বৃহস্পতিবার ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, মাঘ ২৩ ১৪৩১, ০৭ শা'বান ১৪৪৬

ব্রেকিং

গেট ভেঙে ধানমন্ডি-৩২ নম্বরের বাড়িতে ছাত্র-জনতা, ভাঙচুর বুলডোজার মিছিলের ডাক: ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে নিরাপত্তা জোরদার উত্তরাঞ্চলে পেট্রোল পাম্প বন্ধের কর্মসূচি প্রত্যাহার, তেল সরবরাহ শুরু জুলাই সনদ বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করবে ভোটের সময়: প্রেস সচিব সংস্কারের নামে ‘বেশি সময় নেওয়ার কৌশল’ জাতি মানবে না: বিএনপি দিল্লির আদলে ‘ক্যাপিটাল সিটি সরকার’ গঠনের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা ৪০ থেকে কমিয়ে ২৫টি করার সুপারিশ পুরনো চার বিভাগকে প্রদেশ করার সুপারিশ কারণে-অকারণে অবরোধ, ধৈর্যের সীমা শেষ করে দিচ্ছে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জনপ্রশাসন ও বিচারবিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ইউনূসের হাতে কল্যাণ কামনায় আখেরি মোনাজাতে শেষ হল বিশ্ব ইজতেমা সিআইএ’র সব কর্মীকে ‘আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে চাকরি ছাড়ার’ প্রস্তাব ‘আমাকে হত্যা করলে ইরানকে ধ্বংস করুন’: শেষ নির্দেশ ট্রাম্পের

ইসলাম

আহলে কুরআন সজল রোশানের ‘রিলিজিয়াস মাইন্ডসেট’ বই পর্যালোচনা! পর্ব-১

মুফতী লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

 প্রকাশিত: ০৬:০০, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪

আহলে কুরআন সজল রোশানের ‘রিলিজিয়াস মাইন্ডসেট’ বই পর্যালোচনা! পর্ব-১

অনলাইনের কল্যাণে যেমন যত্রতত্র বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা বাড়ছে। তেমনি ধর্ম সম্পর্কে অর্বাচিন গবেষকদেরও প্রাদুর্ভাব ঘটছে। কুরআন ও হাদীসের মৌলিক জ্ঞান না থাকলেও কুরআনের বাংলা অনুবাদ পড়েই বড় বড় জ্ঞানজ্ঞ সেজে বসছেন অনেকেই। বই লিখছেন জ্ঞানের সেই বহর জাতিকে জানাতে।

অনলাইনের কল্যাণে হাদীস অস্বিকারকারী একটি দলের প্রোপাগাণ্ডা ও প্রচারণা লক্ষ্যণীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। যাদেরকে মুনকিরীনে হাদীস বলা হয়। মুনকিরীনে হাদীস দল মূলত কাফের। হাদীস অস্বিকারকারী এসব কাফেরদের বক্তব্যে কিছু জনতুষ্টিবাদী শব্দ ও আকর্ষণ থাকে। থাকে কুরআনের বাহ্যিক অর্থের ছায়াও। ফলে অনেক সাধারণ মানুষ এসব লোকদের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়। ইসলাম থেকে বিচ্যুতও হয়ে যায় অনেক সময়।

এমনি এক মুনকিরীনে হাদীস হলো সজল রোশান। যার মোহনীয় উপস্থাপনা এবং শব্দের মারপ্যাঁচে অনেকেই বিভ্রান্ত হচ্ছেন। মানুষকে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস থেকে দূরে সরাতে তার কসরতের অন্ত নেই। বই লিখেছেন ‘রিলিজিয়াস মাইন্ডসেট’ নামে।

আমরা ধারাবাহিকভাবে তার ভ্রান্তিতা এবং তার যুক্তির নামে কুযুক্তির স্বরূপ উন্মোচন করবো ইনশাআল্লাহ।

