বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ব্রেকিং

শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকাশে সহায়ক শিক্ষাব্যবস্থা দরকার : ড. মুহাম্মদ ইউনূস কাউকে নির্বাচনে ‘আনতে চাই’ বলিনি: আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গে ফখরুল ডেঙ্গু: একদিনে ভর্তি ১০৩৪ রোগী, মৃত্যু ৫ জনের আনিসুল হক ও দীপু মনিসহ সাবেক ৫ মন্ত্রী নতুন মামলায় গ্রেফতার প্রথমবারের মতো সচিবালয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস জন্মদিনের প্রথম প্রহরে তারেক পেয়েছেন মায়ের ফোন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাবেক পুলিশ প্রধানসহ ৮ জন জাবির ছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় বরখাস্ত ৪, ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা সরবরাহ-পর্যবেক্ষণ জোরদারের মাধ্যমে সিন্ডিকেট অকার্যকর করা হবে: উপদেষ্টা প্রতি ইসরায়েলি বন্দির মুক্তিতে পাঁচ মিলিয়ন ডলার দেবেন নেতানিয়াহ লেবাননে সংঘাতে ২শ’র ও বেশি শিশু নিহত : ইউনিসেফ

ইসলাম

কুরআন কীভাবে বুঝব

 আপডেট: ২০:৫১, ১৯ ডিসেম্বর ২০২১

কুরআন কীভাবে বুঝব

[২০১০ সালের ১৬ জুলাই বৃহস্পতিবার ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের ওয়ানিমবাড়ি এলাকার ‘মসজিদে কাদিম’-এ উলামা ও সাধারণ মানুষের এক বিরাট সমাবেশে প্রদত্ত ভাষণ] খুতবায়ে মাসনুনার পর : মুহতারাম দোস্ত ও বুযুর্গ! এটা আমার জন্য কতই না সৌভাগ্যের বিষয় যে, আল্লাহ পাক এমন একটি শহরে আসার তাওফীক দিয়েছেন, যে শহর কুতবুল ইরশাদ মাওলানা গাঙ্গুহী রাহ.-এর খলীফাগণ ও শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান রাহ.সহ অন্য বুযুর্গদের ফায়েযে ধন্য। আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ যে, এ কারণে শহরে দ্বীনি পরিবেশ দেখা যাচ্ছে। আমাকে বলা হয়েছে, ‘কুরআন বুঝার আদব’ সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য; তাই আমি ঐ আয়াত তেলাওয়াত করেছি, যে আয়াতে আল্লাহ পাক নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পৃথিবীতে প্রেরণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন।

 

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণের উদ্দেশ্য আল্লাহ তাআলা বলেন- لقد من الله على المؤمنين اذ بعث فيهم رسولا من انفسهم، يتلو عليهم آياته ويزكيهم ويعلمهم الكتاب والحكمة، وان كانوا من قبل لفى ضلال مبين ‘আল্লাহ মুমিনদের ওপর বড়ই দয়া ও অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের থেকেই একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন।’ যিনি তাদের নিকট তাঁর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করেন, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন। যদিও তারা পূর্বে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতেই ছিল।-আলে ইমরান : ১৬৪ আল্লাহর প্রথম অনুগ্রহ হল -রাসূল প্রেরণ। দ্বিতীয় অনুগ্রহ, মানুষের মধ্য থেকে প্রেরণ। অর্থাৎ এমন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি মানবিক চাহিদাগুলো বোঝেন। তিনি বোঝেন কোন্ জিনিস মানুষের প্রয়োজন, মানুষের কী দরকার। কোনো ফেরেশতা পাঠাননি, যিনি পানাহার করেন না।

 

