বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

কাদিয়ানী সম্প্রদায় অমুসলিম হওয়ার কারণ

মাওলানা মুহাম্মাদ সাজিদুল ইসলাম

 প্রকাশিত: ০৫:০৫, ১৫ অক্টোবর ২০২৪

কাদিয়ানী সম্প্রদায় অমুসলিম হওয়ার কারণ

ভূমিকা

আল্লাহ তাআলার নিকট একমাত্র মনোনীত ধর্ম ইসলাম। ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম আল্লাহ তাআলার নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন

اِنَّ الدِّیْنَ عِنْدَ اللهِ الْاِسْلَامُ.

আল্লাহ তাআলার নিকট একমাত্র মনোনীত ধর্ম ইসলাম। সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৯

অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন

وَ مَنْ یَّبْتَغِ غَیْرَ الْاِسْلَامِ دِیْنًا فَلَنْ یُّقْبَلَ مِنْهُ وَ هُوَ فِی الْاٰخِرَةِ مِنَ الْخٰسِرِیْنَ.

আর যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো ধর্মকে দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করবে, সেটা তার থেকে কিছুতেই কবুল করা হবে না এবং আখেরাতে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। সূরা আলে ইমরান (৩) : ৮৫

ইসলাম গ্রহণ করা মানে ঈমানের কালিমা মুখে উচ্চারণ করা এবং ঈমানের বিষয়গুলো মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা। মুমিন হওয়ার জন্য যেসব বিষয়ের ওপর ঈমান আনা জরুরি, সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি বিষয় এই

এক. আল্লাহর ওপর ঈমান আনার সাথে সাথে হযরত মু‏হাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ঈমান আনা। তাঁর সম্পর্কে এ বিশ্বাস রাখা যে, তিনি আল্লাহর বান্দা ও আল্লাহর রাসূল। তিনি সর্বশেষ নবী ও সর্বশেষ রাসূল এবং তিনি বিশ্বনবী ও শ্রেষ্ঠনবী। কিয়ামত পর্যন্ত আগত মানবতার জন্য তিনিই একমাত্র নবী। তাঁর আনীত শরীয়তই একমাত্র শরীয়ত। তাঁর পর আর কোনো নতুন নবী আসবে না, নতুন শরীয়ত আসবে না। তিনি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সর্বাধিক নৈকট্যপ্রাপ্ত রাসূল, সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। তিনি যেমন শেষনবী, তাঁর উম্মতও শেষ উম্মত। তাঁকে আল্লাহ তাআলা যে শরীয়ত দান করেছেন, তা সর্বশেষ শরীয়ত। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা পূর্বের সকল শরীয়ত রহিত করে দিয়েছেন। তাঁর আবির্ভাবের পর মুক্তির একমাত্র উপায় হল, তাঁর প্রতি ঈমান এনে তাঁকে শেষ নবী হিসেবে গ্রহণ করা এবং তাঁর শরীয়ত ও সুন্নতের অনুসরণ করা।

মুমিনের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আনুগত্য করা যেমন আবশ্যক, সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করাও তেমনি আবশ্যক। আল্লাহ তাআলা এটা অবধারিত করে দিয়েছেন। তাই আল্লাহ তাআলার অবাধ্য ব্যক্তি যেমনিভাবে দুনিয়া-আখেরাতে লাঞ্ছনা ও আযাব ভোগ করবে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবাধ্যতাকারীও দুনিয়া-আখেরাতে লাঞ্ছনা ও আযাব ভোগ করবে।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন

وَ مَنْ یَّعْصِ اللهَ وَ رَسُوْلَهٗ وَ یَتَعَدَّ حُدُوْدَهٗ یُدْخِلْهُ نَارًا خَالِدًا فِیْهَا وَ لَهٗ عَذَابٌ مُّهِیْنٌ.

আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করবে এবং তাঁর সীমাসমূহ লঙ্ঘন করবে, তিনি তাকে আগুনে ফেলবেন, যাতে সে চিরকাল থাকবে এবং তার জন্য রয়েছে অপমানকর শাস্তি। সূরা নিসা (৪) : ১৪

আল্লাহ তাআলা আরো ইরশাদ করেন

وَ مَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَّ لَا مُؤْمِنَةٍ اِذَا قَضَی اللهُ وَ رَسُوْلُهٗۤ اَمْرًا اَنْ یَّكُوْنَ لَهُمُ الْخِیَرَةُ مِنْ اَمْرِهِمْ  وَ مَنْ یَّعْصِ اللهَ وَ رَسُوْلَهٗ فَقَدْ ضَلَّ ضَلٰلًا مُّبِیْنًا.

কোনো মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীর জন্য এ অবকাশ নেই যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোনো বিষয় চূড়ান্ত করে দেওয়ার পরও নিজেদের বিষয়ে তাদের ইখতিয়ার থাকবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করল, সে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে পতিত হল। সূরা আহযাব (৩৩) : ৩৬

দুই. হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে যে কুরআন ও সুন্নাহ নিয়ে এসেছেন, তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। এ বিশ্বাস রাখা যে, কুরআন ও সুন্নাহ্য় যা বর্ণিত হয়েছে, তা সুস্পষ্ট হক এবং মানবজাতির জন্য একমাত্র হেদায়েত।

কুরআন আল্লাহ তাআলার কালাম। আল্লাহ তাআলা যেমন মহান ও মহিমান্বিত, আল্লাহর কালাম কুরআনও তেমনি মহান ও মহিমান্বিত। অন্য কিছু এর সমতুল্য হতে পারে না। আল্লাহ তাআলা এ মহান কালাম তাঁর সর্র্বশেষ নবী ও রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর নাযিল করেছেন এবং তাঁর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণও তাঁকে শিখিয়ে দিয়েছেন। অতএব এর শব্দ-বাক্য যেমনিভাবে কিয়ামত পর্যন্ত সুসংরক্ষিত থাকবে, তেমনি তার অর্থ-মর্মও কিয়ামত পর্যন্ত অবিকৃত থাকবে।

তিন. আল্লাহ তাআলার প্রেরিত অন্যান্য নবী-রাসূলগণের প্রতি ঈমান আনা। নবী রাসূলগণই হলেন মানব জাতির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ শ্রেণি। সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা, আমানতদারি, চারিত্রিক পবিত্রতা ও অন্যান্য গুণ-বৈশিষ্ট্যে তাদের সমতুল্য কেউ হতে পারে না। আল্লাহ তাআলা তাঁদেরকে নবুওতের জন্য বাছাই করেছেন। আল্লাহ তাআলার দেওয়া নবুওতী দায়িত্ব তাঁরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আদায় করেছেন। আল্লাহ তাআলা তাদের সবাইকে মুজেযা দান করে বিশেষভাবে সম্মানিত করেছেন। নবী রাসূলগণ ছাড়া অন্য কারো পক্ষে মুজেযা পাওয়া সম্ভব না।

এগুলো হচ্ছে ইসলাম ও ঈমানের মূলভিত্তি; যার কোনো একটি ছাড়া ঈমান হয় না। এগুলো মনেপ্রাণে গ্রহণ না করলে ইসলামে দাখেল হওয়া যায় না।

পবিত্র কুরআন করীমে মুমিনদের বিশ্বাস সম্পর্কে বলা হয়েছে

اٰمَنَ الرَّسُوْلُ بِمَاۤ اُنْزِلَ اِلَیْهِ مِنْ رَّبِّهٖ وَ الْمُؤْمِنُوْنَ كُلٌّ اٰمَنَ بِاللهِ وَ مَلٰٓىِٕكَتِهٖ وَ كُتُبِهٖ وَ رُسُلِهٖ لَا نُفَرِّقُ بَیْنَ اَحَدٍ مِّنْ رُّسُلِهٖ وَ قَالُوْا سَمِعْنَا
وَ اَطَعْنَاغُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَ اِلَیْكَ الْمَصِیْرُ.

রাসূল (অর্থাৎ হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাতে ঈমান এনেছে, যা তাঁর ওপর তাঁর প্রতিপালকের পক্ষ থেকে নাযিল করা হয়েছে এবং (তাঁর সাথে) মুমিনগণও। তাঁরা সকলে আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি, তাঁর কিতাবসূহের প্রতি এবং তাঁর রাসূলগণের প্রতি ঈমান এনেছে। (তারা বলে,) আমরা তাঁর রাসূলগণের মধ্যে কোনো পার্থক্য করি না (যে, কারো প্রতি ঈমান আনব এবং কারো প্রতি আনব না) এবং তাঁরা বলে, আমরা (আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিধানসমূহ মনোযোগ সহকারে) শুনেছি এবং তা (খুশিমনে) পালন করছি। হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আপনার মাগফিরাতের ভিখারি, আর আপনারই কাছে আমাদের প্রত্যাবর্তন। সূরা বাকারা (২) : ২৮৫

আল্লাহ, ফেরেশতা, কিতাব, রাসূল, তাকদীর, মৃত্যুর পর পুনরুত্থান, আখেরাত, জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদি বিষয়গুলো ইসলামের স্বতঃসিদ্ধ ও সর্ববাদিসম্মত বিষয়। এগুলোর যে তাফসীল ও বিবরণ অকাট্যভাবে ও সুস্পষ্টরূপে কুরআন-সুন্নাহ্য় বর্ণিত হয়েছে, সেটাও স্বতঃসিদ্ধ ও সর্বজনবিদিত। অর্থাৎ রাসূলের ওপর কুরআন নাযিলের পর থেকে অদ্যাবধি সকল যুগের সকল শ্রেণির মুমিন-মুসলিম এ বিষয়গুলো জানে ও বিশ্বাস করে। একজন মানুষ মুসলিম সমাজে বাস করবে আর এ বিষয়গুলো তার জানা থাকবে না এমনটা হতে পারে না। পরিভাষায় এ ধরনের বিষয়গুলোকে বলা হয় ‘জরুরিয়্যাতে দ্বীন’। অর্থাৎ দ্বীনের স্বতঃসিদ্ধ, সর্ববাদিসম্মত ও সর্বজনবিদিত বিষয়।

উদাহরণস্বরূপ আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে মুসলিমদের আকীদা হল, তিনি এক, তাঁর কোনো শরীক নেই। তিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই।

ফেরেশতা সম্পর্কে মুসলিমদের আকীদা হল, তারা আল্লাহ তাআলার মাখলূক। তারা আল্লাহ তাআলার আজ্ঞাবহ। তারা কখনো আল্লাহ তাআলার নাফরমানি করেন না।

নবী-রাসূলদের সম্পর্কে আকীদা হল, তাঁরা আল্লাহ তাআলার নির্বাচিত বান্দা। নবুওত ও রিসালাতের জন্য আল্লাহ তাআলা তাঁদের নির্বাচিত করেছেন। তাঁদের মধ্য থেকে যাদের কথা আল্লাহ তাআলা আমাদের জানিয়েছেন আর যাদের কথা জানাননি, সবাইকে আমরা আল্লাহ তাআলার নবী-রাসূল হিসেবে বিশ্বাস করি। ইহুদী-নাসারা যেভাবে এক নবীকে বিশ্বাস করে, আরেক নবীকে অস্বীকার করে আমরা তেমনটা করি না। আমরা সমস্ত নবীকে নবী হিসেবে এবং সমস্ত রাসূলকে রাসূল হিসেবে বিশ্বাস করি। তাঁদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করি না।

হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে  আকীদা হল, তিনি আল্লাহ তাআলার সর্বশেষ নবী ও রাসূল। তাঁর পরে আর কোনো নতুন নবী বা রাসূল আসবে না। তাঁর পরের কেউ যদি নিজেকে নবী বা রাসূল হিসেবে দাবি করে সে মিথ্যাবাদী, প্রতারক ও কাফের। নবীযুগ থেকে অদ্যাবধি সকল মুমিন-মুসলিমই এটা জানে ও বিশ্বাস করে।

মোটকথা, এগুলো এবং এধরনের আরো যত স্বতঃসিদ্ধ ও সর্ববাদিসম্মত বিষয় ইসলামে রয়েছে, পরিভাষায় এগুলোকে বলা হয় জরুরিয়্যাতে দ্বীন।

জরুরিয়্যাতে দ্বীনের বিষয়গুলো অত্যন্ত নাজুক ও স্পর্শকাতর। এগুলোর কোনো একটাকে যদি কেউ অস্বীকার করে, তাহলে সে নিঃসন্দেহে কাফের। আর এই অস্বীকারের প্রকাশ বিভিন্নভাবে হতে পারে যেমন

ক. সরাসরি মিথ্যা আখ্যা দেওয়া।

খ. সন্দেহ পোষণ করা।

জরুরিয়্যাতে দ্বীনের বিষয়গুলো তো হয়েই থাকে এমন যে, তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। যেমন, আল্লাহ এক, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন আল্লাহ তাআলার সর্বশেষ নবী ও রাসূল ইত্যাদি। তাই এসব বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করার মানেই হল তা অস্বীকার করে দেওয়া।

গ. ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা।

কুরআন কারীমে দ্বীনের বিষয়াদি নিয়ে উপহাসকারীদের সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে

وَ لَىِٕنْ سَاَلْتَهُمْ لَیَقُوْلُنَّ اِنَّمَا كُنَّا نَخُوْضُ وَ نَلْعَبُ  قُلْ اَبِاللهِ وَ اٰیٰتِهٖ وَ رَسُوْلِهٖ كُنْتُمْ تَسْتَهْزِءُوْنَ. لَا تَعْتَذِرُوْا قَدْ كَفَرْتُمْ بَعْدَ اِیْمَانِكُمْ اِنْ نَّعْفُ عَنْ طَآىِٕفَةٍ مِّنْكُمْ نُعَذِّبْ طَآىِٕفَةًۢ بِاَنَّهُمْ كَانُوْا مُجْرِمِیْنَ.

তুমি যদি তাদেরকে জিজ্ঞেস কর, তারা অবশ্যই বলবে, আমরা তো হাসি-তামাশা ও ফুর্তি করছিলাম। বল, তোমরা কি আল্লাহ, আল্লাহর আয়াত ও তাঁর রাসূলকে নিয়ে ফুর্তি করছিলে? অজুহাত দেখিও না। তোমরা ঈমান জাহির করার পর কুফরীতে লিপ্ত হয়েছ। আমি তোমাদের মধ্যে এক দলকে ক্ষমা করলেও, অন্য দলকে অবশ্যই শাস্তি দেব। কেননা তারা অপরাধী। সূরা তাওবা (৯) : ৬৫-৬৬

ঘ. স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত অর্থের বিপরীত কোনো অর্থ করে তার অপব্যাখ্যা করা।

অর্থাৎ যে অর্থটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীন থেকে অদ্যাবধি প্রত্যেক যুগের মুসলিমের মাঝে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত, তার বিপরীত কোনো অর্থ করা। যেমন, কুরআন মাজীদে সালাত, যাকাত, হজ¦ ইত্যাদি বিষয়ের হুকুম রয়েছে। আর এসব শব্দ দ্বারা কী উদ্দেশ্যÑ সেটাও সকল মুসলমান জানে। অতএব এসব ক্ষেত্রে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত অর্থের বিপরীতে যদি কোনো অর্থ করা হয়, তাহলে সেটা নিঃসন্দেহে কুরআন এবং দ্বীন ও শরীয়তের অপব্যাখ্যা এবং এটা স্পষ্ট কুফর। এই শ্রেণির কাফেরকে শরীয়তের পরিভাষায় যিন্দিক ও মুলহিদ বলা হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, মুলহিদ ও যিন্দিকের কুফর অন্য কাফেরদের কুফরের তুলনায় আরো বেশি ভয়াবহ ও জঘন্য।

অতএব কারো মুমিন হওয়া এবং ইসলামে দাখিল হওয়ার জন্য জরুরি হল, সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আমাদেরকে যা কিছু জানিয়েছেন, সমস্ত কিছু মেনে নেওয়া এবং সকল প্রকার কুফর ও শিরক থেকে বেঁচে থাকা।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন

اِنَّ الَّذِیْنَ یَكْفُرُوْنَ بِاللهِ وَ رُسُلِهٖ وَ یُرِیْدُوْنَ اَنْ یُّفَرِّقُوْا بَیْنَ اللهِ وَ رُسُلِهٖ وَ یَقُوْلُوْنَ نُؤْمِنُ بِبَعْضٍ وَّ نَكْفُرُ بِبَعْضٍ وَّ یُرِیْدُوْنَ اَنْ یَّتَّخِذُوْا بَیْنَ ذٰلِكَ سَبِیْلًا، اُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْكٰفِرُوْنَ حَقًّا وَ اَعْتَدْنَا لِلْكٰفِرِیْنَ عَذَابًا مُّهِیْنًا، وَ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا بِاللهِ وَ رُسُلِهٖ وَ لَمْ یُفَرِّقُوْا بَیْنَ اَحَدٍ مِّنْهُمْ اُولٰٓىِٕكَ سَوْفَ یُؤْتِیْهِمْ اُجُوْرَهُمْ وَ كَانَ اللهُ غَفُوْرًا رَّحِیْمًا.

যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণকে অস্বীকার করে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের মধ্যে পার্থক্য করতে চায় ও বলে, আমরা কতককে বিশ্বাস করি ও কতককে অবিশ্বাস করি এবং তার (অর্থাৎ ঈমান ও কুফরের) মধ্যবর্তী কোনো পথ অবলম্বন করতে চায় নিশ্চয় এমন লোকেরাই প্রকৃত কাফের। আর আমি কাফেরদের জন্য লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি। আর যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের প্রতি ঈমান এনেছে এবং তাঁদের মধ্যে কারো ক্ষেত্রে পার্থক্য করেনি, তিনি সত্বর তাদের প্রতিদান দেবেন। আর আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। সূরা নিসা (৪) : ১৫০-১৫২

আল্লাহ তাআলা আরো ইরশাদ করেন

اَفَتُؤْمِنُوْنَ بِبَعْضِ الْكِتٰبِ وَ تَكْفُرُوْنَ بِبَعْضٍ فَمَا جَزَآءُ مَنْ یَّفْعَلُ ذٰلِكَ مِنْكُمْ اِلَّا خِزْیٌ فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَ یَوْمَ الْقِیٰمَةِ یُرَدُّوْنَ اِلٰۤی اَشَدِّ الْعَذَابِ وَ مَا اللهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُوْنَ، اُولٰٓىِٕكَ الَّذِیْنَ اشْتَرَوُا الْحَیٰوةَ الدُّنْیَا بِالْاٰخِرَةِ فَلَا یُخَفَّفُ عَنْهُمُ الْعَذَابُ وَ لَا هُمْ یُنْصَرُوْنَ.

তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশে বিশ্বাস কর আর কিছু অংশ প্রত্যাখ্যান কর? সুতরাং তোমাদের যারা এরকম করে, তাদের একমাত্র পরিণাম পার্থিব জীবনে হীনতা এবং কিয়ামতের দিন তারা কঠিন শাস্তির দিকে নিক্ষিপ্ত হবে, তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আল্লাহ বেখবর নন। এরাই তারা, যারা আখেরাতের বিনিময়ে পার্থিব জীবনকে ক্রয় করে নিয়েছে। সুতরাং তাদের শাস্তি কিছুমাত্র লাঘব করা হবে না এবং তাদেরকে সাহায্যও করা হবে না। সূরা বাকারা (২) : ৮৫-৮৬

অন্যত্র আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন

وَ مَنْ یُّشَاقِقِ الرَّسُوْلَ مِنْۢ بَعْدِ مَا تَبَیَّنَ لَهُ الْهُدٰی وَ یَتَّبِعْ غَیْرَ سَبِیْلِ الْمُؤْمِنِیْنَ نُوَلِّهٖ مَا تَوَلّٰی وَ نُصْلِهٖ جَهَنَّمَ  وَ سَآءَتْ مَصِیْرًا.

যে কেউ রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করবে, তার নিকট সরল পথ প্রকাশ হওয়ার পরও এবং মুসলমানদের পথের বিপরীত পথ অনুসরণ করবে, আমি ওকে সেদিকেই ছেড়ে দেব, যা সে অবলম্বন করেছে (অর্থাৎ ওর অবলম্বন করা পথে চলতে দেব) এবং ওকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। আর তা কত নিকৃষ্ট প্রত্যাবর্তনস্থল। সূরা নিসা (৪) : ১১৫

হাদীস, তাফসীর, ফিকহ ও আকীদা শাস্ত্রে সকল মাযহাবের স্বীকৃত ব্যক্তিত্ব ইমাম আবু জাফর ত্বাহাবী রাহ. (মৃত্যু : ৩২১ হি.) ইসলামী আকীদা বিষয়ক তাঁর কিতাবে বলেন

والإيمان: هو الإقرار باللسان، والتصديق بالجنان، وأن جميع ما أنزل الله تعالى في القرآن، وجميع ما صح عن رسول الله صلى الله عليه و سلم من الشرع والبيان، كله حق.

ঈমান হল, মুখে স্বীকৃতি দেওয়া এবং অন্তরে বিশ্বাস করার নাম। ঈমান মানে, আল্লাহ তাআলা যা কিছু কুরআনে অবতীর্ণ করেছেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শরীয়ত ও (কুরআনের) ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হিসেবে যা কিছু প্রমাণিত সবকিছু সত্য বলে বিশ্বাস করা। আলআকীদাতুত তহাবিয়্যাহ, পৃ. ৯৩-৯৪

তিনি আরো বলেন

والإيمان : هو الإيمان بالله، وملائكته، وكتبه، ورسله، واليوم الآخر، والبعث بعد الموت، والقدر خيره وشره، وحلوه ومره، من الله تعالى، ونحن مؤمنون بذلك كله، لا نفرق بين أحد من رسله، ونصدق كلهم على ما جاؤوا به.

ঈমান হল, আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণ, কিয়ামত দিবস, মৃত্যুর পর পুনরুত্থান, তাকদীরের ভালো-মন্দ আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এই সকল বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। আমরা এই সকল বিষয়ের প্রতি ঈমান রাখি। আমরা তাঁর পয়গম্বরগণের মধ্যে কোনো তারতম্য করি না এবং তাঁরা যা নিয়ে এসেছেন, তা সত্য বলে মেনে নেই। আলআকীদাতুত তহাবিয়্যাহ, পৃ. ৯৮-৯৯

তিনি আরো বলেন

وأن محمدا صلى الله عليه وسلم عبده المصطفى، ونبيه المجتبى، ورسوله المرتضى، خاتم الأنبياء وإمام الأتقياء، وسيد المرسلين وحبيب رب العالمين، وكل دعوى النبوة بعد نبوته فغي وهوى، وهو المبعوث إلى عامة الجن وكافة الورى، بالحق والهدى.

...এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মনোনীত বান্দা, তাঁর নির্বাচিত নবী ও তাঁর প্রিয় রাসূল। তিনি সর্বশেষ নবী, মুত্তাকীদের ইমাম, রাসূলগণের সরদার এবং রাব্বুল আলামীনের প্রিয়পাত্র। তাঁর নবুওতের পর নবুওতের প্রতিটি দাবি মনগড়া ও মিথ্যা এবং চরম ভ্রষ্টতা। তিনিই জিন-ইনসান সকলের প্রতি সত্য ও হেদায়েতসহ প্রেরিত হয়েছেন। আলআকীদাতুত তহাবিয়্যাহ, পৃ. ৪৭-৫৩

ইমাম ইবনুল হুমাম রাহ. (মৃত্যু : ৮৬১ হি.) ইসলামী আকীদার প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য কিতাব ‘আলমুসায়ারা’য় লিখেছেন

نشهد أن محمدا رسول الله، أرسله إلى الخلق أجمعين، خاتما للنبيين وناسخا لما قبله من الشرائع.

আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মু‏হাম্মাদ আল্লাহর রাসূল; তাকে তিনি সমস্ত সৃষ্টির নিকট পাঠিয়েছেন সর্বশেষ নবী এবং পূর্বেকার সকল শরীয়ত রহিতকারী হিসেবে। আলমুসায়ারা ফিল আকাইদিল মুনজিয়াতি ফিল আখিরাহ, পৃ. ১৯৮

ইমাম আবু বকর বাকিল্লানী (মৃত্যু : ৪০৩ হি.) ইসলামী আকীদার প্রাচীন ও নির্ভরযোগ্য কিতাব ‘আলইনসাফ’-এ লিখেছেন

ويجب أن يعلم: أن نبينا محمداً صلى الله عليه وسلم مبعوث إلى كافة الخلق، وأن شرعه لا ينسخ، بل هو ناسخ لجميع من خالفه من الملل.

জানা আবশ্যক যে, আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল সৃষ্টির নিকট প্রেরিত হয়েছেন। তাঁর শরীয়ত রহিত হবে না; বরং তা অন্য সকল ধর্মকে রহিতকারী। আলইনসাফ ফী মা ইয়াজিবু ই‘তিকাদুহু ওয়া লা ইয়াজুযুল জাহলু বিহী, পৃ. ১২৯

শরীয়তে মুহাম্মাদিয়ার মাধ্যমে যেহেতু আল্লাহ তাআলা বিগত সকল শরীয়তকে রহিত করে দিয়েছেন, এজন্য নবী মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবের পর কিয়ামত পর্যন্ত নাজাত ও মুক্তির একটাই মাত্র পথ তাঁর ওপর ঈমান আনা এবং তাঁর শরীয়তকে কবুল করে নেওয়া।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন

وَ مَنْ یَّكْفُرْ بِهٖ مِنَ الْاَحْزَابِ فَالنَّارُ مَوْعِدُهٗ.

আর ওইসব দলের মধ্যে যে ব্যক্তি একে অস্বীকার করে, জাহান্নামই তার নির্ধারিত স্থান। সূরা হূদ (১১) : ১৭

হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন

وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِه، لَا يَسْمَعُ بِيْ أَحَدٌ مِنْ هذِهِ الْأُمَّةِ يَهُودِيٌّ، وَلَا نَصْرَانِيٌّ، ثُمَّ يَمُوتُ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِالَّذِي أُرْسِلْتُ بِه، إِلَّا كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ.

সে সত্তার কসম, যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ, ইহুদী হোক আর খ্রিস্টান হোক, এই উম্মতের যে-ই আমার বিষয়ে শুনবে, অথচ আমার রিসালাতের ওপর ঈমান না এনে মৃত্যুবরণ করবে, অবশ্যই সে জাহান্নামী হবে। সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৩

সূরা বাকারার ৮৫-৮৬ নম্বর আয়াতের উদ্ধৃতিতে যে আকীদার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা হানাফী মাযহাবের বিশিষ্ট ইমাম, ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান আশ-শাইবানী রাহ. (মৃত্যু : ১৮৯ হি.) এই শব্দে ব্যক্ত করেছেন

من أنكر شيئا من شرائع الإسلام فقد أبطل قول لا إله إلا الله.

অর্থাৎ যে ব্যক্তি ইসলামের কোনো একটি মৌলিক বিধানকে অস্বীকার করল, সে তার ঈমানের কালিমা ‘লা ইলাহা ইল্লাহ’-কে বাতিল করে দিল। শরহুস সিয়ারিল কাবীর, ইমাম সারাখসী খ. ৫, পৃ. ৩৬৮

ইমাম গাযালী রাহ. (মৃত্যু : ৫০৫ হি.) ঈমান ও কুফরের সংজ্ঞা এভাবে লিখেছেন

الكفر: هو تكذيب الرسول صلى الله عليه وسلم في شيء مما جاء به. والإيمان: تصديقه في جميع ما جاء به.

কুফর হল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (আল্লাহর পক্ষ থেকে) যা কিছু এনেছেন তার কোনোটির ক্ষেত্রে তাঁকে অস্বীকার করা। আর ঈমান হল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা কিছু এনেছেন, সবকিছুর ক্ষেত্রে তাঁকে বিশ্বাস করা। ফায়সালুত তাফরেকা বাইনাল ইসলামি ওয়াযযানদাকা, পৃ. ৭৮

তো মুমিন হওয়ার জন্য দ্বীন ও শরীয়তের সকল বিষয়কে সত্য মনে করা জরুরি। পক্ষান্তরে যদি দ্বীন ও শরীয়তের কোনো একটি বিষয়কে অবিশ্বাস করে (চাই সরাসরি অস্বীকার করুক বা অপব্যাখ্যা করে অস্বীকার করুক বা তা নিয়ে উপহাস করুক কিংবা তা না হক মনে করুক) তাহলে ঈমান শেষ হয়ে যাবে এবং ওই ব্যক্তি কাফের হয়ে যাবে।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যত বিষয় অকাট্য ও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত, সবগুলোর হুকুম এটাই।

আল্লামা ইবনে নুজাইম রাহ. (মৃত্যু : ৯৭১ হি.) আলআশবাহ ওয়ান নাযায়ের গ্রন্থে বিষয়টি এভাবে বলেছেন

والمرتد أقبح كفرا من الكافر الأصلي.

الإيمان: تصديق سيدنا محمد صلى الله تعالى عليه وسلم في جميع ما جاء به من الدين ضرورة.

الكفر: تكذيب محمد صلى الله عليه وسلم في شيء مما جاء من الدين بالضرورة.

মুরতাদ কুফরের দিক থেকে আসল কাফের অপেক্ষা জঘন্য।

ঈমান হল, হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বীনের যা কিছু নিয়ে এসেছেন বলে অকাট্যভাবে প্রমাণিত ও সর্বজনবিদিত, সে সকল বিষয়ে তাঁকে সত্য বলে বিশ্বাস করা। আর কুফর হল, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বীনের যা কিছু নিয়ে এসেছেন বলে অকাট্যভাবে প্রমাণিত ও সর্বজনবিদিত, তার কোনো একটি বিষয়ে তাঁকে অবিশ্বাস করা। আলআশবাহ ওয়ান নাযায়ের, পৃ. ১৫৯

কাদিয়ানী সম্প্রদায় অমুসলিম হওয়ার কারণসমূহ

মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ও তার অনুসারী কাদিয়ানী সম্প্রদায়  ইসলামের এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ অনেক মৌলিক বিষয়কে অস্বীকার করে নিজেরাই ইসলাম থেকে বের হয়ে গেছে। বক্ষমান প্রবন্ধে কাদিয়ানী সম্প্রদায় অমুসলিম হওয়ার মৌলিক কিছু কারণ নিয়ে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।

কাদিয়ানী সম্প্রদায় অমুসলিম হওয়ার মৌলিক কিছু কারণ

এক. ইসলাম ধর্মের মোকাবেলায় কাদিয়ানী ধর্ম গ্রহণ করা।

দুই. খতমে নবুওতের আকীদা অস্বীকার ও মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর নবুওত দাবি করা।

তিন. মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী কর্তৃক নিজেকে স্বয়ং মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ দাবি করা।

চার. বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবমাননা করা।

পাঁচ. কালিমা তায়্যিবা অস্বীকার করা।

ছয়. মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী কর্তৃক হযরত ঈসা আ. থেকে শ্রেষ্ঠ হওয়ার দাবি করা।

সাত. হযরত ঈসা আ.-এর ওপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করা।

আট. বিশ্বের সকল মুসলমানকে কাফের আখ্যা দেওয়া।

কাদিয়ানী সম্প্রদায় অমুসলিম হওয়ার প্রথম কারণ

ইসলাম ধর্ম অস্বীকার করে কাদিয়ানী ধর্ম গ্রহণ করা

মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ও তার অনুসারীদের কাফের হওয়ার প্রথম ও প্রধান কারণ ‘ধর্ম পরিবর্তন’। কাদিয়ানী সম্প্রদায় নবুওতের মিথ্যা দাবিদার মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর ওপর ঈমান আনার মাধ্যমে ইসলাম ছেড়ে ভিন্ন ধর্ম গ্রহণ করেছে। তাদের দৃষ্টিতে সে ধর্মটিই হল আসল ইসলাম। অথচ তা আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনীত ইসলাম থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

ইতিপূর্বে আমরা পড়েছি, ইসলামের ভিত্তি হল, আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামসহ পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসূলের প্রতি ঈমান আনা এবং আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনীত কুরআন ও শরীয়ত-সুন্নাহর অনুসরণের ওপর। পক্ষান্তরে কাদিয়ানী ধর্ম অনুযায়ী এটি মুমিন হওয়ার জন্য এবং আখেরাতে নাজাত পাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়; বরং তাদের দৃষ্টিতে মুমিন হওয়ার জন্য এবং আখেরাতে নাজাত পাওয়ার জন্য মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর ওপর ঈমান আনা ও তার অনুসরণ করা জরুরি। (নাউযু বিল্লাহ) ইসলাম ও কাদিয়ানী ধর্ম যে এক নয় তা এখান থেকেই স্পষ্ট। উপরন্তু তা তাদের গুরুরাই স্বীকার করেছেন।

এ বিষয়ে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর একটি বক্তব্য তার বড় ছেলে (কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় খলীফা) মির্যা বশীরুদ্দীন মাহমুদ এভাবে উদ্ধৃত করেছেন

حضرت مسیح موعود نے فرمایا ہے: ان کا اسلام اور ہے اور ہمارا اسلام اور ہے۔  ان کا خدا اور ہے اور ہمارا خدا اور۔  ہمارا حج اور ہے ان کا اور۔  اور اسی طرح ان سے ہر بات میں اختلاف ہے۔

হযরত মাসীহে মাওউদ (মির্যা কাদিয়ানী) তো বলেছেন, তাদের (মুসলমানদের) ইসলাম ভিন্ন আর আমাদের ইসলাম ভিন্ন। তাদের খোদা ভিন্ন আর আমাদের খোদা ভিন্ন। আমাদের হজ্ব ভিন্ন আর তাদের হজ্ব ভিন্ন। এমনিভাবে প্রতিটি বিষয়ে তাদের সাথে আমাদের পার্থক্য রয়েছে। কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের মুখপত্র দৈনিক আলফযল, ২১ আগস্ট ১৯১৭ ঈ., পৃ. ৮, কলাম ১

অনুরূপ কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের প্রথম খলীফা হাকীম নুরুদ্দীনের বক্তব্যেও তা সুস্পষ্টভাবে এসেছে। তিনি তার একটি বক্তব্যে বলেছেন

ان کا اسلام اور ہے اور ہمارا اسلام اور ہے۔

তাদের ইসলাম ভিন্ন আর আমাদের ইসলাম ভিন্ন। কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের মুখপত্র দৈনিক আলফযল, ৩১ ডিসেম্বর ১৯১৪ ঈ., পৃ. ৬, কলাম ১

ওপরের দুটি উদ্ধৃতি থেকে বিষয়টি একেবারে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, কাদিয়ানী সম্প্রদায় সম্পূর্ণ আলাদা একটি ধর্মের প্রবক্তা এবং সে ধর্মটি তাদের দৃষ্টিতেও মুসলমানদের ইসলাম থেকে আলাদা। তাদের ধর্মের ভিত্তি যেহেতু মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর ওপর ঈমান আনা এবং তার অনুসরণের ওপর, এজন্য তাদের দৃষ্টিতে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে মানা ছাড়া আখেরাতে নাজাত পাওয়া সম্ভব নয়। এ বিষয়ে হাকীম নুরুদ্দীনের (কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের প্রথম খলীফা) একটি বক্তব্য মির্যাপুত্র বশীর আহমদ এম এ  এভাবে উল্লেখ করেছেন

ایک شخص نے حضرت خلیفۃ المسیح سے سوال کیا کہ حضرت مرزاصاحب کے ماننے کے بغیر نجات ہے یا نہیں؟  فرمایا:  اگر خدا کا کلام سچ ہے تو مرزاصاحب کے ماننے کے بغیر نجات نہیں ہوسکتی۔

এক ব্যক্তি হযরত খলীফাতুল মাসীহ (মির্যা কাদিয়ানীর প্রথম খলিফা, হাকীম নুরুদ্দীন)-এর কাছে প্রশ্ন করেছেন, আচ্ছা, হযরত মির্যা সাহেবকে মানা ছাড়া কী নাজাত পাওয়া যাবে? উত্তরে তিনি বলেন, যদি আল্লাহর কালাম সত্য হয়, তাহলে মির্যা সাহেবকে মানা ব্যতীত নাজাত পাওয়া যাবে না। কালিমাতুল ফছল, পৃ. ৫৯ (মির্যাপুত্র বশীর আহমদ এম এ-কৃত)

