বিচারক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন শহীদ নাঈম

শানারপাড় রওশন আরা ডিগ্রি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র, ১৭ বছর বয়সী মো. নাঈম স্বপ্ন দেখতেন বিচারক হওয়ার। কিন্তু বুলেট তার সেই স্বপ্ন ও জীবন একসঙ্গে ছিনিয়ে নেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়।
গত বছরের ১৯ জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী এলাকায় আন্দোলনে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান নাঈম।
আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দমন-পীড়নের সময় নাঈম শহীদ হন। আন্দোলন তখন কেবল ছাত্রদের আন্দোলন ছিল না, এটি রূপ নিয়েছিল ছাত্র-জনতার বিদ্রোহে।
তার বুকে, হৎপিণ্ডের ঠিক ওপরে প্রবেশ করা একটি গুলি শুধু তার জীবনই কেড়ে নেয়নি, বরং তার পরিবারকেও আর্থিক ও মানসিকভাবে এক অনিশ্চয়তার অন্ধকারে নিক্ষেপ করেছে। তার বাবা মো. কামরুল ইসলাম, একজন পোশাককর্মী, ছেলের মৃত্যুর পর মানসিক আঘাতে বিপর্যস্ত থাকায় কাজে ফিরতে পারেননি।
‘বিচারক হওয়ার স্বপ্ন দেখত নাঈম’
কামরুল ইসলাম (৫৮) জানান, নাঈম শব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট ও ফুটবলে খুবই পারদর্শীই ছিল। এছাড়া আইনজীবী আত্মীয়দের দেখে বিচারক হওয়ার স্বপ্ন দেখত সে।
তিনি আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, ‘ও আমাকে বারবার বলত— 'আব্বু, তুমি কষ্ট পেও না। আমি বড় হয়ে তোমাকে সুখে রাখব।'
যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী এলাকার ভাড়াবাসায় বসে ছেলের মৃত্যুর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি কামরুল।
নাঈম ছিল কামরুল ইসলাম ও গৃহিণী মাহমুদা পারভীন (৪৫) দম্পতির দুই ছেলের মধ্যে ছোট। বড় ছেলে মো. নোমান কবি নজরুল সরকারি কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।
‘ও ফিরল না’
কামরুল জানান, ১৯ জুলাই সকালে তিনি জ্বর ও প্রচণ্ড মাথাব্যথায় শয্যাশায়ী ছিলেন। জুমার আজানের আগে গোসল করে নামাজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেও শেষ পর্যন্ত শরীর খারাপ লাগায় যেতে পারেননি।
কিন্তু নাঈম সেদিন জুমার নামাজ পড়ে বাসায় ফিরে দুপুরের খাবার খেয়ে কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর তার মা জিজ্ঞাসা করেন, নাঈম কোথায়? কামরুল তখন জানান, তিনি কিছুই জানেন না।
বিকেল ৪টার দিকে ছেলের ফেরার অপেক্ষায় ব্যাকুল হয়ে পড়েন মাহমুদা। তখন যাত্রাবাড়ীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছিল।
‘ওর মা আমাকে বলল, 'তুমি একবার বেরিয়ে দেখো, ছেলেটা কোথায়?' আমি তখন বললাম, শরীর ভালো না। কিন্তু ওর অনুরোধে বাড়ির মালিকের সহায়তায় বের হই,’ বলেন কামরুল।
কুতুবখালী উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে পৌঁছে দেখেন, চারদিক নিস্তব্ধ। অথচ সকালেই ছিল তুমুল উত্তেজনা। তিনি জানতেন না, কয়েক ঘণ্টা আগেই সেখানে রক্ত ঝরেছে, যেখানে তার ছেলেসহ পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে।
