বাড়ি ফিরে প্রতিদিন মাকে চুমু খেতেন যে রিফাত সে নেই, রোজ কাঁদেন মা
বিউটি আক্তার সন্তান হারানোর বেদনায় বিমূঢ় হয়ে আছেন।গণ-অভ্যুত্থানে প্রিয় পুত্রআবু বকর রিফাতকে (২৩) হারিয়ে গভীর শোকে নিমজ্জিত তিনি।যে ছেলে প্রতিদিন বাড়ি ফিরে মাকে চুমু খেতেন সে আজ আর নেই। তাই মায়ের বিরামহীন কান্না। ডুকরে কাঁদেন রোজ।
রিফাত গত ৫ আগস্টশহিদ হন। ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে সেদিন স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনার পতন ঘটে। সে আনন্দেনগরীর অন্যান্য এলাকার মতো যাত্রাবাড়িতেওহাজারো মানুষের ঢল নামে।এদের সাথে রাস্তায় আনন্দ মিছিলে যোগ দেন মোহাম্মদবাগ আদর্শ স্কুল এন্ড কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্র রিফাত।
এই স্কুলে ভর্তির আগে রিফাত কওমী মাদ্রাসায় মিজান পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। কওমী মাদ্রাসায় ভর্তির আগে তিনি অন্য একটি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেছিলেন।
রিফাতের মৃত্যুতে তার মাবিউটি আক্তারের(৪৫) শোক তার ব্যক্তিগত ক্ষতিকেও ছাড়িয়ে গেছে। তিনি দেশের সার্বিক পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়ে আবেগাপ্লুত কন্ঠে বলেন, ‘আমার ছেলে সবার জন্য স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনতে তার জীবন উৎসর্গ করেছে। কিন্তু স্বাধীনতা কোথায়? আমরা এখনও গণপরিবহন, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারিনি’।
গত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটাতে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহিদ পুত্রের সম্পর্কে আলাপকালে বিউটি আক্তার বাসসকে বলেন, ‘আমার ছেলের জীবনের বিনিময়ে আমি সারা দেশে শান্তি দেখতে চাই। যার মাধ্যমে দেশে সব ধরনের ঘুষ ও দুর্নীতি বন্ধ হবে। দরিদ্র ও দু:স্থদের সমান অধিকার নিশ্চিত হবে।’
শহিদ সন্তানের গৌরবে গর্বিত পিতা মোঃ আওলাদ হোসেন (৫৫) বেদনা বিহ্বল কন্ঠে বাসসকে বলেন, আমার ছেলে দেশের জন্য জীবন দান করায় তার মৃত্যুতে আমার কোনো দুঃখ নেই। ফ্যাসিবাদী শাসনের পতনের পর হাজার হাজার মানুষকে আনন্দ প্রকাশ করতে দেখে আমি তখনই আমার চোখের পানি মুছে ফেলেছি।’
বেদনা বিধুর কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘এটা গর্বের বিষয় যে আমার ছেলে দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছে।’
চার ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয় রিফাত সবসময় ন্যায়বিচারের প্রতি অনুরাগী ছিলেন। এমনকি যখন তার মা তাকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগদানের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন তখনও তিনি তার অবস্থান থেকে সরে দাঁড়াননি।
রিফাতকে আন্দোলনে যেতে বাধা দিলে তিনি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতেন, ‘আমাকে হত্যা করা হলে আমি শহিদ হব। যদি কেউ শহিদ হয় তার কোন পাপ থাকেনা।’
রিফাত এমন আত্মবিশ্বাসের সাথে কথাটি বলতেন, যা বিউটিকে একইসাথে ভীত এবং অনুপ্রাণিত করেছিল।
