বুধবার ২২ জানুয়ারি ২০২৫, মাঘ ৯ ১৪৩১, ২২ রজব ১৪৪৬

বিজ্ঞান

ফাইভ জি কবে? জবাব নেই বিটিআরসির কাছেও

 আপডেট: ০৯:০৮, ২২ জানুয়ারি ২০২৫

ফাইভ জি কবে? জবাব নেই বিটিআরসির কাছেও

দেশের মানুষ কবে নাগাদ মোবাইল ফোনের পঞ্চম প্রজন্মের ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক তথা ফাইভ জি সেবা পাবে সেই প্রশ্নের জবাব নেই টেলিকম খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির চেয়ারম্যানের কাছেও।

মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিটিআরসির চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এমদাদ উল বারী বলেন, “আমি এই মুহূর্তে একটা টাইম লাইন দিতে পারব না যে কবে ফাইভ জি চালু করব না করব।”

দেশের অন্যান্য খাতের মত টেলিকম খাতেও সংস্কারের কথা উঠেছে। এর মধ্যেই এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির নেতৃত্বে কাজ শুরু করেছে নেটওয়ার্ক ও লাইসেন্সিং রোডম্যাপ পুণর্বিন্যাস কমিটি। এ নিয়ে মঙ্গলবার বিটিআরসির সভা কক্ষে সংস্কার কমিটির সঙ্গে বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে আসেন বিটিআরসির চেয়ারম্যান।

সেখানে বিটিআরসির চেয়ারম্যান বলেন, টেলিকম খাতের অস্পষ্ট নীতিমালা এবং ‘সকাল-বিকাল’ নীতিমালার পরিবর্তনের কারণে বিনিয়োগকারীরা উৎসাহ হারান।

তবে নীতিমালা টেকসই করার নিশ্চয়তা কী করে পাওয়া যাবে, তা স্পষ্ট হয়নি বিটিআরসির চেয়ারম্যানের কথায়। আলোচনায় টেলিকম নেটওয়ার্ক থেকে ‘মধ্যসত্বভোগীদের’ প্রভাব কমিয়ে আনার কথাও ওঠে।

ফাইভ জি কবে নাগাদ আসতে পারে জানতে চাইলে বিটিআরসির চেয়ারম্যান বলেন, “ফাইভ জি নিয়ে আমরা ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছি। ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে কনসাল্টও করেছি। এটা শুধুমাত্র বিজনেস অপারেটরদের একার পক্ষে করা সম্ভব না।

“এটার জন্য দরকার হবে সরকারি ও রেগুলেটরি কিছু উদ্যোগ। এবং এটাকে ফেসিলেটেট করার জন্য আমাদের নেটওয়ার্ক টপোলজিতেও কিছু চেইঞ্জ আনার দরকার আছে। এটা মাথায় রেখেই আমরা কাজগুলো করছি।”

দেশে মোবাইল ইন্টারনেটের ফাইভ জি সেবা চালু করতে ২০২২ এর মার্চে তরঙ্গ বরাদ্দের নিলাম হয়। দেশের চারটি মোবাইল অপারেটর সে সময় ১২৩ কোটি মার্কিন ডলারে ১৯০ মেগাহার্জ তরঙ্গ কেনে।

দেশের প্রধান দুই অপারেটর গ্রামীণফোন ও রবি আলাদাভাবে তিন হাজার ৩৬১ কোটি টাকা খরচ করে ২৬০০ ব্যান্ডের ৬০ মেগাহার্জ করে তরঙ্গ কেনে। বাংলালিংক ২৩০০ ব্যান্ডের ৪০ মেগাহার্জ তরঙ্গ কেনে দুই হাজার ২৪১ কোটি টাকায়।

আর রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা টেলিটক এক হাজার ৬৮১ কোটি টাকায় ২৩০০ ব্যান্ডের ৩০ মেগাহার্জ তরঙ্গ কেনে সে সময়।

নিলামের সময় বিটিআরসি বলেছিল, অপারেটরদের ছয় মাসের মধ্যে ফাইভ জি সেবা চালু করতে হবে। তবে এ সেবার জন্য প্রযোজ্য নীতিমালা প্রণয়ন করতেই বিটিআরসি প্রায় দুই বছর সময় নিয়ে নেয়। সেই নীতিমালা প্রকাশ করা হয় ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে।

সেখানে বলা হয়, ৫জি লাইসেন্সপ্রাপ্ত অপারেটরগুলো এক বছরের মধ্যে এই সেবা চালু করতে পারবে। দ্বিতীয় বছরের শুরু থেকে সব ধরনের ৫জি সেবা চালু করার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে চার অপারেটরকে। এসব সেবার মধ্যে আছে স্মার্ট সিটি, স্মার্ট হোম, ইনটেলিজেন্ট ট্রান্সপোর্টেশন সিস্টেম, স্মার্ট গ্রিডসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সেবা।

এরপর এক বছর হতে চলল, ফাইভ জির কী হল?