‘কেউ বলল, গুলি চলেছে। কিন্তু আমি তখনি ভাবছিলাম, নাঈম তো আন্দোলনে যায় না। পরে বুঝলাম, ও আসলে গোপনে আন্দোলনে যেত,’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন তিনি।
নাঈমকে না পেয়ে বাসায় ফিরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন কামরুল, কিন্তু তার মা ছেলের খোঁজে অস্থির হয়ে ওঠেন।
‘রক্তের বন্যায় লাশ, কিন্তু নাঈম কোথাও নেই’
রাত ১২টায় কারফিউ জারি হলেও তারা রাত ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত যাত্রাবাড়ী ও ডেমরার বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে ছেলের সন্ধান করেন। কিন্তু কোথাও পাননি।
অবশেষে ভোরে ফজরের নামাজ পড়ে বড় ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে যান কামরুল। হাসপাতালের প্রতিটি কর্নারে আহতদের মাঝে খুঁজতে থাকেন নাঈমকে।
‘আমরা ভাবছিলাম, হয়তো ও আহত বা গ্রেপ্তার হয়েছে। কিন্তু তখনো জানতাম না, ও বেঁচে নেই,’ বলেন কামরুল।
হাসপাতালের কর্মীরা জানান, ১৯ জুলাই সেখানে ১০০০-১৫০০ আহত ভর্তি হয়েছিল। আহতদের মধ্যে খুঁজে না পেয়ে তারা মর্গে যান।
‘আমি ৮০-৯০টি লাশ পড়ে থাকতে দেখলাম, কিন্তু নাঈমকে পেলাম না। মর্গ ছিল রক্তে ভরা। তখন আমি নিশ্চিত হলাম, আমার ছেলে বেঁচে আছে। কারণ, সে লাশের মাঝে নেই,’ বলেন তিনি।
এমন সময় বাড়ির মালিক ফোন করে জানান, নাঈমের খোঁজ পাওয়া গেছে। কিছুক্ষণ আশা জেগে উঠলেও পরের কথায় সব শেষ হয়ে যায়— ‘নাঈম মারা গেছে।’
রাকিব নামে এক ছেলে গুলিবিদ্ধ নাঈমকে হাসপাতালে নিয়ে যায় এবং নিজের নামে ভর্তি করায়, কারণ সে তখনও নাঈমের পরিচয় জানত না।
কামরুল আবার মর্গে ফিরে যান। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ফ্রিজিং মর্গে ছেলের নিথর দেহ খুঁজে পান। স্ত্রী ও অন্যরা সেটি দেখে জ্ঞান হারান।
সন্ধ্যা ৬টায় আইনি প্রক্রিয়া শেষে লাশ নিয়ে বরিশালের নলছিটি উপজেলার গ্রামের বাড়িতে যান। পরদিন সকালে পারিবারিক কবরস্থানে নাঈমকে দাফন করা হয়।
‘বিচার চাই, শেখ হাসিনার ফাঁসি চাই’
নাঈমের মা মাহমুদা পারভীন এখনও ছেলের মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না।‘ সেদিন সকালে ছেলেটা মজার কথা বলেছিল। জানতাম না, ওর জীবনের শেষ সকাল,’ বলেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন তিনি।
‘বাড়ির প্রতিটি কোণে ওর স্মৃতি। দরজায় কেউ নক করলেই মনে হয়, নাঈম এসেছে। এখনও প্রতিদিন দুপুর ৩টায় ওর ফেরার অপেক্ষায় বসে থাকি,’ বলেন কান্নায় ভেঙে পড়া এই মা।
ছেলের পড়ার টেবিল দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘ওর বই, কম্পিউটার, সাউন্ডবক্স, টেবিল ফ্যান সব যেমন ছিল, তেমনই আছে। আমি কিছুই সরাতে পারিনি।’
নাঈমের পরিবার হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে। ‘আমি শেখ হাসিনাসহ আমার ছেলেকে হত্যার জন্য যারা দায়ী, তাদের ফাঁসি চাই। গুলি করে ওদের শরীর ঝাঁঝরা করে ফেলা হোক, যাতে ওরা মৃত্যুর আগে সেই যন্ত্রণা বোঝে,’ রাগে-ক্ষোভে বলেন, মাহমুদা পারভীন।