শহীদ রিফাতের খুনিদের বিচার দাবি বাবা-মায়ের

শহীদ আবু বকর রিফাতের (২৩) মা বিউটি আক্তার (৪৫) তার আদরের সন্তানকে হারিয়ে এখনও গভীর শোকে ডুবে আছেন। প্রিয় সন্তানকে চিরতরে হারানোর দুঃখ যেন তাকে এক বেদনার চক্রে বন্দী করে রেখেছে।
শহীদ হওয়ার পটভূমি
দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী রিফাত ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ী এলাকায় হাজারো মানুষের সঙ্গে আনন্দ-উল্লাস করতে গিয়ে শহীদ হন। সেদিন স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতনের পর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের অংশ হিসেবে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে।
মায়ের আর্তনাদ
ব্যক্তিগত শোক ছাপিয়ে বিউটি আক্তারের বেদনা এক পরিবর্তনের আহ্বানে রূপ নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে সকলের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনতে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে। কিন্তু এখনও গণপরিবহন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা স্বাধীনতার স্বাদ পাইনি।’
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ছেলের শহীদ হওয়ার প্রসঙ্গে বাসস-এর সঙ্গে আলাপকালে বিউটি বলেন, ‘আমার ছেলের জীবনের বিনিময়ে আমি চাই দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক, ঘুষ ও দুর্নীতি বন্ধ হোক এবং গরিব-দুঃখীর সমান অধিকার নিশ্চিত হোক।’
বাবার গর্ব ও বেদনা
শোক ও গর্ব মিশ্রিত অনুভূতি প্রকাশ করে রিফাতের বাবা মো. আউলাদ হোসেন (৫৫) বলেন, ‘দেশের জন্য আমার ছেলে শহীদ হয়েছে বলে আমি দুঃখ করি না। আমি চোখের পানি মুছে ফেলেছি, কারণ স্বৈরশাসনের পতনে হাজারো মানুষ আনন্দ প্রকাশ করেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এটা আমার গর্বের বিষয় যে, আমার ছেলে দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছে।’
রিফাতের স্বপ্ন ও সংগ্রাম
চার ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয় ছিলেন রিফাত। ছোটবেলা থেকেই তিনি ন্যায়ের প্রতি অনুরাগী ছিলেন। ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেওয়ার বিষয়ে তার মা যখন তাকে সতর্ক করতেন, তখন তিনি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতেন, ‘আমি যদি মারা যাই, তবে শহীদ হব। শহীদদের কোনো পাপ থাকে না।’
রিফাতের বড় ভাই মাহবুব রানা (২৬) ও দ্বিতীয় ভাই সাইম আহমেদ (২৪) প্রবাসে থাকেন, আর ছোট বোন সামিয়া আক্তার (১৫) কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। পরিবারটি যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকার মোহাম্মদবাগে বসবাস করে।
রিফাত ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলেন। তার বাবা আউলাদ বলেন, ‘একবার সে রাবার বুলেটের আঘাত নিয়ে বাসায় ফিরেছিল, কিন্তু আমাদের তা জানায়নি। পরে তার বোন বিষয়টি আবিষ্কার করে। সে আমাদের দুশ্চিন্তামুক্ত রাখতে চেয়েছিল।
শেষ দিনের স্মৃতি
শহীদ হওয়ার দিনটির স্মৃতি স্মরণ করে আউলাদ বলেন, ‘রিফাত সকাল ১০টায় বাসা থেকে বের হয় এবং রায়েরবাগ প্রধান সড়কে জাতীয় পতাকা মাথায় বেঁধে অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেয়। যাওয়ার আগে সে পরোটা খেয়ে যায় এবং মায়ের কপালে ও গালে চুমু দেয়, যেন মায়ের ভালোবাসা সে সাথে নিয়ে যাচ্ছে।’
