খালেদা গেলেন, তারেক ফিরবেন কবে
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার লন্ডনযাত্রার মধ্যে দুটি প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসছে চায়ের আড্ডা আর রাজনীতির আলোচনায়; সাধারণ মানুষের পাশাপাশি প্রশ্ন আছে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যেও।
আওয়ামী লীগের শাসন অবসানের পর থেকেই বিএনপি নেতাকর্মীদের অনেকে তাদের লন্ডনপ্রবাসী নেতার ফেরার প্রত্যাশায় দিন গুনছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কবে দেশে ফিরবেন, সেই প্রশ্নের উত্তর তারা এখনো পাননি।
১৫ বছর দোর্দণ্ড প্রতাপে দেশ শাসন করা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা গণ অভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছাড়ার পর এখন আছেন ভারতে। তার আমলে যাকে দুর্নীতি মামলায় জেলে পাঠানো হয়েছিল, সেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া অবশেষে পুরোপুরি মুক্তি পেয়েছেন। চিকিৎসার জন্য তিনিও মঙ্গলবার লন্ডনে চলে গেলেন।
আর সেখান থেকেই দ্বিতীয় প্রশ্নের উৎপত্তি। সোশাল মিডিয়ায় বলাবলি হচ্ছে, দেড় দশক আগের সেই ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলার বাস্তবায়ন কি হয়েই গেল?
দেশের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি নিয়ে অস্বস্তি থাকলেও বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা এখনকার পরিস্থিতিতে ‘ওয়ান-ইলেভেনের’ সেই পরিস্থিতির সঙ্গে মেলাতে চান না। তবে তারেক কবে ফিরবেন, সেই প্রশ্নের কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তরও তারা দিতে পারছেন না।
গত সোমবার লন্ডন থেকে দেশে ফিরে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়েন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ৷
জবাবে তিনি বলেন, “বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অবশ্যই দেশে ফিরবেন৷ তবে তারেক রহমানের দেশে ফেরার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ আমরা এখনো সৃষ্টি করতে পারিনি৷ সে জন্য অল্প কিছু সময় লাগবে৷”
২০০৭-০৮ সালের সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে খালেদা জিয়ার মত তার বড় ছেলে তারেক রহমানকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি পরিবার নিয়ে লন্ডনে চলে যান, দেশে আর ফেরেননি।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে নয়া পল্টনে বিএনপির সমাবেশে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বক্তব্য দেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান
গত ১৭ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে নয়া পল্টনে বিএনপির সমাবেশে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বক্তব্য দেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে যেদিন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হল, সেদিনই বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে তারেককে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এরপর গত সাত বছর ধরে লন্ডন থেকে ভিডিও কলেই তিনি দল চালাচ্ছেন। আর দেশে ঝড়-ঝাপটা সামলে বিএনপিকে টিকিয়ে রেখেছেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল আলমগীরসহ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা।
২০২০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার খালেদা জিয়াকে নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তি দেয়। কিন্তু দুই শর্তের কারণে তিনি কার্যত বন্দি ছিলেন বাসা আর হাসপাতালের জীবনে। রাজনৈতিক কোনো কর্মকাণ্ডে তাকে আর দেখা যায়নি।
