বন্ধ।
 
এইচএসসিতে জীবনে আসে রিপা। যার কাছে প্রাইভেট পড়তেন তার বোন। রঙিন সুতোয় ভবিষ্যত জীবন বুনছিলেন তাঁরা। বাধা হয়ে এলেন ভাই। প্রিয় ছাত্রকে এই পথ থেকে সরতে বাধ্য করলেন। রিপার মুখের কথায়, ‘সুবোধ বালকের মতো’ শামীম সরে গেলেন। রিপাকে বিয়ে দিতে জেলা শহর থেকে গ্রামে পাঠানো হলো।

এরপর উদভ্রান্তের মতো কিছু সময়। এইচএসসি পাশ করে ঢাকায় আসা, কোথাও ভর্তি হওয়া, কোথাও চাকরি নেওয়া, কারো সঙ্গে হালকা রোমান্সে জড়িয়ে পড়া-কিন্তু শেষমেষ বুঝি কিংবদন্তি শিল্পি নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর কথায় হুস ফেরে। কেন জীবনটাকে এভাবে নষ্ট করছেন শামীম?

নিয়াজের এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে নতুন বছরে নতুন উদ্দিপনায় পড়া শুরু করে শেষে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি। ব্যবসায়ের বীজ রক্তে। তখন থেকেই শুরু করেছিলেন। কয়েক বছর পর ছেড়েছেন বাধ্য হয়ে। তারপর ঢাকায় এসে চাকরি এবং দ্রুত উত্থানের গল্প। শক্ত পথ সাহসের সাথে পাড়ি দিয়ে দ্রুতই মেঘমালার সাথে গল্প বলা।
তারপরই সেই বোধ।

শামীম সব ছেড়ে নিজেই ফ্রিল্যান্সিং শুরু করেন। এরপর আনেন কোর্স। গুগল অ্যাডস। ওয়েব অ্যানালিটিক্স। সাড়া ভালোই আসছিল। দ্রুত সম্প্রসারিত হয় গ্রামে ফিরে গিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছেলেমেয়েদের একেবারে কম টাকায় ফ্রিল্যান্সিং শিক্ষা দেওয়ার কাজ। অনলাইনে কোর্স শুরু হয়। রাহিতুলের পত্রিকা প্রথম আলো কাভার করে শামীমের কাজ। তার ছাত্রদের সাফল্য। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে শামীমের যাদুকরী শিক্ষাপদ্ধতির কথা। বাড়তে থাকে তার সফল শিক্ষার্থীদের সংখ্যা।

এই সময়ে শামীমের জীবনে আরেকটা পরিবর্তন আসে। তার জন্যই দিন গুনতে থাকা তারুণ্যের প্রেম রিপা ফিরে আসে জীবনে। শামীমকে আর পায় কে! শামীমের সাথে সাথেই থাকেন রিপা, ছায়াসঙ্গী। কথা হলো প্রণয়ের পরিণতিটা কি হলো? এখানেই দাড়ি টেনেছেন লেখক রাহিতুল। যেন পাঠককে কল্পনা করে নিতে বলেছেন নিজের মতো করে।

তারপরই আছে শামীমের ওপর প্রথম আলোতে ছাপা লেখাটা। ২০২৩ এর শেষের দিকের হিসেবে ১৩ হাজারের বেশি ছাত্রকে শিখিয়েছেন শামীম। গুগুল অ্যাডস, ওয়েব অ্যানালিটিক্সের সঙ্গে যোগ হয়েছে ফেসবুক অ্যাডস। তার লক্ষ্য ৫ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রীকে দেশের জন্য এই ফ্রিল্যান্সিং খাতে রেমিট্যান্স যোদ্ধা বানানো। সফল যোদ্ধা। শামীম কী পারবেন- এই প্রশ্ন লেখকের। 

পাঠক এই বইয়ে শামীমের কাছ থেকে যেমন প্রেরণা পাবেন যে কোনো অবস্থায় জীবন বদলের তেমন তার শিষ্যদের গল্পও কখনো মুখে হাসি ফোটাবে, কখনো চোখে আনবে পানি। কখনো সাহসে টগবগে করে তুলবে আপনাকে। কখনো অনুপ্রেরণা হয়ে শামীমসহ ওই ১২ জন ছাড়াও আরো অনেক নাম না জানা শামীমের যোদ্ধাদের বিমূর্ত মুখচ্ছবি ভেসে উঠবে মনের ক্যানভাসে। আর শামীমের নিজেরই আয় যেখানে দু বছর আগে ছিল মাসে ৫ লাখ টাকার বেশি তাহলে এখন কতো তা অনুমান না করাই ভালো! ত্যাগের প্রতিদান বলে কথা!

