এখনও রক্তমাখা টি-শার্টে ছেলেকে খুঁজে ফেরেন শহীদ রাজনের মা

ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই ভয়ংকর একটি দিন হয়ে এসেছিল। রাজধানীর মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হন একাদশ শ্রেণির ছাত্র ফয়জুল ইসলাম রাজন। তার বুকের ডান পাশে বিদ্ধ হয়ে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায় বুলেট। কেডে নেয় তার তরুণ-তাজা প্রাণ।
মৃত্যুর সময় গায়ে থাকা রাজনের রক্তমাখা টি-শার্টটি বুকে জড়িয়ে এখনও ডুকরে কাঁদেন তার শোকাতুর মা মাহমুদা।
শহীদ রাজনের মা বলেন, ‘আশা ছিল, ছেলে লেখাপড়া শেষ করে পরিবারের হাল ধরবে। ওর বাবা আরও একটি বিয়ে করে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে ৯ বছর আগে। আমার বড় ছেলে ভাইবোনের জন্য লেখাপড়া করতে পারেনি। কষ্ট করে ছোট ছেলেটাকে লেখাপড়া শেখাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তাও হলো না। আমরা সব শেষ হয়ে গেলাম।’
রাজধানীর কেরানীগঞ্জের উত্তর বাহের চর এলাকার বাসায় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস-এর প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে শহীদ ফয়জুল ইসলাম রাজনের মা মাহমুদা এসব কথা জানান।
শেষ ফোন কল
শহীদ রাজনের মা বলেন, ‘ছেলেটার জন্য আমার অনেক আশা ছিল। ও চাকরি করে সংসার চালাবে, আমাদের অভাব-অনটন দূর করবে। কিন্তু সে স্বপ্ন এভাবে শেষ হয়ে যাবে, তা জানতাম না। এখন আমি কাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখব? আমার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। আমি আমার ছেলের হত্যার বিচার চাই।’
মাহমুদা বলেন, ‘১৯ জুলাই দুপুর ১২টার দিকে রাজন আমাকে ফোন করেছিল। আমি ওকে জিজ্ঞাসা করি, 'বাবা, তুমি কি আন্দোলনে গেছ?' ও বলল, 'না মা, আমি আন্দোলনে যাইনি।' আমি বললাম, 'আমরা গরিব মানুষ বাবা, আন্দোলনে যেও না। বাসায় শুয়ে থাকো। তোমার কিছু হলে আমাদের দেখবে কে?'
এর কিছুক্ষণ পর আবার আমাকে ফোন করে বলল, 'মা, আমাকে ক্ষমা করে দিও।' তখনই আমি বুঝতে পারি, রাজন আন্দোলনে গেছে। আমি ওকে বললাম, 'সাবধান থেকো বাবা। তোমার কিছু হলে আমরা সবাই শেষ হয়ে যাব।' এই বলে ফোন রেখে দিই।
গুলির খবর ও হাসপাতাল
শহীদ রাজনের মা বলেন, ‘বেলা ৩টার দিকে একটা ফোন আসে। ফোনে এক অপরিচিত নারী জানান, রাজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে ওর বোন ও দুলাভাইকে ফোন করি। তারা মিরপুর এলাকায় থাকত। ওরা আজমল হাসপাতালে গিয়ে রাজনের নিথর দেহ খুঁজে পায়।’
শহীদ ফয়জুল ইসলাম রাজনের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর জেলার মতলব উপজেলার নারায়ণপুরের পাচানি শিকদার বাড়ি। তার বাবা নূর আলম, মা মোছাম্মাৎ মাহমুদা (৪৩)। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে রাজন ছিল সবার ছোট। বড় ভাই এম. রাজীব সাভারের একটি গার্মেন্টসে চাকরি করেন।
ফয়জুল ইসলাম রাজন ১৯ জুলাই শহীদ হলেও তাকে ২০ জুলাই সকাল ৯টার দিকে কেরানীগঞ্জের তারানগর উত্তর বাহের চর কেন্দ্রীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়।
ভাইয়ের শোক
রাজনের বড় ভাই রাজীব বলেন, ‘আমার ছোট ভাইয়ের মরদেহ নিজ হাতে গোসল করানোর মুহূর্তটা এখনও ভুলতে পারছি না। তখন আমার মাথা ঘুরছিল। গুলিবিদ্ধ শরীর গোসল করাতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। এরপরও আমি চোখের পানি আটকে নিজ হাতে ওকে গোসল করিয়েছি। ভাই হারানোর বেদনা কতটা কষ্টের, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। যারা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিচার চাই।’
তিনি বলেন, ‘রাজন রাজধানীর মিরপুরের ঢাকা মডেল ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণিতে পড়ত। পাশাপাশি একটি দোকানে কাজ করে নিজের লেখাপড়ার খরচ চালাত। আমি ওকে ঠিকমতো টাকা দিতে পারতাম না। আমার গার্মেন্টসের ছোট চাকরির আয়ে সংসার চলত না। তাই রাজন দোকানে কাজ করত, নিজের খরচ চালানোর পাশাপাশি কিছু টাকা বাসায়ও দিত।’
সেদিনের ঘটনা
রাজীব বলেন, ‘ওর বন্ধুদের কাছ থেকে শুনেছি, আন্দোলন চলাকালে মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় পুলিশের গুলিতে রাজন শহীদ হয়। গুলি লাগার পর ওকে আজমল হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’
শহীদ রাজনের মা বলেন, ‘গুলিটা বুকের ডান পাশে ঢুকে পিঠ দিয়ে বের হয়ে গেছে। সেদিন আমার মেয়ে ও মেয়ের জামাই আজমল হাসপাতালে রাত ১২টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে রাজনের লাশ নিয়ে আসে। আমি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিচার চাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘১০ বছর আগে আমার স্বামী আরেকটি বিয়ে করেছে। আমি তিন সন্তান নিয়ে কষ্টে দিন পার করছি। আমার এতটুকু চাওয়া, যে ছেলেটা দেশের জন্য জীবন দিল, তাকে যেন যথাযথ সম্মান দেওয়া হয়। আমি চাই, আমার ছেলেকে শহীদের মর্যাদা দেওয়া হোক। যারা আমার ছেলেকে হত্যা করেছে, আমি তাদের বিচার ও কঠোর শাস্তি চাই।’
অর্থসহায়তা ও মামলা
শহীদ রাজনের মা জানান, ‘জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ টাকার চেক পেয়েছি, জামায়াত ইসলামী থেকেও দুই লাখ টাকা পেয়েছি।’
রাজনের বড় ভাই রাজীব বলেন, ‘রাজন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ১৬ আগস্ট মিরপুর মডেল থানায় আমি বাদী হয়ে ২৪ জনের নামে মামলা করেছি। মামলার প্রধান আসামি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।
এছাড়াও মামলার অন্য অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকসহ আওয়ামী লীগ ও যুব সংগঠনের শীর্ষ নেতারা।’