জুলাই ঘোষণাপত্র তৈরিতে ‘তাড়াহুড়ো’ চায় না দলগুলো
জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করতে গিয়ে ‘তাড়াহুড়ো’ ও ’যেনতেন’ প্রক্রিয়ায় যাতে তা করা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে সর্বদলীয় বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোর দিক থেকে পরামর্শ এসেছে।
ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে জুলাই-অগাস্টের গণ আন্দোলন নিয়ে এ ঘোষণাপত্র তৈরির দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারকে দলগুলোর প্রতিনিধিরা ঐকমত্যের ভিত্তিতে তা প্রণয়নের তাগিদও দিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সর্বদলীয় এ বৈঠক থেকে বেরিয়ে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি এমনটিই বলেছেন।
তবে ঘোষণাপত্র প্রকাশের দাবি তোলা জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী এ নিয়ে মতামত নিতে গিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সময়ক্ষেপণের বিষয়ে লক্ষ রাখতে বলেছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল বলেন, “যদিও আমরা ১৫ জানুয়ারি মধ্যে ঘোষণাপত্র জারি করতে পারবেন বলে আশা করেছিলাম। সরকারকে সেভাবে তড়িৎ পদক্ষেপ নিতে দেখি নাই। তারপরও তারা যে উদ্যোগ গ্রহণ করছে তার জন্য সাধুবাদ জানিয়েছি।
“গণঅভ্যুত্থানের অংশীজন মিলে আমরা ঐক্যমতে পৌছাতে পেরেছি। গণঅভ্যুত্থানের অংশীজন ও সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের ঐক্যমতের ভিত্তিতে জুলাই ঘোষণাপত্র জারি করা হবে, এটা এখন নিশ্চিত। পরবর্তী ধাপে আলোচনা করব জুলাই ঘোষণাপত্রে কী কী থাকবে, যা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে রাজপথে নেমে আসা ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হবে।”
এদিন বিকাল সোয়া ৪টায় এ বৈঠক ডেকেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস, যাতে বিএনপিসহ ১৬টি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের ২৭ জন প্রতিনিধি অংশ নেন।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং নতুন প্ল্যাটফর্ম জাতীয় নাগরিক কমিটি নিজেরাই জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়ার ঘোষণা দিলে অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়ে উদ্যোগী হয়। এর অংশ হিসেবে এ বৈঠক ডাকে সরকার।
নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, গণসংহতি আন্দোলন, এবি পার্টি, খেলাফত আন্দোলন, জেএসডি, খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, গণঅধিকার পরিষদ, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি ও গণ ফ্রন্টের প্রতিনিধিরা বৈঠকে ছিলেন।
আরও ছিলেন রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, নেজামে ইসলামী, বাসদ (মার্কসবাদী), জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিরা।
বৈঠকের শুরুতে বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টা। সেখানে দলগুলোর কাছে পাঠানো ঘোষণাপত্রের খসড়া নিয়ে আলোচনা হয়। দলগুলোর প্রতিনিধিরা তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন। সন্ধ্যা ৬টার দিকে বৈঠক শেষ হয়।
বৈঠক থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা এবং আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
বৈঠক শেষে গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, “আমরা বলেছি, এটা যেন তাড়াহুড়ো করে, যেনতেন প্রক্রিয়ায় না করা হয়। ঘোষণাপত্র তৈরির জন্য সরকারের দিক থেকে এই উদ্যোগটা নেওয়া দরকার।
“এটা কী হবে? এটার আইনের দিক কী? রাজনৈতিক দিকগুলো কী? এ প্রশ্নগুলো সকলের ঐকমত্যের জায়গা থেকে ঐকমত্য হতে হবে৷”
প্রথমেই এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটি ড্রাফ কমিটি করার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “ড্রাফট কমিটি ড্যাফটিংয়ের দায়িত্বের জায়গায় থাকবেন। শিক্ষার্থী রাজনৈতিক দলসহ সকল অংশীজনদের মতামতকে যুক্ত করে প্রয়োজনীয় সময় নিয়ে দলিলটি তৈরি করতে হবে৷ একটা ভবিষ্যতের দলিল।
“এটা আমাদের রাজনৈতিক সূত্র হিসাবে সব সময় কাজে লাগবে। সেইভাবে যাতে তৈরি করা হয়।”
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, “একটা কথা মোটা দাগে বলতে পারি, প্রত্যেকটি দল একটা ঘোষণাপত্র হওয়া প্রয়োজন সেটা অনুভব করেছে। তবে তাড়াহুড়ো করলে ৫ অগাস্টে গণঅভ্যুত্থানের মূল চেতনাকে ধারণ করে ঘোষণাপত্র তৈরিতে ভুলভ্রান্তি হতে পারে। সময় নিতে হবে।
“রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের সাথে মতবিনিময় করতে হবে। জুলাই অভ্যুত্থানের জনআকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে, অভ্যুত্থানের ইতিহাস, সংগ্রামের ইতিহাস, স্বাধীনতার পূর্বাপর ইতিহাসসহ সবকিছু মিলিয়ে একটা সুলিখিত ঘোষণাপত্র কীভাবে তৈরি করা যায় সে আলোচনা হয়েছে।
দলগুলোর আলাদা করে প্রস্তাব দেওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “পরবর্তীতে সবগুলোকে একত্র করে একটি সুন্দর ঘোষণাপত্রে রূপান্তরিত করা হবে।”
তার ভাষ্য, “খুব বিলম্ব করে অন্য কোনো অরাজকতা, অন্য কোনো ষড়যন্ত্রের সুযোগ যারা চক্রান্তের জন্য অপেক্ষা করে তারা যেন না পায়। দেরি না করে এই উদ্যোগ দ্রুত শুরু করা উচিত। সরকারের একজন উপদেষ্টা দায়িত্ব নিয়ে বলেছেন, উনারা আমাদের মতামতগুলো পর্যালোচনা করবেন।
“একটা হোমওয়ার্ক করার পরে আমাদের সাথে দ্বিতীয় ধাপে আমাদের সাথে আবার বসবেন।”
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন বলেন, “সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে কিছু পর্যালোচনাসহ প্রকাশ হবে। এরমধ্যে কিছু দৃষ্টিভঙ্গিগত ও শাব্দিক চয়নে সকলের আলোচনার প্রয়োজন। সেটার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো প্রধান উপদেষ্টার কাছে সময় চেয়েছেন।
“তিনি দলগুলোর সময়ক্ষেপনের বিষয়ে লক্ষ রাখতে বলেছেন, যাতে কালবিলম্বও না হয়, আবার যেন দ্রুতগতিতেও না হয়ে মাঝামাঝি সময়ে ঐক্যমতে পৌঁছে সুন্দর একটি জিনিস প্রকাশ করতে পারি সে বিষয়ে সবাই ঐক্যমত হয়েছি।”
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পথে উত্তরণ হতে এ দলিল ছাড়া সম্ভব নয় বলেও মনে করেন তিনি।
হেফাজতে ইসলামের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব জুনাইদ আল হাবিব বলেন, “ঘোষণাপত্রের জন্য আমরা একটা কথা বলে এসেছি, অনেকগুলো বিষয় যেহেতু এখানে উল্লেখ করা হয়েছে কিন্তু সেই জায়গায় ২০১৩ সালের শাপলা চত্ত্বরের গণহত্যাকেও সেখানে সংযোগ করতে হবে। সে কথাটা আমরা বলে এসেছি।”
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, ঘোষণাপত্র তৈরিতে সংবিধান সংস্কার কমিশন বা অন্য কোনো কমিটি বা কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়ার পরামর্শ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে এসেছে।