মাকে নিয়ে আর গ্রামে ফেরা হলো না শহীদ জামাল উদ্দিনের

স্বামী হারা সাহিদা বেগমের বড় ছেলে জামালের কথা ছিল ‘যতো দিন বাঁচবেন মাকে নিয়েই বাঁচবেন’। কিন্তু সেটি আর হয়ে ওঠেনি। গত ১৯ জুলাই দুপুর ১২টার দিকে মোহাম্মদপুর টাউন হলের সামনে পুলিশ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সঙ্গে সংঘর্ষ চালাকালে পদদলিত হয়ে গুরুতর আহত হন। পরে হাসপাতাল নেওয়ার পর সন্ধ্যার দিকে তার মৃত্যু হয়।
শহীদ জামাল উদ্দিন (৩৫) ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার দেউলা ইউনিয়নের ৮নম্বর ওয়ার্ডের মৃত আবুল কালামের বড় ছেলে। তিনি ঢাকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের বাবুর্চির কাজ করতেন। মারা যাওয়ার দুই মাস আগ থেকে বাবুর্চি কাজ কম থাকায় ছোট ভাই লিটনের সঙ্গে অটোরিকশা চালানো শুরু করেন শহীদ জামাল উদ্দিন।
জামাল উদ্দিন বিয়ে করেছিলেন। তার একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। ওই সন্তানের বয়স যখন পাঁচ বছর তখন স্ত্রী রুমা বেগম অন্য এক ছেলেকে বিয়ে করে সন্তানসহ তার কাছে চলে যান। এর পর অনেক চেষ্টা করেও জামালকে আর বিয়ে করাতে পারেননি মা সাহিদা বেগম।
২৫ বছর পূর্বে স্বামী আবু কালাম সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। এর পর ছোট ছোট তিন ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সুখের আসায় ভোলার বোরহানউদ্দিনের দেউলা গ্রাম থেকে ঢাকায় পাড়ি জমান সাহিদা বেগম।
ঢাকার মোহাম্মদপুর চাঁদ উদ্যান এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করে অন্যের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ শুরু করেন তিনি। এভাবে তিন ছেলে এক মেয়েকে অনেক কষ্টে লালন-পালন করে বড় করেছেন স্বামীহারা সাহিদা বেগম।
এর মধ্যে একমাত্র মেয়ে রিনা বেগমকে বিয়ে দিয়েছেন। মেঝো ছেলে জন্মগতভাবে মৃগী রোগী হওয়ায় কোনো কাজ করতে পারেন না। বিগত ৫-৭ বছর ধরে বড় ছেলে জামাল উদ্দিন ও ছোট ছেলে লিটনের আয়ের টাকায় তাদের সংসার ভালোভাবেই চলে আসছিল।
শহীদ জামাল উদ্দিনের মা সাহিদা বেগম বাসস'কে জানান, ২৫ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় জামালের বাবা আবু কালাম মারা যান। মারা যাওয়ার সময় জামালের বয়স ছিল ১০ বছর। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে জামালই সবার বড় ছিল।
ঢাকায় গিয়ে সাহিদা বেগম মানুষের বাসায় কাজ করতেন আর জামাল ছোট দুই ভাই ও এক বোনকে দেখেশুনে রাখতেন। এভাবেই আস্তে আস্তে সবাই বড় হলেন। বড় ছেলে জামাল ও ছোট ছেলে লিটন কাজ করতে শুরু করলেন। কিন্তু মেঝ ছেলে কামাল জন্মগত মৃগীরোগে আক্রান্ত থাকায় কোনো কাজ করতে পারেন না। মেয়ে রিনা বেগমকে বিয়ে দিয়েছেন।
মারা যাওয়ার আগের দিন রাতে শুয়ে শুয়ে মাকে বলেছিলেন, ‘মা ঢাকায় বাসা ভাড়াসহ সব কিছুর দাম বেড়ে গেছে। এখানে আর থাকা যাবে না। আমরা গ্রামের চলে যাব। সেখানে গিয়ে বাড়িতে থাকা পুরনো ঘরটিকে ঠিক করে সেখানে থাকবো। এনজিওর থেকে ঋণ নিয়ে দুই ভাই দুইটি রিকশা কিনে চালানো শুরু করব। মা সাহিদা বেগমও ছেলের এ কথার সঙ্গে সায় দিয়েছেন।
এর পর সকাল ১০টার দিকে নাস্তা করে রিকশা নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায় জামাল। দুপুর ১২টার দিকে খবর আসে জামাল মোহাম্মদপুর টাউন হলের সামনে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে পদদলিত হয়ে আহত হয়েছে। তাকে সাথের লোকজন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে গেছেন। এ খবর পেয়ে পরিবারের লোকজন হাসপাতালে চলে যায়। কিন্তু জামালের সঙ্গে তাদের আর কথা হয়নি।
বিকেলের দিকে জামালের অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় তাকে বাসায় নিয়ে আসার কথা বলেন মা সাহিদা বেগম। মায়ের কথা মতো হাসপাতাল থেকে বের করে অ্যাম্বুলেন্সে উঠানোর সময়ই জামাল মৃত্যুবরণ করেন।
পরে তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে মোহাম্মদপুর ভাড়া বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। আশা ছিল তাকে গ্রামের বাড়িতে এনে মাটি দিবেন। কিন্তু দেশের পরিস্থিতি খারাপ থাকায় অ্যাম্বুলেন্সের চালকরা রাজি হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে মোহাম্মদপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
আদরের ছেলে জামালকে হারিয়ে মা সাহিদা বেগম এখন বাকরুদ্ধ। সন্তানহারা মা সাহিদা কাঁদতে কাদঁতে এখন চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে।
ছেলেহারা মা সাহিদা বিলাপ করে বলেন, স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলে মেয়েদের নিয়ে অনেকটা কষ্ট করেছি। খেয়ে না খেয়ে তাদেরকে মানুষ করেছি। এখন আমার সুদিন ফেরার সময়। ছেলেরা কামাই রোজগার শুরু করছে। আমি এখন সুখের মুখ দেখব। কিন্তু এখন আবার দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে বড় ছেলে আমায় ছেড়ে চলে গেছে। আমার আর সূখ পাওয়া হলো না।
ছেলেহারা মা সাহিদা বলেন,যাদের কারনে আমার ছেলে মারা গেছে আমি বেঁচে থাকাবস্থায় তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখে যেতে চাই। সাহিদা বেগম বলেন,জামালের মৃত্যুর পর সরকারি কিম্বা বেসরকারিভাবে কেউ আমাদের সাহায্য করেননি।