বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ব্রেকিং

শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকাশে সহায়ক শিক্ষাব্যবস্থা দরকার : ড. মুহাম্মদ ইউনূস কাউকে নির্বাচনে ‘আনতে চাই’ বলিনি: আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গে ফখরুল ডেঙ্গু: একদিনে ভর্তি ১০৩৪ রোগী, মৃত্যু ৫ জনের আনিসুল হক ও দীপু মনিসহ সাবেক ৫ মন্ত্রী নতুন মামলায় গ্রেফতার প্রথমবারের মতো সচিবালয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস জন্মদিনের প্রথম প্রহরে তারেক পেয়েছেন মায়ের ফোন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাবেক পুলিশ প্রধানসহ ৮ জন জাবির ছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় বরখাস্ত ৪, ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা সরবরাহ-পর্যবেক্ষণ জোরদারের মাধ্যমে সিন্ডিকেট অকার্যকর করা হবে: উপদেষ্টা প্রতি ইসরায়েলি বন্দির মুক্তিতে পাঁচ মিলিয়ন ডলার দেবেন নেতানিয়াহ লেবাননে সংঘাতে ২শ’র ও বেশি শিশু নিহত : ইউনিসেফ

ইসলাম

ঈদ উদযাপন: সালাফের কিছু অবস্থা ও অনুভূতি

মাওলানা মুহাম্মাদ ইমরান হুসাইন

 আপডেট: ১৮:০৪, ১৮ মে ২০২২

ঈদ উদযাপন: সালাফের কিছু অবস্থা ও অনুভূতি

মেহেরবান আল্লাহ আমাদের দুটি ঈদ দান করেছেন। ঈদ হল খুশির দিন, আনন্দের মৌসুম। ঈদে আমরা খুশি ও আনন্দ প্রকাশ করব এবং দরিদ্র ও অসহায়দের সুখ ও আনন্দদানের চেষ্টা করব। তবে স্মরণ রাখতে হবে, মুসলিমের আনন্দ-উদ্যাপন আর অমুসলিমের আনন্দ-উদ্যাপন এক হতে পারে না। মুমিনের আনন্দ-উদ্যাপন হয় আল্লাহর পছন্দনীয় আমলের মাধ্যমে আর অমুসলিমের আনন্দ-উদ্যাপন হয় তাঁর নাফরমানির মাধ্যমে। মুসলিমের জীবন ও চিন্তা আখেরাতকেন্দ্রিক আর কাফেরের সবকিছু দুনিয়াকেন্দ্রিক। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَ فَرِحُوْا بِالْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَ مَا الْحَیٰوةُ الدُّنْیَا فِی الْاٰخِرَةِ اِلَّا مَتَاعٌ.

তারা (অর্থাৎ কাফেরগণ) পার্থিব জীবনেই উল্লসিত, অথচ আখেরাতের তুলনায় পার্থিব জীবন তো মামুলি ভোগমাত্র। -সূরা রা‘দ (১৩) : ২৬

আল্লাহ তাআলা মুমিনদের উদ্দেশে বলেন-

قُلْ بِفَضْلِ اللهِ وَ بِرَحْمَتِهٖ فَبِذٰلِكَ فَلْیَفْرَحُوْا  هُوَ خَیْرٌ مِّمَّا یَجْمَعُوْنَ.

(হে নবী!) বলুন, এসব আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর রহমতেই হয়েছে। সুতরাং এতেই তাদের আনন্দিত হওয়া উচিত। তারা যা-কিছু পুঞ্জীভূত করে, তা অপেক্ষা এটা শ্রেয়! -সূরা ইউনুস (১০) : ৫৮

ঈদের হাকীকত

আনাস রা. বলেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনায় আগমন করেন তখন দেখেন, মদীনাবাসী বছরে দুই দিন উৎসব করে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা এই দুই দিন আনন্দ-ফুর্তি কর কেন? তারা বলল, জাহেলী যুগে এ দুইটি দিন আমরা উৎসব-আনন্দ করতাম। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- 

إِنّ اللهَ قَدْ أَبْدَلَكُمْ بِهِمَا خَيْرًا مِنْهُمَا: يَوْمَ الْأَضْحَى، وَيَوْمَ الْفِطْرِ.

আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে এ দুই দিনের বদলে উত্তম দুটি দিন দান করেছেন। ঈদুল আযহা ও ঈদুর ফিতর। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১১৩৪; সুনানে নাসাঈ, হাদীস ১৫৫৬

হাদীসটি থেকে স্পষ্ট যে, অমুসলিমদের পর্ব-উৎসব বর্জন করার জন্যই আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দুটি ঈদ দান করেছেন। সুতরাং আমরা আমাদের ঈদ উদ্যাপন করব, অমুসলিমদের পর্ব-উৎসব থেকে বিরত থাকব। সাথে সাথে আমাদের ঈদ যেন অমুসলিমদের পর্ব-উৎসবের মত নিছক পার্থিব আমোদ-প্রমোদের ক্ষেত্র না হয়, সেদিকেও খুব খেয়াল রাখব। হাসান বসরী রাহ.-এর বক্তব্য অনুযায়ী আমাদের ঈদ তো হল-

أما يوم الفطر فصلاة وصدقة وأما يوم الأضحى فصلاة ونسك.

ঈদুল ফিতর হল, ঈদের নামায পড়া ও সদাকাতুল ফিতর আদায় করা এবং ঈদুল আযহা হচ্ছে ঈদের নামায পড়া ও কুরবানী করা। -ফাযাইলুল আওকাত, বায়হাকী, পৃ. ৩০৩-৩০৪ (১৪৪); শুআবুল ঈমান, বায়হাকী ৫/৩৮৬ (৩৪৩৭)

ইবনে রজব হাম্বলী রাহ.-এর ভাষ্যমতে আমাদের ঈদ হল-

وإنما كان يوم الفطر من رمضان عيدا لجميع الأمة، لأنه تعتق فيه أهل الكبائر من الصائمين من النار، فيلتحق فيه المذنبون بالأبرار، كما أن يوم النحر هو العيد الأكبر، لأن قبله يوم عرفة وهو اليوم الذي لا يرى في يوم من الدنيا أكثر عتقا من النار منه، فمن أعتق من النار في اليومين فله يوم عيد، ومن فاته العتق في اليومين فله يوم وعيد.

ঈদুল ফিতরের দিন সমস্ত উম্মতের জন্য ঈদ ও আনন্দের দিন হওয়ার কারণ হল- ঐ দিন আল্লাহ তাআলা রোযাদারদের জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। ফলে যারা গোনাহগার তারাও নেককারদের দলে শামিল হয়ে যায়। আর ঈদুল আযহার দিন বড় ঈদ হওয়ার কারণ হচ্ছে- এর আগের দিন হল আরাফার দিন, যেদিন এত বিপুল পরিমাণ লোকদের জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হয়, সারা বছরের আর কোনো দিন এত লোককে মুক্তি দেওয়া হয় না।

সুতরাং ঈদের দিন যাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হয় তার জন্য সেদিন ঈদ ও খুশির দিন আর ঐ দিন যে মুক্তি পায়নি তার জন্য সেদিন কান্না ও বিলাপের দিন। -লাতাইফুল মাআরিফ, পৃ. ২৩৭-২৩৮

এই হল ঈদের হাকীকত। পুরো এক মাস রোযা রাখা ও তারাবী পড়ার পর ঈদের দিন আল্লাহ রোযাদারদেরকে তাদের মেহনতের সওয়াব ও পুরস্কার দান করবেন। জাহান্নামীদের তালিকা থেকে তাদের নাম মুছে দেবেন। তাই রোযাদাররা খুশি হয়ে শুকরিয়া স্বরূপ দান-সদকা করবে এবং ঈদের নামায আদায় করবে।

আরাফার দিন (কুরবানী ঈদের আগের দিন) হাজ্বীগণ উকুফে আরাফা করেন। আল্লাহ তাআলা তাদের পাপরাশি ক্ষমা করে দেন। ঈদের দিন সামর্থ্যবানরা কুরবানী করে, সকল মুসলমান এক ময়দানে একত্র হয়ে ঈদের নামায আদায় করে। এভাবে হজ¦, কুরবানী ও নামাযের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা মুসলিমদের গোনাহ মাফ করেন এবং আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের মেহমানদারি করেন। ফলে ঈদের আনন্দ গুনাহ মাফ হওয়ার আনন্দ, জাহান্নাম থেকে মুক্তির আনন্দ, মহান আল্লাহ তাআলার মেহমানদারি কবুল করার আনন্দ, সবোর্পরি আল্লাহ প্রদত্ত নিআমতের শুকরিয়া প্রকাশের আনন্দ। বান্দা এসবের জন্য খুশি প্রকাশ করবে,  ঈদের দিনগুলো অনন্দে অতিবাহিত করবে। এই হল ঈদের স্বরূপ। এটাই হল একজন মুসলিমের ঈদ ও আনন্দ। 