৫ অগাস্ট ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর রাষ্ট্রপতি সাজা মওকুফ করে খালেদা জিয়াকে পুরোপুরি মুক্তি দেন। কিন্তু ৭৯ বছর বয়সে নানা অসুস্থতা নিয়ে দলের কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তার সরাসরি অংশ নেওয়া হয়নি। শিগগিরই তিনি সুস্থ হয়ে রাজনীতিতে ফিরতে পারবেন, তেমন সম্ভাবনাও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দেখছেন না।
আওয়ামী লীগের সময়ে বার বার আবেদন করেও চিকিৎসার জন্য খালেদাকে বিদেশে নেওয়ার সুযোগ পাননি পরিবারের সদস্যরা। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর সেই বাধা কাটে। কিন্তু তারপরও তার বিদেশযাত্রায় পাঁচ মাস লেগে গেল কেন, সেই প্রশ্ন আসতে থাকে রাজনীতির অঙ্গনে।
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান গত ২ জানুয়ারি রাতে গুলশানের বাসায় গিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেন। আধা ঘণ্টার বেশি সময় তিনি সেখানে ছিলেন।
চিকিৎসার খোঁজ খবর নেওয়া ছাড়া ওই বৈঠকে আর কী আলোচনা হয়েছি, সে বিষয়ে বিএনপি বা সেনা সদরের তরফে কিছু জানানো হয়নি। তবে কেউ কেউ ধারণা করতে শুরু করেন, চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার পর খালেদা জিয়া আবার দেশে ফিরতে পারবেন– ‘সেই নিশ্চয়তাই’ হয়ত দিতে গিয়েছিলেন সেনাপ্রধান।
চিকিৎসার জন্য মঙ্গলবার রাতে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
চিকিৎসার জন্য মঙ্গলবার রাতে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
বিএনপি কর্মীরা অপেক্ষায়
তারেক রহমান ২০০৮ সালে লন্ডনে চলে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের সময়ে তার অনুপস্থিতিতে পাঁচ মামলায় তাকে সাজা দেওয়া হয়। দায়ের করা হয় শতাধিক মামলা। আদালতের চোখে তিনি হয়ে যান পলাতক আসামি। এমনকি তার বক্তব্য বিবৃতি প্রচারেও নিষেধাজ্ঞা আসে।
এর মধ্যে পাসপোর্টের মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ায় তারেককে যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে হয়। ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু আর মায়ের কারাগারে যাওয়ার মত দুঃসময়েও তার দেশে ফেরা হয়নি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর বিএনপির তৃণমূলের কর্মীদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়; তারা ভাবতে শুরু করেন, এবার হয়ত দেশে ফিরবেন তারেক রহমান।
নেতারাও বলা শুরু করেন, শিগগিরই তারেক দেশে ফিরবেন ‘বীরের বেশে’। কিন্তু সেই আলোচনাও পরে থিতিয়ে যায়। এরপর নেতারা বলতে শুরু করেন, মামলা-মোকাদ্দমা প্রত্যাহার করার পর দেশে ফিরবেন তাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
এখন দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও যখন লন্ডনে ছেলের কাছে চলে গেলেন, বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকে বলতে শুরু করেছেন, নির্বাচনের ‘রোডম্যাপ ঘোষণার পর’ তারেক রহমানের দেশে আসার পথ খুলবে।
তাদের ভাষায়, তারেক রহমান লন্ডনে থাকলেও সর্বক্ষণ দল পরিচালনা করছেন, দেখভাল করছেন। ফলে দেশের যা ‘পরিবেশ-পরিস্থিতি’, তাতে এখনই তার ফেরাটা ‘খুব জরুরি নয়’।
বিএনপি নেতারা নির্বাচনের ‘রোড ম্যাপের’ দাবি তুললেও সরকার সেরকম কোনো আলোচনায় এখনো যায়নি। বরং কয়েকটি দল ‘আগে সংস্কার, পরে নির্বাচনের’ ধারণাতেই সমর্থন দিচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা যে ধারণা দিয়েছেন তা ঠিক থাকলেও আরো এক থেকে দেড় বছর অপেক্ষা করতে হবে নির্বাচনের জন্য।
