বিজয় মিছিলে আক্কাসের মৃত্যু, পরিবারে বিপর্যয়

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দুপুরে ১৬ বছরের স্বৈরশাসন পতনের বিজয় উদযাপন করতে যাত্রাবাড়ীর মুরাদপুর এলাকার ভাড়া বাসা থেকে বের হন মো. আক্কাস আলী, কিন্তু সেই আনন্দের মুহূর্তটি এক অবর্ণনীয় বিষাদে পরিণত হয়।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর বিজয় মিছিলে যোগ দিতে গিয়ে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে শাহাদত বরণ করেন ৪৪ বছর বয়সী প্লাস্টিক কারখানার শ্রমিক মো. আক্কাস আলী।
আক্কাসের আকস্মিক মৃত্যু তার পরিবারে বিপর্যয় ঢেকে এনেছে। কেননা তিন সদস্যের পরিবারে তিনিই ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার স্ত্রী লাভলি আক্তার (৪০) এবং ১৯ বছর বয়সী ছেলে এখন আব্দুর রব অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি। আর্থিক সংকটের সঙ্গে লড়াই করছেন তারা। এখনও উল্লেখযোগ্য কোনো সাহায্য পাননি তারা।
শনির আখড়ার কুদার বাজার এলাকার একটি কওমি মাদ্রাসার ছাত্র আব্দুর রব শেষবার তার বাবার সঙ্গে একসঙ্গে খাওয়ার স্মৃতি স্মরণ করে বলেন, '৫ আগস্ট জোহরের নামাজের পর বাবা তার কারখানা থেকে দুপুরের খাবার খেতে বাড়িতে আসেন। আমিও ছাত্র আন্দোলনের মিছিল থেকে ফিরে আসি। মাসহ আমরা একসাথে দুপুরের খাবার খাই। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিই।'
তিনি বলেন, স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর বিজয় মিছিলে যোগ দিতে তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে কুতুবখালীর দিকে যান। কিন্তু তিনি জানতেন না যে তার বাবাও যাত্রাবাড়ীর ধোলাইপাড় এলাকায় মিছিলে যোগ দিয়েছেন।
তার পরিবারের সদস্যদের মতে আক্কাস রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না। তিনি কখনোই ছাত্র আন্দোলন নিয়ে কথা বলেননি। তবু তিনি শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের পতনের বিজয় মিছিলে যোগ দিয়ে ইতিহাসের সাক্ষী হতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত তার জীবন কেড়ে নেয়।
'আমার বাবা দেশের রাজনীতিতে আগ্রহী ছিলেন না, তাই আমরা ভেবেছিলাম তিনি তার কর্মস্থলে যাবেন। কিন্তু পরে আমি জানতে পারি যে তিনি যাত্রাবাড়ী থানার সামনে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন। তখন আমি ফ্লাইওভারের ওপরেই ছিলাম,' রব বলেন।
মিছিল শেষে তিনি মাগরিবের নামাজের সময় তার মাদ্রাসায় ফিরে আসেন। কিন্তু নামাজের পর ক্লাসে থাকাকালীন একজন শিক্ষক তাকে ডেকে বাড়ি যেতে বলেন। তার পরিবারের একজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বলে জানান তিনি। কিন্তু তিনি বুঝতেই পারেননি যে তার বাবাই গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
বাড়িতে ফিরে তিনি যা দেখলেন তা তার সবচেয়ে খারাপ আশঙ্কাকেও ছাড়িয়ে যায়। :মাদ্রাসা থেকে ফিরে আমি দেখি আমার বাবার নিথর দেহ স্থানীয় মসজিদের সামনে খাটিয়ায় শোয়ানো আছে,' কোনো মতে আবেগ সংবরণ করে রব সেই মর্মান্তিক মুহূর্তের কথা স্মরণ করেন।
আক্কাসের শোকার্ত স্ত্রী লাভলি আক্তার স্মরণ করেন, বাড়ি থেকে বের হওয়ার প্রায় দেড় ঘণ্টা পর কারখানার মালিকের ছেলে নাঈম তাদের বাড়িতে আসেন এবং জানান যে আক্কাসকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
কেউ আক্কাসের ফোন ব্যবহার করে নাঈমকে ফোন করে জানান যে ফোনের মালিক গুরুতর অবস্থায় আছেন। কিন্তু তখনই আক্কাসের মৃত্যু হয়ে গিয়েছিল, কারণ একটি গুলি তার বুক ভেদ করে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ফোনকারী সত্য বলার সাহস পাননি।
'খবর শুনে আমি ভেবেছিলাম এটি রাবার বুলেটের মতো সামান্য আঘাত হতে পারে। তবে আমি আমার ছোট ভাসুর মো. রজ্জাক আলীকে ফোন করি এবং তাকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠাই,' শোকার্ত কণ্ঠে লাভলি বলেন।
'কিন্তু হাসপাতালে পৌঁছে রজ্জাক তার ভাইয়ের নিথর দেহ দেখতে পান,' তিনি বলেন।
রজ্জাক তার এক বন্ধুর সঙ্গে আক্কাসের লাশ মাগরিবের আগেই বাড়িতে নিয়ে আসেন। পরের দিন সকালে আক্কাসকে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। ছেলে রব তার বাবার জানাজা পড়ান।
সেদিনের ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা স্মরণ করে রব বলেন, তিনি নিজেও কয়েকবার গুলি থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পান, আর যাত্রাবাড়ী থানার সামনের রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেক লাশ পড়ে থাকতে দেখেন।
মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার বাসিন্দা আক্কাসের পরিবার গত ৪০ বছর ধরে রাজধানীর দনিয়া এলাকায় বসবাস করছে। তাদের কোনো জমি বা বাড়ি নেই। আক্কাসের বাবা মো. সোনা মিয়া এবং মা মোমেলা খাতুন বহু বছর আগে মারা গেছেন। আক্কাসের একমাত্র ছোট ভাই রজ্জাক পাশে থাকলেও তিনিও আর্থিক সংকটে ভুগছেন। আর তার চার বোনই বিবাহিত।
দৈনন্দিন সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে লাভলি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, 'একজন নারীর জন্য স্বামীই সব। কিন্তু আমি তাকে চিরতরে হারিয়েছি। এখন আমাদের আল্লাহ ছাড়া কেউ নেই।'
তাদের একমাত্র ছেলে রব এখন পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করে সংসার চালানোর চেষ্টা করছেন। 'কিন্তু আমার পড়াশোনার খরচ বাদ দিয়ে যা আয় হয় তা দৈনন্দিন খরচ মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়,' তিনি বলেন।
তাদের এই করুণ অবস্থা সত্ত্বেও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে এখনও কোনো সাহায্য পায়নি তারা। তবে লাভলি আক্তার তার ছেলের জন্য তাৎক্ষণিক আর্থিক সাহায্য এবং সরকারি চাকুরির আবেদন জানান।
এখন কীভাবে সংসার চালাচ্ছেন জানতে চাইলে লাভলি বলেন, স্বামীর মৃত্যুর পর তারা জামায়াতে ইসলামী থেকে ২ লাখ টাকা এবং আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন থেকে ১ লাখ টাকা পেয়েছেন, যা তাদের বেঁচে থাকতে সাহায্য করেছে।
স্বামীর ন্যায়বিচার চেয়ে লাভলি বলেন, 'আমি আমার স্বামীর মৃত্যুর বিষয়ে যাত্রাবাড়ী থানায় একটি মামলা দায়ের করেছি। আমি আক্কাস হত্যার সঙ্গে জড়িতদের মৃত্যুদণ্ড চাই।'