মোটকথা, মুমিনের সুখ-শান্তি ও হাসি-আনন্দ হল দ্বীন ও আখেরাত কেন্দ্রিক। সুতরাং মুমিনের ঈদ ও আনন্দ অমুসলিমের উৎসব-বিনোদনের, আমোদ-ফুর্তির মত হবে না। মুমিন তার ঈদ উদ্যাপনে আল্লাহর নাম ভুলবে না, শরীয়তের সীমা অতিক্রম করবে না এবং বিজাতির উৎসব ও আমোদ-প্রমোদের অনুসরণ করবে না, গুনাহে লিপ্ত হবে না। মুসলিম অন্যান্য সকল বিষয়ে যেমন নবীজীর সুন্নাহর অনুসরণ করে এবং সালাফে সালেহীন তথা মহান পূর্বসূরিদের আদর্শের অনুসরণ করে, ঈদের আনন্দ উদ্যাপনেও তাঁদেরই অনুকরণ করবে। আসুন, জেনে নিই আমাদের মহান পূর্বসূরিগণ কীভাবে ঈদ উদ্যাপন করতেন।

সালাফে সালেহীনের ঈদ উদযাপন

মুমিন ঈদের দিন আল্লাহর নিআমতের উপর খুশি প্রকাশ করবে এবং মাগফিরাত লাভের আনন্দে আনন্দিত হবে। আল্লাহপ্রদত্ত এ খুশির দিনকে বৈধ বিনোদনের মাধ্যমে উদ্যাপন করবে। কিন্তু এতে সে দ্বীন-শরীয়ত পাশ কাটিয়ে উন্মাদ হয়ে পড়বে না, আল্লাহর নাফরমানিতে লিপ্ত হবে না। এমনই ছিল  সালাফে সালেহীনের ঈদ। এখানে তাঁদের  কিছু ঘটনা ও বাণী উল্লেখ করছি। এতেই স্পষ্ট হয়ে যাবে, কীভাবে তাঁরা উদ্যাপন করতেন ঈদ ও ঈদের খুশি।

তাঁদের দৃষ্টিতে ক্ষমা ও পুরস্কার লাভই ঈদের আসল আনন্দ

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. ঈদের দিন বলতেন-

من هذا المقبول منا فنهنيه، ومن هذا المحروم منا فنعزيه، أيها المقبول هنيئا لك، أيها المردود جبر الله مصيبتك.

জানি না, আমাদের মধ্যে কে পুরস্কৃত, তাকে আমরা শাবাশি দিতাম! আর কে বঞ্চিত, তার জন্য আমরা শোক প্রকাশ করতাম! হে পুরস্কৃত! তোমাকে অভিনন্দন। হে বঞ্চিত! আল্লাহ তোমার ক্ষতিপূরণ করুন। -লাতাইফুল মাআরিফ, পৃ. ২৩৫

এর চেয়ে সত্য ও বাস্তব কথা আর কী হতে পারে?

এক বুযুর্গকে দেখা গেল ঈদের দিন তিনি খুব চিন্তিত। তাঁকে প্রশ্ন করা হল, আজ তো খুশি ও আনন্দের দিন। আপনার অবস্থা এমন কেন? তিনি উত্তর দিয়েছেন-

صدقتم ولكني عبد أمرني مولاي أن أعمل له عملا فلا أدري أيقبله مني أم لا؟

আপনাদের কথা সত্য। আসলে আমি হলাম এক গোলাম, আমার মাওলা আমাকে তাঁর জন্য একটা আমল করার (রোযা রাখার) নির্দেশ দিয়েছিলেন। (আমি তা করেছি। কিন্তু) জানি না, তিনি আমার এ আমল কবুল করেছেন কি না। -লাতাইফুল মাআরিফ, পৃ. ২৩৫

হায়, আমরাও যদি এভাবে চিন্তা করতে পারতাম!

ইবনুল জাওযী রাহ. বলেন-

إخواني: ليس العيد ثوبا يجر الخيلاء جره، ولا تناول مطعم بكف شره لا يؤمن شره، إنما العيد لبس توبة عاص تائب يسر بقدوم قلب غائب.

