সংস্কারের নামে ‘বেশি সময় নেওয়ার কৌশল’ জাতি মানবে না: বিএনপি
দে বাস্তবায়ন করা দরকার, আপনারা সেটা চিহ্নিত করুন এবং সকল মহলের সাথে, রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করুন এবং সেটার আইনি সংস্কার করুন। আইনি সংস্কারের পর যদি প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করার দরকার হয় সেটা করবেন … এর জন্য কত সময় লাগবে আমরা জানি।”
বিএনপি যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন চেয়ে এলেও অন্তবর্তী সরকারের উপদেষ্টা এবং জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা আগে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ সারার ওপর জোর দিচ্ছেন।
আগামী নির্বাচন কবে হবে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট তারিখ এখনো ঘোষণা করা হয়। তবে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সংস্কার কতটা করে ভোটে যাওয়া হবে তার ওপর নির্ভর করে ২০২৫ সালের শেষ অথবা ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে হতে পারে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন।
তবে বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন আহমেদ মনে করেন, নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য এত সময়ের প্রয়োজন নেই।
“বর্তমানে নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা প্রণয়নের কাজ প্রায় সমাপ্ত করে এনেছে। আমাদের কাছে তালিকা আছে। মার্চের ২ তারিখের মধ্যে একটা পরিষ্কার ভোটার তালিকা প্রণয়ন হয়ে যাবে।
“এরপর শুনানি আপত্তি চলবে সেটা ধারাবাহিক প্রসেস এবং সেটাও মাস দুয়েকের ভেতরে হয়ে যাবে। সেই প্রজ্ঞাপনও আমরা পেয়েছি নির্বাচন কমিশন থেকে। ডিলিমিটেশন সময়মত হবে এবং অন্যান্য নির্বাচনী কার্য্ক্রম যেগুলো আছে আইনি সংস্কার ছাড়া সেগুলো খুব বেশি সময় নেওয়ার কথা নয়। সুতরাং বেশি সময় নেওয়ার জন্য আপনারা কোনো কৌশল অবলম্বন করলে জাতি সেটা মেনে নেবে না।”
অন্তবর্তীকালীন সরকারের উদ্দেশে সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “আপনারা সংসদ নির্বাচন দিতে দেরি করলে জনগণের সামনে তার যৌক্তিকতা তুলে ধরবেন। আপনারা কি যৌক্তিকতা তুলে ধরেছেন? আপনারা কি আমাদের বক্তব্য কানে তোলেন?
“এখনো সময় আছে, আমি মনে করি আপনারা সবার সাথে আলোচনা করে একটি নির্বাচনী রোডম্যাপ প্রদান করুন এবং সেই নির্বাচনী রোডম্যাপ যদি যৌক্তিক মনে হয়, তা জনগণ মেনে নেবে।”
‘সংস্কারের শ্লথ গতি’
বুধবার বিচার বিভাগ ও প্রশাসনিক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তরের প্রসঙ্গ টেনে সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, ৩১ জানুয়ারির মধ্যে সংস্কারের সকল রিপোর্ট জমা হবে। জানুয়ারিতে আলোচনা হবে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে এবং যারা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির প্রতিনিধিতত্ব করেন সামাজিক শক্তিগুলোর সাথে। জানুয়ারি পার হয়ে গেল, আজকে ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখ। এখন বলছেন মধ্য ফেব্রুয়ারিতে আলোচনার জন্য তারা প্রস্তুত হবেন। তারপরে কতদিন আলোচনা করবেন জানি না।
“আবার আজকে পত্রিকায় দেখলাম, কালকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, শেখ হাসিনা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করছে। তো শেখ হাসিনার দোসররা তো আপনার উপদেষ্টা পরিষদেও অন্তর্ভুক্ত আছে। আমরা পরামর্শ দিয়েছিলাম আপনি তাদেরকে বাদ দেন নাই। শেখ হাসিনার দোসররা প্রশাসনে আছে, সর্বোচ্চ পর্যায়ে আাছে। আমরা বলেছিলাম ফ্যাসিবাদের দোসরদের বহাল রেখে আপনি বেশি দূরে যেতে পারবে না। আপনি কিছু কিছু শুনেছেন। মনে হয়েছে এত শ্লথ গতি, যে আপনি কি সংস্কার করবেন আমাদের বোধগম্য নয়।’’
সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “বিচার বিভাগ সংস্কারের প্রতিবেদনে কি আসছে আমি জানি না। তবে এই সমস্ত নিশিরাতের বিচারকদের বহাল রেখে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে চূড়ান্তভাবে স্বাধীন করা যাবে কিনা, রাখা উচিত হবে কিনা, আমার সন্দেহ আছে। সরিষার ভেতরে ভূত রেখে কখনো মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা আপনি সফল হতে পারবেন না।”