এরপর আল্লাহ পাক নবী প্রেরণের চারটি উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন- ১. يتلو عليهم آياته ‘তাদেরকে কিতাব ও আয়াতসমূহ পড়ে শোনান।’ ২. ويزكيهم ‘তাদেরকে পবিত্র করেন।’ অর্থাৎ তাদের চরিত্রকে পূতপবিত্র ও সুন্দর করেন, উত্তম ও শ্রেষ্ঠ বানান। ৩-৪. ويعلمهم الكتاب والحكمة ‘তাদেরকে কিতাব ও হিকমতের তালীম দেন।’ কুরআন তিলাওয়াত একটি পৃথক উদ্দেশ্য এ চারটি উদ্দেশ্য আল্লাহ পাক চার স্থানে উল্লেখ করেছেন। এতে এগুলোর গুরুত্ব বুঝা যায়। আমি এ চারটির মধ্যে দুইটির আলোচনা করতে চাই। কিতাবের তিলাওয়াত এবং কিতাবের তালীম। আল্লাহ পাক কুরআন শরীফের আয়াতের তেলাওয়াতকে নবী প্রেরণের পৃথক একটি উদ্দেশ্য বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আর কুরআন বোঝাও আলাদা আরেকটি উদ্দেশ্য। এ দ্বারা অনেকের ভুল বুঝাবুঝির অবসান হবে বলে আশা করি, যারা বলেন, মক্তবে বাচ্চাদেরকে তোতা পাখির মতো কুরআন মুখস্থ করানো হয়। তারা অর্থ ও ব্যাখ্যা না বুঝলে তাদের কী ফায়দা হবে? কুরআনের এ আয়াত ওইসব লোকদের ভুল বোঝাবুঝির অবসান করে ঘোষণা দিচ্ছে যে, কুরআনের তেলাওয়াত স্বয়ংসম্পূর্ণ পৃথক একটি উদ্দেশ্য।

 

ইলমে তাজবীদের সৌন্দর্য কুরআন মজীদ হচ্ছে হেদায়াতের ব্যবস্থাপত্র, যা সাধারণ ডাক্তার বা হেকিমদের ব্যবস্থাপত্রের মতো নয়। কারণ তাদের ব্যবস্থাপত্র বুঝতে না পারলে কোনো উপকারে আসে না। আর কুরআন শরীফ হচ্ছে হেদায়াতের এমন ব্যবস্থাপত্র যার এক-একটি অক্ষর পাঠ করলে দশ দশটি নেকী পাওয়া যায়। এটি এমন এক গ্রন্থ, যা থেকে এমন জ্ঞান উৎসারিত হয়েছে, যার উপমা দুনিয়ার কোনো জাতির মধ্যে পাওয়া যাবে না। এগুলোর মধ্য থেকে একটি হল ‘ইলমুত তাজবীদ’। অর্থাৎ কুরআন শরীফের অক্ষরসমূহ উচ্চারণের সঠিক পদ্ধতি। যেমন أ অক্ষরটি কোথা থেকে উচ্চারিত হয়। এর মাখরাজ কী? ب কোথা থেকে উচ্চারিত হয়। ض ও ظ এর মাঝে কী পার্থক্য? এসব বিষয় ইলমে তাজবীদ থেকেই জানা যায়। অন্যান্য ভাষায় এমন বিষয় নেই। যেমন ইংরেজী ভাষায় একথা পাওয়া যায় না যে, D কোথা থেকে বের হয়, C ও H কোথা থেকে উচ্চারিত হয়। এ কারণে দেখা যায়, স্থানভেদে এগুলোর উচ্চারণেরও পার্থক্য হয়। আমেরিকায় এগুলো একভাবে উচ্চারণ করা হয় তো ইউরোপে অন্যভাবে। সবাই নিজ নিজ পদ্ধতিতে উচ্চারণ করে। তেলাওয়াত হচ্ছে কুরআন বুঝার প্রথম ধাপ কুরআন কারীম এমন একটি কিতাব, যা নিয়ে আসতেন হযরত জিবরীল আ.। তিনি কুরআন পড়ে শোনাতেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন- فاذا قرأناه فاتبع قرآنه ‘যখন ফেরেশতা কুরআন পড়তে আরম্ভ করবেন তখন আপনি তাঁর অনুসরণ করুন।’ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে কুরআন শরীফ এভাবেই পড়ে শোনাতেন যেভাবে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে। আর সাহাবায়ে কেরাম তা শিখতেন।

