৫ উইকেটের জয়ে বরিশালের টানা ৫
নান্দনিকতা আর আগ্রাসনকে একসঙ্গে মেলানো খুবই কঠিন। বিপরীতমুখি দুটি ঘরানাকেই এক সুতোয় গাঁথার কাজটি সুনিপুণভাবে করলেন দাভিদ মালান। আগের দুই ম্যাচে ০ ও ৯ রানে আউট হওয়া ব্যাটসম্যান এবার উপহার দিলেন দুর্দান্ত এক ইনিংস। ইংলিশ ব্যাটসম্যানের ফিফটির সঙ্গে অন্য ব্যাটসম্যানদের কার্যকর অবদানে রান তাড়ার চ্যালেঞ্জে জিতে গেল বরিশাল।
বিপিএলে খুলনা টাইগার্সকে ৫ উইকেটে হারিয়ে টানা পঞ্চম জয়ের দেখা পেল ফরচুন বরিশাল।
মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে মঙ্গল খুলনা ২০ ওভারে তোলে ১৮৭ রান। বরিশাল জয় পায় ৫ বল বাকি থাকতে।
দুর্দান্ত ব্যাটসম্যানশিপের প্রদর্শনী মেলে ধরে ৩৭ বলে ৬৩ রানের ইনিংস খেলেন মালান। কম-বেশি অবদান রাখেন দলের সব ব্যাটসম্যানই।
১০ ম্যাচে বরিশালের জয় এখন রংপুর রাইডার্সের সমান ৮টি। তবে রান রেটে গিয়ে রংপুর। এই দুই দলই খেলবে প্রথম কোয়ালিফায়ার ম্যাচে।
খুলনার এটি ১০ ম্যাচে ষষ্ঠ হার। প্লে-অফ খেলা আরেকটু কঠিন হয়ে উঠল তাদের জন্য।
হৃদয়ের ব্যর্থতার পর জমাট জুটি
বরিশালের রান তাড়ায় তাওহিদ হৃদয় ব্যর্থ আরেকবার। একটি করে চার ও ছক্কায় ১১ রানেই শেষ হয় তার ইনিংস।
সেই ধাক্কা বরিশাল সামাল দেয় মালানের দারুণ ব্যাটিংয়ে। তামিম ও মালান, দুই বাঁহাতির জন্য বোলিংয়ে ছিলেন তখন মিরাজ। তাকে দুটি চার মেরেই ছুটতে শুরু করেন মালান। অসাধারণ সব শট খেলতে থাকেন বাঁহাতি ইংলিশ ব্যাটসম্যান। বিশেষ করে, অফ সাইডে তার শটগুলি ছিল দেখার মতো।
প্রথম ওভারে আবু হায়দারকে এক্সট্রা কাভারের ওপর দিয়ে গ্যালারি আছড়ে ফেলার পর তামিম বড় শট খেলতে ধুঁকছিলেন। টাইমিংই ঠিকঠাক করতে পারছিলেন না। অন্য প্রান্তে মালানের টাইমিং ছিল নিখুঁত। পেস-স্পিন, সব বোলিংয়েই তিনি ছিলেন সাবলীল। হাসান মাহমুদকে ছক্কা মেরে ফিফটি করেন ৩১ বলে।
তামিম ১৮ রানে জীবন পান নাঈম সহজ ক্যাচ ছেড়ে দেওয়ায়। তার পর সালমান ইরশাদকে একটি ছক্কা মারলেও আর গতি পাননি। বরিশাল অধিনায়ক আউট হন ২৫ বলে ২৭ রান করে।
জুটিতে রান আসে ৫৬ বলে ৯১, সেখানে মালানের রানই ৬১।
আফিফ-ঝলক
সালমান ইরশাদের বলে সীমানায় দারুণ ক্যাচ নিয়ে তামিমকে ফেরান আফিফ। এরপর বল হাতে মালানকে ফিরিয়ে তিনি ম্যাচে ফেরান খুলনাকে।
কার্যকর জুটি
