পরিবারের অভাব দূর করতে বিদেশ যাওয়া হলো না শহীদ বিজয়ের

ধোলাইপাড় উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মো. বিজয় ছিলেন তার মা সাহিদা (৪২)-এর দুঃখের সংসারে আশার আলো। পরিবারের অভাব দূর করতে চাকরির উদ্দেশে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন তিনি।
কিন্তুতার সে আশা অফার পূর্ণ হলো না । চব্বিশের ৫ আগস্ট স্বৈরচারী শেখ হাসিনার পতনের পর ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিজয় উদযাপনে মিছিল করার সময় যাত্রাবাড়ী থানার সামনে গুলিবিদ্ধ হয় বিজয়। এর চৌদ্দ দিন পর ২৩ আগস্ট সে মারা যায়।
বিজয়ের পরিবারের সদস্যরা জানান, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে প্রায় ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন ঘটে। এর আনন্দ উদযাপনে বিজয় মিছিলে যোগ দেয় বিজয়। এ সময় পুলিশ মিছিলে গুলি বর্ষণ করলে একটি গুলি তার ডান কান ছিদ্র করে বেরিয়ে যায় এবং তার মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বিজয়ের মা সাহিদা রাজধানীর এক পুলিশ কর্মকর্তার বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করেন। এই প্রতিবেদক তার শহীদ সন্তানের বিষয়ে জানতে চাইলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
কাঁদতে কাঁদতে সাহিদা বলেন, ‘আমার ছেলে আমাকে বলত, ‘মা, তুমি অনেক কষ্ট করো। আমি তোমাকে আর কাজ করতে দেব না। দয়া করে আমাকে পাসপোর্ট তৈরি করে দাও, আমি বিদেশে গিয়ে টাকা রোজগার করে তোমার দুঃখ দূর করব, তোমাকে সুখে রাখব।’
তিনি জানান, তার ছোট ছেলে বিজয় বড় ভাই মো. হৃদয় হোসেনের কাছ থেকে ৫০ টাকা নিয়ে ৫ আগস্ট বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটে ঘর থেকে বের হয়। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে হাজারো মানুষের বিজয় মিছিলে অংশ নেয় সে।
কিন্তু রাত ৯টার দিকে কয়েকজন শিক্ষার্থী তাদের বাড়িতে এসে জানায় যে সন্ধ্যা ৬টার দিকে বিজয়ের মাথায় গুলি লেগেছে এবং তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
‘আমরা দ্রুুত ঢাকা মেডিকেলে ছুটে যাই এবং দেখি, আইসিইউতে বিজয়ের চিকিৎসা চলছে। আমার ছেলে ২৩ আগস্ট বিকেল পর্যন্ত সেখানে চিকিৎসাধীন ছিল, কিন্তু সে আর চোখ খুলতে পারেনি। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকে সে আর কোনো কথা বলেনি,’ কান্নায় ভেঙে পড়েন সাহিদা।
‘আমার ছেলে, যে আমাদের ভাগ্য বদলানোর স্বপ্ন দেখিয়েছিল, সে মৃত্যুর আগে কিছুই বলতে পারেনি,’ বললেন তিনি।
ঢাকা সিটি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মো. হৃদয় হোসেন জানান, বিজয় নিয়মিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিত কি না তারা জানেন না।
৫ আগস্ট সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পদত্যাগ কওে ভারতে পালিয়ে গেলে বিজয় সেই আন্দোলনের বিজয় উদযাপনে যায়। কিন্তু সে আর বাড়ি ফেরেনি।
সেই দিনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়, যেখানে দেখা যায় যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ দলবদ্ধভাবে বেরিয়ে এসে বিক্ষোভকারীদের পাখির মতো গুলি করছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সেদিন যাত্রাবাড়ীর রাস্তায় বহু মৃতদেহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল।
শোকার্ত বড় ভাই হৃদয় বলেন, ‘২৩ আগস্ট বিকেলে আমার ভাই মারা যাওয়ার পর আমরা সেদিনই তার লাশ গ্রহণ করি এবং ময়নাতদন্ত ছাড়াই রাতেই জুরাইন কবরস্থানে দাফন করি।’
তিনি জানান, বিজয় তাদের তিন ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিল। তাদের একমাত্র বড় বোন তাহমিনা আক্তার দোলা বিবাহিত। তাদের বাবা মো. দুলাল মিয়া একজন সিএনজি অটোরিকশাচালক।
হৃদয় বলেন, তারা বিজয়কে ঘিরেই স্বপ্ন দেখছিলেন, কারণ সে মেধাবী ও পড়াশোনায় মনোযোগী ছিল।
বরিশালের উজিরপুর উপজেলার এই পরিবার রাজধানীতে স্যাঁতসেঁতে একটি একক কক্ষের ভাড়া বসবাস করছিল।
‘আমি এখনো বেকার। পরিবারের জন্য কিছুই করতে পারিনি,’ বলেন হৃদয়। তবে তারা ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ থেকে ৫ লাখ টাকা পেয়েছেন, যা দিয়ে কিছুদিনের জন্য পরিবারের খরচ চলেছে।
সাহিদাসহ বিজয়ের পরিবার স্বৈরশাসকের দোসরদের বিচার এবং তার ছেলের হত্যার জন্য দায়ীদের মৃত্যুদণ্ড দাবি করেছেন।