 

আলহামদুলিল্লাহ, আজ আমরা উচ্চকণ্ঠে বলতে পারি যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে কুরআন তেলাওয়াত করতেন আমরা হুবহু সেভাবেই তেলাওয়াত করছি। এতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। আল্লাহ পাক এ উম্মতকে এই মর্যাদা দিয়েছেন যে, ইলমে তাজবীদের ন্যায় একটি শাস্ত্র দিয়েছেন। কুরআনের অর্থ বুঝার জন্য কুরআনের আয়াতসমূহ সঠিকভাবে উচ্চারণ করা ও পড়া প্রথম শর্ত। কেউ সহীহ-শুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত করতে না পারলে সে কী করে কুরআন বুঝবে? তাছাড়া কুরআনের তেলাওয়াত হচ্ছে পৃথক একটি উদ্দেশ্য। তাই কেউ একথা মনে করবেন না, মক্তবে কুরআন পাঠ শেখা ও শেখানো বেকার। নাউযুবিল্লাহ। আরবীভাষীদের কিতাবুল্লাহর শিক্ষাদান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণের উদ্দেশ্যাবলির মধ্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি হচ্ছে কিতাবুল্লাহ শিক্ষাদান। এ উদ্দেশ্যের বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, ويعلمهم الكتاب ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুমিনদেরকে কিতাবের তালীম বা শিক্ষা দেন।’ কিতাবের তালীম দ্বারা কী উদ্দেশ্য? শুধু আয়াতের অনুবাদ বলে দিবেন? তিনি তো শিক্ষা দিবেন আবু বকর, উমর, উসমান, আলী রা.কে। তারা কি আরবী ভাষা জানেন না? এঁদের প্রত্যেকেই তো আরবী ভাষায় দক্ষ ছিলেন। হযরত উমর ফারুক রাযিআল্লাহু আনহু আরবী ভাষায় এত দক্ষ ছিলেন যে, বড় বড় সাহিত্যিক পর্যন্ত তাঁর সামনে নিজেদের ‘কালাম’ পেশ করলে তা সংশোধন করতেন। আরবের মহিলারাও তো ছিলেন স্বভাবকবি।

 

অপরদিকে কুরআনের ঘোষণা بلسان عربى مبين ‘কুরআন স্পষ্ট আরবী ভাষায় অবতীর্ণ করা হয়েছে।’ তাহলে তো আরবী ভাষা শিক্ষা করার জন্য বা কুরআনের অর্থ বুঝার জন্য তাঁদের কোনো শিক্ষকের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু দেখা যায়, এরপরও আল্লাহ পাক আরবী ভাষীদের কুরআন শিক্ষা দেওয়ার জন্য নবী প্রেরণ করেছেন। এ থেকে বুঝা গেল যে, কেবল অনুবাদ পড়ে নিলে অথবা শুধু আরবী ভাষা জেনে নিলে কিতাবুল্লাহর বুঝ ও কুরআনের ইলম অর্জন হয় না; বরং কুরআনকে সঠিকভাবে বুঝতে হলে কোনো শিক্ষক বা মুরবিবর অবশ্যই প্রয়োজন। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর স্বভাবগত পার্থক্য আল্লাহ মানুষের প্রকৃতিই এমন বানিয়েছেন যে, তারা শুধু গ্রন্থ পাঠের দ্বারা কোনো বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে পারে না; দক্ষতা অর্জনের জন্য শিক্ষক বা মুরবিবর অবশ্যই প্রয়োজন পড়ে। আল্লাহ পাক কিছু কিছু বিষয়ে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য রেখেছেন। যেমন মুরগী ডিম পাড়ে, ডিম থেকে বাচ্চা বের হয়। বাচ্চা বের হয়ে সে প্রথম দিনেই চলতে শুরু করে। মাছের পোনা পানিতে জন্ম নিয়েই সাঁতার কাটতে আরম্ভ করে। এ দেখে কেউ যদি নিজের বাচ্চাকে পানিতে ছেড়ে দেয় এই ভেবে যে, সে সাঁতার কাটতে আরম্ভ করবে তাহলে কী অবস্থা হবে। বস্ত্তত সাঁতার শিখতে হলেও তার কোনো শিক্ষকের প্রয়োজন।

