মঙ্গলবার ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, মাঘ ২৯ ১৪৩১, ১২ শা'বান ১৪৪৬

ব্রেকিং

সাড়ে ১৬ হাজার ‘গায়েবি মামলা’ প্রত্যাহার হচ্ছে: আসিফ নজরুল আশুলিয়ায় স্বামী-স্ত্রীসহ ৩ পোশাক শ্রমিকের লাশ উদ্ধার জুলাই অভ্যুত্থানের নৃশংসতা নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদন বুধবার কোনো অপরাধীকে ‘বাইরে’ দেখতে চান না স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ডিসেম্বরকে টার্গেট করে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি ইতিহাসের সেরা নির্বাচন হবে এবার: ইউএনডিপি বইমেলার স্টলে হট্টগোলের ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টার নিন্দা, দোষীদের বিচারের আওতায় আনার নির্দেশ গণহত্যার আসামির জামিনে বিচারকদের ‘সতর্ক’ থাকতে বললেন আইন উপদেষ্টা দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ১৪তম ‘সাগর-রুনি হত্যায় যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তারা মুখ খুলেছেন’ সাগর-রুনি হত্যার ১৩ বছর: তদন্ত নিয়ে এখনও ধোঁয়াশায় পরিবার জুনের মধ্যে বাংলাদেশি পাসপোর্ট পাচ্ছেন সৌদিতে থাকা ৬৯ হাজার রোহিঙ্গা ‘আরাকান আর্মির হাতে’ ৪ বাংলাদেশি জেলে অপহৃত জিম্মি মুক্তি না দিলে গাজায় যুদ্ধবিরতি বাতিল হওয়া উচিত: ট্রাম্প ইসরায়েলি জিম্মি মুক্তি স্থগিত করেছে হামাস

স্পেশাল

হার না মানা শাকিলের পরিবারের সব স্বপ্ন চুরমার

 প্রকাশিত: ১১:২২, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

হার না মানা শাকিলের পরিবারের সব স্বপ্ন চুরমার

মো. জুলফিকার আহমেদ, ডাক নাম শাকিল। বয়স ২৩ বছর। ঢাকায় কোটা আন্দোলনে অংশ নেন। পুলিশের ছোঁড়া বুলেটে প্রথমে আহত ও পরে শহিদ হন।  

শাকিল ভোলা সদর উপজেলার ভেলুমিয়া ৩নং ওয়ার্ডের মৃত মো. ছিদ্দিক মৃধার বড় ছেলে। তিনি ঢাকার ধানমন্ডি এলাকার ইউনিভার্সিটি অফ ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভে চারুকলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। 

একই সাথে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা মহানগরের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। 

গত ৪ আগস্ট ঢাকার মিরপুরের-১০ নম্বরে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হলে সাথের বন্ধুরা তাকে প্রথমে কুর্মিটোলা হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে সেখান থেকে তাকে আগারগাঁও নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে তিনদিন তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। পরে ৭ আগস্ট বিকেল ৩টার দিকে মারা যান শাকিল। পরের দিন ৮ আগস্ট বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১০টার দিকে ভোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জানাজা শেষে ভেলুমিয়া গ্রামের বাগমারা রাঢ়ী বাড়ির দরজার জামে মসজিদের পাশে তাকে দাফন করা হয়।

এ সময় তার কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।

শহিদ জুলফিকার আহমেদ শাকিলের গ্রামের বাড়িতে গেলে তার মা বিবি আয়েশা বাসস’কে জানান, বেশ কয়েকবছর আগে জুলফিকারের বাবা মারা যাওয়ার পর তাদের সংগ্রামী জীবন শুরু হয়। ছোট বেলা থেকে তিনি অন্যের বাসায় কাজ করে ছেলের পড়ালেখার খরচ চালিয়ে গেছেন। ছেলে যখন বুঝতে শেখে তখন টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচ জোগাড় করার পাশাপাশি সেই আয় থেকে নিজেদের বাসাভাড়াও দিতো। 

বাবাহারা ছেলেটা চেয়েছিলো নিজে কষ্ট করে বড় হয়ে পরিবারের মুখে হাসি ফোটাবেন। সেটি আর হয়ে ওঠেনি। ঢাকায় উত্তাল আগস্টে ঘাতক বুলেটের আঘাতে তার জীবন প্রদীপ নিভে গেছে। তিনি যে সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন, সেটিও পরিরারের কেউ জানতো না। মারা যাওয়ার পর জানতে পারে। তিনি যে ছাত্র ফেডারেশন করতেন, তার সাথের ছাত্ররাই তাকে বাড়িতে আনা ও দাফনের ব্যবস্থা করে। 