রিফাতের বড় ভাই মাহবুব রানা (২৬) এবং দ্বিতীয় ভাই সাইম আহমেদ (২৪) সৌদি আরব প্রবাসী। তার ছোট বোন সামিয়া আক্তার (১৫) কওমি মাদ্রাসার ছাত্রী। রিফাতের পরিবার নগরীর যাত্রাবাড়ির রায়েরবাগ এলাকার মোহাম্মদবাগে থাকে। তার পিতা বর্তমানে তার দুই ছেলের প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভরশীল।
রিফাত প্রথম থেকেই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন উল্লেখ করে তার বাবা আওলাদ হোসেন ছেলের রাবার বুলেটের ক্ষত নিয়ে বাড়ি ফেরার ঘটনাটি স্মরণ করেন।
তিনি বলেন, ‘যতক্ষণ না তার ছোট বোন এটি আবিষ্কার করেছিল ততক্ষণ পর্যন্ত সে আমাদের কাছ থেকে এটি লুকিয়ে রেখেছিল। আমরা যাতে কোনোভাবেই উদ্বিগ্ন না হই রিফাত সেদিকে খেয়াল রেখেছিলো।’
রিফাতের মৃত্যু দিনের স্মৃতি স্মরণ করে আওলাদ বলেন, সেদিন রিফাত সকাল ১০টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে মাথায় জাতীয় পতাকা বেঁধে রায়েরবাগের প্রধান সড়কে অন্য শিক্ষার্থীদের সাথে আন্দোলনে যোগ দেয়।
তিনি বলেন, বাসা থেকে বের হওয়ার আগে রিফাত পরোটা দিয়ে নাস্তা করে মায়ের আদর নিতে যায়। মায়ের কপালে ও গালে চুমু খায়।
আওলাদ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলেন, ‘আমি আসরের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হলে রিফাতের কয়েকজন বন্ধু কাছে এসে আমাকে তাদের সঙ্গে রায়েরবাগে যেতে বলে।
আমি যখন রায়েরবাগে পৌঁছালাম, তারা আমাকে বলল যে রিফাত মাতুয়াইল হাসপাতালে আছে। তখনই আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে আমার ছেলে আর নেই!’
তিনি শোকার্ত কন্ঠে বলেন, ‘কিন্তু রিফাতকে আমরা সেখানে পাইনি। পরে, আমরা মাতুয়াইল হাসপাতালের পাশে একটি বেসরকারি হাসপাতালে রিফাতের মরদেহ পেয়েছি’।
রিফাতের শোকাহত বাবা জানান, পরে তিনি জানতে পারেন যে ফ্যাসিবাদী শাসনের পতনের আনন্দে উল্লাস প্রকাশকারী হাজারো মানুষের সঙ্গে যাত্রাবাড়ি থানার সামনে পৌঁছালে তার ছেলে পুলিশ সদস্যদের গুলিতে প্রাণ হারায়।
প্রিয় পুত্রকে শেষ বিদায় জানানোর হৃদয়বিদারক কাহিনী বর্ণনা করে অশ্রুসিক্ত চোখে আওলাদ বলেন, তারা ওইদিনই কদমতলী পারিবারিক কবরস্থানে রিফাতকে দাফন করেন।
গত ১৬ বছরের শাসন ব্যবস্থার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘এ সময়ে জনগণ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারেনি। তাই দেশকে ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে মুক্ত করতে আমার ছেলে তার জীবন উৎসর্গ করেছে।’
তিনি আওয়ামী শাসনের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘পাঞ্জাবি আর টুপি পরে রাস্তায় হাঁটা খুবই কষ্টকর ছিল। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে সরকার জামায়াত-শিবিরের তকমা লাগিয়ে লোকদের গ্রেপ্তার করতো’।
রিফাতের মা বিউটি আক্তার তার ছেলের মৃত্যুর পর থেকে এখনও পর্যন্ত শোকাচ্ছন্ন। তিনি মনে করেন যে তার জীবন আর কখনোই আগের মতো হবে না।
বিউটি শোকাহত কন্ঠে বলেন, ‘রিফাত আমার সবচেয়ে ছোট ছেলে ছিল। এখন সবাই আছে। কিন্তু সবার ছোট রিফাতকে দেখতে পাচ্ছি না। সে কখনই আমার কাছে ফিরে আসবে না।’