 

শিক্ষক ছাড়া কোনো বিষয়ে পূর্ণতা অর্জন হয় না কেউ যদি মেডিকেল সাইন্সের গ্রন্থাদি কিনে এনে সেগুলো পড়ে, এরপর চিকিৎসা দিতে আরম্ভ করে, তাহলে গোরস্থানের অধিবাসী বাড়ানো ছাড়া আর কী সেবা হবে? তেমনি কেউ প্রকৌশল বিদ্যার বইপত্র পড়ে নিলেই তাকে লোকেরা ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে মেনে নেবে না। বাজারে রন্ধনের বিষয়ে অনেক বই পাওয়া যায়, যেগুলোতে নিয়ম কানুন লিখিত। বিরিয়ানী কিভাবে হয়, কাবাব কিভাবে বানাতে হয়, কোরমা কিভাবে তৈরি করা যায়-এসব নিয়ম দেখে দেখে কোরমা, কাবাব তৈরি করলে জানি না তা কি আজব ধরনের খানা হবে; এর জন্যও অভিজ্ঞ ব্যাক্তির কাছে প্রশিক্ষণ নিতে হয়। দুনিয়ার কোনো বিষয়ই অভিভাবকের তত্ত্বাবধান ছাড়া হাসিল করা যায় না। নবী ছাড়া শুধু কিতাব কখনো অবতীর্ণ হয়নি আল্লাহ তাআলা যে কিতাবই অবতীর্ণ করেছেন, ইঞ্জিল, যাবুর, তাওরাত বা কুরআন প্রত্যেকটির সাথে নবী পাঠিয়েছেন। এমনও ঘটেছে যে, নবী এসেছেন, নতুন কিতাব আসেনি। তবে এমন উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে না যে, শুধু কিতাব এসেছে, নবী আসেননি। কেন? কারণ মানুষকে তো আল্লাহ পাকই সৃষ্টি করেছেন, তাই মানুষের প্রকৃতি ও স্বভাব তাঁরই ভালো জানা আছে যে, কিতাবের সাথে মানুষের জন্য শিক্ষক ও অভিভাবকেরও প্রয়োজন। আলো ছাড়া কিতাবের দ্বারা কোনো ফায়দা হয় না কুরআন শরীফের এক স্থানে আল্লাহ পাক খুবই সূক্ষ্মভাবে উল্লেখ করেন- قد جاءكم من الله نور وكتاب مبين ‘তোমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে নূর ও খোলা কিতাব।’ -মায়েদা : ১৫ এখানে নূর দ্বারা উদ্দেশ্য, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষার আলো। এ থেকে বুঝা গেল যে, কিতাব যতই শ্রেষ্ঠ হোক না কেন, এর সাথে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষার আলো না থাকলে তা দ্বারা সুফল পাওয়া যাবে না। এর দৃষ্টান্ত হল চোখের জ্যোতি। চোখের জ্যোতি না থাকলে শুধু গ্রন্থ কী সুফল দিবে? তেমন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষার জ্যোতি ছাড়া কুরআন শরীফ থেকেও ফায়দা হাসিল করা যাবে না। কিতাব শিক্ষা দেওয়া নবীর দায়িত্ব মক্কার মুশরিকদের দাবি ছিল ‘কুরআন কেন একবারে নাযিল হয় না।’ -ফুরকান : ৩২ আল্লাহ চাইলে তো এমন হত যে, লোকেরা রাতে ঘুমাতে যেত আর সকালে উঠে দেখত যে, বালিশের নিচে উন্নত বাঁধাই করা কুরআনের কপি। আর তাদেরকে বলে দেওয়া হত, নাও, কিতাব এসে গেছে। পড়, বুঝ এবং আমল কর। এমন হলে তা তো অলৌকিক বিষয় হত। ফলে ঈমান আনারও আশা বেশি করা যেত। কিন্তু এমন হয়নি; বরং কুরআন এল, সাথে নূর নিয়ে এল। যেন এমন না হয় যে, তোমরা নিজেদের মনমতো অর্থ বুঝতে আরম্ভ কর এবং নিজের বুঝমতো আমল শুরু কর। এ কারণেই আল্লাহ পাক শিক্ষক পাঠিয়েছেন এবং তাকে কিতাব শিক্ষা দেয়ার দায়িত্ব দিয়েছেন। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وانزلنا اليك الذكر لتبين للناس ما نزل اليهم ‘হে নবী! আমি তোমার উপর কুরআন এজন্য অবতীর্ণ করেছি যাতে তুমি লোকদের সামনে এসব বিষয় স্পষ্ট করে দাও, যা তাদের জন্য অবতীর্ণ হয়েছে।’ -নাহল : ৪৪ প্রথম ইসলামী মাদরাসার শিক্ষাদান পদ্ধতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কিতাব কিভাবে শিক্ষা দিয়েছেন? হযরত সাদ বিন আবী ওয়াক্কাস রা. বলেন, আমি আট বছরে সূরায়ে বাকারা শিক্ষা করি। এভাবে যে-‘একই সাথে ইলম, আমল ও কুরআন তেলাওয়াত শিক্ষা করতাম।’ এভাবে শিখতে আমার আট বছর লেগে ছিল। আল্লামা সুয়ূতি রাহ. ‘আল ইতকান’ গ্রন্থে এ বর্ণনা উল্লেখ করেছেন, আশা করি আসহাবে সুফফাহ সম্পর্কে আপনারা জানেন। এরা ওইসব সাহাবী ছিলেন, যারা সুফফা নামক স্থানে পড়ে থাকতেন। তাদের একমাত্র কাজ ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেন তা হাসিল করা। ইসলামের ইতিহাসে সর্ব প্রথম মাদরাসা ও প্রথম ভার্সিটি হচ্ছে এই সুফফা। এখানে কী হত? সাহাবায়ে কেরাম রা., রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে হাজির হতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলতেন, যা করতেন তাঁরা তা শিখতেন, বুঝতেন। তাঁর চলাফেরা নিকট থেকে প্রত্যক্ষ করতেন। এগুলো দ্বারা কুরআন শরীফের তাফসীর বুঝতেন। এটাই ছিল সাহাবায়ে কেরামের ইলম হাসিলের পদ্ধতি। অর্থাৎ কুরআনের ইলম ও এর উপর আমল একই সাথে তাঁরা হাসিল করতেন। শুধু অনুবাদের উপর নির্ভর করে কুরআনের ব্যাখ্যা করা মূর্খতা সাহাবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সান্নিধ্য লাভ করেছেন। তাঁরই সান্নিধ্যে থেকে ইলম হাসিল করেছেন। এরপর সাহাবায়ে কেরাম তাবেয়ীদেরকে শিক্ষা দেন। তাবেয়ীরা তাবে তাবেয়ীদেরকে। এভাবে আলহামদুলিল্লাহ নবী-শিক্ষার এ ধারাবাহিকতা আজ আমাদের পর্যন্ত চলে এসেছে।

