অসময়ে চলে যাওয়ায় অন্ধকার নেমে এসেছে শহীদ ইমনের পরিবারে

মা রিনা বেগম চেয়েছিলেন ছেলে বেঁচে থাকুক, আন্দোলনে না যাক। গভীর আবেগ ও ভালোবাসা দিয়ে সেই চেষ্টাই করেছিলেন তিনি। কিন্তু মায়ের সব অনুরোধ-উপরোধ উপেক্ষা করে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনের অবসান ঘটাতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিয়ে শহীদ হন টাঙ্গাইলের গোপালপুরের ইমন। একমাত্র কর্মক্ষম বড় ছেলেকে অসময়ে হারিয়ে এখন পুরো পরিবারে অন্ধকার নেমে এসেছে।
গণঅভ্যুত্থানের সেই উত্তাল সময় ৪ আগস্ট, মির্জাপুরের গোড়াইতে কোঠা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্র-জনতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ চলছিল। এ সময় ইমনও সকলের সাথে আন্দোলনে অংশ নেন। হঠাৎ পুলিশের একটি বুলেট ইমনের বুক দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বের হয়ে যায়। পিচ ঢালা রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন ইমন।
এর পর আহত অবস্থায় প্রথমে তাকে স্থানীয় মির্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অবস্থা গুরুতর হওয়ায় ইমনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ১৫ দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে গত ১৮ আগস্ট সকালে না ফেরার দেশে চলে যান কলেজ ছাত্র ইমন।
টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার হেমনগর ইউনিয়নের নলিন গ্রামের মৃত মো. জুলহাস শেখ ও রিনা বেগম দম্পতির তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে ইমন ছিলেন সবার বড়। ১০ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে এ সংসারের হাল ধরেন ইমন।
অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন ইমন। লেখা-পড়ার পাশাপাশি টিউশনি করে সংসারের খরচ চালাতেন। গোপালপুর মনিরুজ্জামান খান বিএম কলেজ থেকে ২০২৩ সালে এইচএসসি পাস করেন ইমন। এরপর সর্বশেষ হেমনগর ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হন।
ইমন সবসময় স্বপ্ন দেখতেন, লেখাপড়া শেষ করে ভাল চাকুরি করে একদিন সংসারের দুঃখ-কষ্ট দূর করবেন। সেই স্বপ্ন আর পূরণ করতে পারলেন তিনি। বড় অসময়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
শহীদ ইমনের মা রিনা বেগম সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে অশ্রুভেজা নয়নে বাসসকে জানান, শুরু থেকে ইমন গোপালপুর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় ছিল। আন্দোলনে যেতে নিষেধ করা হলেও আমাদের কথা শুনেনি।
ইমন সবসময় বলত আমাকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করো না। তুমি তো ভয় পাও, আমার যদি কিছু হয়ে যায়। তুমি দেখে নিও, আমার কিছু হবে না। আন্দোলনের অংশ নেয়ার কথা বলে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের গোড়াই এলাকায় তার চাচার বাসায় গিয়ে ওঠে ইমন।
গত ৪ আগস্ট বেলা ২টায় দিকে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের গোড়াইতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয় ইমন। গুরুতর আহতাবস্থায় প্রথমে ইমনকে মির্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
তিনি আরো জানান, মির্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালে ইমনের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে জরুরি ভিত্তিতে মাইক্রোবাসে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে পুলিশ গাড়ি থামায়।
পুলিশ যখন জানতে পারে রোগী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ, তখন তারা আহত ইমনকে গাড়ি থেকে জোর করে নামিয়ে পেটে লাথি মারে। পরে লাঠি দিয়ে বেদম পেটায়। শুধু ইমনকেই নয়, পুলিশ সদস্যরা গাড়ির চালকসহ ইমনের সাথে থাকা সঙ্গীদেরও মারধর করে। পরে অনেক অনুনয়-বিনয় করে ছাড়া পান তারা।
