মেয়ের জন্মের আগেই শহীদ হলেন সাব্বির

বাবার মতোই নিজের সন্তানের মুখ দেখার আগেই পৃথিবী ছেড়ে যেতে হলো মো. সাব্বির হাওলাদারকে। ২০২৮ সালের জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশবাসীর জন্য সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার প্রত্যাশায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেন তিনি।
সাব্বিরের বাবা মো. জসিম হাওলাদার ২৪ বছর আগে আকস্মিক স্ট্রোকে মারা যান, তখন সাব্বির ছিলেন মায়ের গর্ভে মাত্র এক মাসের। বাবার স্নেহ কেমন হয়, তা কখনোই জানা হয়নি তার।
বাবার মতো পিতৃস্নেহবঞ্চিত হলো মেয়েও
বেদনাদায়কভাবে, একই পরিণতি হলো সাব্বিরের একমাত্র সন্তানেরও। ৪ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হওয়ার পর তিন দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ৭ আগস্ট না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি। তখন তার স্ত্রী মেঘলা আক্তার ছিলেন আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এক মাসেরও বেশি সময় পর জন্ম নেয় তাদের একমাত্র মেয়েসন্তান, শেহজা ইসলাম মুনতাহা।
মুনতাহাও বাবার স্নেহ বঞ্চিত হয়ে বড় হবে। হয়তো অন্য শিশুদের বাবার কোলজুড়ে হাসতে দেখে এক মুহূর্তের জন্য ভাববে, তার বাবাও যদি বেঁচে থাকতেন!
২৩ বছর বয়সী বাস হেলপার সাব্বির ১৯ বছর বয়সী স্ত্রী মেঘলা আক্তার ও বৃদ্ধা মা সাবিনা খাতুনকে রেখে গেছেন, যার বয়স এখন ৫০-এর কোঠায়।
সাব্বিরের মা সাবিনা খাতুন বলেন, ‘আমার স্বামী মারা গিয়েছিলেন ২৪ বছর আগে, তখন সাব্বির আমার গর্ভে মাত্র এক মাসের। বড় ছেলে জুয়েল তখন খুব ছোট ছিল। অন্যের বাড়িতে কাজ করে দুই ছেলেকে বড় করেছি। কিন্তু সাব্বির কখনো বাবার ভালোবাসা পায়নি। এখন আমার নাতনিও বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হলো।’
মায়ের হাতে রান্না ভুনা খিচুড়ি খাওয়া হলো না
সেদিনের কথা স্মরণ করে সাবিনা বলেন, সকালে সাব্বির বাসা থেকে বের হওয়ার আগে বলেছিল, ‘মা, ভুনা খিচুড়ি আর মুরগির মাংস রান্না করো, ফিরে এসে তোমার সঙ্গে খাব।’
সাবিনাও ছাত্রদের মেসে রান্নার কাজে বের হন। সকাল ১১টার দিকে রান্নার সময় এক প্রতিবেশী ছুটে এসে জানান, সাব্বির গুলিবিদ্ধ হয়েছে এবং তাকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়েছে।
হাসপাতালে ছুটে গিয়ে দেখেন, আইসিইউতে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে তার ছেলে। মাথায় একটি গুলি লেগেছে, আর তিনটি গুলি আঘাত করেছে গলা, বুক ও হাতে।
‘দেখো, কীভাবে আমার ছেলের শরীর ঝাঁঝরা হয়ে গেছে,’ বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন সাবিনা।
৪ আগস্ট ওর মৃত্যুই লেখা ছিল
তিন দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ৭ আগস্ট মাগরিবের সময় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সাব্বির। ময়নাতদন্ত ছাড়াই সেদিন রাতেই তাকে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়।
সাবিনা বলেন, তিনি জানতেন না সাব্বির আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। ‘কখনো দেখিনি ওকে মিছিলে যেতে। হয়তো ৪ আগস্ট ওর মৃত্যুই লেখা ছিল, তাই সেদিন ও রাস্তায় নেমেছিল।’
সেই আন্দোলন পরদিন ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের পতন ঘটায়। কিন্তু জীবনের জন্য লড়াইরত অবস্থায় থাকায় সাব্বির তা দেখে যেতে পারেনি।
স্ত্রীর শোকগাথা
মেঘলা আক্তার জানান, ঘটনার দিন তিনি বাবার বাড়ি, সায়েদাবাদের ঋষিপাড়ায় ছিলেন। সেখানে এক সপ্তাহ থাকার কথা ছিল।
সকাল ১১টায় স্বামীকে ফোন করেন তিনি। কিন্তু অপরিচিত কেউ রিসিভ করে ফোন কেটে দেয়। এরপর দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেও কোনো খোঁজ না পেয়ে আতঙ্ক বাড়তে থাকে তার।
বিকেল ৫টার দিকে বাসায় ফেরার পথে অনেকেই তাকে সাব্বিরের খোঁজ জিজ্ঞেস করছিল। কিন্তু কেউ-ই তার সামনে সত্য কথাটি বলতে পারেনি।
বাসার সামনে পৌঁছে এক প্রতিবেশীর কাছে জানতে পারেন, সাব্বির গুলিবিদ্ধ হয়েছে এবং তাকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু দরজা বন্ধ দেখে হতভম্ব হয়ে যান তিনি।
পরে বাবার বাড়িতে ফিরে পরিবারের সদস্যদের জানান। তার মা-বাবা হাসপাতালে ছুটে যান, আর তাকে বাড়িতেই থাকতে বলেন।
পরদিন হাসপাতালে গিয়ে দেখেন, স্বামী মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। কিন্তু আর ফেরা হয়নি তার।
‘স্বামীর মৃত্যুর এক মাস পর ১৯ সেপ্টেম্বর আমার মেয়ের জন্ম হয়,’ বলেন মেঘলা। ‘সে জন্মের পর থেকেই বাবাহারা। বাবার আদর কেমন, সে কোনোদিন বুঝতে পারবে না।’
অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ : আর্থিক সংকট
এখন সাবিনা, মেঘলা ও নবজাতক মুনতাহার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। সাবিনা ছাত্রদের মেসে রান্না করে যা উপার্জন করেন, তা দিয়ে কোনো রকমে সংসার চলে। অন্যদিকে, মেঘলা এখনো বাবার বাড়িতে আশ্রিত, কারণ তার নিজস্ব কোনো আর্থিক অবলম্বন নেই।
সাবিনা বলেন, ‘আমার ছেলে আমাদের একমাত্র ভরসা ছিল। আমি রান্নার কাজ করে ওকে সাহায্য করতাম। কিন্তু এখন আমরা চরম দুঃসময় পার করছি।’
তবে মেঘলা জানান, জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে তারা পাঁচ লাখ টাকা, জামায়াতে ইসলামী থেকে দুই লাখ টাকা এবং আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন থেকে এক লাখ টাকা পেয়েছেন, যা দিয়ে আপাতত সংসার চলছে।
কিন্তু পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে এখনো ন্যায়বিচারের আশায় বুক বাঁধছেন সাব্বিরের মা ও স্ত্রী। তাদের একটাই দাবি- সাব্বির হত্যার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।