বন্ধুগণ! জমকালো জামা পরা, যা অহংকার সৃষ্টি করে এবং আড়ম্বরপূর্ণ খাবার খাওয়া, যার অনিষ্ট থেকে বাঁচা যাবে না- এর নাম ঈদ নয়; ঈদ হল আল্লাহভোলা কলব তাওবার জামা পরিধান করা, যা অদৃশ্যের (আল্লাহর) সঙ্গে মিলনের আনন্দে আন্দোলিত থাকে। -আততাবসিরাহ ২/১১৪

হে আল্লাহ! আমাদেরকে এমন স্বচ্ছ হৃদয় দান করুন, যা প্রকৃত ঈদ ও আনন্দ অনুভব করতে পারে- আমীন। 

আবু মানছুর শীরাজী রাহ. বলেন-

ليس العيد لمن غرف له إنما العيد لمن غفر له.

যাকে অঞ্জলি ভরে দান করা হল, ঈদ তো তার জন্য নয়। ঈদ তো হল ঐ ব্যক্তির জন্য, যার গুনাহ মাফ করে দেওয়া হল। -মুজামুস সাফার, আবু তাহের সিলাফী, পৃ. ৩০২ (১০০৮)

হায়! আমাদেরও যদি ঈদ-আনন্দে অনুভূতিটা এমন হত!

এসব বর্ণনা ও ঘটনা থেকে স্পষ্ট যে, সালাফে সালেহীনের আনন্দ ছিল আল্লাহর ক্ষমা ও অনুগ্রহ লাভের মাঝে। জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের মাঝে। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত লাভের মাঝে।

এভাবে সর্বদা এমনকি ঈদ ও খুশির মুহূর্তেও আল্লাহর মাগফিরাত ও জান্নাত লাভের আশায় এবং আল্লাহর ক্রোধ ও জাহান্নাম থেকে বাঁচার চিন্তায় ব্যাকুল থাকতেন সালাফে সালেহীন।

একদা ঈদুল ফিতরের দিন ওয়াহাব ইবনে ওয়ারদ রাহ. দেখলেন, কিছু লোক আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছে। এ দেখে তিনি বললেন-

إن كان هؤلاء يقبل منهم صيامهم فما هذا فعل الشاكرين، وإن كان هؤلاء لم يقبل منهم صيامهم فما هذا فعل الخائفين.

আল্লাহ তাআলা যদি তাদের রোযা কবুল করে থাকেন (তাহলে তো তাদের শোকর করা উচিত।) শোকরগুযার বান্দারা তো এভাবে ফুর্তিতে মত্ত হতে পারে না। আর যদি আল্লাহ তাদের রোযা কবুল না করেন (তাহলে তো তাদের ভীত-শঙ্কিত হওয়া উচিত।) ভীত-শঙ্কিত লোকেরা তো হাশি-তামাশা করতে পারে না। -ফাযাইলুল আওকাত, বায়হাকী, পৃ. ৩২২ (১৫৮, ১৫৭)

ঈদের দিন আল্লাহ তাআলা তার বেশুমার বান্দার গুনাহখাতা মাফ করেন। এই দিনেও যারা মাগফিরাত লাভ করতে পারে না তারা বাস্তবেই হতভাগা। ঈদের দিন যারা এসব চিন্তা না করে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় তাদের প্রতি লক্ষ করে হাসান বসরী রাহ. বলেন-

العجب من اللاعب الضاحك في اليوم الذي يفوز فيه المحسنون ويخسر فيه المبطلون.

আজ নেককার বান্দারা সফল হবে এবং বদকার লোকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এমন দিনেও লোকেরা খেল-তামাশায় মত্ত! খুবই আশ্চর্যের বিষয়! -লাতাইফুল মাআরিফ, পৃ. ২৩৫

বস্তুত ঈদের দিন হচ্ছে গোটা রমযানের ইবাদত-বন্দেগির পুরস্কার লাভের দিন। এদিন সে-ই কৃতকার্য হল, যার ইবাদত কবুল হল, গুনাহ মাফ হল। যার গুনাহ মাফ হল না, ইবাদত কবুল হল না, তারচে হতভাগা আর কে হতে পারে! এমন ব্যক্তির জন্য রাসূলও ধিক জানিয়েছেন।

(দ্র. আলআদাবুল মুফরাদ, বুখারী, হাদীস ৬৪৪)

বাস্তব কথা হল, আমাদের পূর্বসূরিগণ এভাবেই মুহাসাবা ও আত্মসমালোচনার দৃষ্টিতে নিজের দিকে তাকাতেন। মুহাসাবা বিহীন নিছক আনন্দে গা ভাসিয়ে  দেওয়া, আরো আফসোসের বিষয় হল, গুনাহের মাধ্যমে আনন্দ উদ্যাপন করা কখনই মুমিনের শান নয়।

ঈদ মানে খুশি। ঈদ মানে আনন্দ। কিন্তু কার জন্য? কী জন্য? এগুলো নিয়েও আত্মবিশ্লেষণ করা দরকার। পাশাপাশি এ-ও চিন্তা করা দরকার, এ আনন্দ কীভাবে উদ্যাপন করব?