প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশে তিনি বলেন, “সুতরাং বিচার ব্যবস্থা হোক, প্রশাসন হোক, নির্বাচনী ব্যবস্থা হোক সর্বত্র ফ্যাসিবাদের দোসরদের আপনাকে ক্লিন করতে হবে, পরিষ্কার করতে হবে এবং একটি গণতান্ত্রিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে আমরা যে সাংবিধানিক রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চাই, সেই সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেন প্রথম নির্বাচনমুখী সংস্কারের।”
২০২৩ সালে বিএনপি যে ৩১ দফা দিয়েছিল, সেই প্রসঙ্গ ধরে দলটির এই নেতা বলেন, “আমরা মূলনীতিগুলো ৩১ দফা উদ্ধৃত করেছি। সংস্কার কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে পরবর্তীতে নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার জনগণের কাছে যাবে এবং জনগণের চাহিদা অনুযায়ী এই সংস্কার প্রস্তাবগুলো গঠন করবে এবং জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে সেই সংস্কারগুলো গ্রহীত হবে এবং সেটা বাস্তবায়ন হবে তাহলেই জাতির মঙ্গল।”
‘দ্বি-চারিতা’
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “আপনারা আওয়ামী লীগকে কোনো কর্মসূচি করার জন্য রাজপথে নামতে দেবেন না। মানি, সমর্থন করি। কিন্তু এভাবে আওয়ামী লীগকে আপনি কয়দিন রাজপথে পুলিশ দিয়ে ঠেকাবেন। আপনারা বলবেন, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আমরা চাই না, আওয়ামী লীগ এদেশে রাজনীতি করতে পারবে না। কিন্তু কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন? আইনি কোনো পদক্ষেপ এই সরকার নিয়েছে? না।
“আমরা বলেছিলাম সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদ অনুসারে রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য বিচারের ব্যবস্থা করা হোক এবং সেই নিরিখে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধন করার আমরা দাবি জানিয়েছিলাম, জনগন দাবি করেছে।
“এই সরকার অধ্যাদেশ ও আইন সংশোধনের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, হঠাৎ করে তারা কেবিনেট মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নিল, এটা করা যাবে না। কেন? একদিকে চাইবেন আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ হোক, আবার তাদের বিচার করবেন না, আবার পুলিশ দিয়ে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে আপনারা বাধা দেবেন– এতো স্ববিরোধিতা ঠিক নয়।”
সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে, ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে এদেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখান করেছে, আওয়ামী ফ্যাসিবাদের রাজনীতিকে প্রত্যাখান করেছে, তাদেরকে বিতাড়ন করেছে। সেই আওয়ামী লীগ ‘আওয়ামী লীগ’ নামে রাজনীতি করতে পারবে না… এই আওয়াজ আমরা উঠাচ্ছি। আমরা আওয়ামী লীগের গণহত্যার এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে বিচার দাবি করছি।
“বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নির্ধারণ হোক বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে পারবে কিনা নির্বাচন করতে পারবে কিনা। সংবিধানে বিধান সংযুক্ত আছে, সে অনুযায়ী আপনারা আইন প্রণয়ন করুন। কাউকে কাউকে বলতে শোনা যাচ্ছে, মানবতাবিরোধী অপরাধ আদালতে যাদের বিচার হচ্ছে, সেই বিচারে হয়ত অবজারবেশন আসবে আওয়ামী লীগের রাজনীতি সম্পর্কে। সেটা অত্যন্ত দুর্বল অবজারবেশন। তখনও আপনাদেরকে (অন্তবর্তীকালীন সরকার) প্রশাসনিক আদেশ দিতে হবে, তখনও আপনাদেরকে আইন প্রণয়ন করতে হবে সেই অবজারবেশনের নিরিখে।
“কিন্তু এখন যদি আপনারা সোচ্চার হন, বিচারের জন্য বাংলাদেশের মানুষ চায় বাংলাদেশ থেকে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদ রাজনীতির একদম নির্মূল হয়ে যাক, সেই ব্যবস্থা আপনারা নিতে পারেন। বিচার বিভাগের সংস্কারের রিপোর্টে সেই বিষয়গুলো আসবে কিনা আমি জানি না।”
জাতীয় প্রেসক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলের আঞ্চলিক সম্পাদক পরিষদের উদ্যোগে ‘জাতীয় ঐক্য ও বর্তমান বাস্তবতা’ শীর্ষক এই আলোচনা সভা হয়।
সংগঠনের সভাপতি খালেদ সাইফুল্লাহ সোহেল খানের সভাপতিত্বে ও যুগ্ম সম্পাদক সেলিম পারভেজের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক এরফানুল হক নাহিদসহ আঞ্চলিক সম্পাদক পরিষদের নেতৃবৃন্দ বক্তব্য দেন।