বিটিআরসি চেয়ারম্যান বলেন, “আমি অত পেছনের লিগ্যাসিতে যেতে পারব না। আই ক্যাননট অ্যানসার ফর দ্যাট। কিন্তু ওই যে ২৩০০ ও ২৬০০ তরঙ্গ এখনো ফাইভজির জন্য বরাদ্দ আছে। আমরা জুনের মধ্যে ৭০০ মেগাহার্জের অকশন করার প্রস্তুতি নিচ্ছি।”

২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কে এক আলোচনা সভায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তার তথ্য প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ওই বছরের মধ্যেই ফাইভ জি চালুর ঘোষণা দেন। ওই বছরের ডিসেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রীয় সংস্থা টেলিটক ও বিটিসিএল এর মাধ্যমে ছয়টি জায়গায় ফাইভ জির পরীক্ষামূলক সার্ভিসের ঘোষণা দেন তৎকালীন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তফা জব্বার।

এরপর পেরিয়ে গেছে অনেক দিন, কিন্তু ফাইভ জি আর বাংলাদেশের মানুষের হয়নি। মোবাইল অপারেটরগুলো বলে আসছে, ফাইভ জি নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের জন্য তাদের বহু বিনিয়োগের বিষয় রয়েছে। এছাড়া তারা এদেশে ফাইভ জির বাণিজ্যিক সম্ভাবনাও খুব একটা দেখছে না।

নেটওয়ার্কে মধ্যসত্বভোগী কারা?

দেশের বিদ্যমান টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক থেকে মধ্যসত্বভোগীদের ‘বিতাড়ন করার’ ঘোষণা দিয়েছেন বিটিআরসি চেয়ারম্যান এমদাদ উল বারী।

তিনি বলেন, “আমাদের টেলিকমিউনিকেশনের যে নেটওয়ার্কটা আছে, এটা এখন বিভিন্ন স্তরে টুকরো টুকরো হয়ে আছে। এগুলো বিভিন্ন কারণে এসেছে, একসময় হয়ত যৌক্তিক ছিল, কোথাও আবার হয়ত যৌক্তিক ছিল না। কিন্তু এই মুহূর্তে আমরা দেখছি নেটওয়ার্কের অনেকগুলো লেয়ার আছে যারা আসলে মধ্যস্বত্বভোগী হয়ে দাঁড়িয়েছে।

“যারা ট্রান্সমিশন খরচ কমানোর জায়গায় বরং বাড়াচ্ছে। এই জায়গাগুলোকে রিভিউ করে আমরা চাই সহজ, সক্ষম, এফিশিয়েন্ট ও সাশ্রয়ী একটা নেটওয়ার্ক তৈরি করতে। যেখানে মধ্যসত্বভোগী থাকবে না অথবা কম থাকবে।”

এই মধ্যসত্বভোগী কারা তা স্পষ্ট করেননি বিটিআরসির চেয়ারম্যান। তবে খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুরুর দিকে মোবাইল অপারেটরগুলো নিজেরাই টাওয়ার, ফাইবার অপটিক কেবল বসানোসহ সব কাজ করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর টাওয়ার, ফাইবারসহ কিছু নতুন লাইসেন্সের ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে। এখন মোবাইল নেটওয়ার্কের টাওয়ার থেকে শুরু করে, অপটিক্যাল ফাইবারসহ অনেক ক্ষেত্রেই টেলকো অপারেটরদের তৃতীয় পক্ষের ওপর নির্ভর করতে হয়। এখানে কোম্পানিগুলো ‘মনোপলি’ চালিয়ে আসছে বলে অভিযোগ করে আসছে মোবাইল অপারেটরগুলো।

এখন ২৯টি ক্যাটাগরিতে ৩০০০ এর বেশি লাইসেন্স দেওয়া আছে। যার বেশিরভাগই রাজনৈতিক বিবেচনায় দেওয়া বলে অভিযোগ রয়েছে। এগুলো বিটিআরসি কীভাবে সংস্কার করবে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, “আমরা ইন্ডাস্ট্রির টাইমলাইনে চলছি। লাইসেন্স মানে হচ্ছে একটা কমিটমেন্ট। তার ওপর ভিত্তি করে মানুষ ইনভেস্ট করেছে। আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এখন যে লাইসেন্সিংয়ের নীতিটা আছে, এখান থেকে বের হয়ে আসা।

“এখন আমরা যে জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলছি, সেখান থেকে দেখতে পাচ্ছি, আমাদের বড় বড় যে লাইসেন্সগুলো দেওয়া হয়েছিল ২০১১-২০১২ এর দিকে, যেগুলো শেষ হবে ২০২৬ ও ২০২৭ এর দিকে। এটা আমাদের একটা টাইম দিচ্ছে। এই টাইমলাইনটাকে ধরে নিয়ে আমরা একটা কাজ করছি যে যখনই তাদের লাইসেন্স রিনিউ করার সময় আসবে এই সময়টাকে পুঁজি করে আমরা ট্রান্সফরমেশনটাকে বাস্তবায়ন করব।”