কাদিয়ানী সম্প্রদায় অমুসলিম হওয়ার দ্বিতীয় কারণ

খতমে নবুওতের আকীদার অস্বীকার ও মির্যা কাদিয়ানীর নবুওত দাবি করা

আমরা জানি, হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ নবী, তাঁর পর নতুন কোনো নবী আসবে না এটা ইসলামের এমন মৌলিক আকীদা, যা ছাড়া ঈমান হতেই পারে না। এই আকীদা ইসলামের ওইসব  মৌলিক বিশ্বাসের  অন্তর্ভুক্ত, যা অস্বীকার করলে কিংবা অপব্যাখ্যা করলে কেউ আর মুসলিম থাকে না। সুতরাং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওত লাভের পরের কোনো ব্যক্তি যদি নিজেকে নবী বা রাসূল দাবি করে, তাহলে সে নিশ্চিত কাফের, মিথ্যাবাদী ও প্রতারক। আর যারা নবুওতের মিথ্যা দাবিদারকে বিশ্বাস করবে, তারাও কাফের হয়ে যাবে।

তাওহীদ, রিসালাত, কিয়ামত, আখেরাত, কুরআন অবতীর্ণ হওয়া, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয হওয়া, কা‘বা শরীফ কেবলা হওয়া ইত্যাদি বিষয় যে পর্যায়ের মৌলিক ইসলামী আকীদা, খতমে নবুওতের আকীদাও ঠিক ওই পর্যায়ের ইসলামী আকীদা। এসকল বুনিয়াদি আকীদার ওপর ঈমানের ভিত্তি হওয়াটা এমন স্বতঃসিদ্ধ, অকাট্য, সুপ্রতিষ্ঠিত, সর্ববাদিসম্মত ও সর্বজনবিদিত যে, যে ব্যক্তিই ইসলামকে চেনে, সে-ই জানে যে, ইসলামের এই বিশ্বাসগুলো হচ্ছে ঈমানের মূল ভিত্তি। এগুলো ছাড়া কেউ মুসলমান হতে পারে না। এমনকি অমুসলিমরাও জানে যে, ইসলাম ও ঈমানের ভিত্তি এই আকীদাগুলোর ওপর।

যেমনিভাবে আমরা আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে আল্লাহ তাআলার কালাম কুরআন পেয়েছি, তেমনিভাবে আমরা তাঁর কাছ থেকে এসব আকীদা-বিশ্বাসও পেয়েছি। যেভাবে আমাদের কাছে তাঁর পক্ষ থেকে এ বার্তা পৌঁছেছে যে, তিনি আল্লাহ তাআলার বান্দা ও রাসূল, ঠিক সেভাবেই এই বার্তাও পৌঁছেছে যে, তিনি ‘খাতামুন্নাবিয়্যীন’। তাঁর পরে নতুন করে আর কোনো নবী আসবে না। এজন্য আকীদায়ে খতমে নবুওত এবং এ ধরনের সকল  মৌলিক ইসলামী আকীদার যে কোনোটির অস্বীকার করা বা অপব্যাখ্যা করা ঠিক তেমনই, যেমন কুরআন কারীম আল্লাহর কালাম হওয়া এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত হওয়াকে অস্বীকার করা। অথবা মু‏হাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল হওয়াকে অস্বীকার করা।

এ বিষয়টি জানার পর ইসলামের উল্লিখিত মৌলিক আকীদাগুলোর কোনোটির অস্বীকারকারী বা অপব্যাখ্যাকারী যে কাফের ও অমুসলিম এ বিষয়ে কারো কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। আর না এর জন্য অতিরিক্ত কোনো দলীল পেশ করার প্রয়োজন আছে।  তথাপি বিষয়টি আরো বিস্তারিতভাবে জানার জন্য নিম্নে কুরআন কারীম এবং হাদীস শরীফ থেকে কিছু দলীল পেশ করা হল।

কুরআন কারীম থেকে

কুরআন কারীমের বহু আয়াতে আকীদায়ে খতমে নবুওতের বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমের বহু আয়াতে বিভিন্ন আঙ্গিকে আকীদায়ে খতমে নবুওতের বিষয়টি তাঁর বান্দাদের শিক্ষা দিয়েছেন। তন্মধ্যে নিম্নে শুধু একটি আয়াত উল্লেখ করা হল।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন

مَا كَانَ مُحَمَّدٌ اَبَاۤ اَحَدٍ مِّنْ رِّجَالِكُمْ وَ لٰكِنْ رَّسُوْلَ اللهِ وَ خَاتَمَ النَّبِیّٖنَ وَ كَانَ اللهُ بِكُلِّ شَیْءٍ عَلِیْمًا.

মুহাম্মাদ তোমাদের কোনো পুরুষের পিতা নন, বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং খাতামুন্নাবিয়্যীন (অর্থাৎ নবীদের মধ্যে সর্বশেষ।) আল্লাহ তাআলা সর্ব বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞাত। সূরা আহযাব (৩৩) : ৪০

খাতামুন্নাবিয়্যীন শব্দের অর্থ স্পষ্ট। আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর রিসালাত ও নবুওতের ধারার সমাপ্তি ঘোষণা করেছেন এবং তাঁকে ‘শেষ নবী’ আখ্যা দিয়েছেন। তাই তিনি সর্বশেষ নবী। তাঁর প্রতি অবতীর্ণ হেদায়েতের কিতাব কুরআন কারীম আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত সর্বশেষ আসমানী কিতাব। তাঁকে প্রদত্ত শরীয়ত আল্লাহর দেওয়া সর্বশেষ আসমানী শরীয়ত। তাঁর উম্মত সর্বশেষ উম্মত। বিষয়টি আয়াতের অর্থ থেকেই স্পষ্ট। এর পরও স্বয়ং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসংখ্য হাদীসে তা বারবার বলেছেন।

‘খাতামুন্নাবিয়্যীন’-এর এই অর্থ ও মর্ম সাহাবায়ে কেরাম কুরআন কারীম ও নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে হাসিল করেছেন। তাদের কাছ থেকে হাসিল করেছেন তাবেয়ীগণ। এভাবে নবীযুগ থেকে অদ্যাবধি ধারাবাহিকতার সাথে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর মাঝে এ অর্থটি স্বীকৃত ও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে।

বিষয়টি যেহেতু একেবারেই স্বতঃসিদ্ধ, তাই এর জন্য তাফসীরের কোনো কিতাবের হাওয়ালা পেশ করার প্রয়োজন ছিল না। তথাপি তাফসীরের একটি প্রাচীন কিতাবের উদ্ধৃতি পেশ করছি। উদ্ধৃতিটি ইমাম ইবনে জারীর তবারী রাহ.-এর। তাঁর ব্যাপারে খোদ মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীও স্বীকার করেন তিনি ‘ইমামুল মুফাসসিরীন’ তথা মুফাসসিরগণের ইমাম । ইমাম আবু জাফর তাবারী রাহ.  (মৃত্যু : ৩১০ হি.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন

ولكنه رسول الله وخاتم النبيين، الذي ختم النبوة فطبع عليها، فلا تفتح لأحد بعده إلى قيام الساعة...

তিনি আল্লাহর রাসূল ও শেষ নবী, যিনি নবুওতের ধারাবাহিকতার সমাপ্তি ঘটিয়েছেন এবং তাতে মোহর লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং তাঁর পর নবুওতের ধারা কিয়ামত পর্যন্ত কারো জন্য খোলা হবে না...। তাফসীরে তাবারী, খ. ২০, পৃ. ২৭৮

খতমে নবুওতের আকীদাটি কুরআন কারীমের বহু আয়াতে বিভিন্ন আঙ্গিকে আলোচিত হয়েছে। এখানে সংক্ষিপ্ততার জন্য একটি মাত্র আয়াত উল্লেখ করা হল। বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন উপমহাদেশের প্রখ্যাত মুফতী ও মুফাসসির হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ শফী রাহ. রচিত পুস্তিকা ‘খতমে নবুওত’।

হাদীস শরীফ থেকে

ইসলামের এই মৌলিক আকীদাটি যেমন কুরআন মাজীদের বহু আয়াতে আলোচিত হয়েছে, তেমনিভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসংখ্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। নিম্নে আকীদায়ে খতমে নবুওত বিষয়ক কিছু হাদীস উল্লেখ করা হল

হাদীস নং-১

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: إِنَّ مَثَلِي وَمَثَلَ الأَنْبِيَاءِ مِنْ قَبْلِي، كَمَثَلِ رَجُلٍ بَنَى بَيْتًا فَأَحْسَنَه وَأَجْمَلَه، إِلَّا مَوْضِعَ لَبِنَةٍ مِنْ زَاوِيَةٍ، فَجَعَلَ النَّاسُ يَطُوفُونَ بِه، وَيَعْجَبُونَ لَه، وَيَقُولُونَ هَلَّا وُضِعَتْ هذِهِ اللَّبِنَةُ؟ قَالَ: فَأَنَا اللَّبِنَةُ وَأَنَا خَاتِمُ النَّبِيِّينَ.

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন আমার এবং পূর্ববর্তী নবীদের উদাহরণ হল ওই ব্যক্তির মতো, যে অত্যন্ত চমৎকার ও দৃষ্টিনন্দন একটি প্রাসাদ নির্মাণ করল। তবে প্রাসাদের এক কোণায় একটি ইট পরিমাণ জায়গা খালি রেখে দিল। মানুষ প্রাসাদটি দেখতে আসা শুরু করল এবং মুগ্ধ হতে লাগল। আর বলতে লাগল, এখানের ইটটি রাখা হয়নি কেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমিই সেই ইট এবং আমিই শেষ নবী। সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৫৩৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২২৮৬

হাদীস নং-২

সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী রা.-কে সম্বোধন করে বলেছে

أَنْتَ مِنِّي بِمَنْزِلَةِ هَارُونَ مِنْ مُوسى، إِلَّا أَنَّه لَا نَبِيَّ بَعْدِي.

তোমার এবং আমার সম্পর্ক মূসা ও হারূনের সম্পর্কের মতো। তবে হাঁ, আমার পরে কোনো নবী নেই। সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৪০৪; সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৪১৬; জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৭৩১

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ ইরশাদের প্রেক্ষাপট হল, তিনি জিহাদের এক সফরে আলী রা.-কে সঙ্গে না নিয়ে মদীনায় অবস্থানরত নারী ও শিশুদের তত্ত্বাবধানের জন্য রেখে যাচ্ছিলেন। এতে তিনি মনঃক্ষুণ্ন হলেন। তাই নবীজী তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, মূসা আলাইহিস সালাম যেমনিভাবে তূর পাহাড়ে যাওয়ার সময় হারূন আলাইহিস সালামকে প্রতিনিধিরূপে রেখে গিয়েছিলেন, আমি তোমাকে ওইভাবেই রেখে যাচ্ছি। এতে কি তুমি সন্তুষ্ট নও?

তবে যেহেতু হারূন আলাইহিস সালাম নবী ছিলেন, তাই এতে দূরবর্তী কোনো আশঙ্কা হয় কি না সেজন্য বিষয়টি স্পষ্ট করে বলে দিলেন ‘তবে আমার পরে কোনো নবী নেই।’

এই হাদীস সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা. ছাড়াও আরো অনেক সাহাবী বর্ণনা করেছেন। এজন্য হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ রাহ. এই হাদীসকে মুতাওয়াতির বলেছেন। (দেখুন, ইযালাতুল খাফা আন খিলাফাতিল খুলাফা, খ. ৪, পৃ. ৩৬৯)

হাদীস নং-৩

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: فُضِّلْتُ عَلَى الْأَنْبِيَاءِ بِسِتٍّ: أُعْطِيتُ جَوَامِعَ الْكَلِمِ، وَنُصِرْتُ بِالرُّعْبِ، وَأُحِلَّتْ لِيَ الْغَنَائِمُ، وَجُعِلَتْ لِيَ الْأَرْضُ طَهُورًا وَمَسْجِدًا، وَأُرْسِلْتُ إِلَى الْخَلْقِ كَافَّةً، وَخُتِمَ بِيَ النَّبِيُّونَ.

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমাকে অন্যান্য নবীগণের ওপর ছয়টি বিশেষ বৈশিষ্ট্য দান করা হয়েছে।

এক. আমাকে অল্প শব্দে বিপুল তাৎপর্য বোঝানোর যোগ্যতা প্রদান করা হয়েছে।

দুই. শত্রুপক্ষের মনে ভীতি সৃষ্টি করে আমাকে সাহায্য করা হয়েছে।

তিন. আমার জন্য গণীমতের সম্পদ হালাল করে দেওয়া হয়েছে।

চার. সমস্ত ভূখণ্ড আমার জন্য মসজিদ এবং তার মাটিকে পবিত্রকারী বানানো হয়েছে।

পাঁচ. আমাকে সমগ্র সৃষ্টি জগতের জন্য পাঠানো হয়েছে।

ছয়. আমার মাধ্যমে নবুওতের ধারা সমাপ্ত করে দেওয়া হয়েছে। সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫২৩; জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫৫৩

নবুওতের মিথ্যা দাবিদারদের বিষয়ে নবীজীর সতর্কবাণী

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিকে অসংখ্য হাদীসে একথার ঘোষণা দিয়েছেন যে, তাঁর পরে কেউ নবী হবে না। অন্যদিকে এ বিষয়েও উম্মতকে অত্যন্ত কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন যে, ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য একদল মিথ্যাবাদী ও ধোঁকাবাজ জন্ম নেবে, যারা মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করবে এবং মিথ্যা দাবি করে বলবে, তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত নবী নাঊযুবিল্লাহ।

তাই নবীজী উম্মতকে ওইসকল ধোঁকাবাজ ও নবুওতের মিথ্যা দাবিদারদের থেকে বাঁচানোর জন্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট  ভাষায় সতর্ক করে গিয়েছেন।

ছাওবান রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন

لاَ تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى تَلْحَقَ قَبَائِلُ مِنْ أُمَّتِي بِالمُشْرِكِينَ، وَحَتَّى يَعْبُدُوا الأَوْثَانَ، وَإِنَّهُ سَيَكُونُ فِي أُمَّتِي ثَلاَثُونَ كَذَّابُونَ كُلُّهُمْ يَزْعُمُ أَنَّهُ نَبِيٌّ وَأَنَا خَاتَمُ النَّبِيِّينَ لاَ نَبِيَّ بَعْدِي.

ততক্ষণ কিয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না আমার উম্মতের কিছু মানুষ মুশরিকদের সাথে এমনভাবে মিশে যাবে যে, তারা মূর্তিপূজাতেও লিপ্ত হবে। অচিরেই আমার উম্মতের মাঝে ত্রিশজন ‘কাযযাব’ তথা চরম মিথ্যাবাদীর আবির্ভাব হবে, তারা প্রত্যেকেই দাবি করবে সে নবী; অথচ আমিই শেষ নবী, আমার পরে কোনো নবী নেই। জামে তিরমিযী, হাদীস ২২১৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪২৫২

খতমে নবুওতের আকীদা যেমনিভাবে কুরআন-হাদীসের অকাট্য ও সন্দেহাতীত দলীল দ্বারা প্রমাণিত, তেমনিভাবে সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর যামানা থেকে আজ পর্যন্ত উম্মতের সকল সদস্য এব্যাপারে একমত যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর নতুন নবুওতের দাবি উত্থাপনকারী এবং সেই দাবি কবুল করে তার ওপর ঈমান আনয়নকারী কেউই মুসলমান নয়। যদি কেউ মুসলমান হওয়ার পর খতমে নবুওতের আকীদা অস্বীকার করে, তাহলে সে ইসলাম থেকে খারেজ হয়ে যাবে এবং মুরতাদ ও ধর্মদ্রোহী সাব্যস্ত হবে। তার সাথে ধর্মত্যাগী-মুরতাদের আচরণই করা হবে। ইসলামের সুদীর্ঘ ইতিহাস তার সাক্ষী।

ইমাম ইবনে হাযম আন্দালুসী রাহ. (মৃত্যু : ৪৫৬ হি.) বলেন

وقد صح عن رسول الله صلى الله عليه وسلم بنقل الكواف التي نقلت نبوته وأعلامه وكتابه، أنه أخبر أنه لا نبي بعده،
إلا ما جاءت الأخبار الصحاح من نزول عيسى عليه السلام، الذي بعث إلى بني إسرائيل...

যে বিপুল পরিমাণ বর্ণনাকারীর সূত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওত, তাঁর মুজেযা এবং তাঁর আনীত কিতাব (কুরআন কারীম) বর্ণিত হয়েছে, এমন বিপুল পরিমাণ বর্ণনাকারীর সূত্রেই একথা বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তাঁর পরে কোনো নবী নেই।

এটা ভিন্ন বিষয় যে, বহু সহীহ হাদীসে একথা এসেছে যে, কিয়ামতের পূর্বে নবী ঈসা আ. আবার পৃথিবীতে আসবেন; যিনি (আমাদের নবীর পূর্বে) বনী ইসরাঈলের নবী ছিলেন...। আলফিছাল ফিল মিলালি ওয়াল আহওয়াই ওয়ান নিহাল, খ. ১, পৃ. ৬৭-৬৮

যারা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরে নবুওতের মিথ্যা দাবি করবে অথবা কাউকে নবীর মর্যাদা দেবে কিংবা রাসূলের পরে নিজের ওপর ওহী অবতীর্ণ হওয়ার দাবি করবে এজাতীয় কয়েক শ্রেণির কথা উল্লেখ করে কাজী ইয়ায রাহ. (মৃত্যু : ৫৪৪ হি.) বলেন

فهؤلاء كلهم كفار، مكذبون للنبي صلى الله عليه وسلم، لأنه أخبر صلى الله عليه وسلم أنه خاتم النبيين لا نبي بعده، وأخبر عن الله تعالى أنه خاتم النبيين وأنه أرسل كافة للناس، وأجمعت الأمة على حمل هذا الكلام على ظاهره، وأن مفهومه المراد به دون تأويل ولا تخصيص، فلا شك في كفر هؤلاء الطوائف كلها قطعا، إجماعا وسمعا.

সুতরাং তারা সকলেই কাফের এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মিথ্যা প্রতিপন্নকারী। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তিনি সর্বশেষ নবী, তাঁর পরে কোনো নবী নেই। তিনি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকেও এই সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি শেষ নবী এবং তাঁকে সমগ্র মানবজাতির জন্য পাঠানো হয়েছে।

এ বিষয়ে গোটা উম্মতের ইজমা ও ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাতামুন্নাবিয়্যীন তথা শেষ নবী এ কথাটি সম্পূর্ণ স্বীয় বাহ্যিক অর্থের ওপর প্রতিষ্ঠিত। স্বাভাবিকভাবে বাক্যের যে অর্থ বোঝা যায় এটাই তার উদ্দীষ্ট অর্থ। এখানে ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যা দাঁড় করানো কিংবা ওই বাক্যের ব্যাপকতাকে সংকুচিত করার কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং উপরোক্ত দলগুলোর কাফের হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এটা কুরআন-সুন্নাহর সুস্পষ্ট বক্তব্য ও উম্মতের ঐকমত্য দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত। আশশিফা বিতা‘রীফি হুকূকিল মুস্তফা, পৃ. ৩০৭

মোল্লা আলী কারী রাহ. (মৃত্যু : ১০১৪ হি.) বলেন

دعوى النبوة بعد نبينا صلى الله عليه وسلم كفر بالإجماع.

আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর নবুওত দাবি করা সর্বসম্মতভাবে কুফরী। শরহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ৪৫১

আল্লামা ইবনে নুজাইম রাহ. (মৃত্যু : ৯৭১ হি.) আলআশবাহ ওয়ান নাযায়ের কিতাবে লেখেন

إذا لم يعرف أن محمدا صلى الله عليه وسلم آخر الأنبياء، فليس بمسلم؛ لأنه من الضروريات.

যদি কোনো ব্যক্তি মু‏হাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বশেষ নবী না মানে, তাহলে সে মুসলমান নয়, কেননা তা দ্বীনের স্বতঃসিদ্ধ ও সর্বজনবিদিত বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। আলআশবাহ ওয়ান নাযায়ের , পৃ. ১৬১

এই আকীদাটি ফাতাওয়া আলমগীরীতে এভাবে এসেছে

إذا لم يعرف الرجل أن محمدا صلى الله عليه وسلم آخر الأنبياء عليهم وعلى نبينا السلام، فليس بمسلم.

যদি কোনো ব্যক্তি মু‏হাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বশেষ নবী না মানে, তাহলে সে মুসলমান নয়। ফাতাওয়া আলমগীরী, খ. ২, পৃ. ২৬৩

ফিকহে হানাফীর প্রসিদ্ধ কিতাব ফাতাওয়া বাযযাযিয়ায় আছে

وأما الإيمان بسيدنا عليه الصلاة والسلام فيجب بأنه رسولنا في الحال وخاتم الأنبياء والرسل، فإذا آمن بأنه رسول ولم يؤمن بأنه خاتم الرسل، لا ينسخ دينه إلى يوم القيامة، لا يكون مؤمنا.

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ঈমান আনার ক্ষেত্রে এ বিশ্বাস রাখা আবশ্যক তিনি বর্তমানেও আমাদের রাসূল এবং তিনিই সর্বশেষ নবী ও রাসূল। সুতরাং কেউ যদি শুধু তাঁর রাসূল হওয়ার প্রতি ঈমান রাখে, কিন্তু তিনি সর্বশেষ রাসূল এবং তাঁর আনীত দ্বীন ও শরীয়ত কিয়ামত পর্যন্ত বলবৎ থাকবে এ বিশ্বাস না রাখে, তাহলে সে মুমিন বলে গণ্য হবে না। ফাতাওয়া বাযযাযিয়া, খ. ৬ পৃ. ৩২৭

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এ বিষয়টি দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, কুরআন-হাদীসের অকাট্য দলীল ও ইজমায়ে উম্মত তথা গোটা উম্মতের ঐকমত্য দ্বারা প্রামাণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ নবী। তাঁর পরে নতুন কোনো নবী আসবে না। অতএব তাঁর পরের কেউ যদি নিজেকে নবী দাবি করে, সে নিশ্চিতভাবে মিথ্যুক ও প্রতারক। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বাণী ও ঘোষণা অস্বীকার করার কারণে সে নিশ্চিতভাবে কাফের। আর তাকে যারা বিশ্বাস করবে বা অনুসরণ করবে, তারাও কাফের ও অমুসলিম।

যুগে যুগে নবুওতের মিথ্যা দাবিদারদের আত্মপ্রকাশ

ইসলামের সাড়ে চৌদ্দ শ বছরের ইতিহাসে অনেক ভণ্ড ও প্রতারক নিজেদেরকে নবী দাবি করেছে। খোদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যামানায় আসওয়াদ আনাসী ও মুসায়লামা নামে দুই ব্যক্তি নিজেদেরকে নবী দাবি করে লাঞ্ছিত ও অভিশপ্ত হয়েছে। এরপর বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন এলাকায় নবুওতের মিথ্যা দাবি নিয়ে কেউ কেউ আত্মপ্রকাশ করেছে। কিন্তু প্রত্যেক যুগের উলামায়ে কেরাম, সাধারণ পাক্কা ঈমানদারগণ ও শাসকবৃন্দ সকলেই নিজেদের অবস্থান থেকে যিম্মাদারি আদায় করেছেন এবং এসকল ভণ্ডদের প্রতারণা ও জঘন্যতম কুফরী থেকে উম্মতকে রক্ষা করেছেন।  সকল মুসলিমগণ সহীহ ইলমের ব্যাপক চর্চা করেছেন। তারা এ ধরনের প্রতারকদের দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন।

উলামায়ে কেরাম তাদের সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করেছেন এবং ইসলামের সহীহ তালীম মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন। দাওয়াত, তালীম, তাসনীফ (রচনা) এবং ওয়ায-নসীহতের মাধ্যমে ঈমান ও আকীদার বিষয়গুলোকে সমাজে তরতাজা রেখেছেন। আর এ ধরনের প্রতারকদের সমস্ত প্রতারণা দলীলের আলোকে ধরিয়ে দিয়েছেন এবং নিজ নিজ যুগের শাসকদেরকে তাদের কুফরীর ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করেছেন।

শাসকগণ তাদের বিষয়ে ইসলামী শরীয়তের বিধান বাস্তবায়ন করেছেন। শরীয়তের দণ্ডবিধি হিসেবে কারো ওপর মুরতাদের শাস্তি প্রয়োগ করেছেন। আর যারা তাদের দুর্ভাগা অনুসারীদের নিয়ে মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের পর তাঁর প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর রা.-এর প্রথম জিহাদই ছিল নবুওতের মিথ্যা দাবিদার ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে।

কাদিয়ানী সম্প্রদায় কর্তৃক খতমে নবুওতের আকীদা অস্বীকার এবং মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর নবুওত দাবি

কুরআন-হাদীসের অকাট্য দলীল ও গোটা মুসলিম উম্মাহর ইজমা দ্বারা প্রমাণিত, ইসলামের এই মৌলিক আকীদার সম্পূর্ণ বিপরীতে কাদিয়ানীদের আকীদা হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে নবুওত ও রিসালাতের ধারাবাহিকতা শেষ হয়ে যায়নি; বরং তাঁর ওফাতের পরেও নতুন নবী আসার ধারা অব্যাহত আছে! (নাউযু বিল্লাহ)

মির্যা কাদিয়ানী তার বইপত্রের বিভিন্ন স্থানে খতমে নবুওতের আকীদাকে অস্বীকার করে সরাসরি নবুওত দাবি করেছেন। মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী আকীদায়ে খতমে নবুওতকে ব্যঙ্গ করে বলেছেন

আমাদের ধর্মবিশ্বাস তো এটাই যে, যেই ধর্মে নবুওতের সিলসিলা জারি নাই, তা মুর্দা ও মৃত। ইহুদী, খ্রিস্টান ও হিন্দু ধর্মকে তো আমরা এজন্যই মৃত বলি, সেসব ধর্মে এখন আর কেউ নবী হয় না। যদি ইসলামের অবস্থাও একই হয়, তাহলে আমরা তো কিচ্ছা-কাহিনির অনুসারীই থেকে যাব। কেন এই ধর্মকে অন্য ধর্মের ওপর শ্রেষ্ঠ বলা হয়? একটা বৈশিষ্ট্য তো থাকা উচিত। মালফূযাত (মির্যা কাদিয়ানীর বাণী সংকলন), খ. ৫, পৃ. ৪৪৭ (নতুন সংস্করণ)

মির্যা কাদিয়ানীর বড় ছেলে বশীরুদ্দীন মাহমুদ (কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় খলীফা) তার ‘আনওয়ারে খেলাফত’ নামক পুস্তকে বলেছেন

اگر میری گردن کے دونوں طرف تلوار بھی رکھ دی جائے اور مجھے کہا جائے کہ تم یہ کہو کہ آنحضرتﷺ کے بعد کوئی نبی نہیں آئے گا تو میں اسے ضرور کہوں گا تو جھوٹا ہے،کذاب ہے،آپ کے بعد نبی آسکتے ہیں اور ضرور آسکتے ہیں۔

যদি আমার গলার দুই পাশে তলোয়ার রেখেও আমাকে বলা হয়, তুমি বল, হযরত (মুহাম্মাদ) সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরে কোনো নবী আসবে না, তাহলে আমি তাকে অবশ্যই বলব, তুমি মিথ্যাবাদী। তাঁর পরে নবী আসতে পারে এবং অবশ্যই আসতে পারে। আনওয়ারে খেলাফত, আনওয়ারুল উলূম (মির্যা বশীরুদ্দীন মাহমুদের রচনাসমগ্র), খ. ৩, পৃ. ১২৭

মির্যা কাদিয়ানী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের তেরো শ বছর পরে এসে বিংশ শতাব্দীর মানুষকে লক্ষ করে বলেছেন

میں کوئی نیا نبی نہیں مجھ سے پہلے سیکڑوں نبی آچکے ہیں۔

আমি কোনো নতুন নবী নই; আমার আগে শত শত নবী আগমন করেছেন। কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের পত্রিকা আলহাকাম, ১০ এপ্রিল ১৯০৮ ঈ., পৃ. ২, কলাম ২

মির্যা কাদিয়ানী এভাবে আকীদায়ে খতমে নবুওতকে অস্বীকার করে চরম ধৃষ্টতার সাথে তার বইপত্রের বিভিন্ন স্থানে নবুওতের মিথ্যা দাবি করেছেন। নিম্নে মির্যা কাদিয়ানীর নবুওত দাবির আরো কিছু উদ্ধৃতি উল্লেখ করা হল

মির্যা কাদিয়ানী তার ‘এক গালতি কা ইযালা’  বা ‘একটি ভুল সংশোধন’ নামক পুস্তকে লিখেছেন

‘সুতরাং আমি যখন আজ পর্যন্ত খোদার নিকট হতে প্রায় দেড় শত ভবিষ্যদ্বাণী লাভ করে স্বচক্ষে পূর্ণ হতে দেখেছি। তখন আমার নবী ও রসূল হওয়া আমি কীরূপে অস্বীকার করতে পারি? যখন স্বয়ং খোদাতাআলা আমাকে নবী ও রসূল আখ্যা দিয়েছেন, তখন আমি কীরূপে এটা প্রত্যাখ্যান করতে পারি এবং তাঁকে ছেড়ে অন্যকে ভয় করি?’ এক গালতি কা ইযালা, একটি ভুল সংশোধন (বাংলা), পৃ. ৮ (বাংলাদেশে কাদিয়ানীদের মূলকেন্দ্র বকশী বজার, ঢাকা থেকে অনূদিত)

মির্যা কাদিয়ানী তার ‘আরবা’ঈন’ নামক পুস্তকে লিখেছেন

‘খোদা হচ্ছেন সেই খোদা, যিনি নিজের রাসূলকে; অর্থাৎ, এ অধমকে হেদায়েত, সত্য ধর্ম... আর উত্তম চরিত্রসহ পাঠিয়েছেন।’ আরবা’ঈন (বাংলা), পৃ. ৯২ (বাংলাদেশে কাদিয়ানীদের মূলকেন্দ্র বকশী বাজার, ঢাকা থেকে অনূদিত)

মির্যা কাদিয়ানী ‘তাতিম্মায়ে হাকীকাতুল ওহী’ পুস্তকে লেখেন

میں اس خدا کی قسم کھا کر کہتا ہوں  جس کے ہاتھ میں میری جان ہے کہ اسی نے مجھے بھیجا ہے اور اسی نے میرا نام نبی رکھا ہے۔

আমি ওই খোদার কসম করে বলছি, যার হাতে আমার জীবন, তিনিই আমাকে পাঠিয়েছেন এবং তিনিই আমার নাম নবী রেখেছেন। তাতিম্মায়ে হাকীকাতুল ওহী, রূহানী খাযায়েন (মির্যা কাদিয়ানীর রচনাসমগ্র), খ. ২২, পৃ. ৫০৩

‘দাফেউল বালা’ পুস্তকে মির্যা কাদিয়ানী লিখেছেন

‘প্রকৃত সত্য খোদা তিনিই, যিনি কাদিয়ানে তাঁর রসূল পাঠিয়েছেন।’ দাফেউল বালা (বাংলা), পৃ. ১২ (বাংলাদেশে কাদিয়ানীদের মূলকেন্দ্র বকশী বজার, ঢাকা থেকে অনূদিত)

এমন আরো অনেক বক্তব্য রয়েছে, যেখানে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় নবুওতের মিথ্যা দাবি করেছেন। মৃত্যুর তিন দিন পূর্বেও মির্যা কাদিয়ানী তার নবুওত দাবির বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন; যা প্রকাশিত হয় ঠিক মৃত্যুর দিন ২৬ মে ১৯০৮ ঈ. তারিখে ‘আখবারে আম’ পত্রিকায়। মির্যা কাদিয়ানী সেখানে লিখেছেন

‘আল্লাহর আদেশ মোতাবেক আমি একজন নবী। আমি এই দাবী অস্বীকার করলে আমার পাপ হবে। যেহেতু আল্লাহ আমাকে নবী নাম দিয়েছেন, আমি তা কীভাবে প্রত্যাখ্যান করতে পারি। আমি মরণ পর্যন্ত এই বিশ্বাস আঁকড়ে থাকব। নবুয়ত ও খিলাফত (বাংলা), পৃ. ৭৬ (বাংলাদেশে কাদিয়ানীদের মূলকেন্দ্র বকশী বজার, ঢাকা থেকে অনূদিত); মাজমূয়ায়ে ইশতেহারাত (মির্যা কাদিয়ানীর প্রচারপত্র), খ. ২, পৃ. ৭২৫ (নতুন সংস্করণ)

মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নিজের কথার ভিত্তিতেই কাফের

মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী মূলত ১৮৮০ সাল থেকে নিজের সম্পর্কে বিভিন্ন দাবিদাওয়া শুরু করেন। প্রথমে তিনি নিজেকে যামানার মুজাদ্দিদ বলে দাবি করেন। এরপর ১৮৯১ সালে আরেকটু অগ্রসর হয়ে নিজেকে মাহদী ও প্রতিশ্রুত মাসীহ দাবি করেন। অতঃপর ১৯০০/১৯০১ সালে সরাসরি নবুওত দাবি করে বসেন।

তবে মির্যা কাদিয়ানী নবুওত দাবির পূর্বে (অর্থাৎ ১৯০১ সালের পূর্বে) তার বইপত্রের বিভিন্ন স্থানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শেষনবী বলে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন এবং তাঁর পরে নবুওতের দাবিদারকে অভিশপ্ত, কাফের ও ইসলামের গণ্ডি বহির্ভূত আখ্যা দিয়েছেন।

মির্যা কাদিয়ানী তার ‘আসমানী ফায়সালা’ বইয়ে লেখেন

আমি নবুওতের দাবিদার নই, বরং এমন দাবিদারকে ইসলামের গণ্ডি বহির্ভূত মনে করি। আসমানী ফায়সালা, রূহানী খাযায়েন (মির্যা কাদিয়ানীর রচনাসমগ্র), খ. ৪, পৃ. ৩১৩

হামামাতুল বুশরা নামক পুস্তিকায় মির্যা কাদিয়ানী লেখেন

‘আর আমার দ্বারা নবুওয়তের দাবী করে ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত হওয়া এবং কাফের জাতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়া মোটেও সম্ভবপর নয়... সেক্ষেত্রে আমি মুসলমান হয়েও কীভাবে নবী হবার দাবী করতে পারি?’ হামামাতুল বুশরা (বাংলা), পৃ. ১৪২-১৪৩ (বাংলাদেশে কাদিয়ানীদের মূলকেন্দ্র বকশী বজার, ঢাকা থেকে অনূদিত)

মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী এসকল স্পষ্ট বক্তব্য প্রদান করার পরেও ১৯০১ সালে নিজেই সরাসরি নবুওত দাবি করে বসেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত এ দাবির ওপরই থাকেন।

আর এর মাধ্যমে তিনি যেমনিভাবে কুরআন-সুন্নাহ ও ইজমায়ে উম্মতের আলোকে কাফের সাব্যস্ত হন, তেমনি নিজের কথার ভিত্তিতেও কাফের ও ইসলামের গণ্ডি বহির্ভূত সাব্যস্ত হন।

কাদিয়ানী সম্প্রদায় কাফের হওয়ার তৃতীয় কারণ

মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী কর্তৃক নিজেকে স্বয়ং মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ দাবি করা

কাদিয়ানী সম্প্রদায় কাফের হওয়ার তৃতীয় মৌলিক কারণ হল, তারা মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে স্বয়ং মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ বিশ্বাস করে। কারণ মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী দাবি করেছেন, তিনি স্বয়ং মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ। তার মাঝে স্বয়ং মু‏হাম্মাদ রাসূলুল্লাহর সত্তা বিরাজমান। গোটা কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের আকীদা ও বিশ্বাস হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীতে দুইবার আবির্ভূত হয়েছেন। প্রথমবার মক্কায়, দ্বিতীয়বার কাদিয়ানে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর রূপে নাঊযুবিল্লাহ।

মির্যা কাদিয়ানীর মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ হওয়ার দাবি!

মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নিজেকে মু‏হাম্মাদ রাসূলুল্লাহ দাবি করে তার ‘এক গালতি কা ইযালা’ নামক পুস্তকে লিখেছেন

مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللهِ وَالَّذِينَ مَعَه ٗ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ.

‘এই ঐশী বাণীতে আমার নাম মুহাম্মদ রাখা হয়েছে এবং রসূলও।’ একটি ভুল সংশোধন (বাংলা), পৃ. ৪ (বাংলাদেশে কাদিয়ানীদের মূলকেন্দ্র বকশী বাজার, ঢাকা থেকে অনূদিত)

মূলত এটা কুরআন মাজীদের সূরা ‘ফাতহে’র শেষ আয়াত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। মির্যা কাদিয়ানীর দাবি এই আয়াত তার ওপর অবতীর্ণ হয়েছে এবং এই আয়াতে তাকে মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ বলা হয়েছে নাঊযুবিল্লাহ।

এভাবে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী তার বিভিন্ন পুস্তক-পুস্তিকায় নিজেকে মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ দাবি করেছেন। তার এসব বক্তব্য এমন, যার মধ্যে কোনো ব্যাখ্যার অবকাশ নেই। আমাদের জানামতে এমন জঘন্য কুফরী দাবি করার দুঃসাহস ইতিপূর্বে নবুওতের কোনো মিথ্যা দাবিদার করেনি।

কাদিয়ানীদের দাবি ‘মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহর দুই আবির্ভাব’!

পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের আকীদা মতে আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীতে দুইবার আগমন করেছেন। প্রথমবার মক্কায় মুহাম্মাদে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আকৃতিতে। দ্বিতীয়বার কাদিয়ানে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর আকৃতি নিয়ে। অর্থাৎ যেই মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ মক্কায় আগমন করেছিলেন, তিনিই নাকি আবার কাদিয়ানে আগমন করেছেন মির্যা কাদিয়ানীর রূপ নিয়ে নাঊযুবিল্লাহ।

মির্যা কাদিয়ানী তার ‘খুতবায়ে ইলহামিয়া’ নামক পুস্তকে লিখেছেন

واعلم أن نبينا صلى الله عليه وسلم كما بعث في الألف الخامس كذلك بعث في آخر الألف السادس باتخاذه بروز المسيح الموعود.

জেনে রেখো, আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমনিভাবে পঞ্চম সহস্রাব্দে আবির্ভূত হয়েছেন (অর্থাৎ খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে)। তেমনিভাবে মাসীহে মাওউদের (মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর) প্রতিচ্ছবি গ্রহণ করে ষষ্ঠ সহস্রাব্দের (অর্থাৎ হিজরী চতুর্দশ শতকের) শেষে আবির্ভূত হয়েছেন...। খুতবায়ে ইলহামিয়া, রূহানী খাযায়েন (মির্যা কাদিয়ানীর রচনাসমগ্র), খ. ১৬, পৃ. ২৭০

মির্যা কাদিয়ানী তার ‘তোহফায়ে গোলড়বিয়া’ নামক পুস্তকে লিখেছেন

لہذا جیسا کہ مومن کیلئے دوسرے احکام الہی پر ایمان لانا فرض ہے ایسا ہی اس بات پر بھی ایمان فرض ہے کہ آنحضرتﷺ کے دو بعث ہیں۔

সুতরাং যেমন মুমিনের জন্য আল্লাহর অন্যান্য বিধানাবলির ওপর ঈমান আনা ফরয, তেমনি একথার ওপরও ঈমান আনা ফরয যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুই আবির্ভাব। তোহফায়ে গোলড়বিয়া, রূহানী খাযায়েন (মির্যা কাদিয়ানীর রচনাসমগ্র), খ. ১৭, পৃ. ২৫৪

মির্যা কাদিয়ানীর মেজো ছেলে বশীর আহমদ এম এ লিখেছেন

پس مسیح موعود خود محمد رسول الله ہے،  جو اشاعت اسلام کے لئے دوبارہ دنیا میں تشریف لائے۔

সুতরাং মাসীহে মাওউদ (মির্যা কাদিয়ানী) স্বয়ং মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ। ইসলাম প্রচারের জন্য তিনি দ্বিতীয়বার পৃথিবীতে আগমন করেছেন। কালিমাতুল ফছল, পৃ. ৬৮ (মির্যাপুত্র বশীর আহমদ এম এ-কৃত)

মির্যা কাদিয়ানী মূলত এই আকীদাকে হিন্দুদের থেকে ধার করেছে। হিন্দু ধর্মের একটি মারাত্মক কুফরী বিশ্বাস হল পুনর্জন্মবাদ। হিন্দুদের এই পুনর্জন্মবাদের বিশ্বাসকে অবলম্বন করেই মির্যা কাদিয়ানী ও তার অনুসারীরা দাবি করে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুই আবির্ভাব। তারা বলতে চায়, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রূহ ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে একবার আব্দুল্লাহ ও আমেনা দম্পতির পুত্ররূপে দুনিয়ায় আগমন করেছিলেন। ফের সেই রূহ ১৮৩৯/১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর রূপে দুনিয়ায় আবার ফিরে আসেন নাঊযুবিল্লাহ।

তাদের দাবি ‘মির্যা কাদিয়ানী হুবহু মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ!’

যেহেতু মির্যা কাদিয়ানীর দাবি, তার আকৃতিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বিতীয়বার দুনিয়াতে আগমন করেছেন, তাই এর ওপর ভিত্তি করে তিনি দাবি করেছেন, তার মাঝে ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাঝে সত্তাগত কোনো পার্থক্য নেই। বরং তার সত্তা হুবহু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরই সত্তা, পার্থক্য শুধু বাহ্যিক আকৃতির!!

মির্যা কাদিয়ানী তার ‘এক গালতি কা ইযালা’ নামক পুস্তকে লিখেছেন

‘এর ভিত্তিতে খোদা বারবার আমার নাম নবীউল্লাহ এবং রসূলুল্লাহ রেখেছেন; কিন্তু বুরুজীরূপে। এর মধ্যে আমার নিজস্ব সত্তা নেই, পরন্তু মুহাম্মদ (সঃ) বিরাজমান। এ কারণে আমার নাম মুহাম্মদ (সঃ) এবং আহমদ (সঃ) হয়েছে। সুতরাং নবুওয়ত এবং রেসালাত অপর কারও নিকট গেল না, মুহাম্মদ (সঃ)-এর বস্তু মুহাম্মদ (সঃ)-এর নিকট রইল।” একটি ভুল সংশোধন (বাংলা), পৃ. ১৫ (বাংলাদেশে কাদিয়ানীদের মূলকেন্দ্র বকশী বাজার, ঢাকা থেকে অনূদিত)

মির্যা কাদিয়ানী তার পুস্তক ‘খুতবায়ে ইলহামিয়া’য় লিখেছেন

اورخدا نے مجھ پر اس رسول کریم کا فیض نازل فرمایا اور اس کو کامل بنایا اوراس نبی کریم ﷺ  کے لطف اور جود کو میری طرف کھینچا۔یہاں تک کہ میرا  وجود اس کا وجود ہوگیا۔ پس وہ جو میری جماعت میں داخل ہو ا درحقیقت میرے سردار خیرالمرسلین کے صحابہ میں داخل ہوا ۔

আল্লাহ তাআলা আমার ওপর মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহর ফয়েজ অবতীর্ণ করেছেন এবং তাতে পূর্ণতা দান করেছেন। তাঁর দয়া ও বদান্যতা আমাকে দান করেছেন। একপর্যায়ে আমার সত্তা তাঁরই সত্তা হয়ে গেছে। সুতরাং যে আমার জামাতে প্রবেশ করবে, সে মূলত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত হবে। খুতবায়ে ইলহামিয়া, রূহানী খাযায়েন (মির্যা কাদিয়ানীর রচনাসমগ্র), খ. ১৬, পৃ. ২৫৮

কাদিয়ানী সম্প্রদায় কাফের হওয়ার চতুর্থ কারণ

বিশ্বনবী হযরত মু‏হাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবমাননা করা

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবমাননাকারী কাফের

কাদিয়ানী সম্প্রদায় কাফের হওয়ার বড় একটি কারণ হল, রাসূল অবমাননা করা। মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী অত্যন্ত জঘন্য পন্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শানে বেয়াদবী করেছেন। অথচ কোনো নবীর শানে সামান্যতম বেয়াদবী করলেই ঈমান থাকে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এমন অবমাননা করার পরেও ইসলামের দাবি করা শুধুই প্রতারণা ও ধোঁকা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদাহানি হয় এমন উক্তি করা যে ইসলাম থেকে খারিজ হওয়ার কারণ তা সর্বজনবিদিত।

ইমাম আবু ইউসুফ রাহ. (মৃত্যু : ১৮২ হি.) বলেন

وأيما مسلم سب رسول الله صلى الله عليه وسلم أو كذبه، أو عابه، أو تنقصه فقد كفر بالله، وبانت منه امرأته.

যে মুসলমানই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালি দেবে, অথবা তাঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে, অথবা তাঁর দোষ চর্চা করবে, অথবা তাঁর মর্যাদাহানি করবে, সে কাফের হয়ে যাবে এবং আল্লাহর অবিশ্বাসী সাব্যস্ত হবে। আর তার স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে। কিতাবুল খারাজ, পৃ. ১৯৯

সুতরাং মির্যা কাদিয়ানী ও তার অনুসারীরা বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবমাননা ও তাঁর শানে বেয়াদবিমূলক বক্তব্য প্রদান করার কারণে ইসলামের গণ্ডি থেকে বের হয়ে গেছে।

জানা কথা, আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। তিনি সকল নবী-রাসূলগণের সরদার। আল্লাহ তাআলা তাকে যে মর্যাদা ও বিশেষ বৈশিষ্ট্যসমূহ দান করেছেন, তাতে তাঁর সমতুল্য কেউ হতে পারে না। সুতরাং  কেউ যদি নিজেকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমতুল্য দাবি করে বা তাঁর কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে নিজের জন্য দাবি করে, তাহলে যে সে চরম বেয়াদবি করল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

নিম্নে কাদিয়ানী সম্প্রদায় কর্তৃক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবমাননার কিছু দিক উল্লেখ করা হল

তাদের দাবি ‘মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সকল কামালাত মির্যা কাদিয়ানীর মাঝে!’

মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর দাবি, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ তাআলা যত মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য দান করেছেন, তা মির্যা কাদিয়ানীর মাঝে বিদ্যমান রয়েছে নাঊযুবিল্লাহ।

মির্যা কাদিয়ানী তার ‘এক গালতি কা ইযালা’ নামক পুস্তকে লিখেছেন

‘আমি যখন বুরুজীভাবে আঁ হযরত (সঃ) এবং বুরুজী রঙে সমস্ত মুহাম্মদী কামালাত মুহাম্মদী নবুওয়তসহ আমার প্রতিবিম্বের দর্পণে প্রতিফলিত হয়েছে, তখন স্বতন্ত্র ব্যক্তি কোথা হতে আসলেন, যিনি পৃথকভাবে নবুওয়তের দাবি করলেন।’ একটি ভুল সংশোধন (বাংলা), পৃ. ১০ (বাংলাদেশে কাদিয়ানীদের মূলকেন্দ্র বকশী বাজার, ঢাকা থেকে অনূদিত)

অর্থাৎ যেহেতু মির্যা কাদিয়ানী প্রতিচ্ছায়ারূপে স্বয়ং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সকল মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য তাঁর নবুওতসহ মির্যা কাদিয়ানীর অর্জন হয়ে গেছে নাঊযুবিল্লাহ।

মির্যা কাদিয়ানী তার মালফূযাতে বলেছেন

کمالات متفرقہ جو تمام دیگر انبیاء میں پائے جاتے تھے وہ سب حضرت رسول کریمﷺ میں ان سے بڑھ کر موجود تھے اور اب وہ سارے کمالات حضرت رسول کریمﷺسے ظلی طور پر ہم کو عطاء کئے گئے۔اس لئے ہمارا نام آدم، ابراہیم، موسیٰ، نوح، داود، یوسف، سلیمان، یحییٰ، عیسیٰ وغیرہ ہےৃ  پہلے تمام انبیاء ظل تھے نبی کریم کی خاص صفات میں اور اب ہم ان تمام صفات میں نبی کریم کے ظل ہیں۔

আলাদা আলাদাভাবে সকল নবীর মাঝে যে গুণ-বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল, তার সমষ্টি আরো অধিকহারে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাঝে বিদ্যমান ছিল। এখন ঐসকল গুণ-বৈশিষ্ট্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিচ্ছায়ারূপে আমাকে দেওয়া হয়েছে। আর এ কারণেই আমার নাম আদম, ইবরাহীম, মূসা, নূহ, দাঊদ, ইউসুফ, সুলাইমান, ইয়াহইয়া, ঈসা ইত্যাদি... পূর্বের সকল নবী ছিলেন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশেষ বিশেষ গুণের প্রতিচ্ছবি; এখন আমি ঐ সকল গুণেই রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিচ্ছবি!! মালফূযাত (মির্যা কাদিয়ানীর বাণী সংকলন), খ. ২, পৃ. ২০১ (নতুন সংস্করণ)

এ কারণে কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের নিকট রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মির্যা কাদিয়ানীর মর্যাদা একেবারে বরাবর। বিষয়টি উল্লেখ করতে গিয়ে তারা তাদের মুখপত্র ‘দৈনিক আলফযল’-এ এভাবে লিখেছে

خداتعالیٰ کے نزدیک حضرت مسیح موعود کا وجود آنحضرتﷺ کا ہی وجود ہے۔  یعنی خدا کے دفتر میں حضرت مسیح موعود اور آنحضرت آپس میں کوئی دوئی یا مغائرت نہیں رکھتے۔  بلکہ ایک ہی شان ایک ہی مرتبہ اور ایک ہی منصب اور ایک ہی نام رکھتے ہیں۔ گویا لفظوں میں باوجود دو ہونے کے ایک ہی ہیں۔

আল্লাহ তাআলার নিকট হযরত মাসীহে মাওউদের (মির্যা কাদিয়ানীর) সত্তাটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরই সত্তা। অর্থাৎ আল্লাহর খাতায় হযরত মাসীহে মাওউদ (মির্যা কাদিয়ানী) ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের মাঝে কোনো বৈপরীত্য নেই; বরং উভয়ের একই অবস্থান, একই মর্তবা, একই মর্যাদা ও একই নাম। শাব্দিকভাবে দুইজন হলেও বাস্তবে এক! কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের মুখপত্র দৈনিক আলফযল, ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯১৫ ঈ., পৃ. ৭, কলাম ২ (প্রবন্ধকার মুহাম্মাদ সাঈদ সাদী কাদিয়ানী)


তাদের দাবি ‘মির্যা কাদিয়ানী বিশ্বনবী!’

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বড় একটি বৈশিষ্ট্য হল, আল্লাহ তাআলা তাঁকে বিশ্বনবী বানিয়েছেন। এটা এমন বৈশিষ্ট্য, যা আল্লাহ তাআলা তাকে ব্যতীত অন্য কোনো নবীকে দান করেননি। আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে বলেন

قُلْ یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اِنِّیْ رَسُوْلُ اللهِ اِلَیْكُمْ جَمِیْعَا.

বলে দিন, হে মানবমণ্ডলী! তোমাদের সবার প্রতি আমি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। সূরা আ‘রাফ (৭) : ১৫৮

পক্ষান্তরে মির্যা কাদিয়ানীর দাবি, আল্লাহ তাআলা তাকে বিশ্বনবী হিসেবে পাঠিয়েছেন। মির্যা কাদিয়ানী বলেন, আল্লাহ তাআলা তাকে ওহী মারফত বলেছেন

وقل يا أيها الناس إني رسول الله إليكم جميعا أي مرسل من الله.

(মির্যা) তুমি বলে দাও, হে মানবমণ্ডলী আমি তোমাদের সবার প্রতি আল্লাহর রসূল। অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত। তাযকিরাহ (মির্যা কাদিয়ানীর ওহী-ইলহাম সংকলন), পৃ. ২৯২

তাদের দাবি ‘মির্যা কাদিয়ানী খাতামুন্নাবিয়্যীন!’

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য আল্লাহ তাআলা তাঁকে ‘খাতামুন্নাবিয়্যীন’ অর্থাৎ শেষনবী বানিয়েছেন।

মির্যা কাদিয়ানীর দাবি, তিনি যেহেতু স্বয়ং মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (?) সুতরাং তিনি ‘খাতামুন্নাবিয়্যীন’ অর্থাৎ শেষনবী নাঊযুবিল্লাহ।

মির্যা কাদিয়ানী তার ‘এক গালতি কা ইযালা’ নামক পুস্তকে লিখেছেন

‘আমি বারবার বলেছি

وَّ اٰخَرِیْنَ مِنْهُمْ لَمَّا یَلْحَقُوْا بِهِمْ .

এই আয়াত অনুযায়ী আমিই বুরুজীভাবে সেই খাতামুল আম্বিয়া এবং খোদা আজ হতে বিশ বছর পূর্বে বারাহীনে আহমদীয়া (নামক পুস্তকে) আমার নাম মুহাম্মদ (সঃ) ও আহমদ (সঃ) রেখেছেন এবং আমাকে আঁ হযরত (সঃ)-এরই সত্তা নির্ধারিত করেছেন।’ একটি ভুল সংশোধন (বাংলা), পৃ. ১০ (বাংলাদেশে কাদিয়ানীদের মূলকেন্দ্র বকশী বাজার, ঢাকা থেকে অনূদিত)

মির্যা কাদিয়ানী তার ‘কিশতিয়ে নূহ’ পুস্তকে লিখেছেন

‘মুবারক (আশিসপ্রাপ্ত) তাহারা, যাহারা আমাকে চিনিতে পারিয়াছে। আমি খোদার সকল পথসমূহের মধ্যে সর্বশেষ পথ, এবং আমি তাঁহার যাবতীয় জ্যোতির মধ্যে সর্বশেষ জ্যোতি:। হতভাগ্য সেই ব্যক্তি, যে আমাকে পরিত্যাগ করে, কারণ আমি ব্যতীত সব অন্ধকার।’ কিশতিয়ে নূহ (বাংলা), পৃ. ৭৬ (বাংলাদেশে কাদিয়ানীদের মূলকেন্দ্র বকশী বাজার, ঢাকা থেকে অনূদিত)

এটাই কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের আকীদা ও বিশ্বাস। তারা তাদের এই আকীদার কথা তাদের মুখপত্র ‘দৈনিক আলফযল’-এ খুব স্পষ্টভাবেই লিখেছে

پس حضرت مسیح موعود  وہی نور ہیں جس کا سب نوروں کے آخر میں آنا مقدر ہوچکا تھا اور وہی نبی ہیں جس کا آنا سب سے آخر ہوا۔

সুতরাং মাসীহে মাওউদ (মির্যা কাদিয়ানী) সেই নূর, যা সব নূরের শেষে আসা নির্ধারিত ছিল এবং তিনি সেই নবী, যিনি সবার শেষে আগমন করেছেন। কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের মুখপত্র দৈনিক আলফযল, ২৮ অক্টোবর ১৯১৫ ঈ., পৃ. ৩, কলাম ২ (প্রবন্ধকার মুহাম্মাদ সাঈদ সাদী কাদিয়ানী)

তাদের দাবি ‘মির্যা কাদিয়ানী সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল!’