ওই ১২ যোদ্ধার যুদ্ধের গল্পের মধ্যে আছে মাত্র ১৬ বছর বয়সেই সোহেলের হাজার হাজার ডলার আয়ের কাহিনি। নামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে করোনাকালে চাকরি হারিয়ে রাতে স্কুলের নাইটগার্ড, দিনে অন্যকাজে আয় করার হাঁড়ভাঙ্গা শ্রম করা ফজলে এলাহীর কথা। শামীমের কোর্স তার জীবনের গতিপথ বদলে দিয়ে তাকে বানিয়েছে ফ্রিল্যান্সিং প্ল্যাটফর্মের অন্যতম সফল একজন। মাত্রই এইচএসসি পাশ করে বাপ্পির কঠোর পরিশ্রম ও ত্যাগে কল্পনার বাইরের আয়ের উৎসও ওই স্কিলআপার। কামলা দিয়ে ল্যাপটপ কিনে, কোর্সের ফি পুরোটা না দিতে পেরেও দরিদ্র সংসারকে প্রবল কঠোর মানসিকতা আর পরিশ্রমে তুলে আনা উচ্চমাধ্যমিক পাশ নিয়ামুলের সাফল্যের গল্প চোখে পানি আনবেই।

রিমনের চিন্তাশীল জগতে দারিদ্রের সঙ্গে লড়ে অদম্য হয়ে ওঠার গল্পও প্রেরণা জাগায়। যেমন মনটাকে টুকরো টুকরো করে দেয় শিল্পির ট্রেন দুর্ঘটনায় এক পা হারানোর ঘটনা। কিন্তু পরক্ষণেই হেরে না গিয়ে জীবনের সাথে যুদ্ধ করে এই জগৎ থেকে হাজার হাজার ডলার আয়ের গাথা মন জুড়াবে। নিজের সেক্টরে সম্ভবত বাংলাদেশে মেয়েদের মধ্যে সর্বপ্রথম ফাইভারে টপ রেটেড হওয়া পপির গল্পটা অন্যরকম। আট মাসে টপ রেটেড। মাসে আয় ৩ হাজার ডলারের বেশি। অথচ একটা ল্যাপটপের অভাবে কি ভোগান্তি না ছিল তার। শাশুড়ির কিনে দেওয়া ল্যাপটপ আর অনুসন্ধিৎসু মন পপিকে সাফল্যের চূড়ায় নিয়ে যাবে তা বলাই যায়। আছে মায়ের গয়না বেঁচে মঈদুলের ল্যাপটপ কিনে শামীমের কোর্সের শিক্ষায় গাড়ি-বাড়ি করে ফেলার অসাধারণ গল্প। দিনে চাকরি আর রাতে আইরিনের ফ্রিল্যান্সিংয়ের সাধনা মেয়েদের নতুন করে সাহস জোগাবে। অন্য গল্পগুলোও বুকের পিঞ্জর ছুঁয়ে যায়। এসব গল্প ও বইটা বর্তমান থেকে নিয়ে অনাগত প্রজন্মকে দেখাবে দেশ বদলের স্বপ্ন।

এই ২০২৫ সালের একুশে বইমেলায় বের হয়েছে রাহিতুলের বইটি। বেশ কাটতি ছিল। চলছে এখনো। প্রতিভাষা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত। অনলাইনে পাওয়া যায় রকমারি, প্রথমা.কম, গ্রন্থিক.কম-এ। বইয়ের গায়ের মূল্য ৩০০ টাকা।

শামীম হুসাইন ফ্রিল্যান্সার গড়ার কারিগর- এই বই এখন রকমারির ২০২৫ বেস্টসেলার এর ফিকশন তালিকার ১ নম্বরে আছে। ২০২৪ এর ১ এপ্রিল থেকে ৩১ মার্চ ২০২৫ অব্দি প্রকাশিত নতুন বইয়ের সেলের ওপর ভিত্তি করে ৪টি মূল বিভাগের বেস্টসেলার ৭ জন করে ২৮ জন লেখক এবং বেস্টসেলার ৭টি করে বইয়ের জন্য ২৮টি প্রকাশনা সংস্থা ‘রকমারি অনলাইন বইমেলা বেস্টসেলার অ্যাওয়ার্ড-২০২৫’ লাভ করবে।

সময় আর বেশি নেই। রাহিতুলের শামীমময় বইটা পুরস্কারের দাবি তো প্রকাশের পর থেকেই জানিয়ে আসছে!

বিশেষ কথা: আপনিও কি ফ্রিল্যান্সিংয়ের সংগ্রামী জীবনে ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে চলেছেন? সাফল্য-ব্যর্থতা ভিন্ন প্রসঙ্গ। যদি আপনি মনে করেন আপনার গল্পটাও উঠে আসা উচিত তাহলে নিঃশঙ্কোচে যোগাযোগ করুন +8801674932987 (Whatsapp) এই নম্বরে।