কেন আসছে না গুগল-ফেইসবুক

দেশে গুগল-ফেইসবুকের মত বড় কোম্পানি কেন বিনিয়োগে উৎসাহী হচ্ছে না সেই ব্যাখ্যা দিয়ে বিটিআরসি চেয়ার‌ম্যান বলেন, “আমাদের দেশে অ্যামাজন-গুগল-ফেইসবুক ডেটাসেন্টার করে না। একটা হচ্ছে তারা নীতিমালা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এর পাশাপাশি প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর অপ্রতুলতাও বড় জিনিস।

“ওনাদের লাগে বড় বড় রোবাস্ট ডেটা সেন্টার, যেটা এখানে তৈরি হয়নি। এর জন্য লাগে ইন্টারন্যাশনাল কানেক্টিভিটি। আমাদের কানেক্টিভিটি অতটা রিলায়েবল হয়েছে কী হয়নি এ ধরনের নানা বিষয় এখানে দেখার বিষয় আছে।”

টেকসই নীতিমালার নিশ্চয়তা কে দেবে

এক প্রশ্নের জবাবে বিটিআরসির চেয়ারম্যান বরেন, “বিনিয়োগের পথে প্রধান বাধাগুলোর একটা যেটা আমরা বারবারই দেখি সেটা হচ্ছে স্পষ্ট ও টেকসই নীতিমালার অভাব। আমাদের অনেক নীতিমালাই স্পষ্ট হচ্ছে না, অনেকগুলো সকাল-বিকাল পরিবর্তন হচ্ছে।

“এতে করে বড় বড় গ্লোবাল কোম্পানি যারা আছে, তারা যখন বিনিয়োগ করতে যান, তখন বিনিয়োগের নিশ্চয়তা সম্বন্ধে অনেক আশাবাদী হন না। এই কথাটা উনারা বারবার বলছেন। এটা আমাদের বড় পয়েন্ট।”

বিটিআরসি কী করে টেকসই নীতিমালার নিশ্চয়তা দিতে চায়? সরকার পরিবর্তন হলে যে নীতিমালার পরিবর্তন হবে না তার নিশ্চয়তা কে দেবে?

চেয়ারম্যান বলেন, “নীতিমালা টেকসই হবে কী হবে না- সেটা সরকারের দায়িত্ব। তবে আমরা এক্ষেত্রে সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে সুপারিশ করি। কিন্তু সেই নীতিমালা যেন টেকসই হতে পারে, সেজন্য আমরা বারবার বলছি, আমরা গ্রাহকের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে দেখব।”

ব্রডব্যান্ডে গুরুত্ব

দেশের ইন্টারনেট সেবার ক্ষেত্রে ব্রডব্যান্ডের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে জানিয়ে বিটিআরসি চেয়্যারম্যান বলেন, “এই মুহূর্তে আমাদের যে নেটওয়ার্কটা আছে, এর বেশিরভাগ কমিউনিকেশন লোড পড়ে আছে স্পেক্ট্রামের (মোবাইল তরঙ্গ) ওপর। আমরা কেমন করে স্পেক্ট্রামের ওপর থেকে লোড কমিয়ে আমাদের ফিক্সড ব্রডব্যান্ডে নিয়ে যেতে পারি এটা একটা বিষয় আলোচনা হয়েছে।”

তিনি বলেন, “এখনো ইন্টারনেটের মাত্র সাত-আট শতাংশ আসে ফিক্সড ব্রডব্যান্ড থেকে, ৯২-৯৩ শতাংশ আসে মোবাইল থেকে। আমরা যদি বৈশ্বিকভাবে দেখি, অনেক বড় ডিজিটাল সার্ভিসগুলো যখন আসবে, তখন ব্রডব্যান্ডের ওপরে নির্ভরতা বাড়বে। কিন্তু আমাদের দেশে ব্রডব্যান্ডের জায়গাটায় অনেক বাধা-বিপত্তি আছে। এই বাধা কাটিয়ে উঠতে পারবে এমন নেটওয়ার্ক আমাদের গড়তে হবে।”

ভোক্তারাও পরামর্শ দিতে পারবেন

সংস্কারের জন্য সাধারণ মানুষের পরামর্শও শুনবে কমিটি। সেজন্য একটি ই-মেইল খোলা হয়েছে।

[email protected] – এই ঠিকানায় সাধারণ মানুষ ও ভোক্তারা তাদের মত করে পরামর্শ পাঠাতে পারবেন জানিয়ে বিটিআরসি চেয়ারম্যান বলেন, “সবকিছু দেখে নিয়ে আমরা আশা করছি মার্চ মাসের মধ্যে আমরা হয়ত একটা রোডম্যাপ তৈরি করে সরকারকে দিতে পারব।”