আল্লাহ তাআলা আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল বানিয়েছেন। সকল নবীর ওপর তাঁকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। নবীগণের ইমাম ও খতীব বানিয়েছেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন

إِذَا كَانَ يَوْمُ القِيَامَةِ كُنْتُ إِمَامَ النَّبِيِّينَ وَخَطِيبَهُمْ وَصَاحِبَ شَفَاعَتِهِمْ، غَيْرُ فَخْرٍ.

কিয়ামত দিবসে আমি সকল নবীর ইমাম হব। তাঁদের খতীব হব এবং শাফায়াতকারীও হব। (এটা আল্লাহর নিআমত) কোনো গর্ব নয়। জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৯৪১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২১২৪৫

মির্যা কাদিয়ানীর দাবি, আল্লাহ তাআলা তাকেও সকলের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।

মির্যা কাদিয়ানী বলেন, আল্লাহ তাআলা তাকে ওহী মারফত জানিয়েছেন

আসমান থেকে অনেক আসন অবতীর্ণ হয়েছে, কিন্তু তোমার আসন সবচেয়ে ওপরে স্থাপন করা হয়েছে। তাযকিরাহ (মির্যা কাদিয়ানীর ওহী-ইলহাম সংকলন), পৃ. ২৮২ (চতুর্থ সংস্করণ)

অন্যত্র মির্যা কাদিয়ানী বলেন, আল্লাহ তাআলা তাকে বলেছেন

إني فضلتك على العالمين.

(হে মির্যা) আমি তোমাকে সমগ্র বিশ্বের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। তাযকিরাহ (মির্যা কাদিয়ানীর ওহী-ইলহাম সংকলন), পৃ. ৯৯ (চতুর্থ সংস্করণ)

বরং আল্লাহ তাআলা নাকি মির্যা কাদিয়ানীকে ওহীর মাধ্যমে জানিয়েছেন, বিশ্বজগৎ কিছুই সৃষ্টি করা হত না, যদি মির্যা কাদিয়ানীকে সৃষ্টি করা না হত

لولاك لما خلقت الأفلاك.

(হে মির্যা) আমি তোমাকে সৃষ্টি না করলে বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করতাম না। তাযকিরাহ (মির্যা কাদিয়ানীর ওহী-ইলহাম সংকলন), পৃ. ৫৫৬ (চতুর্থ সংস্করণ)

বিষয়টি কাদিয়ানীদের মুখপত্র ‘দৈনিক আলফযল’-এর একটি কলামে এভাবে লেখা হয়েছে

اے مسلمان کہلانے والو! اگر تم واقعی اسلام کا بول بالا چاہتے ہو اور باقی دنیا کو اپنی طرف بلاتے ہو تو پہلے خود سچے اسلام کی طرف آجاؤ جو مسیح موعود میں ہوکر ملتا ہے۔اسی کے طفیل آج بروتقویٰ کی راہیں کھلتی ہیں۔اسی کی پیروی سے انسان فلاح ونجات کی منزل مقصود پر پہنچ سکتا ہے۔ وہ وہی فخر اوّلین وآخرین ہے جو آج سے تیرہ سو برس پہلے رحمۃ للعالمین بن کر آیا تھا۔

হে মুসলিম পরিচয়ধারীরা! তোমরা যদি সত্যিকার অর্থেই ইসলামের বিজয় চাও এবং পৃথিবীকে নিজেদের দিকে আহ্বান কর, তাহলে আগে নিজেরা সত্যিকার ইসলামের দিকে ফিরে আস। এই সত্য ইসলাম কেবল মাসীহে মাওউদের (মির্যা কাদিয়ানী) কাছেই পাওয়া যাবে। তার মাধ্যমেই আজ পুণ্য ও তাকওয়ার পথ উন্মুক্ত হয়েছে। তার অনুসরণেই মানুষ সফলতা ও নাজাতের লক্ষবস্তুতে পৌঁছতে সক্ষম হবে। তিনিই হলেন পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের গৌরবের পাত্র। যিনি আজ থেকে তেরো শ বছর পূর্বে রাহমাতুল্লিল আলামীনরূপে পৃথিবীতে এসেছিলেন। কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের মুখপত্র দৈনিক আলফযল, ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯১৫ ঈ., পৃ. ৩, কলাম ৩

কাদিয়ানীদের মুখপত্র দৈনিক আলফযলে যা বলা হয়েছে, এটাই কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের আকীদা। তারা মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকেও শ্রেষ্ঠ মনে করে। যহুরুদ্দীন আকমল নামক মির্যা কাদিয়ানীর এক খাস মুরীদ এ বিষয়টি কবিতা আকারে লিখে মির্যা কাদিয়ানীর সমীপে নিবেদন করেন। নিম্নে কবিতাটির দুটি চরণ দেওয়া হল

محمد پھر اتر آئے ہیں ہم میں * اور آگے سے ہیں بڑھ کر اپنی شان میں

محمد دیکھنے ہوں جس نے اکمل *  غلام احمد کو دیکھے قادیان میں

মুহাম্মাদ আমাদের মাঝে পুনরায় আগমন করেছেন/ স্বীয় মর্যাদায় পূর্বের (মুহাম্মাদের) চেয়ে আরো অগ্রগামী হয়ে।

পূর্ণতাপ্রাপ্ত মুহাম্মাদকে যদি কেউ দেখতে চাও/ তবে কাদিয়ানে এসে (মির্যা) গোলাম আহমদকে দেখে নাও। কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের মুখপত্র আখবারে বদর, ২৫ অক্টোবর ১৯০৬ ঈ., পৃ. ১২, কলাম ১

মির্যা কাদিয়ানীর মেজো ছেলে বশীর আহমদ এম এ বিষয়টি এভাবে উপস্থাপন করেছেন। বশীর আহমদ এম এ তার ‘কালিমাতুল ফছল’ নামক পুস্তকে লিখেছেন

اگر نبی کریم کا انکار کفر ہے تو مسیح موعود کا انکاربھی کفر ہونا چاہئے۔ کیونکہ مسیح موعود نبی کریم سے کوئی الگ چیز نہیں ہےبلکہ وہی ہے۔ اگر مسیح موعود کا منکر کافر نہیں تو نعوذ باالله نبی کریم کا منکر بھی کافر نہیں۔ کیونکہ یہ کس طرح ممکن ہے کہ پہلی بعثت میں آپ کا انکار کفر ہو۔ مگر دوسری بعثت میں جس میں بقول حضرت مسیح موعود آپ کی روحانیت اقوی اور اکمل اور اشد ہےآپ کا انکار کفر نہ ہو۔

যদি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমকে অস্বীকার করা কুফরী হয়ে থাকে, তাহলে মাসীহে মাওউদকে (মির্যা কাদিয়ানীকে) অস্বীকার করাও কুফরী হওয়া উচিত। কেননা মাসীহে মাওউদ (মির্যা কাদিয়ানী) নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ভিন্ন কোনো সত্তা নন, বরং স্বয়ং তিনিই। সুতরাং যদি মসীহে মাওউদের অস্বীকারকারী কাফের না হয়, তাহলে নাঊযুবিল্লাহ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অস্বীকারকারীও কাফের হবে না। কেননা এটা কীভাবে সম্ভব যে, প্রথম আবির্ভাবে তার অস্বীকার কুফর হবে, কিন্তু দ্বিতীয় আবির্ভাবে তার অস্বীকার কুফর হবে না! অথচ মাসীহে মাওউদের কথা অনুযায়ী দ্বিতীয় আবির্ভাবে তার আধ্যাত্মিক শক্তি আরো বেশি মজবুত, শক্তিশালী ও পূর্ণ। কালিমাতুল ফছল, পৃ. ৫৬-৫৭ (মির্যাপুত্র বশীর আহমদ এম এ-কৃত)

তাদের দাবি ‘মুহাম্মাদী নবুওত রহিত হয়ে গেছে’!

কাদিয়ানীদের বইপত্রগুলো লক্ষ করলে দেখা যায়, কাদিয়ানীদের নিকট হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওত ও রিসালাতের যামানা শেষ হয়ে গেছে এবং তা কার্যত রহিত হয়ে গেছে। কেননা কাদিয়ানীদের আকীদা অনুযায়ী এখন মির্যা কাদিয়ানীর আনুগত্যই একমাত্র নাজাতের উপায় এবং মির্যা কাদিয়ানী ছাড়া ইসলাম ধর্ম মৃত!

মির্যা কাদিয়ানীর তথাকথিত এলহাম

قل إن كنتم تحبون الله فاتبعوني يحببكم الله.

‘বল, যদি তোমরা খোদার প্রতি ভালবাসা রাখ, তবে আস, আমার অনুবর্তিতা কর, যাহাতে খোদাও তোমাদের প্রতি ভালবাসা রাখেন।’ হাকীকাতুল ওহী (বাংলা), পৃ. ৬৫ (বাংলাদেশে কাদিয়ানীদের মূলকেন্দ্র বকশী বাজার, ঢাকা থেকে অনূদিত); তাযকিরাহ (মির্যা কাদিয়ানীর ওহী-ইলহাম সংকলন), পৃ. ৫৪৫, ৫৪৭ (চতুর্থ সংস্করণ)

এটা মূলত কুরআন কারীমের সূরা আলে-ইমরানের ৩১ নম্বর আয়াত। যাতে আল্লাহ তাআলা শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুসরণ করতে বলেছেন। কিন্তু মির্যা কাদিয়ানী দাবি করেছেন, এটা তার নিকট আসা ইলহাম এবং এতে তাকে অনুসরণ করতে বলা হয়েছে নাঊযুবিল্লাহ।

মির্যা কাদিয়ানী তার ‘আরবা’ঈন’ নামক পুস্তকে লিখেছেন

‘আল্লাহ তা‘আলা বারাহীনে আহমদীয়াতে আমার নাম ইবরাহীম রেখেছেন। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন

سلام على إبراهيم، صافيناه ونجيناه من الغم، واتخذوا من مقام إبراهيم مصلّى

অর্থাৎ শান্তি বর্ষিত হোক ইবরাহীমের ওপর (অর্থাৎ এই অধমের ওপর), আমরা তার সাথে খাঁটি বন্ধুত্ব করেছি এবং তাকে সর্বপ্রকার দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত করেছি। আর তোমরা যারা অনুবর্তিতা কর, তোমরা ইবরাহীমের পদচিহ্নকে নামাজের স্থানরূপে গ্রহণ কর; অর্থাৎ নাজাতের জন্য তার পরিপূর্ণ আনুগত্য কর।’Ñ আরবা’ঈন (বাংলা), পৃ. ৮৫ (বাংলাদেশে কাদিয়ানীদের মূলকেন্দ্র বকশী বাজার, ঢাকা থেকে অনূদিত)

‘আর এটাও বলেছেন

واتخذوا من مقام إبراهيم مصلّى

এটি কুরআন শরীফের আয়াত, এ স্থলে এর অর্থ হচ্ছে, এই ইবরাহীম (অর্থাৎ মির্যা কাদিয়ানী) যাকে পাঠানো হয়েছে, তোমরা নিজের ইবাদত ও বিশ্বাসসমূহকে তার রীতি-নীতির অধীনস্ত কর। আর প্রত্যেক বিষয়ে তার আদর্শে নিজেদের গড়।’ আরবা’ঈন (বাংলা), পৃ. ৮৬ (বাংলাদেশে কাদিয়ানীদের মূলকেন্দ্র বকশী বাজার, ঢাকা থেকে অনূদিত)

‘এমনই এ আয়াত

واتخذوا من مقام إبراهيم مصلّى

এদিকে ইঙ্গিত করে যে, যখন উম্মতে মুহাম্মদীয়ার মাঝে অনেক দল সৃষ্টি হবে তখন শেষ যুগে এক ইবরাহীম জন্ম নেবে। আর ঐসকল দলসমূহের মাঝে কেবল সেই দলই নাজাত পাবে, যারা সেই ইবরাহীমের অনুসারী হবে।’ আরবা’ঈন (বাংলা), পৃ. ৮৬ (বাংলাদেশে কাদিয়ানীদের মূলকেন্দ্র বকশী বাজার, ঢাকা থেকে অনূদিত)

মির্যা কাদিয়ানী আরো বলেছেন

‘যেহেতু আমার শিক্ষার মাঝে আদেশ-নিষেধ উভয়টি আছে, আর শরীয়তের প্রয়োজনীয় আহকামের সংস্কার আছে, তাই খোদা তা‘আলা আমার ওপর অবতীর্ণ ওহীকে ‘ফুলক’ অর্থাৎ নৌকা নামে অবহিত করেছেন..., এখন লক্ষ কর! খোদা আমার ওহী, শিক্ষা এবং বাইয়াতকে নূহের নৌকা আখ্যা দিয়েছেন। আর সকল মানুষের জন্য এটিকে নাজাতের মাধ্যম বানিয়েছেন। যার চোখ আছে দেখুক, যার কান আছে শুনুক।’ আরবা’ঈন (বাংলা), পৃ. ১০২ (বাংলাদেশে কাদিয়ানীদের মূলকেন্দ্র বকশী বাজার, ঢাকা থেকে অনূদিত)

যেহেতু মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর ভাষ্যমতে তার নবুওত, শিক্ষা, ওহী ও তার সংস্কারকৃত শরীয়তই পুরা মানবজাতির নাজাতের একমাত্র মাধ্যম (?), তাই এ থেকে স্পষ্ট তাদের নিকট এখন কেবলমাত্র বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরীয়ত, শিক্ষা, ও তাঁর ওহী নাজাতের জন্য যথেষ্ট নয়; বরং মির্যা কাদিয়ানীর আগমনে এগুলো বাতিল ও রহিত হয়ে গেছে! এ কারণে কাদিয়ানীদের নিকট মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ছাড়া ইসলাম ধর্ম মৃত!

মির্যা কাদিয়ানীর বিশিষ্ট মুরীদ মুহাম্মাদ সাদেক মির্যা কাদিয়ানীর জীবনীগ্রন্থ ‘যিকরে হাবীব’-এ লিখেছেন

“সম্ভবত ১৯০৬ ঈ. সালে খাজা কামালুদ্দীন সাহেবের প্রচেষ্টায় ‘ওয়াতান’ পত্রিকার সম্পাদকের সাথে মৌলভী মুহাম্মাদ আলী সাহেব একটি সমঝোতা করেন যে, ‘রিভিউ অফ রিলিজিওন’-এ আহমদীয়া সিলসিলার বিষয়ে কোনো লেখা থাকবে না। কেবলমাত্র সাধারণ ইসলাম বিষয়ক লেখা থাকবে। আর ‘ওয়াতান’-এর সম্পাদক তার পত্রিকায় ‘রিভিউ অফ রিলিজিওন’-এর সাহায্য-সহযোগিতার জন্য প্রচারণা চালাবে। কিন্তু হযরত মাসীহে মাওউদ আ. (মির্যা কাদিয়ানী) এই প্রস্তাবনা অপছন্দ করেছেন। আর জামাতের মধ্যেও ব্যাপকভাবে এর বিরোধিতা করা হয়েছে। হযরত সাহেব বলেছেন, তোমরা কি আমাকে বাদ দিয়ে মুর্দা (মৃত) ইসলাম দুনিয়ার সামনে পেশ করবে?” যিকরে হাবীব, পৃ. ১৪৬-১৪৭ (মুহাম্মাদ সাদেক কাদিয়ানীকৃত মির্যা কাদিয়ানীর জীবনীগ্রন্থ)

পাঠক উপরোক্ত উদ্ধৃতিগুলো থেকে সহজেই উপলদ্ধি করতে পারবেন যে, বর্র্তমান যামানায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সবচেয়ে বড় অবমাননাকারী গোষ্ঠী হল কাদিয়ানী সম্প্রদায়। তারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং ইসলামী শরীয়তের সবচেয়ে বড় বিদ্রোহী। শেষনবী, শ্রেষ্ঠনবী, বিশ্বনবী, রহমাতুল্লিল আলামীন এসব হল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু তাদের নিকট এ সব বৈশিষ্ট্য নাকি মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর!! ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন।

তারা নিজেদের ধর্মের নাম ইসলাম দিয়ে কাদিয়ানী মতবাদকে ইসলামের নামে পেশ করছে। ইসলাম এবং আখেরী নবীর সকল বৈশিষ্ট্য নবুওতের মিথ্যা দাবিদারদের গুরুর জন্য সাব্যস্ত করছে। এখানে তাদের রাসূল অবমাননার সামান্য কিছু চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া এমন আরো অনেক উদ্ধৃতি রয়েছে। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শানে এমন অবমাননা করার পরেও ইসলামের দাবি করা, ইসলাম ও মুসলামানদের সাথে মশকরা করার শামিল। রাসূলের শানে এমন বেয়াদবি করার পরেও তাদের কাফের ও মুরতাদ হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে?

কাদিয়ানী সম্প্রদায় কাফের হওয়ার পঞ্চম কারণ

কালিমা তায়্যিবার অস্বীকার করা

‘কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের কালিমা’

কাদিয়ানী সম্প্রদায় কালিমা তায়্যিবা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মু‏হাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’-এর শব্দ-বাক্য ঠিক রেখে তার অর্থ ও মর্মের মাঝে চরম বিকৃতি ঘটিয়েছে এবং এর দ্বারা তারা কালিমা তায়্যিবাকেই অস্বীকার করছে। যেহেতু মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নিজেকে স্বয়ং মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ দাবি করেছে, তাই কাদিয়ানীদের কালিমার মাঝে ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ দ্বারা মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে।

মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর মেজো ছেলে বশীর আহমদ এম এ তার ‘কালিমাতুল ফছল’ নামক পুস্তকের ৬৭ নং পৃষ্ঠায় নিজেই এই প্রশ্ন তুলেছেন যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর যদি মির্যা সাহেব নবী হয়ে থাকেন, তাহলে আমরা কেন তার (নামের) কালিমা পড়ি না। আমাদের কালিমা অন্যদের মতো কেন?