 

এখন যদি কেউ বলে, আমার কোনো শিক্ষকের প্রয়োজন নেই, আমি অনুবাদ পড়ে পড়ে যা বুঝে আসে বুঝে নিব-তাহলে আপনি নিজের বিবেককে জিজ্ঞাসা করুন, যে কুরআনের তাফসীর বুঝানোর জন্য আল্লাহ পাক নবী প্রেরণ করেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তেইশ বছর পর্যন্ত তা শিক্ষা দিয়ে গেছেন, সাহাবায়ে কেরাম যার পিছনে জীবন ব্যয় করেছেন, তাবেয়ীন যা সংরক্ষণ করে আমাদের পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন-এসব কিছু না মেনে যদি কেউ বলে আমার কোনো শিক্ষকের প্রয়োজন নেই; বরং আমি যা বুঝব তাই সঠিক, তাহলে এর থেকে বড় নির্বুদ্ধিতা আর কী হতে পারে? ‘কুরআন সহজ’-এর অর্থ কী? কুরআন শরীফের একটি আয়াতের অর্থ বোঝার ক্ষেত্রে কারো কারো ভুল হয়। এখানে তা দূর করা জরুরি। কুরআন বলে, ولقد يسرنا القرآن للذكر فهل من مدكر ‘আমি কুরআনকে উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ করে দিয়েছি।’ অতএব কেউ আছে কি যে উপদেশ গ্রহণ করবে? কেউ কেউ বলে, আমরা কুরআন থেকেই কুরআনের অনুবাদ নিজে বুঝব এবং এর উপর আমল করব। যারা এমন কথা বলে, তারা এ আয়াতের মর্মই বুঝেনি। খুব ভাল করে মনে রাখতে হবে যে, কুরআনের বিষয়বস্ত্তসমূহ দুই প্রকার : প্রথম প্রকার : কিছু আয়াত এমন রয়েছে যেগুলোতে আল্লাহপাক মানুষকে উপদেশ দিয়েছেন যে, আল্লাহ এক, আখিরাত সম্পর্কে বলেছেন যে, একদিন তোমাদের সকলকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। এ উপদেশ একজন সাধারণ মানুষ শুধু অনুবাদ পড়ে গ্রহণ করতে পারবে। এ কারণেই তো কুরআন স্পষ্ট বলেছে, উপদেশ গ্রহণের ক্ষেত্রে সহজ।

 

দ্বিতীয় প্রকার : দ্বিতীয় প্রকারের বিষয়বস্ত্ত, যেগুলোতে আল্লাহ পাক আহকাম ও আমছাল বা উপমা পেশ করেছেন। এসব হুকুমের ব্যাপারে আল্লাহ নিজে বলেন- وتلك الامثال نضربها للناس وما يعقلها الا العالمون ‘আমি এসব উপমা মানুষের উপকারার্থে প্রদান করে থাকি তবে তা কেবল ইলমওয়ালারাই বুঝবে।’ আর ইলম তা-ই যা সাহাবায়ে কেরাম অর্জন করেছিলেন। যদি চৌদ্দশ বছর পর এখন কেউ বলে, আমি নিজে গবেষণা করে কুরআনের ব্যাখ্যা বলব, এ পর্যন্ত যা তাফসীর করা হয়েছে তা আমার বুঝে আসছে না, এগুলো আমি মানি না, বরং আমি আমার বুদ্ধি দিয়েই বুঝব, তাহলে ওই ব্যক্তি পদে পদে ভুল করবে? নিছক বুদ্ধির অনুসারী ‘মুফাসসির’ উপমহাদেশে সর্বপ্রথম এমন তাফসীর করেছেন স্যার সায়্যিদ আহমদ। তার তাফসীর থেকে মনে হয়, পূর্ণ কুরআন যেন রূপক। এতে হাকিকত বা বাস্তব বলতে কোনো কিছু নেই। কুরআনের এক আয়াতে এসেছে যে, যখন হযরত মূসা আ.-এর কাছে তার কওম পানি চাইল তখন মুসা আ. আল্লাহর দরবারে দুআ করলে আল্লাহ পাক হুকুম দিলেন, اضرب بعصاك الحجر ‘তুমি তোমার লাঠি দ্বারা পাথরে আঘাত কর।’ স্যার স্যায়িদ আহমদ এ আয়াতের ব্যাখ্যা এভাবে করেন- اضرب এর অর্থ হল চলা। আর ‘হাজার’ অর্থ পাহাড়। তো আয়াতের অর্থ পাহাড়ে চড়লে ওখানে ঝর্ণা দেখতে পারবে।’ মূসা আ. পাহাড়ে চড়ে ঝর্ণা দেখতে পেলেন। তো এটা কোনো মুজিযা নয়, এটা ছিল বাস্তবতা। এটা এমন এক তাফসীর যা পূর্ববর্তী সকল তাফসীর থেকে ভিন্ন।

 