রিফাত ছিল ভালোবাসা ও স্নেহের মূর্ত প্রতীক, সবসময় সে তার ভালোবাসা প্রকাশের উপায় খুঁজে বেড়াত।
তিনি তার পুত্রের আবেগময় স্মৃতি স্মরণ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তিনি বলেন, ‘রিফাত যখনই বাড়ি ফিরত, আমার গালে চুমু খেতো। এখন, তার মতো আমাকে কেউ আর আদর করে না।’
বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় প্রতিদিন রিফাত মায়ের কাছে ২০ টাকা চেয়ে নিতেন। সেসব দিনের কথা স্মরণ করে বিউটি আক্তার বলেন, ‘এখন আমার কাছে কেউ টাকা চায় না। এই শূন্যতা আমি প্রতিদিন অনুভব করি।’
রিফাতের শেষ টাকা চাওয়ার স্মৃতি স্মরণ করে কাঁদতে কাঁদতে বিউটি বলেন, ‘৫ আগস্ট সকালে ভাঙতি টাকা না থাকায় আমি তাকে দিতে পারিনি।’
‘তবে সে বাড়ি ফিরলে তাকে কিছু টাকা দিতে বলেছিল। কিন্তু সে জীবিত অবস্থায় ফিরে আসেনি, কান্না থরথর কন্ঠে তিনি বলেন, ‘আমি কখনই ভাবিনি যে আমার ছেলের মরদেহ আমাকে দেখতে হবে।’
রিফাতের শোকার্ত মা বলেন, ‘আমার ছেলের একটা বড় স্বপ্ন ছিল। সে ইতালি যেতে চেয়েছিলো। এ উদ্দেশ্যে সে তার পাসপোর্ট বানিয়েছিলো এবং কিছু টাকাও জমা দিয়েছিলো।’
ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ছেলের প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করে বিউটি বলেন, সে বলেছিলো, ‘আমি বিদেশ যাওয়ার পর আপনার জন্য একটি গাড়ি কিনব এবং একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) ঘরের সুবিধা সহ একটি বাড়ি তৈরি করব।’ কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতিগুলো অপূর্ণই থেকে যাবে!
বিউটি তার অসহনীয় কষ্টের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘রিফাতের স্মৃতি সারাক্ষণ আমাকে ঘিরে থাকে। আমি এক মূহুর্তের জন্যও তার হাসি এবং তার কথা ভুলতে পারি না।
ওগুলো আমার কানে প্রতিধ্বনিত হয় সারাক্ষণ। তার হাসি আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তার মৃত্যুর পর থেকে আমি ঘুমাতে পারি না।’
ভাইয়ের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর থেকে রিফাতের ছোট বোন সামিয়া গভীর বেদনায় নিমগ্ন। তিনি ভারাক্রান্ত কন্ঠে বলেন, ‘আমার ভাইয়ের মৃত্যু কোনোমতেই মেনে নিতে পারছি না।’
বেদনা বিহ্বল কন্ঠে সামিয়া বলেন, রিফাত শুধু আমার ভাই ছিলেন না। আমার সবচেয়ে কাছের ও ভরসার মানুষ ছিলেন। আমার আর দুই ভাই বিদেশে থাকায় তিনি আমার পথের দিশারী ছিলেন।’
‘কিন্তু এখন নির্মমভাবে আমাদের সে বন্ধন ছিন্ন হয়েছে। শেখ হাসিনার নির্দেশে আমার ভাইকে পুলিশ হত্যা করেছে!’ তার ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য শেখ হাসিনাকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘আমার ভাইকে কেন হত্যা করা হলো? তিনি কোনো অপরাধ করেননি। তিনি শুধু অন্যায়ের বিচার চেয়েছিলেন।’
তিনি দৃঢ় কন্ঠে বলেন, ‘আমি চাই আমার ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হোক। আমি আমার ভাইয়ের হত্যাকারীদের বিচার চাই।’
এদিকে রিফাতের বাবা আওলাদ তার পুত্রের হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবি জানিয়েছেন।