পরবর্তী পৃষ্ঠায় নিজেই এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন দুইভাবে। প্রথম উত্তরের মূল কথা হল, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ”-এর অর্থের মাঝে মির্যা কাদিয়ানীও অন্তর্ভুক্ত। তাই ভিন্ন কালিমার প্রয়োজন নেই।

বশীর আহমদ এম এ লিখেছেন

“হাঁ, হযরত মাসীহে মাওউদের (মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী) আগমনের কারণে (কালিমার অর্থের মাঝে) অবশ্যই একটি পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। আর তা হল, মাসীহে মাওউদের আগমনের পূর্বে ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’-এর অর্থের মাঝে কেবলমাত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্বে আগমনকারী নবীগণ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। কিন্তু মাসীহে মাওউদের আগমনের পর ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’-এর অর্থের মাঝে আরেকজন নবী অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। সুতরাং মাসীহে মাওউদের আগমনের কারণে কালিমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ বাতিল হয়নি; বরং আরো বেশি শান নিয়ে চমকাচ্ছে। মোটকথা, এখনো ইসলামে প্রবেশ করার কালিমা এটাই। তবে পার্থক্য এতটুকুই, মাসীহে মাওউদের আগমনের কারণে ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’-এর অর্থের মাঝে আরেকজন নবী  অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।” কালিমতুল ফছল, পৃ. ৬৮ (মির্যাপুত্র বশীর আহমদ এম এ-কৃত)

অর্থাৎ মুসলমানদের কালিমার মাঝে ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ দ্বারা মুহাম্মাদে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদ্দেশ্য; কিন্তু কাদিয়ানীদের কালিমায় ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’-এর অর্থের মধ্যে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীও অন্তর্ভুক্ত নাঊযুবিল্লাহ।

মির্যা বশীরের দ্বিতীয় উত্তরের মূল কথা হল, মির্যা কাদিয়ানী যেহেতু স্বয়ং মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (?), যিনি দুনিয়াতে দ্বিতীয়বার আগমন করেছেন, তাই ভিন্ন কালিমার প্রয়োজন নেই। হাঁ, যদি তার স্থানে অন্য কেউ আসত, তাহলে ভিন্ন কালিমার প্রয়োজন হত।

বশীর আহমদ এম এ লিখেছেন

যদি তর্কের খাতিরে মেনে নেওয়া হয় যে, কালিমা শরীফে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম এজন্য উল্লেখিত হয়েছে যে, তিনি শেষ নবী; তবুও কোনো সমস্যা নেই এবং এর পরও আমাদের নতুন কোনো কালিমার প্রয়োজন নেই। কেননা মাসীহে মাওউদ (মির্যা কাদিয়ানী) নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ভিন্ন কিছু নয়। তিনি নিজেই বলেছেন

صار وجودي وجوده

‘আমার সত্তাটি হুবহু তাঁরই সত্তা।’

তিনি আরো বলেছেন

من فرق بيني وبين المصطفى فما عرفني وما رأى

‘যে আমার এবং মুস্তফা-এর মাঝে পার্থক্য করে, সে আমাকে দেখেওনি, আমাকে চেনেওনি।’ আর এটা এজন্যই যে, আল্লাহ তাআলার প্রতিশ্রুতি ছিল, তিনি আরেকবার খাতামুন্নাবিয়্যীনকে দুনিয়াতে প্রেরণ করবেন; যা وآخرين منهم আয়াত থেকে বোঝা যায়। সুতরাং মাসীহে মাওঊদ স্বয়ং মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ। ইসলাম প্রচারের জন্য তিনি দ্বিতীয়বার পৃথিবীতে আগমন করেছেন। অতএব আমাদের নতুন কোনো কালিমার প্রয়োজন নেই। তবে মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহর পরিবর্তে অন্য কারো আগমন ঘটলে নতুন কালিমার প্রয়োজন হত। কালিমাতুল ফছল, পৃ. ৬৮ (মির্যাপুত্র বশীর আহমদ এম এ-কৃত)

অর্থাৎ তাদের কালিমায় ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ দ্বারা মির্যা কাদিয়ানীই উদ্দেশ্য। কালিমা তায়্যিবার যে দুটি ব্যাখ্যা কাদিয়ানীরা দিয়েছে এবং তাতে তাদের যে আকীদা প্রকাশ পেয়েছে, তা ইসলাম ও মুসলমানদের সাথে স্পষ্ট গাদ্দারী ও কালিমা তায়্যিবার চরম অবমাননা। তারা মূলত ইসলামের কালিমা অস্বীকার করে মির্যা কাদিয়ানীর কালিমা পাঠ করে। তাদের لا إله إلا الله محمد رسول الله (লা ইলাহা ইল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ) বলা আর لا إله إلا الله ميرزا غلام أحمد رسول الله  [লা ইলাহা ইল্লাহু মির্যা গোলাম আহমদ রাসূলুল্লাহ (?)] বলা একই কথা। উভয়ের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। এই হল কাদিয়ানীদের ইসলাম, এই হল কাদিয়ানীদের ঈমানের কালিমা। কালিমার শব্দ তো ঈমানের শব্দ, কিন্তু ওরা একে বিকৃত করে এর আড়ালে পোষণ করে সম্পূর্ণ কুফরী বিশ্বাস!

কাদিয়ানী সম্প্রদায় কাফের হওয়ার ষষ্ঠ কারণ

মির্যা কাদিয়ানী কর্তৃক হযরত ঈসা আ. থেকে শ্রেষ্ঠ হওয়ার দাবি করা

কোনো নবী থেকে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করা কুফর

দ্বীনে ইসলামের অন্যতম মৌলিক আকীদা হল কোনো ব্যক্তি সে যত বড় আল্লাহর ওলী হোক না কেন, কোনো নবী থেকে শ্রেষ্ঠ বা তার বরাবর হতে পারবে না। কেউ এমন দাবি করলে সে মুরতাদ ও ইসলামের গণ্ডিবহির্ভূত।

ইমাম আবু হাইয়ান আন্দালূসী রাহ. (মৃত্যু : ৭৪৫ হি.) তার বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ ‘আলবাহরুল মুহীত’-এ বলেন

ومن ذهب إلى أن النبوة مكتسبة لا تنقطع، أو إلى أن الولي أفضل من النبي، فهو زنديق يجب قتله.

যে ব্যক্তি এই বিশ্বাস করে যে, নবুওত চেষ্টা করে অর্জন করা যায় এবং এর ধারা বন্ধ হয়নি কিংবা এই বিশ্বাস করে যে, নবী হতে ওলী উত্তম, তাহলে এমন ব্যক্তি যিন্দীক। তাকে কতল করা (মুসলিম শাসকের জন্য) ফরয। আলবাহরুল মুহীত, খ. ৮, পৃ. ৪৮৫

 ‘হযরত ঈসা আ. থেকে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি!’

হযরত ঈসা আ. আল্লাহ তাআলার অতি মর্যাদাসম্পন্ন শরীয়তের অধিকারী একজন নবী। আল্লাহ তাআলা তাঁকে বনী ইসরাঈলের নিকট পাঠিয়েছিলেন। ইহুদীরা হযরত ঈসা আ.-কে হত্যার চেষ্টা করেছিল; কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাঁকে আসমানে উঠিয়ে নেন। তিনি কিয়ামতের পূর্বে আসমান থেকে অবতরণ করবেন এবং দাজ্জালকে কতল করবেন।

মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী বিভিন্নভাবে হযরত ঈসা আ. থেকে শ্রেষ্ঠ হওয়ার দাবি করেছেন। তার এই দাবি তিন কারণে কুফর

এক. এর মাধ্যমে মির্যা কাদিয়ানীর নবুওত দাবি প্রমাণিত হয়। কেননা যে ব্যক্তি হযরত ঈসা আ. থেকে শ্রেষ্ঠ হবেন, তার ধারণামতে তিনি তো অবশ্যই নবী হবেন।

দুই. এর মাধ্যমে মির্যা কাদিয়ানীর এই দাবিও সামনে আসে, সে শরীয়তবাহী নবী। কেননা হযরত ঈসা আ. শরীয়তের অধিকারী নবী ছিলেন।

তিন. এতে হযরত ঈসা আ.-এর চরম অবমাননা হয়। আর কোনো নবীর অবমাননা করা স্পষ্ট কুফরী।

আল্লাহর নবী ঈসা আলাইহিস সালামের অবমাননার বিষয়ে মির্যা কাদিয়ানীর কিছু বক্তব্য তুলে ধরা হল

মির্যা কাদিয়ানী তার ‘দাফেউল বালা’ পুস্তকে লিখেছেন

‘তার বিপরীতে খোদা তাআলা এই উম্মতের মাঝে (প্রতিশ্রুত) মসীহ মাওউদকে পাঠিয়েছেন, যিনি পূর্বের মসীহের তুলনায় সকল প্রকার মর্যাদায় শ্রেয় এবং তিনি এই দ্বিতীয় মসীহের নাম গোলাম আহমদ রেখেছেন।’ দাফেউল বালা (বাংলা), পৃ. ১৫ (বাংলাদেশে কাদিয়ানীদের মূলকেন্দ্র বকশী বাজার, ঢাকা থেকে অনূদিত)

মির্যা কাদিয়ানী তার ‘হাকীকাতুল ওহী’ পুস্তকে লিখেছেন

‘খোদা এই উম্মতের মধ্য হইতে প্রতিশ্রুত মসীহ্কে প্রেরণ করিয়াছেন, যিনি ঐ প্রথম মসীহের চাইতে সকল স্বীয় গৌরবে অনেক উচ্চাসীন... আমি কসম করিতেছি ঐ সত্তার, যাহার হস্তে আমার প্রাণ আছে, যদি মসীহ ইবনে মরিয়ম আমার যুগে আসিতেন তবে যে কাজ আমি করিতে পারি, তিনি কখনো তাহা করিতে পারিতেন না এবং যে নিদর্শন আমা দ্বারা প্রকাশিত হইতেছে তিনি কখনো তাহা দেখাইতে পারিতেন না।’হাকীকাতুল ওহী (বাংলা), পৃ. ১১৭ (বাংলাদেশে কাদিয়ানীদের মূলকেন্দ্র বকশী বাজার, ঢাকা থেকে অনূদিত)

মির্যা কাদিয়ানী আরো লিখেছেন

‘যেস্থলে খোদা ও তাঁহার রসূল এবং সকল নবী শেষ যুগের মসীহ্কে (মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী) তাঁহার কীর্তি ও মহান কর্মের দরুন শ্রেয়ঃ সাব্যস্ত করিয়াছেন, সেস্থলে এই কথা বলা শয়তানী কুপ্ররোচনা যে, তুমি কেন মসীহ্ ইবনে মরিয়মের তুলনায় নিজেকে শ্রেয়ঃ সাব্যস্ত কর।’হাকীকাতুল ওহী (বাংলা), পৃ. ১২৩ (বাংলাদেশে কাদিয়ানীদের মূলকেন্দ্র বকশী বাজার, ঢাকা থেকে অনূদিত)

‘অতএব খোদা দেখাইতেছেন যে, এই রসূলের নগণ্য দাস ইসরাঈলী মসীহ ইবনে মরিয়মের চাইতে বড়। এই কথায় যে-ব্যক্তির ক্রোধাগ্নি প্রজ্জলিত হয় তাহার স্বীয় ক্রোধাগ্নিতে মরিয়া যাওয়ার অধিকার আছে।’হাকীকাতুল ওহী (বাংলা), পৃ. ১১৯ (বাংলাদেশে কাদিয়ানীদের মূলকেন্দ্র বকশী বাজার, ঢাকা থেকে অনূদিত)

মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর এজাতীয় আরো অনেক বক্তব্য রয়েছে। তন্মধ্যে এখানে মাত্র কয়েকটি বক্তব্য উল্লেখ করা হল।

কাদিয়ানী সম্প্রদায় কাফের হওয়ার সপ্তম কারণ

হযরত ঈসা আ.-এর ওপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করা

কোনো নবীর শানে সামান্যতম বেয়াদবিও কুফর

কোনো নবীর শানে সামান্যতম বেয়াদবি করা বা তাঁর মর্যাদায় আঘাত লাগে, এমন কোনো কথা বলা ইসলাম থেকে খারিজ হওয়ার অন্যতম কারণ। কাযী ইয়াজ রাহ. (মৃত্যু : ৫৪৪ হি.) তার বিখ্যাত ‘আশশিফা বিতা‘রীফি হুকূকিল মুস্তফা’ গ্রন্থে বলেন

وكذلك من أضاف إلى نبينا صلى الله عليه وسلم تعمد الكذب فيما بلغه وأخبر به...أو استخف به أو بأحد من الأنبياء، أو أزرى عليهم، أو آذاهم أو قتل نبيا ،أو حاربه، فهو كافر بإجماع.

অনুরূপ যে ব্যক্তি মনে করে, আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা কিছু পৌঁছিয়েছেন এবং যার সংবাদ দিয়েছেন, সে ক্ষেত্রে তিনি মিথ্যা বলেছেন, সে গোটা উম্মতের সর্বসম্মতিক্রমে কাফের... এমনিভাবে যে তাঁর বা অন্য কোনো নবীর মর্যাদাহানী করে বা তাঁদের অবজ্ঞা করে বা কোনো নবীকে কতল করে বা তাঁর সাথে যুদ্ধ করে, সে ব্যক্তি গোটা উম্মতের সর্বসম্মতিক্রমে কাফের। আশশিফা বিতা‘রীফি হুকূকিল মুস্তফা, খ. ২, পৃ. ২৮৪

কোনো নবীর শানে সামান্যতম বেয়াদবিও যে ইসলাম থেকে খারিজ হওয়ার কারণ, তা মির্যা কাদিয়ানী নিজেও স্বীকার করেছেন। মির্যা কাদিয়ানী লিখেছেন

اسلام میں کسی نبی کی تحقیر کفر ہے اور سب پر ایمان لانا فرض ہے۔

ইসলামে কোনো নবীকে হেয় করা কুফর এবং সকল নবীর প্রতি ঈমান আনা ফরয। চশমায়ে মারেফাত, রূহানী খাযায়েন (মির্যা কাদিয়ানীর রচনাসমগ্র), খ. ২৩, পৃ. ৩৯

নবী অবমাননার মতো ভয়াবহ এই ঈমান বিধ্বংসী কাজটা মনে হয় যেন মির্যা কাদিয়ানীর এক ধরনের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। পেছনে উল্লেখ করা হয়েছে, মির্যা কাদিয়ানী কতভাবে শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবমাননা করেছে। তার বিভিন্ন বইপত্রে সে অন্যান্য নবী-রাসূলেরও অবমাননা করেছে। এখানে হযরত ঈসা আ. সম্পর্কে মির্যা কাদিয়ানীর ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্যের কিছু উদাহরণ উল্লেখ করা হল

‘হযরত ঈসা আ.-এর ওপর মিথ্যাচারের অপবাদ’

মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী হযরত ঈসা আ.-কে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করতে গিয়ে লিখেছেন

ہائے کس کے آگے یہ ماتم لے جائیں کہ حضرت عیسیٰ علیہ السلام کی تین پیش گوئیاں صاف طور جھوٹی نکلیں اور آج کون زمین پر ہے جو اس عقدہ
کو حل کر سکے۔

হায়! আজ কার কাছে এই মাতম নিয়ে যাব, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের তিনটি ভবিষ্যদ্বাণী স্পষ্ট মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। আজ পৃথিবীতে এমন কে আছে, যে এই জটিলতার সমাধান করতে পারবে। এজাযে আহমদী, রূহানী খাযায়েন (মির্যা কাদিয়ানীর রচনাসমগ্র), খ. ১৯, পৃ. ১২১

‘মদপানের অপবাদ’

মির্যা কাদিয়ানী হযরত ঈসা আ.-এর ওপর মদপানের অপবাদ দিয়ে লিখেছেন

‘ইউরোপের লোকের মদ যত অনিষ্ট করিয়াছে, তাহার কারণ এই যে, ঈসা (আঃ) মদ্যপান করিয়াছেন, হয়ত কোনো রোগবশতঃ বা প্রাচীন অভ্যাস অনুযায়ী তিনি এরূপ করিয়াছেন।’ কিশতিয়ে নূহ (বাংলা), পৃ. ৮৭ (বাংলাদেশে কাদিয়ানীদের মূলকেন্দ্র বকশী বাজার, ঢাকা থেকে অনূদিত)

‘হযরত ঈসা আ.-এর ওপর গালি-গালাজ এর অপবাদ’

মির্যা কাদিয়ানী হযরত ঈসা আ.-এর ওপর গালি-গালাজের অপবাদ দিয়ে লিখেছেন

حضرت عیسیٰ علیہ السلام نے خود اخلاقی تعلیم پر عمل نہیں کیا۔ انجیر کے درخت کو بغیر پھل کے دیکھ کر اس پر بددعا کی اور دوسروں کو دعا کرنا سکھایا اور دوسروں کو یہ بھی حکم دیا کہ تم کسی کو احمق مت کہو مگر خود اس قدر بدزبانی میں بڑھ گئے کہ یہودی بزرگوں کو ولدالحرام تک کہہ دیا ۔اور ہر ایک وعظ میں یہودی علماء کو سخت سے سخت گالیاں دیں اور برے برے ان کے نام رکھے۔ اخلاقی معلم کا فرض ہے کہ پہلے آپ اخلاق کریمہ دکھلاوے۔

হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম নিজে নৈতিক শিক্ষার ওপর আমল করেননি। আঞ্জির (ডুমুর) গাছ ফলবিহীন দেখে তার ওপর বদ-দুআ করেছেন। অথচ অন্যদেরকে দুআ করতে শিখিয়েছেন। অন্যদেরকে এই আদেশও করেছেন যে, তোমরা কাউকে আহমক বলবে না; কিন্তু নিজে মুখ-খারাপে এতটাই লাগামহীন হয়ে পড়েছেন যে, ইহুদীদের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গকে হারামজাদা পর্যন্ত বলে ছেড়েছেন। তিনি প্রতিটি ওয়াজে ইহুদী আলেমদেরকে কঠিন কঠিন গালি দিয়েছেন এবং তাদের বিভিন্ন খারাপ নাম রেখেছেন। নৈতিক শিক্ষকের জন্য ফরয প্রথমে নিজে উত্তম চরিত্র দেখানো। চশমায়ে মাসীহী, রূহানী খাযায়েন (মির্যা কাদিয়ানীর রচনাসমগ্র), খ. ২০, পৃ. ৩৪৬

আরেকটি মারাত্মক অপবাদ

মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর দাবি, হযরত ঈসা আ.-এর সাথে বেশ্যা নারীদের সম্পর্ক ছিল নাঊযুবিল্লাহ।

মির্যা কাদিয়ানী ‘দাফেউল বালা’ নামক পুস্তকের শুরুতে ‘সতর্কীকরণ’ শিরোনামের অধীনে টীকায় লিখেছেন

‘তবে হযরত ঈসা (আ.)-এর ন্যায়পরায়ণতা ঐ যুগের ন্যায়পরায়ণদের তুলনায় অধিক বলে প্রমাণ হয় না; বরং হযরত ইয়াহিয়া নবী (আ.) হযরত ঈসা (আ.)-এর চেয়ে একটু বেশিই বুযুর্গীর অধিকারী। কারণ তিনি মদপান করতেন না। তাঁর সম্পর্কে একথাও শোনা যায় নি, কোন চরিত্রহীন/নারী এসে নিজের হারাম উপার্জিত টাকা দিয়ে তার মাথায় তেল মালিশ করেছে। অথবা নিজ হাত বা মাথার চুল দিয়ে তাঁর শরীর স্পর্শ করেছিল। অথবা কোনো সম্পর্ক ছাড়াই কোনো যুবতী নারী তাঁর সেবা করত। এজন্যই খোদাতা’লা কুরআনে হযরত ইয়াহিয়া (আ.)-এর নামের সাথে ‘হাসূরান’ (শব্দ) ব্যবহার করেছেন। অথচ হযরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে এই শব্দ ব্যবহার করেননি। সেইসব গল্প কাহিনী এমন শব্দ ব্যবহারের পথে প্রতিবন্ধক ছিল। হযরত ইয়াহিয়া (আ.)-এর হাতে, যাকে খ্রিস্টানরা ‘ইউহান্না’ এবং পরবর্তীতে ‘এলিয়া’ বলে আখ্যায়িত করেছে, হযরত ঈসা (আ.) নিজ কৃত পাপ হতে তওবা করেছিলেন এবং তাঁর খাস মুরিদদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন।’ দাফেউল বালা, ‘সতর্কীকরণ’ শিরোনামের টীকা (বাংলাদেশে কাদিয়ানীদের মূলকেন্দ্র বকশী বাজার, ঢাকা থেকে অনূদিত)

মির্যা কাদিয়ানীর এজাতীয় আরো অনেক বক্তব্য রয়েছে। এখানে মাত্র কয়েকটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করা হলেছে। অতএব একজন নবীর শানে এমন জঘন্য অপবাদ অরোপ করার পরেও ইসলামের দাবি করা, ইসলাম ও মুসলমানদের সাথে তামাশা ছাড়া আর কী হতে পারে?

