দুই শিশু সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত শহীদ নবীনের স্ত্রী রুমা

দিনটি ছিল ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই, শুক্রবার। সকালে গোসল করে জুমার নামাজ পড়তে ছেলেকে নিয়ে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন নবীন তালুকদার। ছেলেকে বলেছিলেন, ‘তুমি আজ বাড়ির পাশের মসজিদে নামাজ পড়ো, আমি বায়তুল মোকাররমে নামাজ পড়ব। আগামীকাল তোমার সঙ্গে ক্রিকেট খেলব।’ এই বলে পল্টনে চলে যান নবীন। আর ঘরে ফিরে আসেননি তিনি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রাজধানীর পল্টনে গত ১৯ জুলাই পুলিশের গুলিতে শহীদ হন নবীন তালুকদার (৪০)। তিনি পেশায় ছিলেন লাইব্রেরি ও নার্সারি ব্যবসায়ী। ঢাকার শ্যামপুরের ভাড়া বাসায় বৃদ্ধ মা, স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন তিনি।
বাউফল উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন নবীন। তার গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার সূর্যমণি ইউনিয়নের পূর্ব ইন্দ্রকূল গ্রামে।
বাবার নাম মরহুম ফকরুল ইসলাম ধলা তালুকদার, মায়ের নাম সাহিদা বেগম (৬০)।
শহীদ নবীন তালুকদারের স্ত্রীর নাম রুমা আক্তার (৩৯)। মেয়ের নাম হাজেরা তালুকদার রুহানা (১৫) আর ছেলের নাম নূরনবী তালুকদার রোহান (১৫)।
তারা দুজন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
ঘটনার বর্ণনায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে নবীন তালুকদারের স্ত্রী রুমা আক্তার বলেন, ‘আমার সন্তানদের বাবা ১৯ জুলাই, শুক্রবার বিকেল ৪টার দিকে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। গুলি লেগে মাথার খুলি সরে যায়, মগজ বেরিয়ে আসে। সন্ধ্যায় খবর পেলাম, তিনি আর নেই।’
রুমা বলেন, ‘পরদিন ২০ জুলাই, শনিবার, লাশ নিতে হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়েছি। থানায় দৌড়েছি অনেকবার। সব জায়গায় ভোগান্তি। প্রশাসনের কেউ সাহায্য করেনি। সবাই হতাশ করেছে আমাকে—যেন আমার স্বামী শহীদ হয়েও মহাঅপরাধ করে ফেলেছে।’ কান্নায় চোখ ভিজিয়ে শহীদ নবীন তালুকদারের স্ত্রী অসহায়ের মতো বলেন, ‘আমার সব শেষ হয়ে গেছে।’
‘সেদিন সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আমি তাকে বলেছিলাম, বাইরে অনেক ঝামেলা হচ্ছে, কোথাও যেয়ো না। সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়ে বলল, "কোথাও যাচ্ছি না, আমার কিছু হবে না।"’
পরে, শুক্রবার জুমার দিন হওয়ায় বাবা-ছেলে গোসল করেন। জুমার নামাজের প্রস্তুতি নিয়ে ছেলেকে বাড়ির কাছের মসজিদে রেখে বায়তুল মোকাররমে যান তিনি। ছেলেকে বলে যান, ‘আগামীকাল শনিবার তোমার সঙ্গে ক্রিকেট খেলব।’
শহীদ হওয়ার দিন বিকেলে তার সঙ্গে শেষবারের মতো কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমি যেখানে আছি, সেখানে অনেক গোলাগুলি হচ্ছে, তুমি টেনশন করো না। আমি এখান থেকে বের হয়ে তোমাকে ফোন করব।’
পরে আর ফোন আসেনি। কান্নায় ভেঙে পড়ে রুমা আক্তার বলেন, ‘পরে আমি বারবার ফোন করলেও সেই ফোন আর রিসিভ হয়নি। কিছুক্ষণ পর ছাত্র-জনতার কেউ একজন ফোন করে স্বামীর মৃত্যুর খবর জানায়।’
ঢাকা মেডিক্যালে লাশ খুঁজে পেতে সহায়তা করেন বাউফলের আরিফুল ইসলাম আরিফ। তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চাকরি করেন।
আরিফ বলেন, ‘এদিন ঢাকা মেডিক্যালে অনেক লাশ এসেছিল। তার মধ্যে পোশাকের বর্ণনা অনুযায়ী নবীন তালুকদারের লাশ সন্ধান করে পেয়েছি। পরে আমার ভাইয়ের লাশ বলে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে রাখি। যদিও এটি করা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ।’
‘ফোন পেয়ে ঢাকা মেডিক্যালে গেলাম স্বামীর লাশ আনতে। সেখানে সারাদিন লেগে ময়নাতদন্ত করা হয়। পরে সন্ধ্যার দিকে লাশ নিয়ে এসেছি শ্যামপুরে।’
কান্নায় ভেঙে পড়েন শহীদ নবীন তালুকদারের স্ত্রী।
কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘জানাজার পর গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফলের ইন্দ্রকূলে নিয়ে যাই। কিন্তু সেখানেও বাধা আসে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এবং সূর্যমণি ইউপি চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন বাচ্চু জানাজা দিতে বাধা দেন। মরেও শান্তি পেল না আমার স্বামী!’
