একটি নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার সন্ধানে — ভবিষ্যতের বাংলাদেশের শাসন, নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন।

একটি নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার সন্ধানে—অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান।
বাংলাদেশের ইতিহাস, সমাজ ও রাজনীতির প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান বহু নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। রাষ্ট্র পরিচালনা, শাসনব্যবস্থা ও রাজনৈতিক ধারা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমাধানের চেষ্টা করছে। এই প্রেক্ষাপটে সংস্কার, নির্বাচন এবং ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক রূপরেখা নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান। এটি তাঁর দুই পর্বের লেখার শেষ অংশ।
আন্দোলন থেকে দল গঠন পর্যন্ত
১৯৯১ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর ২০০৯ সাল পর্যন্ত সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই দুবার করে ক্ষমতায় আসে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, এই সময়কালে তারা গণতান্ত্রিক চর্চাকে দৃঢ় করতে ব্যর্থ হয়। বরং, উভয় দল তাদের ক্ষমতা সংহত করতে এবং বিজয়ীর জন্য সবকিছু নিশ্চিত করতে ব্যস্ত ছিল।
বিএনপির মধ্যে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, দখলদারি এবং চাঁদাবাজির মতো অভিযোগ ব্যাপক আকার ধারণ করে। দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে অনেককে বহিষ্কার করেও এসব বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বিএনপি বৃহত্তম দল হিসেবে উঠে আসে। তাদের নেতাদের গণতন্ত্র নিয়ে বক্তব্য জনসাধারণের মধ্যে সমাদৃত হয়। কিন্তু মাঠপর্যায়ে ক্ষমতার শূন্যতা পূরণ করতে গিয়ে বিএনপির অনেক কর্মী পুরোনো অপসংস্কৃতিতে ফিরে গেছেন। এই অবস্থায় দলের নেতৃত্বকে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ আমলে নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
নতুন নেতৃত্বের সূচনা
অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে শুরু হওয়া সংস্কার উদ্যোগ শিক্ষার্থীদের কাছে ইতিবাচকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়। অনেক শিক্ষার্থী সক্রিয়ভাবে এতে যুক্ত হয় এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে। এটি তরুণ নেতৃত্বের নতুন রাজনৈতিক সম্ভাবনার সূচনা হিসেবে দেখা যাচ্ছে।
একই সঙ্গে, ক্ষমতাচ্যুত সরকারের বিরোধিতায় ঐক্যবদ্ধ শক্তিগুলোর ভেতর থেকেও তরুণদের দৃঢ় ভূমিকা সামনে এসেছে। বিশেষত ছাত্রদের আগ্রাসী অংশগ্রহণ, তাদের সমাজ পরিবর্তনের প্রণোদনা এবং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দাবি মানুষের মধ্যে সাড়া জাগায়।
এনসিপির চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
এনসিপি ইতিহাসের বিতর্কে জড়িয়ে না পড়ে নিজেদের ভবিষ্যতমুখী দল হিসেবে উপস্থাপন করলেই সফল হতে পারে। যদিও কিছু নেতা সংবিধান পুনর্লিখন ও দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র ঘোষণার মতো উচ্চকিত বক্তব্য দিয়েছেন, তবুও মূল নীতিগত দিকগুলো দেশের সংবিধানে ইতিমধ্যেই বিদ্যমান।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে একটি বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির প্রয়োজন ছিল, যা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বিপক্ষীয় আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। এনসিপি সেই সম্ভাবনার এক প্রতিচ্ছবি। তবে তাদের উচিত হবে অতীত ইতিহাসে ডুবে না গিয়ে ভবিষ্যতের একটি ন্যায্য ও সমতা-ভিত্তিক রাজনীতির প্রতিশ্রুতি দেওয়া।
নেতৃত্ব ও দায়িত্ব
৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর ছাত্র আন্দোলনের গতি কিছুটা ম্লান হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে অনেকেই এখনো এনসিপিতে যোগ দিতে দ্বিধায় আছে। রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা শিক্ষার্থীদের জন্য চিরস্থায়ী নয়—তারা মূলত পড়াশোনা ও কর্মসংস্থান নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তাই এনসিপির জন্য দরকার হবে একটি সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি, কার্যকর কর্মসূচি এবং সংগঠিত নেতৃত্ব।
তাদের আরও প্রয়োজন স্বচ্ছ রাজনৈতিক তহবিল, যাতে তারা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হতে পারে এবং অন্য দলগুলোর জন্য একটি ইতিবাচক উদাহরণ স্থাপন করতে পারে।
সংস্কার না নির্বাচন?
অধ্যাপক ইউনূসের দৃষ্টিতে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন একটি বড় লক্ষ্য হলেও, প্রকৃত পরিবর্তন আনতে হলে দরকার প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। এজন্য তিনি সংবিধান, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন, গণমাধ্যমসহ নানা ক্ষেত্রে টাস্কফোর্স গঠন করেছেন। তবে এই প্রক্রিয়ায় তরুণ, নারী ও সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব সীমিত ছিল।
সংস্কার কার্যকর করতে রাজনৈতিক ঐকমত্য অপরিহার্য। এজন্য গঠিত হয়েছে ‘ঐকমত্য কমিশন’, যা বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাব একত্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে উপস্থাপন করছে। তবে এই উদ্যোগে অধ্যাপক ইউনূস বা অন্তর্বর্তী সরকার সরাসরি যুক্ত না থাকায় এটি কেবল বিশেষজ্ঞদের মতামতের সমষ্টি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিটি রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে যেমন সম্ভাবনা থাকে, তেমনি থাকে দায়িত্বও। এখন দেখার বিষয়—নতুন রাজনৈতিক শক্তি কতটা কার্যকরভাবে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে পারে এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা কীভাবে গড়ে ওঠে।