কাদিয়ানী সম্প্রদায় কাফের হওয়ার অষ্টম কারণ

বিশ্বের সকল মুসলমানকে কাফের আখ্যা দেওয়া

মির্যা কাদিয়ানী তার তথাকথিত ওহী ও এলহাম সম্বলিত পুস্তক ‘তাযকিরা’য় বলেছেন

خدا تعالیٰ نے میرے پر ظاہر کیا ہے کہ ہر ایک شخص جس کو میری دعوت پہنچی ہے اور اس نے مجھے قبول نہیں کیا وہ مسلمان نہیں ہے۔

আল্লাহ তাআলা আমাকে জানিয়েছেন, যে ব্যক্তির নিকট আমার দাওয়াত পৌঁছল, কিন্তু সে আমাকে গ্রহণ করল না, সে মুসলমান না। তাযকিরাহ (মির্যা কাদিয়ানীর ওহী-ইলহামের সংকলন), পৃ. ৫১৯ (চতুর্থ সংস্করণ); হাকীকাতুল ওহী (বাংলা), পৃ. ১৩০ (কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের মূলকেন্দ্র বকশী বাজার, ঢাকা থেকে অনূদিত)

মির্যা কাদিয়ানীর বড় ছেলে ও কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় খলীফা মির্যা বশীরুদ্দীন মাহমুদের বক্তব্য আরো মারাত্মক। তিনি বলেছেন

کل مسلمان جو حضرت مسیح موعود کی بیعت میں شامل نہیں ہوئے خواہ انہوں نے حضرت مسیح موعود کا نام بھی نہیں سنا وہ کافر اور اسلام سے خارج ہیں۔

সকল মুসলমান, যারা হযরত মাসীহে মাওউদ (মির্যা কাদিয়ানী)-এর বাইআতে শামিল হয়নি, হোক তারা হযরত মাসীহে মাওউদের নামও শোনেনি, সবাই কাফের এবং ইসলাম থেকে খারিজ। আয়নায়ে সাদাকাত, আনওয়ারুল উলূম (মির্যা মাহমুদের রচনাসমগ্র), খ. ৬, পৃ. ১১০

মির্যা কাদিয়ানীর মেজো ছেলে বশীর আহমদ এম এ লিখেছেন

ہر ایک ایسا شخص جو موسی کو تو مانتا ہے مگر عیسی کو نہیں مانتا یا عیسی کو مانتا ہے مگر محمد کو نہیں مانتا اور یا محمد کو مانتا ہےپھر مسیح موعود کو نہیں مانتا ، وہ نہ صرف کافر بلکہ پکا کافر اور دائرۂ اسلام سے خارج ہے۔

প্রত্যেক ওই ব্যক্তি, যে মূসাকে মানে, কিন্তু ঈসাকে মানে না অথবা ঈসাকে মানে, কিন্তু মুহাম্মাদকে মানে না, কিংবা মুহাম্মাদকে মানে, অথচ মাসীহে মাওউদকে (মির্যা কাদিয়ানীকে) মানে না, সে স্রেফ কাফেরই নয়; বরং পাক্কা কাফের এবং সে ইসলামের গণ্ডিবহির্ভূত। কালিমাতুল ফছল, পৃ. ২০ (মির্যাপুত্র বশীর আহমদ এম এ-কৃত)

‘মুসলমানদের পেছনে নামায না পড়ার কারণ’

যেহেতু কাদিয়ানীরা মির্যা কাদিয়ানীর ওপর ঈমান না আনার কারণে বিশ্বের সকল মুসলমানকে কাফের মনে করে, তাই তারা মুসলমানদের পেছনে নামায পড়া, তাদের জানাযায় শরীক হওয়া, তাদের কাছে মেয়ে বিবাহ দেওয়া ইত্যাদিকে হারাম মনে করে।

কাদিয়ানীদের দ্বিতীয় খলীফা মির্যা বশীরুদ্দীন মাহমুদ বলেছেন

ہمارا فرض ہے کہ غیر احمدیوں کو مسلمان نہ سمجھیں اور نہ ان کے پیچھے نماز پڑھیں۔ کیونکہ ہمارے نزدیک وہ خدا تعالی کے ایک نبی کے منکر ہیں۔

আমাদের কর্তব্য হল, আমরা যেন অ-আহমদীদেরকে মুসলমান মনে না করি এবং তাদের পেছনে নামায আদায় না করি। কেননা আমাদের নিকট তারা খোদা তাআলার একজন নবীকে অস্বীকারকারী। আনওয়ারে খেলাফত, আনওয়ারুল উলূম (মির্যা মাহমুদের রচনাসমগ্র), খ. ৩, খ. ১৪৮

মির্যা বশীরুদ্দীন মাহমুদের আরেকটি বক্তব্য লক্ষ করুন

اب ایک اور سوال رہ جاتا ہے کہ غیر احمدی تو حضرت مسیح موعود کے منکر ہوئے اس لیے ان کا جنازہ نہیں پڑھنا چاہئے لیکن اگر کسی غیر احمدی کا چھوٹا بچہ مر جائے تو اس کا جنازہ کیوں نہ پڑھا جائے۔  وہ تو مسیح موعود کا مکفر نہیں۔ میں یہ سوال کرنے والے سے پوچھتا ہوں کہ اگر یہ درست ہے تو پھر ہندوئوں اور عیسائیوں کے بچوں کا جنازہ کیوں نہیں پڑھا جاتا؟

আরেকটি প্রশ্ন, অ-আহমদী তো হযরত মাসীহে মাওউদের অস্বীকারকারী এজন্য তার জানাযা পড়া উচিত না; কিন্তু যদি কোনো অ-আহমদীর ছোট শিশু মারা যায়, তাহলে তার জানাযা কেন পড়া যাবে না? সে তো মাসীহে মাওউদের অস্বীকারকারী নয়। আমি এই প্রশ্নকারীকে জিজ্ঞেস করতে চাই, যদি এই কথা সঠিক হয়, তাহলে হিন্দু ও খ্রিস্টানদের ছোট শিশুর জানাযা কেন পড়া হয় না? আনওয়ারে খেলাফত, আনওয়ারুল উলূম (মির্যা মহমুদের রচনাসমগ্র), খ. ৩, পৃ. ১৫০

উপরোক্ত উদ্ধৃতিগুলো থেকে সহজেই অনুমেয় যে, কাদিয়ানী ধর্ম ইসলাম থেকে সম্পূর্ণ আলাদা একটি ধর্ম। মুসলিম উম্মাহর সাথে দূরতম কোনো সম্পর্কও তাদের নেই। যা তারা নিজেরাই তাদের বইপুস্তকের মধ্যে স্বীকার করেছে। সুতরাং মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের উচিত তাদের এই বাস্তবতাকে বুঝে তাদেরকে অমুসলিম বলে ঘোষণা করা।

শেষ কথা

এখানে কাদিয়ানী সম্প্রদায় অমুসলিম হওয়ার মাত্র আটটি কারণ উল্লেখ করা হল। এছাড়াও তাদের অমুসলিম হওয়ার আরো অনেক কারণ রয়েছে। যেমন, অন্যান্য নবীগণের আবমাননা, কুরআন-হাদীসের অবমাননা, শাআয়েরে ইসলাম তথা ইসলামের নিদর্শনাবলীর অবমাননা ইত্যাদি। এর যেকোনোটিই তাদের কাফের হওয়ার জন্য যথেষ্ট। তবে মূলকথা আগেই বলা হয়েছে যে, কাদিয়ানী সম্প্রদায় খতমে নবুওতের আকীদাকে অস্বীকার করে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর ওপর ঈমান আনার মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে কাদিয়ানী ধর্ম গ্রহণ করেছে। সুতরাং ইসলাম ধর্মের অনুসারী বলে পরিচয় দেওয়ার কোনো অধিকার তাদের নেই। ইসলামের মৌলিক আকীদা-বিশ্বাস অস্বীকার করে মুসলিম হওয়ার দাবি করা স্পষ্ট ধোঁকা এবং প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়। সুতরাং সকল মুসলমানের কর্তব্য হল, ইসলামের নামে তাদের এই প্রতারণা সম্পর্কে সচেতন হওয়া। আল্লাহ তাআলা সকলকে এই ভয়াবহ কুফরী ফেতনা থেকে হেফাজত করুন আমীন।

 

টীকা :

১. বাংলাদেশে কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের মূলকেন্দ্র বকশী বাজার, ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘নবুয়ত ও খিলাফত’ (প্রকাশকাল : বাংলা অনুবাদ- ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ঈ.) নামক বইয়ের শুরুতে পরিভাষা নামে একটি শিরোনাম দেওয়া হয়েছে। সেখানে তারা নিজেদের পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছে

‘আহমদীয়া মুসলিম জামা’ত : এমন একটি মুসলিম সম্প্রদায়, যারা প্রতিশ্রুত মসীহ্ ও মাহদী হিসেবে কাদিয়ানে আবির্ভূত হযরত মির্যা গোলাম আহমদ (আ.)-এর সকল দাবি মেনে নিয়েছে।’

 ২. মির্যা কাদিয়ানীও তার ‘আয়েনায়ে কামালাতে ইসলাম’ নামক পুস্তকে একটি আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে জারীর তাবারী রাহ.-কে ইমামুল মুফাসসিরীন বলে স্বীকার করেছেন। দেখুন, আয়েনায়ে কামালাতে ইসলাম; রূহানী খাযায়েন (মির্যা কাদিয়ানীর রচনাসমগ্র), খ. ৫, পৃ. ১৬৮

 ৩. মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নিজেই এই পুস্তিকাটি লেখার প্রেক্ষাপট লিখেছেন। মির্যা কাদিয়ানীর কোনো এক ভক্ত তার নবুওত দাবির বিষয়ে না জানার কারণে অন্যদের সামনে মির্যা কাদিয়ানীর নবুওত দাবির বিষয়টি অস্বীকার করে বসে। মির্যা কাদিয়ানীর কাছে এই সংবাদ পৌঁছলে তিনি তার ভক্তের এই ভুল সংশোধনের জন্য পুস্তিকাটি লেখেন এবং তাতে নিজের নবুওত দাবির বিষয়টি স্পষ্ট করেন। দেখুন, একটি ভুল সংশোধন (বাংলা), পৃ. ৩ (বাংলাদেশে কাদিয়ানীদের মূলকেন্দ্র বকশী বাজার, ঢাকা থেকে অনূদিত)


 ৪. মির্যা কাদিয়ানীর দাবি, আল্লাহ তাআলা নাকি আদম আ. থেকে শুরু করে শেষ অবধি পৃথিবীর বয়স সাত হাজার বছর নির্ধারণ করেছেন। আর পৃথিবীর পঞ্চম সহস্রাব্দে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রথম আবির্ভাব হয়েছে এবং ষষ্ঠ সহস্রাব্দের শেষে মির্যা কাদিয়ানীর রূপে তার দ্বিতীয় আবির্ভাব হয়েছে। পৃথিবীর বয়স শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সাত হাজার বছর হওয়ার বিষয়টি নাকি সব নবীর কিতাব এবং কুরআন থেকে প্রমাণিত। (দেখুন, লেকচার সিয়ালকোট (বাংলা), পৃ. ১১-১৩)

মির্যা কাদিয়ানীর এই বক্তব্য যে সম্পূর্ণ অবাস্তব তা বলাই বাহুল্য। এটা কুরআনের ওপর সরাসরি মিথ্যাচার।

৫. মির্যা কাদিয়ানী হযরত ঈসা আ. সম্পর্কে অপবাদ দিয়ে তা-ই লিখেছে, যা বাস্তবে মির্যা কাদিয়ানীর মধ্যে আছে। এখানে মির্যা কাদিয়ানীর কিছু চারিত্রিক বিষয় উল্লেখ করা হল।

মির্যা কাদিয়ানী হযরত ঈসা আ. সম্পর্কে যে কুরুচিকর বক্তব্য দিয়েছে, তার প্রতিটি বিষয় মির্যা কাদিয়ানীর জীবনে বিদ্যমান। কুরআন হাদীসের নামে তার মিথ্যাচার, অন্যকে দেওয়া তার গালিগালাজ, বেগানা নারীদের সাথে তার অবাধ মেলামেশা এবং তার অন্যান্য চারিত্রিক স্খলন তুলে ধরার জন্য স্বতন্ত্র পুস্তকের প্রয়োজন। আমরা এখানে কেবলমাত্র দুয়েকটি বিষয় উল্লেখ করছি।

মির্যা কাদিয়ানীর মুখের ভাষা এতটাই অশালীন ছিল যে, তার গালিগালাজ নিয়ে স্বতন্ত্র পুস্তিকা লেখা হয়েছে। তার লিখিত পুস্তকাদিতে প্রায় হাজারের অধিক গালিগালাজ রয়েছে। এগুলো উল্লেখ করা যদিও ভদ্রতা পরিপন্থী, তবুও তাদের বাস্তবতাকে তুলে ধরার জন্য মুসলমানদেরকে দেওয়া তার দুটি গালি উল্লেখ করছি

মির্যা কাদিয়ানী তার ‘আয়েনায়ে কামালাতে ইসলাম’ নামক পুস্তকে লিখেছেন

تلك كتب ينظر إليها كل مسلم بعين المحبة والمودة، وينتفع من معارفها ويقبلني، ويصدق دعوتي إلا ذرية البغايا.

প্রত্যেক মুসলমান আমার ওইসকল কিতাবের দিকে মহব্বতের দৃষ্টিতে দেখে এবং তা থেকে উপকৃত হয়। আমাকে গ্রহণ করে এবং আমার দাওয়াতকে সত্যায়ন করে, কিন্তু বেশ্যার বাচ্চারা ছাড়া! আয়েনায়ে কামালাতে ইসলাম, রূহানী খাযায়েন (মির্যা কাদিয়ানীর রচনাসমগ্র), খ. ৫, পৃ. ৫৪৭-৫৪৮

অন্যত্র মির্যা কাদিয়ানী লেখেন

دشمن ہمارے بیابانوں کے خنزیر ہو گئے اور اُن کی عورتیں کتیوں سے بڑھ گئی ہیں۔

দুশমনেরা জঙ্গলের শূকর হয়ে গেছে/ আর তাদের স্ত্রীরা কুকুর থেকেও নিকৃষ্ট।নাজমুল হুদা, রূহানী খাযায়েন (মির্যা কাদিয়ানীর রচনাসমগ্র), খ. ১৪, পৃ. ৫৩

বেগানা নারীদের সাথে মির্যা কাদিয়ানীর কেমন সম্পর্ক ছিল, তা তার ছেলেই তার জীবনীগ্রন্থে লিখে দিয়েছেন। বিভিন্ন নারীরা তার বিভিন্ন খেদমতে নিয়োজিত ছিল। তার শরীর টিপে দেওয়া, রাতে তাকে পাহারা দেওয়া, পাখা দিয়ে বাতাস করা, টয়লেটে পানি এগিয়ে দেওয়া ইত্যাদি কাজ নারীরাই আঞ্জাম দিত। যয়নব নামক এক নারীর বক্তব্য, সে কখনো অর্ধরাত আবার কখনো সারারাত মির্যা কাদিয়ানীর খেদমত করেছে। আর মির্যা কাদিয়ানীও মাঝেমধ্যে নিজের বরকত (?) তাকে দিয়েছে।

[দ্র. সীরাতুল মাহদী খ. ১, পৃ. ৭২৫, ৭৫৮, ৭২২, ৭৮৯-৭৯০; খ. ২, পৃ. ২৯৭ (লেখক, মির্যাপুত্র বশীর আহমদ এম এ)]

মুহাম্মাদ সাদেক নামে মির্যা কাদিয়ানীর এক খাস মুরিদ ছিল। তিনি মির্যা কাদিয়ানীর জীবনীর ওপর আরেকটি বই লিখেছেন ‘যিকরে হবীব’ নামে। মুহাম্মাদ সাদেক সেখানে লিখেছেন মির্যা কাদিয়ানীর কামরার এক কোণে মটকায় পানি রাখা ছিল। একবার মির্যা কাদিয়ানীর এক নারী সেবিকাকে সেখানে তারই উপস্থিতিতে উলঙ্গ হয়ে গোসল করতে দেখা গেছে। (দ্র. যিকরে হাবীব, পৃ. ৩৮)

আলকাউসার