শিরোনাম হল, আপনার ধর্মই আপনার আ্যাটিচিউড।

ভেতরে লিখেছেন: “আমার আপনার ধর্ম মানে আমাদের সহজাত বৈশিষ্ট্য। আমাদের স্বতস্ফুর্ত বিশ্বাস, ভাবনা বা আচরণ। এই সহজাত বৈশিষ্ট্যকেই ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয় আ্যাটিচিউড বা মানসিকতা। আপনার আ্যাটিচিউড মানে আপনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে যা করেন। [রিলিজিয়াস মাইন্ডসেট-১৩]

এখানে বলা হচ্ছে যে, ব্যক্তির আ্যাটিচিউড তথা আমরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে যা কিছু করি, স্বতস্ফুর্তভাবে যা বিশ্বাস করি ও আচরণ দেখাই সেটাই আমাদের ধর্ম।

এরপর আবার ‘আ্যাটিচিউড’ ব্যক্তি হিসেবে আলাদা হতে পারে এর প্রমাণ হিসেবে পজেটিভ আ্যাটিচিউড এবং নেগেটিভ অ্যাটিচিউড উদাহরণ দেয়া হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হল, যদি প্রতিটি ব্যক্তির স্বয়ংক্রিয় বা স্বতস্ফুর্ত মানসিকতার নাম তার ধর্ম হয়, তাহলে একজন ডাকাতের ধর্ম তার ডাকাতী?

নাস্তিকের ধর্ম তার নাস্তিকতা?

চোরের ধর্ম চুরি করা?

লম্পটের ধর্ম লাম্পট্যতা?

কারণ, ‘প্রতিটি ব্যক্তির মানসিকতা বা স্বতস্ফুর্ত মানসিকতা ভিন্ন’ একথা প্রমাণের জন্য কোন মহাজ্ঞানী হবার প্রয়োজন নেই। সজল সাহেব নিজেই প্রমাণ দিয়েছেন যে, মানসিকতা পজেটিভও হয়, আবার নেগেটিভও হয়। এর মানে পজেটিভ মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তির কাছে সেটাই তার ধর্ম। আর নেগেটিভ মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তির কাছে তার নেগেটিভিটিটাই তার ধর্ম?

যদি ব্যক্তির অ্যাটিচিউড বা মানসিকতার নাম তার ধর্ম হয়, যাদের মানসিকতা নেগেটিভ। যেমনটি  আপনি নিজেই উদাহরণ দিয়ে বলেছেন যে, কারো মাঝে পজেটিভ অ্যাটিচিউড থাকে, আবার কারো মাঝে নেগেটিভ আ্যাটিচিউড থাকে।

আর ধর্মের উপর আমল করাইতো ধার্মিকের কাজ। সেই হিসেবে নেগেটিভ মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তির উক্ত নেগেটিভ মানসিকতার ধর্মের উপরই কি আমল করা উচিত?

নাকি তার স্বতস্ফুর্ত মানসিকতা না থাকা সত্বেও সেই ধর্ম পরিবর্তন করা উচিত?

যদি পরিবর্তন করে, তাহলেতো সে আর ধার্মিক থাকবে না।

কারণ, নেগেটিভ মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তি যখন জোর করে পজেটিভ আচরণ করবে, সেটিতো আর তার ধর্ম নয়, বরং অধর্ম। কারণ, পজেটিভ আচরণ তার স্বয়ংক্রিয় আচরণ নয়, বরং জোরপূর্বক বা চাপিয়ে দেয়া আচরণ।

সেই হিসেবে যত নেগেটিভ মানসিকতার লোক পজেটিভ আচরণ করবে, তারা সবাই ধর্মহীন। ধর্মবিরোধী। তার  ধর্ম বিষয়ে নাফরমান?