তামিম-মালানের বিদায়ের পর বরিশালকে পথে রাখেন মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ। মুশফিক ক্রিজে যাওয়ার পরপরই ছক্কা মারেন আফিফ হোসেন ও নাসুম আহমেদকে। প্রথম বলে বাউন্ডারিতে শুরু করে মাহমুদউল্লাহও ছুটতে থাকেন দ্রুততায়। তিন বলের মধ্যে দুটি ছক্কা মারেন তিনি মোহাম্মদ নাওয়াজকে।
তবে দুজনের কেউই কাজ শেষ করতে পারেননি। বদলি ফিল্ডার মাহমুদুল হাসান জয়ের সরাসরি থ্রো থামায় মাহমুদউল্লাহকে (১৩ বলে ২৪)। পায়ে টান লাগায় তখন মাঠ ছেড়ে যান বোলার সালমান ইরশাদ। ওভারটি শেষ করার দায়িত্ব পান আবু হায়দার। তার প্রথম বলে শর্ট কাভারে ক্যাচ দেন মুশফিক (১৭ বলে ২৪)।
ফাহিম-নাবির ফিনিশিং
টানা দুই বলে অভিজ্ঞ দুই ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে কাজ বেশ কঠিন হয়ে যায় বরিশালের। ৩.৩ ওভারে তখন তাদের প্রয়োজন ৩৬ রানের।
তবে ফাহিম আশরাফ ক্রিজে গিয়েই চার ও ছক্কা মেরে সমীকরণ সহজ করে ফেলেন। পরের ওভারে হাসান মাহমুদের বলে নাবির বিশাল ছক্কায় ম্যাচ চলে আসে নাগালে।
৬ বলে ১৮ রান করে অপরাজিত থাকেন ফাহিম, ১০ বলে ১৫ রান করে নাবি।
মিরাজের তিন ছক্কা
খুলনা ব্যাটিংয়ে নামে টস হেরে। ম্যাচের প্রথম ওভারে জেমস ফুলারের বলে মোহাম্মদ নাঈম শেখের ছক্কার পরও প্রথম তিন ওভারে ১৬ রান তোলে খুলনা। মেহেদী হাসান মিরাজের ঝড়ে পরের তিন ওভারে আসে ৪০ রান।
চতুর্থ ওভারে মোহাম্মদ নাবিকে টানা দুই বলে চার ও ছক্কা মারেন মিরাজ। পরের ওভারে টানা দুই বলে বিশাল দুটি ছক্কা মারেন তিনি ফাহিম আশরাফকে। প্রথমটি আপার কাট করে পয়েন্টের ওপর দিয়ে, পরেরটি স্লগ করে মিড উইকেটে।
পাওয়ার প্লের শেষ ওভারে দুর্দান্ত এক ইয়র্কারে মিরাজকে (১৮ বলে ২৯) থামান ইবাদত হোসেন চৌধুরি। খুলনা অধিনায়কের পায়ে লেগে বল ছোবল দেয় স্টাম্পে। পায়ে আঘাত পেয়ে তিনি মাঠ ছাড়েন স্ট্রেচারে।
ইবাদতের স্যালুট
মিরাজকে আউট করে ইবাদতকে দেখা যায় সেই চেনা উদযাপনে মেতে উঠতে। প্রায় দুই বছর পর বিপিএলে দেখা যায় তার ‘স্যালুট।’
চোটের কারণে গত বিপিএলে তিনি খেলতে পারেননি। চোটের কারণে এক বছরের বেশি সময় মাঠের বাইরে থেকে কিছুদিন আগে ফেরেন জাতীয় লিগ দিয়ে। পরে জাতীয় লিগ টি-টোয়েন্টিতে পাঁচ ম্যাচ খেলে শিকার করেন ১০টি উইকেট। ৩১ বছর বয়সী পেসার এবারের বিপিএলে প্রথম সুযোগ পেলেন এই ম্যাচ দিয়েই।
সুইপোলজিস্টের ঝলক, নাঈমের ঝড়