তাঁরা ঈদের খুশি প্রকাশ করতে গিয়ে গোনাহে লিপ্ত হতেন না

ঈদের খুশি উদ্যাপন করতে গিয়ে অনেক মানুষ গোনাহে লিপ্ত হয়ে পড়েন। নযরের গুনাহ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের নাফরমানিতে জড়িয়ে পড়েন। সালাফ এ বিষয়ে সজাগ-সচেতন ছিলেন।

ওয়াকী ইবনুল জার্রাহ রাহ. বলেন, ঈদের দিন সুফিয়ান সাউরী রাহ.-এর সাথে বের হলাম। তিনি বললেন-

إن أول ما نبدأ به في يومنا غض أبصارنا.

আজকের দিন যে কাজের মাধ্যমে আমরা ঈদের সূচনা করব তা হল দৃষ্টির হেফাযত। -আলওয়ারা‘, ইবনে আবিদ দুনিয়া, পৃ. ৬৩ (৬৬)

আবু হাকীম রাহ. বলেন, হাস্সান ইবনে আবু সিনান রাহ. ঈদের নামাযে বের হলেন। নামায থেকে ফিরে এলে তার স্ত্রী দৃষ্টির গুনাহ থেকে বেঁচেছেন কি না জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন-

ويحك ما نظرت إلا في إبهامي منذ خرجت من عندك حتى رجعت إليك.

কী বলছ! ঘর হতে বের হওয়া থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত দৃষ্টি কেবল পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলির প্রতি নিবদ্ধ ছিল। -হিলইয়াতুল আওলিয়া ৩/১১৫; আলইল্ম, ইবনে আবিদ দুনিয়া, পৃ. ৩২ (৬৮); আলওয়ারা‘, ইবনে আবিদ দুনিয়া, পৃ. ৬৪ (৬৮); সিফাতুস সফওয়া ৩/৩৩৬-৩৩৭

তাঁরা ঈদের দিন দান-সদকা ও ইসতিগফারের প্রতি উৎসাহিত করতেন

খলীফাতুল মুসলিমীন উমর ইবনে আবদুল আযীয রাহ. তাঁর গভর্নরদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন-

ঈদের নামাযের আগে সাধ্যানুযায়ী দান-সদকা করবে। যাদের দান করার সামর্থ্য নেই তারা যেন ঈদের পরে রোযা রাখে।

এরপর তিনি বলেন, ঈদের দিন তোমরা বেশি বেশি বলতে থাকবে, যেমন বলেছিলেন আমাদের পিতা আদম আলাইহিস সালাম-

رَبَّنَا ظَلَمْنَاۤ اَنْفُسَنَا وَ اِنْ لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَ تَرْحَمْنَا لَنَكُوْنَنَّ مِنَ الْخٰسِرِیْنَ.

হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজ সত্তার উপর জুলুম করে ফেলেছি। আপনি যদি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন ও আমাদের প্রতি রহম না করেন, তবে আমরা অবশ্যই অকৃতকার্যদের অন্তভুর্ক্ত হয়ে যাব। [সূরা আরাফ (৭) ২৩]

আরো বলতে থাকবে, যেমন বলেছিলেন নূহ আলাইহিস সালাম-

وَاِلَّا تَغْفِرْ لِیْ وَ تَرْحَمْنِیْۤ اَكُنْ مِّنَ الْخٰسِرِیْنَ.

আপনি যদি আমাকে ক্ষমা না করেন ও আমার প্রতি দয়া না করেন, তবে আমিও ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তভুর্ক্ত হয়ে যাব। [সূরা হুদ (১১) : ৪৭]

ইবরাহীম আলাইহিস সালামের মতো দুআ করতে থাকবে-

وَ الَّذِیْۤ اَطْمَعُ اَنْ یَّغْفِرَ لِیْ خَطِیْٓـَٔتِیْ یَوْمَ الدِّیْنِ.

