বোনের বিয়েতে আনন্দের স্বপ্ন অপূর্ণই রয়ে গেল শহীদ তন্ময়ের

বাইশ বছর বয়সী দোকান কর্মচারী সাইফুল ইসলাম তন্ময় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন তার ছোট বোনের বিয়ের দিনটির জন্য। ৯ আগস্ট তার বোনের বিয়ে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই বহুল প্রতীক্ষিত পারিবারিক আয়োজনের মাত্র চার দিন আগে ৫ আগস্ট তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
আন্দোলনের মিছিলে তন্ময়
বিয়ের প্রস্তুতির ব্যস্ততার মধ্যেও দেশের স্বার্থে আন্দোলনে যোগ দিতে তন্ময় ৫ আগস্ট সকালে বাসা থেকে বের হন। শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে শাহবাগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে যোগ দেন তিনি।
সেদিন আন্দোলনের উদ্দেশ্য সফল হয়। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। কিন্তু তন্ময় আর ফিরে আসেননি।
রক্তাক্ত আন্দোলনের ঐতিহাসিক বিজয়ও তিনি দেখে যেতে পারেননি।
গুলিতে ঝরে গেল জীবন
তন্ময়ের বাবা, বাস কোম্পানির টিকিট মাস্টার শফিকুল ইসলাম রানা (৪৮) শেষ পর্যন্ত তার ছেলের নিথর দেহ খুঁজে পান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) মর্গে মৃতদেহের স্তূপের মধ্যে। সহযোদ্ধা ও চিকিৎসকদের ভাষ্যমতে তন্ময় সেদিন দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটের দিকে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী এলাকায় পুলিশ ব্যারিকেড ভাঙার সময় মাথায় গুলিবিদ্ধ হন।
শোকার্ত মায়ের কান্না
তন্ময়ের মা রেবেকা সুলতানা (৪২) বলেন, ‘আমার ছেলে তার বোন নারগিস সুলতানার বিয়ের জন্য কত কিছু পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু সে সেই দিনটি দেখে যেতে পারল না।’ কুতুবখালী বাসায় বসে কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
তিনি আরও জানান, কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরুর পর থেকেই তন্ময় রাজপথে আন্দোলনে অংশ নিচ্ছিল। ২৬ জুলাই তিনি রাবার বুলেটেও আহত হন।
‘২৮ জুলাই আমি তার পিঠের ক্ষতচিহ্ন দেখি এবং তাকে আন্দোলনে না যাওয়ার অনুরোধ করি। কিন্তু সে আমার কথা শোনেনি,’ বলেন তন্ময়ের মা।
শেষ বিদায়ের প্রাক্কালে
৫ আগস্ট সকালে যাত্রাবাড়ীর রসুলপুরের ভাড়া বাসা থেকে তন্ময় বের হওয়ার সময় বলেছিলেন, ‘আমি ফিওে এসে নাশতা করব।’ কিন্তু আর ফেরা হয়নি তার।
তন্ময়ের বাবা শফিকুল ইসলাম জানান, ৫ আগস্ট দুপুর ১টা ১৫ মিনিটে তার কাছে একটি ফোনকল আসে। বলা হয়, তার ছেলে আহত অবস্থায় যাত্রাবাড়ীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে আছেন। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর পর জানতে পারেন, তন্ময়কে ঢামেকে পাঠানো হয়েছে।
‘আমি বুঝতে পারি, আমার ছেলে আর বেঁচে নেই। আমি সরাসরি ঢামেকের মর্গে যাই। সেখানে মৃতদেহের স্তূপের মধ্যে ছেলেকে খুঁজে পাই,’ বলেন শফিকুল।
মর্গের কর্মচারীরা জানান, তন্ময়কে মাথায় দুটি গুলি করা হয়েছিল- একটি পাশ দিয়ে মাথা ভেদ করে চলে যায়, আরেকটি মাথার ভেতওে থেকে গেছে।
পরিবারের শোক ও আর্থিক সংকট
সেদিন বিকেলেই সারা দেশ যখন শেখ হাসিনার পতনে বিজয় উদযাপন করছিল, তখন মাগরিবের পর দনিয়া কবরস্থানে তন্ময়কে দাফন করা হয়।
তন্ময় ছিলেন চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়। তার বাবা জানান, করোনাকালে সংসার চালাতে দোকানের চাকরি নেন তন্ময়। এর আগে তিনি মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন এবং কোরআনের আট পারা মুখস্থ করেছিলেন।
তন্ময়ের মৃত্যুর পর বাবা শফিকুল ইসলাম শোক সইতে না পেরে তার চাকরি ছেড়ে দেন। পরিবারের ভরণপোষণের সামর্থ্য না থাকায় তারা কুমিল্লার দেবিদ্বারের পৈতৃক ভিটেতে ফিওে গেছেন।
শফিকুল জানান, তিনি এখন ছোট্ট এক খণ্ড জমিতে চাষাবাদ করে সংসার চালানোর পরিকল্পনা করছেন। তবে ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ ও ‘জামায়াতে ইসলামী’র আর্থিক সহায়তা তার পরিবারকে তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটাতে সাহায্য করেছে।
ন্যায়বিচারের দাবি
তন্ময়ের বাবা-মা তার হত্যার জন্য দায়ীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। বাবা শফিকুল বলেন, ‘আমি ২২ বছর ধরে আমার ছেলেকে লালন-পালন করেছি। কিন্তু শেখ হাসিনা আমার ছেলেকে আমার কাছ থেকে চিরদিনের জন্য কেড়ে নিল।’
তন্ময়ের মা বলেন, ‘শুধু একজন মা-ই জানে, কী কষ্ট করে সন্তান বড় করতে হয়। আমি দারিদ্র্যের মধ্যেও ছেলেকে বড় করেছি। কিন্তু সে আমাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেল, তার স্বপ্নগুলো ফেলে রেখে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি চাই শেখ হাসিনাকে প্রকাশ্যে বিচারের মুখোমুখি করা হোক এবং আমার ছেলের মৃত্যুর জন্য তাকে জবাবদিহির আওতায় আনা হোক।’