পুলিশ ছেড়ে দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয় ইমনকে বহনকারী মাইক্রোবাসটি। তবে ভাগ্যক্রমে ঠিক সময়ে একটি অ্যাম্বুলেন্স পান তারা, রওনা হন ঢাকার পথে। তবে অ্যাম্বুলেন্সের চালক ঢাকা মেডিকেল কলেজে পর্যন্ত যেতে অস্বীকৃতি জানালে ইমনকে উত্তরার লেক ভিউ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সেখানে দুদিনেই চিকিৎসা বাবদ খরচ হয় প্রায় তিন লাখ টাকা। ধার দেনা করে সে টাকা জোগাড় করে তার পরিবার। এরপর ৬ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইমন ১৮ আগস্ট সকালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
শহীদ ইমনের মা রিনা বেগম জানান, ১০ বছর বয়সে বাবাকে হারায় ইমন। তখন আমার বড় ছেলে ইমন সংসারের হাল ধরে। চারজনের পরিবারে ইমনই ছিলেন একমাত্র কর্মক্ষম। ইমন লেখাপড়ায় ছিল অত্যন্ত মেধাবী। ও স্বপ্ন দেখত, লেখা-পড়া শেষ করে একদিন সংসারের অভাব অনটন দূর করবে। সেই ইমনকে হারিয়ে মা রিনা বেগম এখন দিশেহারা।
আন্দোলনের সময় ওর সাথে ফোনে প্রায়ই কথা হতো, কবে বাড়ি ফিরবি বললে বলত খুব শীঘ্রই বাড়ি ফিরব মা। ইমন বাড়ি ফিরেছে ঠিকই কিন্তু লাশ হয়ে। আন্দোলনে যেতে নিষেধ করেছিলাম, কিন্তু আমার কোন কথা শোনেনি।
ছেলের চিকিৎসার ব্যয় বহনে এরই মধ্যে সহায়সম্বল বিক্রি করেছেন মা রিনা বেগম। সেই ধার-দেনা এখন পরিশোধ করতে পারেননি তিনি। সে চিন্তায় এখন তার সব সময়।
তিনি জানান, কেন্দ্রীয় বিএনপির প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুটু এক লাখ টাকা এবং একটি অটোরিকশা কিনে দিয়েছেন। আমার মেঝ ছেলে সুমন সেই অটোরিকশা চালিয়ে আমাদের সংসারে খরচ মিটাচ্ছে।
তিনি বলেন, স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক দল আমাদের পরিবারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা, এ ছাড়া বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে আমরা ২ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছি। এখন তার একটাই চাওয়া ছেলের হত্যার বিচার।
ইমনের ছোট ভাই সুজন আহমেদ জানান, আমার ভাই খুবই বিনয়ী ও পরোপকারী ছিল। বটগাছের মতো ছায়া দিয়ে এ পরিবারকে আগলে রেখেছিল। সে নিজে কষ্ট করত কিন্ত অভাবের সংসারে আমাদের কখনও অভাব বুঝতে দেয়নি। বড় ভাইয়ের শোকের আমাদের মাও কাতর হয়ে গেছে।
তিনি আরও জানান, আমার ভাই দেশের মানুষের জন্য জীবন দিয়েছেন। আল্লাহ যেন আমার ভাইকে শহীদি মর্যাদা দান করে, জান্নাতের বাসিন্দা হিসেবে কবুল করে এ জন্য সবার কাছে দোয়া চাই। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় ইমনসহ সকল নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী প্রত্যেক ব্যক্তিকে বিচারের আওতায় আনার দাবিও জানান তিনি।
শহীদ ইমনের সহপাঠী সাইফুল ইসলাম জানান, গোপালপুর হেমনগর ইউনিয়নের ছাত্র অধিকার পরিষদের সমন্বয়ক ছিলেন ইমন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই সামনের সারিতে ছিলেন তিনি।
বুকে গুলিবিদ্ধ ইমন যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তখন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর সর্বাক্ষণিক চিকিৎসার খোঁজখবর নিয়েছেন এবং আর্থিক সহযোগিতা করেছেন।
এরই মধ্যে ইমনের চিকিৎসার ব্যয় বহনে সহায় সম্বল বিক্রি করে পরিবারটি এখন নিঃস্ব হয়ে গেছে। সংসারে হাল ধরেছে মেজ ছেলে সুমন। সে অটোরিকশা চালিয়ে তার উপার্জিত অর্থ এবং সকলের সাহায্য সহযোগিতা এখন অনেক কষ্টে জীবন-যাপন করছেন ইমনের মা রিনা বেগম।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের টাঙ্গাইলের অন্যতম সমন্বয়ক আল আমিন বাসসকে জানান, টাঙ্গাইলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মোট শহীদ হন ৯ জন। ইমন টাঙ্গাইল মির্জাপুর উপজেলার গোড়াই এলাকায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়। এ আন্দোলনে ইমনের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। বাকি ৮ জন ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে শহীদ হয়েছেন।
টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক শরিফা হক বাসসকে জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যে সব পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সহযোগিতার করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধারা অব্যাহত থাকবে। তাছাড়া সরকারিভাবে ঘোষণা আছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহতের পরিবারকে পাঁচলাখ টাকা করে দেয়া হবে।