শনিবার ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ফাল্গুন ১০ ১৪৩১, ২৩ শা'বান ১৪৪৬

স্পেশাল

পরীক্ষার ফি যোগাড় করতে ঢাকা গিয়ে লাশ হয়ে ফিরল রাইহান

 প্রকাশিত: ১০:৩৮, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

পরীক্ষার ফি যোগাড় করতে ঢাকা গিয়ে লাশ হয়ে ফিরল রাইহান

রাইহান কবির নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার পানিশাইল গ্রামের রিকশাচালক মামুন সরদারের একমাত্র পুত্র। বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে ডাক্তার বানাবেন। দরিদ্র পরিবারের একমাত্র আশা-ভরসা ছিল রাইহান। কিন্তু চব্বিশের জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ঢাকায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হওয়ায় পরিবারের সকল স্বপ্ন যেন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।

রাইহানের পিতা মামুন সরদার ও মা রানী বেগম তাদের একমাত্র মেয়ে, ১১ বছর বয়সী তসলিমাকে নিয়ে শোকে মুহ্যমান। এখনো কান্নার রোল ওঠে তাদের বাড়ি থেকে। সন্তানহারা মা যখন-তখন ডুকরে কেঁদে ওঠেন। একমাত্র ছেলের অনুপস্থিতিতে বাড়িটি তাদের অন্ধকার মনে হয়।

রাইহান স্থানীয় পানিশাইল বরেন্দ্র আলীয়া মাদ্রাসায় পড়ত। ২০২৫ সালে দাখিল পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। 

পড়ালেখার পাশাপাশি কম্পিউটারে অনলাইন ভিত্তিক কিছু কাজ করে সামান্য আয় করত, যা দিয়ে লেখাপড়ার খরচ চালাত। দাখিল পরীক্ষার ফরম পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা যোগাড় করতে গত মে মাসে সে ঢাকা যায়। 

উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন কম্পিউটার কাজ করে টাকা যোগাড় করে বাড়ি ফেরার।

একসময় বাবা-মাসহ ঢাকায় থাকত রাইহানের পরিবার। বাবা রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতেন। সেই সুবাদে ঢাকার পরিবেশ কিছুটা পরিচিত ছিল তার কাছে। সে ভরসাতেই এবার একা ঢাকায় গিয়েছিল। কিন্তু পরিবারের স্বপ্ন পূরণ না করে তাকে ফিরতে হলো লাশ হয়ে।

রাইহান গাজীপুর বোর্ড বাজার এলাকায় থেকে কম্পিউটার কাজ করত। ২০ জুলাই শনিবার, সরকার পতনের আন্দোলন তখন তুঙ্গে। চারদিকে উত্তাল পরিস্থিতি। মিছিল-মিটিং, পুলিশের গুলি, টিয়ার গ্যাস, লাঠিচার্জ- এসব স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওই দিন বিকাল সোয়া তিনটায় রাইহান রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি দেখছিল। 

এমন সময় পুলিশের গুলি এসে তার মাথায় বিদ্ধ হয়।

এক ব্যক্তি রাইহানের মোবাইল থেকে তার বাবাকে ফোন করে জানান, ‘আপনার ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। শহীদ তাজউদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। দ্রুত আসুন।’ যেন আকাশ ভেঙে পড়ে বাবা-মায়ের মাথায়। ঢাকায় যেতে টাকার প্রয়োজন, কিন্তু সে টাকাই নেই তাদের হাতে।

২০ মিনিট পর আবার ফোন আসে। এবার আরও মর্মান্তিক সংবাদ- রাইহান আর নেই! পরিবারের সবাই নির্বাক হয়ে যায়। রেজাউল ইসলাম নামের গ্রামের এক ব্যক্তি ঢাকায় থাকতেন। তার মাধ্যমেই ২১ জুলাই সকালে রাইহানের লাশ গ্রামে পৌঁছায়। সেদিনই গ্রামবাসীর চোখের জলে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

রাইহানের পিতা মামুন সরদারের কোনো জমি নেই। সরকারের খাস জমির ওপর বাড়ি বানিয়ে বসবাস করছেন তারা। সেই বাড়ি থেকেই দেখা যায় রাইহান কবিরের কবর। দিন-রাত সেই কবরের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বাবা-মা।

এ পর্যন্ত জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকা, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা এবং স্থানীয় বিএনপির পক্ষ থেকে ১৬ হাজার টাকা সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।

রাইহানের বাবা-মা তাদের সন্তানের হত্যার বিচার ও রাষ্ট্রীয় সম্মান দাবি করেছেন।