৭৫ গুলি নিয়ে চিরনিদ্রায় সেলিম, স্মৃতির স্মারক গর্ভের সন্তান
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে টানা ১২ দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে হেরে যাওয়া সেলিম তালুকদার জেনে যেতে পারেননি তার রক্তের উত্তরাধিকারের কথা।
১৮ জুলাই বাসা থেকে বেরিয়ে রাজধানীর মেরুল বাড্ডার প্রগতি সরণীর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগেই দিনই স্ত্রীর প্রেগন্যান্সি টেস্ট করিয়েছিলেন। তিনি ফলাফল জেনে যেতে পারেননি।
পুলিশের হয়রানির ভয়ে ১২ ঘণ্টা কেবল এ হাসপাতাল থেকে ও হাসপাতাল ঘুরে বেড়াতে হয়েছে স্বজনদের এই মৃত্যুপথযাত্রীকে নিয়ে। রাজধানীর ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতাল ভর্তি নিয়েছিলো সর্বশেষ।
সেখানেই লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। ১ আগস্ট শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন সেলিম। ২ আগস্ট যখন ঝালকাঠির নলছিটির পৈতৃক মাটিতে মাথা, বুক আর পিঠে ৭৫টি গুলি নিয়ে সমাহিত হলেন তার ঠিক দুদিন পরেই ছিলো সেলিম-সুমি আক্তারের প্রথম বিবাহবার্ষিকী।
আর শেখ হাসিনার সরকার পতনের দিন পরিবার জানতে পারে, সুমী আক্তার গর্ভবতী। যার গর্ভকাল ছিলো সেদিন পর্যন্ত চার সপ্তাহ ছয় দিন। কিন্তু অনাগত সন্তানের কথা জেনে যেতে পারলেন না বাবা।
রেন্ট এ কার চালক সুলতান তালুকদার ও সেলিমা বেগম দম্পতির ছেলে সেলিম তালুকদার। তিন বোনের এক ভাই। পরিবারের সঙ্গে থাকতেন বাড্ডার লিংক রোডে।
পরিবার জানায়, এসএসসি, এইচএসসির পর সেলিম বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি (বিইউএফটি) থেকে অনার্স সম্পন্ন করে নারায়ণগঞ্জ মাল্টিফ্যাবস লিমিটেড কোম্পানিতে চাকরি করতেন। মাস্টার্সে ভর্তির অপেক্ষায় ছিলেন।
অফিস থেকে ছুটি নিয়েছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য। ১৭ জুলাই রাতে অনার্সের আইডি কার্ডও বের করে রাখেন। ১৮ জুলাই সকালে রাজধানীর বাড্ডা লিংক রোডের বাসা থেকে বের হন নাস্তা না করেই। মা খেয়ে বের হতে বলেছিলেন। বেলা ১১টায় স্ত্রীর ফোনেই কল দিয়ে এক তরুণ জানায়, সেলিম ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
সুলতান তালুকদার বলছিলেন, গুলিবিদ্ধ সন্তানকে পুলিশের হয়রানির ভয়ে কোথাও ভর্তি করাতে পারছিলেন না। ১২ ঘণ্টা দৌড়াদৌড়ির পর পপুলার হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারেন।
তিনি আক্ষেপ করে বলছিলেন, যখন ছেলে মারা যায় তখন মৃত্যুর সনদও পুলিশের ইচ্ছামত নিতে হয়েছে। তাকে বাধ্য করা হয়, লিখিতভাবে স্বাভাবিক মৃত্যুর স্বীকারোক্তি দিতে।
সুলতান তালুকদার বলছিলেন, “একমাত্র ছেলেকে হারিয়েছি, সে তো আর ফিরে আসবে না। তাই কোনো মামলার ঝামেলায় যেতে চাই না।”
২ অগাস্ট ঝালকাঠির নলছিটিতে জানাজা শেষে মসজিদের পাশে পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয় সেলিমকে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা নলছিটি শহরের বাসস্ট্যান্ডে ‘বিজয় উল্লাস ৭১’ চত্বরকে ‘শহীদ সেলিম তালুকদার স্মৃতি চত্বর’ নাম দেন।
স্বামীকে হারিয়ে পুরো পৃথিবীটাই বদলে গেছে সুমী আক্তারের। অনাগত সন্তানের মাঝেই অনুভব করছেন স্বামীর অস্তিত্ব। ঝালকাঠি শহরের কবিরাজ বাড়ি এলাকার মতিউর রহমান চুন্নুর মেয়ে সুমী আক্তার। বড়ভাই নাহিদুল ইসলাম ওমানপ্রবাসী। মেঝোভাই ইলিয়াস হাওলাদার পড়াশোনা শেষ করেছেন।
সুমী আক্তার বলছিলেন, বিয়ের এক বছর উপলক্ষে তাদের চট্টগ্রামে বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিলো। তিনি স্বামীর জন্য নতুন পোশাক কিনেছিলেন। কয়েক মাস আগে থেকে স্বামীর মুখেও ছিলো বিবাহবার্ষিকীতে চমকে দেওয়ার ঘোষণা। সেলিম একটি কন্যা সন্তানের আশা করতেন সবসময়।
উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যয়নরত স্ত্রী সুমী আক্তার বলছেন, নিজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হলে সন্তান নিয়ে কারো বোঝা হয়ে থাকতে হবে না তাকে। সুমী তার স্বামীর হত্যাকাণ্ডের বিচার চান।
তবে মরদেহ কবর থেকে তোলা বা ময়নাতদন্ত হোক এমন কিছু কোনোভাবেই চান না তিনি।
শহীদ সেলিমের মা সেলিমা বেগম হয়তো আর সকালের নাস্তা নিয়ে অপেক্ষা করবেন না সন্তানের জন্য। তবে এখন আক্ষেপ নিয়ে অপেক্ষা সেলিমের অনাগত সন্তানের জন্য।