উক্ত পৃষ্ঠার শেষ দিকে তিনি লিখেন:

“আমাদের ধর্ম হচ্ছে আমাদের আ্যাটিচিউড বা আমাদের স্বতস্ফুর্ত আচরণের বহিঃপ্রকাশ। আমি যখন বলব আমার ধর্ম হচ্ছে ইসলাম তো আমার আচার আচরণ, বিশ্বাস, ভাবনায় স্বতস্ফুর্তভাবে ইসলামি বিধি-নিষেধ ফুটে উঠবে। যার ধর্ম হিন্দু তার সহজাত বৈশিষ্ট্যে বেদ বা গীতার শিক্ষা স্পষ্ট থাকতে হবে। খ্রিষ্টান মানে তার চরিত্রে বাইবেলের প্রতিফলন থাকবে।

কিন্তু আমরা কতজন আমাদের নিজ নিজ ধর্মের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ? [রিলিজিয়াস মাইন্ডসেট-১৩-১৪]

আগে বলা হল, আমরা স্বতস্ফুর্তভাবে যা করি সেটার নাম ধর্ম।

আর এখানে বলা হচ্ছে, আমাদের ধর্ম স্বতস্ফুর্ত আচরণের বহিঃপ্রকাশ।

দুটির অর্থ একই দাঁড়ায়। সেটি হল, আমরা স্বতস্ফুর্ত ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে যে বিশ্বাস ও আচরণের মানসিকতা পোষণ করবো সেটাই আমার ধর্ম।

তাহলে এটা কেন বলা হচ্ছে যে, কারো ধর্ম ইসলাম হলে তার ভাবনায় স্বতস্ফুর্তভাবে ইসলামি বিধি-নিষেধ ফুটে উঠতে হবে?

যদি কারো মাঝে স্বতস্ফুর্তভাবে ইসলামী বিধিনিষেধ না থাকে, তাহলেতো সেটা তার ধর্মই হয়নি।

যেহেতু ইসলাম তার ধর্মই হয়নি। তাহলে তার মাঝে সেই ধর্মের রীতিনীতি থাকতে হবে কেন?

আর যদি বলেন। না তার ধর্ম ইসলাম। তাহলে আপনার ধর্মের সংজ্ঞা অনুপাতে ইসলামের রীতিনীতি তার মাঝে স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্বতস্ফুর্ত বিশ্বাস ও আচরণে বিদ্যমান।

যেহেতু স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইসলামের বিশ্বাস, আচরণ বিদ্যমান আছে, তাহলে এমন প্রশ্নই অবান্তর যে ধর্মের অনুসারী তার ধর্মের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ নয়।

এর মানে হয়তো, আপনার ধর্মের সংজ্ঞাই ভুল কিংবা আপনার উদাহরণ ভুল। নাকি দু’টিই ভুল?

আগের বক্তব্য ছিল স্বতস্ফুর্ত মানসিকতার নাম ধর্ম। এবার বলা হচ্ছে যে, ইসলাম ধর্মের অনুসারীর জন্য স্বতস্ফুর্তভাবে ইসলামী রীতিনীতি ফুটে উঠতে হবে। নতুবা এটা তার ধর্ম পালন হবে না।

তাহলে প্রশ্ন হল, যদি  স্বতস্ফুর্ত মানসিকতার নাম ধর্ম হয়, তাহলে তার জন্য আবার স্বতস্ফুর্তভাবে নির্দিষ্ট রীতিনীতি মানতে হবে কেন?

আমরা আগে জেনেছি যে, স্বতস্ফুর্ত কোন কিছু করাই হল ধর্ম। তাহলে ইসলামের জন্য যদি রীতিনীতি স্বতস্ফুর্তভাবে পালন করতে হয়, তাহলে রীতিনীতিগুলো ইসলাম ধর্মের একটি ধর্ম হিসেবে সাব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে।

তাহলে কি ধর্মেরও একটি ধর্ম আছে?

যেহেতু সজল সাহেব কুরআনকে মানেন। কুরআনকেই একমাত্র দলীল ও পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান বিশ্বাস করেন।

এখন আমাদের জানার বিষয় হল, স্বয়ংক্রিয় মানসিকতার নাম ধর্ম। এমন আজগুবি থিউরীটা কুরআনের কোন আয়াতের অনুবাদ?

নাকি আপনার নিজস্ব থিউরী দিয়ে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা করে ধর্মের দৈত্যে পরিণত হয়েছেন?

সঠিক কথা!