আওয়ামী লীগের বাচ্চু চেয়ারম্যানের বাধায় কোনো স্কুল মাঠ না পেয়ে বিলের মধ্যে নবীন তালুকদারের জানাজার ব্যবস্থা করেন স্থানীয়রা। পরে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
সরকারি বা বেসরকারি সহযোগিতা পেয়েছেন কি না—এমন প্রশ্নের উত্তরে রুমা আক্তার বাসসকে বলেন, ‘সরকারিভাবে আমরা কিছু পাইনি। তবে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম অর্থসহায়তা এসেছে—দলটি ২ লাখ টাকা দিয়েছে। পরে বিএনপির পক্ষ থেকে আরও আড়াই লাখ টাকা পেয়েছি। জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে এখনো টাকা পাইনি, আবেদন করেছি।’
নবীন তালুকদারের স্ত্রী রুমা বলেন, ‘যারা আমার স্বামীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে, তাদের বিচার চাই। বিশেষ করে হুকুমের দায়ে খুনি হাসিনার এবং হত্যায় জড়িত পুলিশের ফাঁসি চাই। হাসিনাকে যেন দেশের মাটিতে এনে ফাঁসি দেওয়া হয়।’
রুমা আক্তার বলেন, ‘সরকার যেন আমার দুই সন্তানকে ঠিকভাবে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে সাহায্য করে। আর আমাকে শহীদের স্ত্রী হিসেবে একটি সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করে দিলে আমার সংসারটি দুই সন্তান ও শাশুড়িকে নিয়ে ভালোভাবে চালিয়ে নিতে পারব।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে শহীদ নবীন তালুকদারের মেয়ে হাজেরা তালুকদার রুহানা বলেন, ‘বাবাকে অনেক মিস করি। বাবা আমাকে 'মামনী' বলে ডাকতেন। বাইরে থেকে আমাদের জন্য মজাদার অনেক কিছু নিয়ে আসতেন। বাবা স্কুলে নিয়ে যেতেন। এসব খুব মিস করি। সরকার যেন আমার পরিবারের দায়িত্ব নেয়।’
শহীদ নবীন তালুকদারের মা ষাটোর্ধ্ব সাহিদা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘যারা আমার একমাত্র ছেলেকে হত্যা করেছে, আমার বুক খালি করেছে, তাদের ফাঁসি চাই। আর হুকুমের আসামি হিসেবে খুনি হাসিনার ফাঁসি চাই।’
তিনি বলেন, ‘আমি যেন মৃত্যুর আগে চোখে দেখে যেতে পারি, আমার ছেলের খুনিদের ফাঁসি হয়েছে। তাহলেই আমার আত্মা শান্তি পাবে। সরকারের কাছে আকুল আবেদন, আমিসহ আমার সন্তানের পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব যেন সরকার নেয়।’
উল্লেখ্য, নবীন হত্যার ঘটনায় গত ২০ আগস্ট রাজধানীর পল্টন থানায় শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে অজ্ঞাতনামা ১৫০ থেকে ২০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন শহীদ নবীন তালুকদারের স্ত্রী রুমা আক্তার।