‘কিন্তু আসর নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হতেই রিফাতের কয়েকজন বন্ধু এসে আমাকে রায়েরবাগ যেতে বলে। সেখানে গিয়ে জানতে পারি, রিফাত মাতুয়াইল হাসপাতালে আছে। সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলাম, আমার ছেলে আর বেঁচে নেই।’
‘কিন্তু মাতুয়াইল হাসপাতালে তাকে পাইনি। পরে পাশের এক বেসরকারি হাসপাতালে রিফাতের মৃতদেহ পাই,’ স্মৃতিচারণ করেন শোকাহত বাবা।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য
রিফাতের পরিবার পরে জানতে পারে, যাত্রাবাড়ী থানার সামনে যখন হাজারো মানুষ স্বৈরশাসনের পতনে উল্লাস করছিল, তখন পুলিশ গুলি চালিয়ে তাকে হত্যা করে।
প্রিয় সন্তানের শেষ বিদায়ের হৃদয়বিদারক স্মৃতি শেয়ার করে আউলাদ বলেন, ‘আমরা সেদিনই রিফাতকে কদমতলী পারিবারিক কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত করি।’
স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ
গত ১৬ বছরের শাসন নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে দেশের মানুষকে স্বাধীনতা এনে দিতে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছে, কারণ গত ১৭ বছরে আমরা প্রকৃত স্বাধীনতা পাইনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘পাঞ্জাবি-টুপি পরে রাস্তায় হাঁটাও কঠিন ছিল। কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলে সরকার মানুষকে জামাত-শিবির বলে গ্রেপ্তার করত।’
শূন্যতার কষ্ট
রিফাতের মা বিউটি আক্তার এখনও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তিনি বলেন, ‘রিফাত ছিল আমার সবচেয়ে ছোট সন্তান। সবাই থাকলেও আমি রিফাতকে দেখতে পাই না। সে আর কখনো ফিরে আসবে না।’
রিফাতের স্মৃতি এখনও তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তিনি বলেন, ‘ও যখন বাসায় আসত, আমার গালে চুমু দিত। এখন আমাকে আর কেউ এভাবে ভালোবাসে না,’ কাঁদতে কাঁদতে বলেন তিনি।
রিফাত প্রতিদিন বাসা থেকে বের হওয়ার আগে ২০ টাকা চাইত। এই প্রসঙ্গে বিউটি বলেন, ‘এখন আর কেউ আমার কাছে টাকা চায় না। এই শূন্যতা আমি প্রতিদিন অনুভব করি।’
শহীদ হওয়ার দিন সকালেও রিফাত টাকা চেয়েছিল, কিন্তু বিউটি দিতে পারেননি, কারণ তার কাছে খুচরা টাকা ছিল না। তিনি বলেন, ‘রিফাত বলেছিল, "বিকেলে ফিরে এসে নেব।" কিন্তু সে আর ফিরে আসেনি।’
অপূর্ণ স্বপ্ন
রিফাতের স্বপ্নের কথা স্মরণ করে তার মা বলেন, ‘আমার ছেলে ইতালি যেতে চেয়েছিল। সে পাসপোর্ট করেছিল এবং কিছু টাকাও জমিয়েছিল।’
‘ও আমাকে বলেছিল, "আমি বিদেশে গিয়ে তোমার জন্য গাড়ি কিনব, এসি-সহ বাড়ি বানাব।" কিন্তু সেই স্বপ্নগুলো আর পূরণ হবে না,’ বিউটি ভারী মনে বলেন।
বিচারের দাবি
রিফাতের ছোট বোন সামিয়া ভাইয়ের মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না। তিনি বলেন, ‘আমার ভাই শুধু ভাই ছিল না, সে আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল। দুই ভাই প্রবাসে থাকায় সে-ই আমার সবকিছু ছিল।’
কিন্তু এখন সেই বন্ধন ছিন্ন হয়েছে। সামিয়া বলেন, ‘আমার ভাইকে শেখ হাসিনার নির্দেশে পুলিশ হত্যা করেছে। কেন আমার ভাইকে মারা হলো? সে তো কোনো অপরাধ করেনি, শুধু ন্যায়বিচার চেয়েছিল।’
তার দাবি স্পষ্ট ও দৃঢ়: ‘আমি আমার ভাইয়ের হত্যাকারীদের বিচার চাই। আমি ন্যায়বিচার চাই।’ রিফাতের বাবা আউলাদ হোসেন বলেন, ‘আমি আমার ছেলের হত্যাকারীদের মৃত্যুদণ্ড চাই।’