“ধর্ম” শব্দের একটি শাব্দিক অর্থ। আরেকটি হল, তার পারিভাষিক অর্থ। শাব্দিক অর্থ সর্বদা শব্দের মূল উদ্দেশ্য হয় না। কখনো কখনো পারিভাষিক অর্থটাই মূল ধরা হয়।

যেমন ‘গাছে কাঠাল গোঁফে তেল”। এর মানে কি? আসলে শাব্দিক অর্থ হিসেবে এর কোন অর্থবহ অর্থ হয় না।

কিন্তু বাগধারা হিসেবে এর কিন্তু পারিভাষিক একটি সুন্দর অর্থ আছে। সেটা হল, প্রাপ্তির আগেই ভোগের আয়োজন। অর্থাৎ কোন কিছু পাওয়ার আগেই তা ভোগ করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ।

আমাদের গ্রামের মানুষ ডালকে অশুদ্ধ ভাষায় বলে ডাইল। “ডাইল” শব্দটির শাব্দিক অর্থ কিন্তু ডাল।

কিন্তু মদ্যপদের কাছে তাদের মদের আড্ডায় কিন্তু “ডাইল” মানে ডাল নয়। বরং তাদের পরিভাষায় “ডাইল” মানে “ফেন্সিডিল”।

এখন ‘ডাইল’ শব্দের শাব্দিক অর্থ যদি আপনি মদ্যপদের ‘ডাইল’ খাওয়ার সেখানেও প্রয়োগ করে বিশাল ফিরিস্তি লিখে ফেলেন, তাহলে আপনার জ্ঞান প্রকাশ পাবে না, বরং আপনি হাসির পাত্র হবেন।

আরবীতে এর ভুরি ভুরি উদাহরণ দেয়া যাবে। যেমন হজ্জ্ব। শাব্দিক অর্থ ইচ্ছে করা। কিন্তু ইচ্ছে করা অর্থ দিয়ে হজ্জ্বের মৌলিকত্ব কিছুতেই বুঝে আসবে না। বরং তার পারিভাষিক অর্থটাই হল মূল।

তেমনি বাংলা  ভাষার শব্দ ‘ধর্ম’। যার শাব্দিক অর্থ হল, ‘কোন কিছুর বৈশিষ্ট্য’। সেই বৈশিষ্ট্যটাই উক্ত বস্তুটির ধর্ম।

কিন্তু এই শাব্দিক অর্থ দিয়ে পারিভাষিক ধর্মকে মূল্যায়ন করা আহমকী বৈ আর কী?

আসলে পারিভাষিক অর্থে ধর্ম কোন স্বয়ংক্রিয় মানসিকতার নাম নয়। বরং স্রষ্টা কর্তৃক নির্দেশিত পথে চলার নাম হল ধর্ম। আর ইসলাম ধর্মের পারিভাষিক অর্থ হল, আল্লাহ তাআলা ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশ ও নিষেধ মান্য করার নাম।

নিজের স্বতস্ফুর্ত মানসিকতা পালন করার নাম ধর্ম বলা ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতা কিংবা ইচ্ছেকৃত বিভ্রান্তি ছড়ানো বৈ কিছু নয়।

هُوَ الْحَيُّ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ فَادْعُوهُ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ ۗ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ [٤٠:٦٥]

তিনি চিরঞ্জীব, তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। অতএব, তাঁকে ডাক তাঁর খাঁটি ধর্মের মাধ্যমে। সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজগতের পালনকর্তা আল্লাহর। [সূরা গাফির-৬৫]

فَادْعُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ [٤٠:١٤]

অতএব, তোমরা আল্লাহকে খাঁটি ধর্ম বিশ্বাস সহকারে ডাক, যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে। [সূরা গাফির-১৪]

সুতরাং বুঝা গেল স্বঘোষিত পণ্ডিত সজল রোশান ধর্মের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তা তার মনগড়া ও বানোয়াট। এর সাথে সত্যিকার ধর্মের কোন সম্পর্কই নেই।

মুসলিম বাংলা