নাদিমের মৃত্যুতে দুই সন্তান নিয়ে অকূলপাথারে স্ত্রী নেহা

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই, শুক্রবার, জুমার নামাজ পড়তে বাসা থেকে বেরিয়ে রাজধানীর বনশ্রীতে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন নাদিম মিজান। কথা ছিল, নামাজ শেষে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে দুপুরের খাবার খাবেন।
নামাজ পড়তে বেরিয়ে যাওয়ার পর তার স্ত্রী তাবাসসুম আক্তার নেহা এবং তাদের ছেলেরা তার বাবার বাড়িতে গিয়েছিলেন। কারণ সেদিন তাদের বাসায় গ্যাস ছিল না। তাই আগে থেকেই নেহা ঠিক করেছিলেন দুপুরে বাবার বাসায় গিয়ে খাবেন। নামাজ শেষে নাদিমেরও সেখানে যাওয়ার কথা ছিল।
নেহা, তার বাবা-মা, ভাই এবং অন্যরা একসঙ্গে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য নাদিমের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। নামাজের সময় শেষ হওয়ার পরও তিনি না আসায়, তারা সবাই খেয়ে নেন, তবে নাদিমের জন্য খাবার ঢেকে রাখা হয়।
শহীদ নাদিম মিজানের স্ত্রী তাবাসসুম আক্তার নেহা বলেন, ‘আমাদের ভাড়া বাসা থেকে বাবার বাসা খুব বেশি দূরে নয়। তাই আমাদের বাসায় গ্যাস না থাকায় সকালে আম্মুকে ফোন করে বলেছিলাম, দুপুরে আমরা তোমাদের বাসায় খাব। নাদিম যখন নামাজ পড়তে বের হচ্ছিল, তখন বললাম, তুমি নামাজ পড়ে ওই বাসায় চলে আসো, আমি ছেলেদের নিয়ে আগেই চলে যাই।’
নাদিম নামাজ পড়তে বের হলে আমরাও বাবার বাসায় চলে যাই। ওর ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে সবাই খেয়ে নিই, আর আম্মা ওর জন্য খাবার ঢেকে রাখেন।
তিনি বলেন, ‘অনেকক্ষণ হয়ে গেলেও নাদিম ফিরে এল না। এর মধ্যে আমাদের বাসার কাছের গলিতে বিশৃঙ্খলা ও গুলির শব্দ শুনতে পাই। তখন বাইরে গিয়ে দেখি, আমার স্বামীর পেটে গুলি লেগেছে, রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে! আমরা তাকে তাৎক্ষণিকভাবে কাছের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাই, যেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’
রাজধানীর মিরপুরের শাহ আলী থানার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের জি ব্লকের বাসায় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস-এর প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ নাদিম মিজানের স্ত্রী তাবাসসুম আক্তার নেহা (২৩) এসব কথা জানান।
নাদিমের স্ত্রী নেহা বলেন, ‘আমি প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে শুনেছি, মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসার পর আমার স্বামী গুলিবিদ্ধ হন। পুলিশ বা বিজিবি এই গুলি চালিয়েছে। পরে ১৯ জুলাই রাতে আমার স্বামীকে ময়নাতদন্ত ছাড়াই মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়।’
নেহা বলেন, ‘তিন ভাইয়ের মধ্যে আমার স্বামী ছিলেন সবার বড়। আমরা আগে মিরপুরে থাকতাম। আমার শাশুড়ি ২০২৩ সালের ডিসেম্বর এবং শ্বশুর ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে মারা যান। এরপর আমরা বনশ্রীতে চলে যাই, আর আমার স্বামী গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসার আয় দিয়ে আমাদের সংসার ভালোভাবেই চলছিল।’
