আমার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল : শহীদ আকাশের মা

জন্মের এক বছরের মাথায় ওর বাবা মতিউর রহমান আমাকে ও আকাশকে ছেড়ে অন্যত্র বিয়ে করে চলে যায়।
এরপর আকাশকে নিয়ে শুরু হয় আমার কষ্টের জীবন। আমি অনেক কষ্ট করে, খেয়ে না খেয়ে আকাশকে বড় করেছিলাম। ওকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু আমার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল। এখন যেদিকে তাকাই, আমি শুধু অন্ধকার দেখি। আমি কী নিয়ে থাকব, কীভাবে কাটবে আমার দিন?
রাজধানীর মিরপুর পল্লবী থানার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ভাড়া বাসায় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস-এর প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বৈষম্যবিরোধী আদালনের শহীদ ইমন হাসান আকাশের মা ববি আক্তার কথাগুলো বলেন।
তিনি বলেন, ‘আমি কী নিয়ে বাঁচব, কী নিয়ে থাকব? আমার আর কেউ রইল না। আমাকে দেখবে কে? শিশু বয়সেই ওর বাবা আরেকটা বিয়ে করে আমাদের ফেলে চলে যায়। এরপর থেকে আকাশকে নিয়ে শুরু হয় আমার কষ্টের জীবন। আমি মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করেছি। আমার আর কোনো সন্তান নেই, একমাত্র সন্তান আকাশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু মুহূর্তেই শেষ হয়ে গেল আমার সবকিছু। এখন আমি চারপাশ অন্ধকার দেখি।’
বৈষম্যবিরোধী আদালনের শহীদ ইমন হাসান আকাশ (২২) রাজধানীর মিরপুরে মায়ের সঙ্গে থাকতেন। সংসারের হাল ধরতে একটি কুরিয়ার সার্ভিসে চাকরি করতেন।
অর্থসংকটের কারণে এসএসসি পাস করার পর আর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। আকাশ ও তার মা ববি আক্তারের (৪৫) ছিল ছোট্ট সংসার। আকাশের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর জেলার সখিপুর উপজেলার মাদবরকান্দি গ্রামে।
২০২৪ সালের ৪ আগস্ট সন্ধ্যায় ছাত্র-জনতার আদালনে মিরপুর-১০ নম্বরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান আকাশ। তার মাথার ডান পাশে গুলি লাগে, যা বাম দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। পরদিন ৫ আগস্ট সকাল ৮টার দিকে মাদবরকান্দি গ্রামের কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
শহীদ আকাশের মা ববি আক্তার বলেন, ‘আমার আকাশ আমার কাছে নেই, সে আমাকে রেখে অনেক দূরে চলে গেছে। আমার বুকটা খালি হয়ে গেছে। ওর কথা মনে হলেই বুক ফেটে কান্না আসে। সাত মাস আমার সন্তান আমাকে মা বলে ডাকেনি। আকাশ ছাড়া এখন দিনও ফুরায় না, রাতও কাটে না। অনেক কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি। এখনও সন্ধ্যা হলেই মনে হয়, এই বুঝি আকাশ এসে আমাকে মা বলে ডাকবে। বলবে, মা, বিরিয়ানি খাবে? রান্না করে দাও। বেঁচে থাকতে কত বকা দিতাম এসব খাবার খাওয়ার জন্য। এখন এসব কথা মনে হলে বুকটা ফেটে যায়। আল্লাহ কেন আমার কাছ থেকে সবকিছু কেঁড়ে নিলেন?’