সুইপ খেলার দক্ষতার জন্য ‘সুইপোলজিস্ট’ নাম পেয়ে যাওয়া অ্যালেক্স রস ছোট্ট নমুনা দেখান তার দক্ষতার। তানভির ইসলামকে সুইপ করে ছক্কা মারেন তিনি, পরের বলে রিভার্স সুইপ করে মারেন চার, এরপর আরেকটি চার প্রথাগত সুইপে।
ততক্ষণে জেগে উঠেছেন নাঈমও। ইবাদতকে টানা দুটি বাউন্ডারিতে পাওয়ার প্লে শেষ করার পর পরপর চার মারেন তিনি ফুলারকে। এরপর ফাহিমকে তিন বলে ছক্কা-চার-ছক্কায় পঞ্চাশে পৌঁছে যান ২৬ বলেই।
পরের ডেলিভারিতেই অবশ্য ক্যাচ দেন তিনি উইকেটের পেছনে। জুটিতে আসে ২০ বলে ৫২ রান।
খুলনার রানের গতিও একটু কমে আসে পরের চার ওভারে। নাবির বলে রস বোল্ড হয়ে যান ১৫ বলে ২০ করে।
আফিফের দুই রূপ
আফিফ হোসেনের শুরুটা ছিল মন্থর। ১৪ বলে তার রান ছিল ৯। পরে পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি রিশাদ হোসেন ও ইবাদতকে দুটি ছক্কা মেরে। তবে আগের বহুবারের মতো একবার ব্যর্থ হন ইনিংসকে পূর্ণতা দিতে (২৭ বলে ৩২)।
মারকাটারি মাহিদুল
১০ ওভারে যে দলের রান ছিল ১০২, পরের ৭ ওভারে তারা যোগ করতে পারে কেবল আর ৪৮ রান। দুইশর পথে থাকা দলের তখন ১৮০ হওয়া নিয়েই শঙ্কা।
শেষ পর্যন্ত শেষ তিন ওভারে ৩৭ রান তুলতে পারে তারা মূলত মাহিদুল ইসলাম অঙ্কনের সৌজন্যে। স্লগ ওভারে বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ে এবারে বিপিএলে নিজেকে নতুন করে তুলে ধরা এই ব্যাটসম্যান খেলেন আরেকটি কার্যকর ইনিংস। তিন দফায় তাকে জীবন দিয়ে নিজেদের বিপদ ডেকে আনে অবশ্য বরিশালও।
শেষ ওভারে প্রথম দুই বলে ছক্কার পর টানা তিন বলে রান নিতে পারেননি মাহিদুল। তার পরও অপরাজিত থাকেন ১২ বলে ২৭ রান করে। উইলিয়াম বোসিস্টো ১৬ বলে করেন ২০।
নেই পুঁজি খুব খারাপ ছিল না। তবে তা যথেষ্ট হয়নি বরিশালের ব্যাটিং গভীরতার সামনে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
খুলনা টাইগার্স: ২০ ওভারে ১৮৭/৫ (মিরাজ ২৯, নাঈম ৫১, রস ২০, আফিফ ৩২, বসিস্টো ২০*, নাওয়াজ ২, মাহিদুল ২৭*, ফুলার ৩-০-৩২-১, নাবি ৪-০-২২-১, ইবাদত ৪-০-৪৫-১, ফাহিম ৪-০-৪৯-২, তানভির ১-০-১৬-০, রিশাদ ৪-০-২২-০)।
ফরচুন বরিশাল : ১৯.১ ওভারে ১৮৮/৫ (হৃদয় ১১, তামিম ২৭, মালান ৬৩, মুশফিক ২৪, মাহমুদউল্লাহ ২৪, ফাহিম ১৮*, নাবি ১৫; মিরাজ ৪-০-২৯-০, আবু হায়দার ২.৪-০-৩৫-২, হাসান ৩.১-০-৩৬-০, বসিস্টো ১-০-৫-০, ইরশাদ ২.২-০-২১-১, নাসুম ৩-০-২৮-০, আফিফ ১-০-১৩-১, নাওয়াজ ২-০-১৮-০)
ফল: ফরচুন বরিশাল ৫ উইকেটে জয়ী।
ম্যান অব দা ম্যাচ: দাভিদ মালান।