এবং যার কাছে আমি আশা রাখি, হিসাব-নিকাশের দিন তিনি আমার অপরাধসমূহ ক্ষমা করবেন। [সূরা শুআরা (২৬) : ৮২]

মূসা আলাইহিস সালামের মতো ইস্তিগফার করতে থাকবে-

رَبِّ اِنِّیْ ظَلَمْتُ نَفْسِیْ فَاغْفِرْ لِیْ فَغَفَرَ لَهٗ اِنَّهٗ هُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِیْمُ.

হে আমার প্রতিপালক! আমি নিজ সত্তার প্রতি জুলুম করেছি। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। সুতরাং আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিলেন। নিশ্চয়ই তিনি অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। [সূরা কাসাস (২৮) : ১৬]

তদ্রƒপ, যুন্নূন (ইউনুস) আলাইহিস সালাম যেভাবে দুআ ইউনুস পড়েছিলেন সেভাবে পড়তে থাকবে-

لَاۤ اِلٰهَ اِلَّاۤ اَنْتَ سُبْحٰنَكَ  اِنِّیْ كُنْتُ مِنَ الظّٰلِمِیْنَ.

(হে আল্লাহ!) তুমি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। তুমি সকল ত্রুটি থেকে পবিত্র। নিশ্চয়ই আমি অপরাধী। [সূরা আম্বিয়া (২১) : ৮৭]  -ফাযাইলুল আওকাত, বায়হাকী, পৃ. ৩০৬-৩০৭ (১৪৬)

ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়

মুসলিম পরস্পরে সাক্ষাৎ হলে একে-অপরকে সালাম দেবে- এটাই তো উত্তম আদর্শ। এরচেয়ে উত্তম আর কোনো অভিবাদন হতে পারে না। সালামের অর্থের দিকে তাকালেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। সালামের মাধ্যমে পরস্পরের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় কল্যাণের দুআ করা হয়।

السلام عليكم ورحمة الله وبركاته.

আপনাদের প্রতি বর্ষিত হোক সালাম ও শান্তি এবং বর্ষিত হোক আল্লাহর রহমত ও বরকত।

তাছাড়া সালামের রয়েছে আরো অনেক ফযীলত। যেমন, হাদীস শরীফে এসেছে, সালামের মাধ্যমে পরস্পরের মধ্যে মিল-মহব্বত পয়দা হয়, ঈমানের পূর্ণতা লাভ হয় এবং জান্নাতে দাখেল হওয়ার পথ সুগম হয়। (দ্রষ্টব্য : সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫১৯৩)

অতএব আমাদের জন্য শ্রেষ্ঠতম শুভেচ্ছা ও আদর্শ অভিনন্দন হল সালাম। এটাকে আমরা আঁকড়ে ধরব। সালামের বেশি বেশি প্রচলন ঘটাব, বিশেষ করে ঈদ ও অন্যান্য আনন্দের মুহূর্তগুলোতে।

সালামের পর আমরা একে-অপরের জন্য দুআ করতে পারি। ঈদের দিন সাক্ষাৎ হলে রাসূলের সাহাবীগণ যে শব্দ-বাক্যের মাধ্যমে একে-অপরের জন্য দুআ করতেন তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও শিক্ষণীয়। এতেই নিহীত আছে- মুসলিমের প্রকৃত ঈদ ও খুশি কী এবং কীসের মাধ্যমে ঈদ-আনন্দ পূর্ণতা লাভ করে এবং কীসে সফলতা ও কল্যাণ। আর তা হল, আল্লাহর কবুলিয়াত; তাঁর দরবারে আমাদের আমল কবুল হওয়া এবং তাঁর সন্তুষ্টি লাভ হওয়া। তাই তো সাহাবীগণ সবাই সবার জন্য এই কবুলিয়াতের দুআই করতেন। সাঈদ ইবনে জুবায়ের রাহ. বলেন-

كان أصحاب رسول الله صلى الله عليه وآله وسلم إذا التقوا يوم العيد يقول بعضهم لبعض : تَقَبّلَ اللهُ مِنّا وَمِنْكُمْ.

ঈদের দিন সাহাবায়ে কেরাম মিলিত হলে একে-অপরের উদ্দেশে বলতেন-

تَقَبّلَ اللهُ مِنّا وَمِنْكُمْ.

আল্লাহ কবুল করুন আমাদের থেকে এবং আপনাদের থেকে (সকল আমল)। -ফাতহুল বারী ২/৪৪৯; আলজাওহারুন্নাকী ৩/৩২০