কুরআনের অন্য এক স্থানে যেখানে জান্নাতের আলোচনা করতে গিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘জান্নাতে ফলমূল থাকবে, হুর থাকবে, বাগান ও মহল থাকবে।’ স্যার সায়্যিদ বলেন, ‘এগুলো আল্লাহ পাক এজন্য বলেছেন, যাতে অশিক্ষিত বেদুঈনদের একটু লোভ হয়। বাস্তবে জান্নাত ও হুর বলতে কোনো কিছুই নেই; বরং জান্নাত হল এক বিশেষ ধরনের প্রশান্তি, যা নেককার লোকদের অর্জিত হবে।’ মূলত শিক্ষক না থাকায় এ অবস্থা হয়েছে। শিক্ষক ও মুরবিব ছাড়া নিজের চিন্তা-বুদ্ধি দিয়ে কুরআন বুঝতে আরম্ভ করলে অবশ্যই গোমরাহী ও ভ্রষ্টতার দ্বার উন্মুক্ত হবে। এ কারণেই আল্লাহ পাক কুরআনের সাথে রাসূলও প্রেরণ করেন।

 

শুধু নিজের বুদ্ধি দিয়ে কুরআন বুঝনেওয়ালা গোমরাহ কুরআনে এসেছে- والسارق والسارقة فاقطعوا ايديهما ‘পুরুষ চোর এবং নারী চোরের হাত কেটে দাও।’ এখন এক নতুন ‘মুফাসসির’ বলেন, হাত কেটে দাও অর্থ অকর্মণ্য করে দাও এবং তাকে এমন শাস্তি দাও যাতে সে আর কখনো চুরি না করে বা চুরি করার সাহস না পায়। তিনি এমন তাফসীর কেন করলেন? কারণ পশ্চিমারা বলে, ইসলামে হাত কাটার শাস্তি একটি পাশবিক কাজ। তাই তাদের ভয়ে, তাদের সামনে হাত জোড় করে বলতে লাগলেন, আয়াতের অর্থ হাত কাটা নয়; বরং এমন শাস্তি দেওয়া, যাতে আর কখনো চুরি করতে না পারে। তো কোনো শিক্ষক ও মুরবিব না থাকলে এমন সব ‘তাফসীরে’র পথ উন্মোচিত হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দিকনির্দেশনা ও সাহাবায়ে কেরাম রা. থেকে বর্ণিত তাফসীর ছাড়া নিজের বুদ্ধি দিয়ে শুধু অনুবাদের সাহায্যে কুরআনের তাফসীর আরম্ভ করলে ভ্রষ্টতা ও গোমরাহীর কোনো সীমা থাকবে না। কুরআন বুঝতে আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন এ কারণেই কুরআনের কোনো কোনো স্থানে ويعلمهم الكتاب এর পূর্বে ويزكيهم এসেছে। অর্থাৎ প্রথমে তাদের পরিশুদ্ধ কর, পাক-পবিত্র কর, তাদের চরিত্র গঠন কর, ইখলাস ও লিল্লাহিয়্যাত পয়দা কর। এরপর অর্থ শিক্ষা দিলে ফায়দা হবে। এ কারণেই কুরআন শরীফের আয়াত-ولا يمسهم الا المطهرون-এর এক তাফসীর এও করা হয় যে, কুরআনকে পাক পবিত্র না হয়ে স্পর্শ করো না। অর্থাৎ যারা খারাপ আখলাক থেকে পাক সাফ হয়, তাদের মধ্যে ইখলাস ও তলব পয়দা হবে তখন তারা কুরআন শিক্ষায় মনোযোগী হবে। প্রথমে আল্লাহর কাছে দুআ করুন, তিনি যেন পাক-পবিত্র করে দেন এবং ইখলাস ও হকের তলব পয়দা করে দেন। এরপর শিক্ষক ও মুরবিবর নিকট থেকে তা শিক্ষা করুন। তাহলে কুরআনের নূর হাসিল করা সম্ভব হবে। নতুবা গোমরাহীর দ্বার উন্মুক্ত হবে। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন। অনুবাদ : হাফেয মাওলানা ফখরুযযামান

অনলাইন নিউজ পোর্টাল