তিনি বলেন, ‘অনেক যুদ্ধ-সংগ্রাম করে সন্তানটিকে বড় করেছি। আমি অভাবে থাকলেও আমার সন্তানকে কখনো কষ্ট বুঝতে দেইনি। আমি বাড়ি বাড়ি কাজ করেছি। ওর শরীরে কোনো আঘাত লাগলে কখনো আমাকে বলত না, কারণ আমি কষ্ট পাব বলে। আমার স্নেহের সন্তানটিকে গুলি করে মেরে ফেলল। খুবই সভ্য-শান্ত ছিল ছেলেটা।’
ববি আক্তার বলেন, ‘ওর বাবা মতিউর রহমান গার্মেন্টসে চাকরি করত। সেখানেই এক নারীকে বিয়ে করে। এক বছরের একটি শিশুকে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমার কত কষ্ট হতো, সেটা একমাত্র আমিই জানি, আর আল্লাহ জানেন। স্বপ্ন ছিল ছেলেটাকে বিয়ে দিয়ে ঘরে বউ তুলব। কিন্তু সেই স্বপ্নও আমার শেষ হয়ে গেল।’
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘ওইদিন ওর বন্ধুরা মেসেজ পাঠায় মোবাইলে। এরপর আমি জানতে চাই, কোথায় যাবি? আকাশ বলে, আমি আদালতে যাব।
তখন আমি বলি, তুমি আমার একমাত্র ছেলে, তোমার কিছু হলে আমার কেউ থাকবে না। আন্দোলন চলাকালে সে ছাত্রদের পানি খাওয়াচ্ছিল, আবার কখনো আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিল। মিরপুর-১১ নম্বরে আমাদের বাসা। সেদিন প্রথমে ইসিবি চত্বর গিয়ে মিরপুর-১০ নম্বরে যায়।’
‘কিছুক্ষণ পর আমি মোবাইল কল দিয়ে জানতে চাই, কোথায় আছিস? সে বলে, আমি আসছি আম্মু, তুমি চিন্তা করো না। আমি তখন তাকে বলি, তুমি ভাত খেয়ে আসো বাসায়। সে বলে, আমার জন্য ভাত রেখে দিও, তুমি খেয়ে নাও। আমি এসে ভাত খাব। আবার দুপুরে কল দিলে ও বলে, আম্মু, তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে থাকো, আমি বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে খাচ্ছি।’
শহীদ আকাশের মা বলেন, ‘এরপর আমি ঘুমিয়ে যাই। ঘুম থেকে উঠি বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে, আবার কল দিই। কিন্তু ফোন রিসিভ করে না। পরে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে ওর এক বন্ধু কল দিয়ে বলে, আঁহঃর, আকাশ মারা গেছে। আমি তখন কান্নাকাটি শুরু করি।
‘আমার ভাইয়ের কাছে কল দিয়ে বলি, আকাশ নাকি মারা গেছে। সে তখন সব জায়গায় খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারে, আকাশ গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ওর বন্ধুরা মিরপুর-১০ নম্বর ডা. আজমল হাসপাতালে নিয়ে যায়, সেখানেই চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পরে আমি হাসপাতালে গিয়ে ওর লাশ বাসায় নিয়ে আসি। এরপর শরীয়তপুর আমার বাবার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আকাশকে দাফন করা হয়।’
ববি আক্তার বলেন, ‘আকাশ এসএসসি পাস করেছিল, এরপর টাকার অভাবে আর পড়তে পারেনি। পরে সংসারের হাল ধরতে একটি কুরিয়ার সার্ভিসে কাজ শুরু করে।
বর্তমানে আমার ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা, প্রেসার হাই। ঠিকমতো কাজ করতে পারি না। মাসে পাঁচ হাজার টাকার ওষুধের খরচ হয়। আমি রান্না করে লোকজনকে খাওয়াতাম। মাসে বাসা ভাড়া ১৫ হাজার টাকা দিতে হতো। আকাশ মাসে ১৫ হাজার টাকা বেতন পেত। দু’জনের খাওয়া-দাওয়া ভালোভাবেই চলছিল।’
তিনি বলেন, ‘আমার এতটুকু চাওয়া, যে মানুষটি দেশের জন্য জীবন দিয়েছে, সে যেন যথাযথ সম্মান পায়। আমার ছেলেকে যেন শহীদের মর্যাদা দেওয়া হয়।’
কারও কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে ববি আক্তার বলেন, ‘জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ টাকার চেক ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা পেয়েছি।’
বৈষম্যবিরোধী আদালত চলাকালীন ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট রাজধানীর মিরপুর-১০ এলাকায় ছাত্র-জনতার আদালতে অংশ নেন ইমন হাসান আকাশ। ওইদিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে পুলিশ, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে শহীদ হন আকাশ।
এ ঘটনায় ২৭ আগস্ট পল্লবী থানায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৬৩৭ জনের নামে হত্যা মামলা দায়ের করেন মা ববি আক্তার। এ মামলায় ইতোমধ্যে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।