আমার সন্তান এতিম হয়ে জন্মাল : আক্ষেপ শহীদ বাবুর স্ত্রীর

‘আমি এই বয়সে স্বামীকে হারিয়ে বিধবা হয়েছি। আমার তিনটি কন্যাসন্তানই এখন আমার একমাত্র ভবিষ্যৎ। আমি একজন সাধারণ নারী। কীভাবে এদের মানুষ করব, সেই দুশ্চিন্তায় দিশেহারা হয়ে পড়েছি।’
কথাগুলো বলেন, দিনাজপুর জেলার বিরল উপজেলার নোনা গ্রামের বাসিন্দা সিরাজুল ইসলামের কন্যা শারমিন আক্তার (২৪)। তিনি ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে শহীদ আসাদুল হক বাবুর বিধবা স্ত্রী।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমি ২০১৯ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলাম, কিন্তু পাস করতে পারিনি। এরপর আমার বাবা আমাকে ওই বছরের ১৯ আগস্ট বিরল উপজেলার ভান্ডারা ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর গ্রামের জয়নাল আবেদীনের ছেলে আসাদুল হক বাবুর সঙ্গে বিয়ে দেন। বিয়ের পর আমরা ঢাকায় চলে যাই। বাবু যাত্রাবাড়ীর কাজিরগাঁও মসজিদ রোডে ভাড়া বাসায় থেকে রিকশা চালিয়ে সংসার চালাত।’
আন্দোলনের মিছিলে বাবুর শেষ যাত্রা
শারমিন বলেন, ‘আমাদের সংসারে প্রথমে জমজ কন্যাসন্তান খাতিজা ও আছিয়ার জন্ম হয়। তাদের বয়স এখন দুই বছর দশ মাস। সংসার ভালোই চলছিল। এর মধ্যেই আমার গর্ভে আরেকটি সন্তান আসে। বাবু বলেছিল, এবার আমাদের একটি পুত্রসন্তান হবে। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য, সেই সন্তান জন্মানোর আগেই আমার স্বামী বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নির্মমভাবে নিহত হয়।’
গত ৭ নভেম্বর বাবুর মৃত্যুর পর তার স্ত্রী শারমিন আরেকটি কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। নাম রাখা হয়েছে আসিফা। শারমিন বলেন, ‘আমার স্বামী দেখে যেতে পারল না আমাদের তৃতীয় সন্তানের মুখ। এতিম হয়ে জন্মাল সে। এটা কীভাবে মেনে নেব!’
তিনি আরও বলেন, ‘৫ আগস্ট দুপুরে বাসায় খেয়ে আমার স্বামী রিকশা নিয়ে বের হয়। পরে জানতে পারি, সে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে গিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার মিছিলে অংশ নেয়। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মিছিলে গুলি চালায়। বাবু গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই পড়ে যায়। দীর্ঘক্ষণ রাস্তায় পড়ে থাকার পর আন্দোলনকারীরা তাকে উদ্ধার করে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যায়। চিকিৎসার ব্যবস্থা না থাকায় পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানকার জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’
মৃত্যুর সংবাদ পেলেন স্ত্রী শারমিন
হাসপাতালের মর্গে স্বামীর মরদেহ খুঁজে পাওয়ার বর্ণনাশারমিন বলেন, ‘সেদিন রাত ৮টার দিকে এক নারী আমার স্বামীর ফোন থেকে কল করে জানায়, বাবু গুলিতে মারা গেছে, তার লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আছে। আমি তখন হতভম্ব হয়ে যাই, কী করব বুঝতে পারছিলাম না। দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে রাত ৯টার পর হাসপাতালে ছুটে যাই। সেখান থেকে শ্বশুর-শাশুড়িকেও খবর দিই। সবাই মিলে বাবুর লাশ খুঁজতে থাকি। অবশেষে এক কক্ষে রাখা অনেক লাশের মধ্যে আমরা বাবুর ক্ষত-বিক্ষত মরদেহ শনাক্ত করি।’
গ্রামে বাবুর দাফন
বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ, শোকে ভেঙে পড়লেন মাশহীদ বাবুর পিতা জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘ঢাকা থেকে দিনাজপুর আসা পর্যন্ত পুরো পথজুড়ে আমরা লাশ ধরে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছি। ৬ আগস্ট সকালে আমরা বাবুর লাশ নিয়ে গ্রামে পৌঁছি। বাদ জোহর পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। জানাজায় বহু মানুষ অংশ নেয়, সবাই কান্নায় ভেঙে পড়ে। ৮ আগস্ট বাড়িতে কোরআনখানি ও দোয়া-মাহফিল আয়োজন করি। এরপর কয়েক দিন গ্রামে থেকে আবার ঢাকায় কর্মস্থলে ফিরে যাই।’
শারমিন বলেন, ‘সন্তান জন্মের সম্ভাব্য সময় থাকায় আমি বাবার বাড়ি চলে আসি। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি ঢাকায় যাওয়ার সময় এক মেয়ে আসিয়াকে সঙ্গে নিয়ে যান, আর খাদিজা আমার কাছে থেকে যায়। এরপর ৭ নভেম্বর আমার আরেকটি মেয়ে-সন্তান হয়। ওর নাম রেখেছি আসিফা। এখন আমি দুই সন্তানসহ বাবার বাড়িতে রয়েছি।’
বাবুকে হারিয়ে শারমিনের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত
তিনি জানান, ‘স্বামী মারা যাওয়ার পর জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে সাড়ে তিন লাখ, বিএনপি থেকে ৫০ হাজার এবং ২৮ নভেম্বর দিনাজপুর জেলা প্রশাসন থেকে ২৫ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছি। এই টাকা দিয়ে স্বামীর দোয়া মাহফিল করেছি এবং এখন দুই শিশুকে নিয়ে কষ্টে জীবনযাপন করছি। আমি সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি, যেন আমাকে আমার যোগ্যতা অনুযায়ী একটি সরকারি চাকুরি দেওয়া হয়। তাহলে আমি আমার সন্তানদের মানুষ করতে পারব।’
বিচার ও সহায়তার আবেদন
শহীদ বাবুর বাবা জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘আমি ৩০ বছর ধরে ঢাকার ডেমরা উপজেলায় একটি সাইকেলের পার্টসের কারখানায় কাজ করি। আমার একমাত্র ছেলে বাবু রিকশা চালিয়ে সংসার চালাত। এখন আমার পুত্রহত্যার বিচার চাই। বাবা হিসেবে সন্তানের লাশ কাঁধে নেওয়া যে কতটা কষ্টের, তা আমি বুঝেছি।’
শহীদ বাবুর মা আলেয়া বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘যারা আমার বাবুকে গুলি করে হত্যা করেছে, আল্লাহ যেন এই দুনিয়াতেই তাদের বিচার করেন।’