বিবি আয়েশা আরো জানান, ঢাকায় অন্যের বাসায় কাজ করে দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট ছেলে মো. সুমন ও বড় ছেলে শাকিলকে নিয়ে মিরপুর-১২ নম্বরের ডি-ব্লকে একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন। ছোট ছেলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে আর এগুয়নি। তাই শাকিল তাকে একটি কারখানায় কাজে দিয়েছেন। নিজে কষ্ট করে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। গত মাসে আগের বাসাটি ছেড়ে দিয়েছেন। তাই এ মাসে নতুন বাসা দেখার কথা ছিলো।

গত ৪ আগস্ট দুপুরের দিকে বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় মা বিবি আয়েশা বলেছিলেন, বাবা আন্দোলনে যাওয়ার দরকার নাই। বাইরে ঝামেলা চলে। তখন ছেলে বলেছিলো, মা আমার প্রতি তোমার আস্থা নাই? আমি বাসা দেখতে যাচ্ছি। এরপর দুপুর দেড়টার দিকে তার সাথের বন্ধুরা খবর নিয়ে আসে শাকিল এক্সিডেন্ট করেছে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পরিবারের কেউ না গেলে তাকে ভর্তি করবে না। এ খবর শুনে তারা মা বিবি আয়েশা হাসপাতালে যান। গিয়ে দেখেন তার ছেলে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার মাথায় দুইটা গুলি লেগেছে। একটি বের হয়ে গেলেও অপরটি ভেতরে রয়ে গেছে। এ অবস্থায় তার আর জ্ঞান ফেরেনি। ওইদিন বিকেল ৩টার দিকে চিকিৎসাধীন অরস্থায় মারা যায় শাকিল। 

ছেলেকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করার বিচার দাবি করেন তিনি।

শাকিলের মামা শহীদুল ইসলাম বাসস’কে জানান, ২০০০ সালের দিকে মেঘনার ভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়ে ভোলা সদর উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়ন থেকে শাকিলের বাবা ছিদ্দিক তাদের বাড়িতে আসেন। তখন  শাকিলের বয়স ছিল ৮ থেকে ১০ বছর। অল্পকদিনের মধ্যেই বিরল রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর বাবা ছিদ্দিকুর রহমান মারা যান। বাবা মারা যাওয়ার পর তাঁর মা বিবি আয়েশা ছোট ছোট ছেলে-সন্তানদের নিয়ে পাড়ি জমান ঢাকায়। সেখানে নিজে অন্যের বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজ করে ছেলে শাকিলের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে নেন। শাকিল ক্লাশ ওয়ান থেকে ফাইভ পর্যন্ত ঢাকার মিরপুরে ব্র্যাক স্কুলে ফ্রি’তে লেখাপড়া করেন। পাঠশালা নামের একটি স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ওই ক্লাশের বেতন ছিলো ৫০ টাকা। কিন্তু এ টাকা দেয়ার সামর্থ্য ছিলো না তাদের।  শাকিলের পরিবারিক অবস্থা দেখে ও মেধা ভালো হওয়ায় স্কুল কর্তৃপক্ষ বেতন মওকুফ করে দেয়। মেধাবী ও পড়ালেখার আগ্রহ দেখে স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে থাকার জন্য একটি রুমেরও ব্যবস্থা করে দেয়। শাকিল ওই রুমে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। শাকিল ২০২০ সালে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আদর্শ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যাপীঠ থেকে এসএসসি পাশ করেন। এরপর মিরপুরের হারুন মোল্লা ডিগ্রি কলেজ থেকে ২০২২ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি ২০২৩  সালে ধানমন্ডির ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভে চারুকলা বিভাগে ভর্তি হন। লেখাপড়ার পাশাপাশি ছবি আঁকা ও টিউশনি করে নিজের খরচ চালাতেন। সেখান থেকে মাকে বাসা ভাড়ার টাকাও দিতেন শাকিল। 

মা আয়শা বেগম বলেন, ছেলে আমার কি পড়তো অথবা কি করতো এর কিছুই পরিবারের কাউকে জানাতো না। সে হয়তো চেয়েছিলো নিজে ভালো চাকরি করে আমাকে চমকে দেবে। কিন্তু সেটি আর হলো না। অবশেষে সবাইকে চমকে দিয়ে সে নিজেই পরপারে চলে গেছে। 

ছেলেহারা মা আয়শা কাঁদতে কাঁদতে তার সন্তান হত্যাকারীদের বিচার দাবি করেন। 

তিনি জানান,পরিবারের অন্যতম উপার্জনক্ষম মেধাবী ছেলেকে  হারিয়ে তিনি এখন চোখেমুখে অন্ধকার দেখছেন। এখন প্রতিদিনের আর্তবিলাপাই তার সঙ্গী।

এদিকে জামায়াতে ইসলামী থেকে ও ভোলার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও কিছু সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়ার কথা জানিয়েছেন শাকিলের মা আয়শা বেগম।