পরিবারের সদস্যরা জানান, ৩৫ বছর বয়সী নাদিম মিজান তার দুই ছেলে আনাস (৩) ও আহনাফ (২)কে বাসা থেকে বের হওয়ার আগে প্রায়ই চুমু খেতেন। ১৯ জুলাই শুক্রবার দুপুরেও ছেলেদের চুমু খেয়ে তিনি নামাজ পড়তে বের হন। রাজধানীর বনশ্রীতে তার বাসা থেকে রামপুরা থানা সংলগ্ন নিকটবর্তী একটি মসজিদে জুমার নামাজ পড়ার জন্য বেরিয়েছিলেন তিনি।
শহীদ নাদিমের স্ত্রী বলেন, ‘বড় ছেলে আনাসের বয়স তিন বছর, আর আহনাফের বয়স দুই বছর। দুই ভাইয়ের মধ্যে আনাসের সঙ্গে তার বাবার বেশ ভাব ছিল। বাবাই ছিল তার সব আনন্দের উৎস। কিন্তু দীর্ঘ আট মাস হয়ে গেল, আনাস বাবাকে দেখতে পায় না, কোলে উঠে জড়িয়ে ধরতে পারে না। প্রতিদিনই সে বাবার খোঁজ করে। কিন্তু সে জানে না, তার বাবা আর কখনো ফিরে আসবে না।’
তাবাসসুম নেহা যখন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন তার চোখের নিচে কালচে দাগ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চেহারা বলে দিচ্ছিল, স্বামীর মৃত্যুতে অবুঝ দুই সন্তানকে নিয়ে অকূলপাথার পাড়ি দিচ্ছেন তিনি। ২০১৮ সালে নাদিম মিজানের সঙ্গে বিয়ে হয় তাবাসসুম নেহার। তখন তিনি সবে নবম শ্রেণির ছাত্রী।
স্বামীর স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘বিয়ের পর ও-ই আমাকে পড়াশোনা করিয়েছে। এসএসসি পাসের পর কনসিভ করলাম। বড় বাচ্চাটা হলো। এরপর আমি আর পড়াশোনা করতে চাইনি। কিন্তু ও বলত, পড়াশোনা চালিয়ে যেতে।’
নেহা বলেন, ‘ছেলেদের পড়াশোনা, তারা বড় হয়ে কী হবে: এসব নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল নাদিমের। বড় ছেলে আনাসের ভর্তির জন্য মিরপুরের একটি মাদ্রাসা ঠিক করে রেখেছিলেন তিনি। কিন্তু ছেলের মাদ্রাসায় যাওয়া আর দেখা হলো না তার।’
তাবাসসুম নেহা বলেন, ‘বড় ছেলেটা সারাক্ষণ বাবার সঙ্গেই থাকত। খেলাধুলা সব বাবার সঙ্গেই করত। সে বাবাকে খোঁজে, জড়িয়ে ধরতে চায়। কী উত্তর দিই ওকে?’ আন্দোলন-সংগ্রাম কোনো কিছুতেই না থেকেও স্বামীর এমন মৃত্যু কিছুতেই মানতে পারছেন না নেহা।
তিনি বলেন, ‘আমরা কখনো কিছুতেই ছিলাম না। নাদিম রাজনীতি করত না। তারপরও কেন তাকে মরতে হলো?’ তিনি জানান, মৃত্যুর পর নাদিমকে মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। তবে তার মৃত্যুর ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। প্রশাসন থেকে কোনো সাহায্য-সহযোগিতাও পায়নি তার পরিবার।
‘আমাদের কোনো টাকা-পয়সার প্রয়োজন নেই। লাশ তোলা হোক, ময়নাতদন্ত হোক, এটা আমরা চাই না’ উল্লেখ করে শহীদ নাদিম মিজানের স্ত্রী বলেন, ‘সেদিনের অবস্থা ও কষ্টের কথা কীভাবে বলব! সেদিনের কথা মনে হলেই বুক মোচড় দিয়ে ওঠে। ছেলে দুটি সারাদিন আব্বু আব্বু বলে ডাকাডাকি করে। তাদের মুখের দিকে তাকাতে পারি না।’
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার সন্তান দুটির নিরাপদ ভবিষ্যৎ চাই। তাদের সঠিকভাবে পড়াশোনা করাতে চাই। আমার বাবা-মা ও দুই দেবরের সহযোগিতায় এখনও খেয়ে-পড়ে বেঁচে আছি। যদি সরকার আমাকে একটি আবাসন ও চাকুরির ব্যবস্থা করে দিত, তাহলে সন্তানদের নিয়ে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পারতাম।’ এ সময় তিনি সকল শহীদ পরিবারের জন্য রেশনের ব্যবস্থা চালু ও সরকারি হাসপাতালগুলোতে ফ্রি-চিকিৎসার ব্যবস্থা করার দাবি জানান।