আবার নির্বাচন কীভাবে হবে তা নিয়েও অন্য অনেক দলের সঙ্গে বিএনপির মতভেদ আছে। জামায়াতসহ বিভিন্ন দল সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতির পক্ষে বলে আসছে। সেখানে বিএনপির অবস্থান পুরোপুরি উল্টো।
সব কিছু মিলিয়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আর তারেকের ফেরা নিয়ে বিএনপি কর্মীদের মধ্যে এক ধরনের ধোঁয়াশা রয়েছে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও এ নিয়ে প্রশ্ন আছে, কারণ দেশের রাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে, তা তারা বুঝতে চান।
২০১৫ সালে খালেদা জিয়া লন্ডনে গেলে নিজেই গাড়ি চালিয়ে তাকে বাড়ি নিয়ে যান বড় ছেলে তারেক রহমান।
২০১৫ সালে খালেদা জিয়া লন্ডনে গেলে নিজেই গাড়ি চালিয়ে তাকে বাড়ি নিয়ে যান বড় ছেলে তারেক রহমান।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী রেজাউল করীম শাওন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তারেক রহমান বিএনপির তরুণ-যুবাদের আইকন। আট হাজার মাইল দূর থেকে তিনি দল সংগঠিত করেছেন, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনে যে বিপ্লব হয়ে গেল, সেই বিপ্লবের নেপথ্যের কারিগরও ছিলেন তিনি।
“কিন্তু এখন খুব আশঙ্কায় থাকি, যখন দেখি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অন্যরকম। বেগম খালেদা জিয়া নেই, তিনি হচ্ছেন বিএনপির উজ্জীবনী শক্তি। তিনিও চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গেছেন। কীভাবে দল এখন শক্তি পাবে বুঝতে পারছি না।”
মিরপুর বাঙলা কলেজের ছাত্রদল কর্মী নুরুল হক মেহেদি বলেন, “অন্তবর্তীকালীন সরকার যেভাবে সংস্কার সংস্কার বলে সময় ক্ষেপণ করছে, তাতে কবে নির্বাচন হবে এটা বলা কঠিন। রাজনীতির ফিল্ডই যদি ওপেন না হয়, তাহলে পবিরেশ কীভাবে হবে। দেশে এখনো স্বৈরাচারের দোসররা বিপ্লবকে ব্যর্থ করার ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে।
“যে যাই বলুক ভাই, তারেক রহমানই হচ্ছে বিএনপির কাণ্ডারি। কিন্তু এরকম পরিস্থিতিতে এখন তার আসা হচ্ছে না … এটাই স্বাভাবিক। এটা নিয়ে বেশি আলাপের প্রয়োজন নাই।”
আখলাকুর রহমান কাজ করেন একটি বীমা কোম্পানিতে। দেশের রাজনীতি কোন পথে যাচ্ছে, তা নিয়ে তার মনেও সন্দেহ কাজ করছে।
“বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৬০ লাখ মামলা। অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সকল মামলা প্রত্যাহারের ব্যবস্থা নিতে দাবি জানিয়েছিল কয়েক মাস তো হয়ে গেল। এখনো ফলাফল সেভাবে নেই। সরকার বলে ‘করা হবে’।
“শুধু তাই নয়, দেখবেন বড় বড় নেতাদের বিরুদ্ধেও মামলা ১০/২০টা প্রত্যাহার বা খারিজ করে আর এগোচ্ছে না। তার মানে কী? ডাল মে কুচ কালা হ্যায়।”
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার নেতাকর্মীদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তবে তিনিও তারেকের ফেরার কোনো সম্ভাব্য সময় বলতে পারেননি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “আপনারা জানেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাহেবের বিরুদ্ধে মিথ্যা-রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা হয়েছে। তার মামলাসমূহ নিষ্পত্তির পর অবশ্যই দেশে ফিরবেন।এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।
“তারেক রহমান এদেশের মাটি ও মানুষকে ধারণ করছেন, তারেক রহমান এদেশের জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রতীক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও গণতন্ত্রের আপসহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আদর্শের পতাকাকে বহন করছেন। তার জন্যে জনগণ অপেক্ষায় আছে, থাকবে।”
‘মাইনাস টু?’
বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মেয়াদ শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে জটিলতায় আওয়ামী লীগ ও সমমনাদের ভোট বর্জনের ঘোষণা আর সংঘাত সহিংসতায় খাদের কিনারে পৌঁছে যায় দেশ। ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। দেশে জারি হয় জরুরি অবস্থা।
২০০৭ সালের সেই ঘোলাটে সময়ে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে সরিয়ে দিয়ে ‘সংস্কারের মাধ্যমে নতুন ধারার' রাজনীতি চালুর কথা শুরু হয়। খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে নির্বাসনে পাঠানোর সেই কথিত প্রকল্প রাজনীতির অঙ্গনে পরিচিতি পায় ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ নামে।
সে সময় দুই নেত্রীকেই দুর্নীতির মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কয়েক মাস পর মুক্তি পেলে শেখ হাসিনা চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান। তখন তার ফেরা আটকে দেওয়ারও চেষ্টা হয়।
মুক্তি পাওয়ার পর খালেদা জিয়াকেও দেশের বাইরে যেতে চাপ দেওয়ার কথা শোনা যায়। খালেদা জিয়া না গেলেও তার ছেলে তারেক রহমান মুক্তি পাওয়ার পর সপরিবারে লন্ডনে চলে যান।
২০০৮ সালের নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। পরের তিনটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনেও তারা ক্ষমতায় থেকে যায়। বিএনপি নেতাকর্মীদের কাছে সেটা ছিল বিরাট ‘দুঃসময়’।
অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর এখন একইরকম দুঃসময় নেমে এসেছে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর। বিএনপির সামনে এখন তেমন কোনো চ্যালেঞ্জ না থাকলেও দলটির নেতাকর্মীদের কথায় ‘বিরাজনীতিকরণ’ ও ‘মাইনাস টু থিওরির’ সেই শঙ্কা ফিরে আসছে।
শান্তিনগরের আবুজর গিফারী কলেজের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাহাবুদ্দিন চৌধুরী বলেন, “রাজনীতির আকাশ পরিষ্কার নয়। কালো মেঘ ও কুয়াশায় কেমন যেন খটকা লাগছে। আবার কি মাইনাস টু থিওরির খেলা শুরু হল? শেখ হাসিনাও নেই, খালেদা জিয়াও নেই।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের অধ্যাপক মো. রফিকুল ইসলাম অবশ্য তেমন কোনো শঙ্কা দেখছেন না।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, দেশের বেশিরভাগের জনগোষ্ঠী যে দুই রাজনৈতিক দলের সমর্থক, সে দুই দলের নেত্রীই এখন দেশের বাইরে। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এমন ঘটনায় ‘মাইনাস টু ফর্মুলার’ কথা যে ফিরে আসবে, সেটা অস্বাভাবিক নয়।
“কিন্তু ২০০৭ সালের জানুয়ারি মইন উদ্দিন-ফখরুদ্দীনের সরকারের সময় যখন মাইনাস টু ফর্মুলা বাস্তবায়নের চেষ্টা হয়েছিল, তখন দুই দলের নেতাকর্মীদের বেশিরভাগই জেলে ছিলেন। আর এখন বিএনপির বেশিরভাগ নেতাকর্মী মুক্ত ও রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়। তাই এ মুহূর্তে মাইনাস টু ফর্মুলা বাস্তবায়ন বা সেদিকে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না।”
আওয়ামী লীগের পতন আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাজনীতির পুরনো চক্কর থেকে বাংলাদেশকে বের করে আনতে চায়। তবে তারাও দুই নেত্রীর অনুপস্থিতিকে ‘মাইনাস টু’ হিসেবে দেখতে রাজি নয়।
আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও নয় দফার ঘোষক আব্দুল কাদের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "ওয়ান-ইলেভেনের পরিস্থিতি আর বর্তমান পরিস্থিতি এক না। তখন দুইটা রাজনৈতিক দল ও তাদের নেত্রী দেশে ছিল। তখন তারা গণহত্যা বা এমন কোন অপরাধের কারণে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়নি।
“অপরদিকে এখন এমন কোনো অবস্থা তৈরি হয়নি যে তাদের রাজনৈতিক দলকে মাইনাস করা হবে। এখন শেখ হাসিনা গণহত্যার সাথে জড়িত, অপরদিকে খালেদা জিয়া একজন অসুস্থ মানুষ। বিগত কয়েক বছরে উনি বারবার আবেদন করেছেন, আমাদের সুশীল সমাজও বারবার সবাই আন্দোলন করেছে, কথা বলেছে তাকে বিদেশে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য। তাকে তখন যেতে দেওয়া হয়নি। এখন যখন পরিস্থিতি ঠিক হয়েছে, তখন বিএনপির পক্ষ থেকেই তাকে চিকিৎসা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিদেশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।”
কাদের বলেন, “আমাদের জায়গা থেকে আমরা চাই, শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচার করা হোক। আর খালেদা জিয়া সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে আসুক।"
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় মনে করেন, বিরাজনীতিকরণ বা ‘মাইনাস’ করার ওই তত্ত্ব এ দেশের মানুষ ‘গ্রহণ করেনি’।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “জনগণের সাথে, মাটি ও মানুষের সাথে যে দলটি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে, তাকে কোনো তত্ত্ব দিয়ে বিলীন করা যাবে না, নিশ্চিহ্ন করা যাবে না। এক-এগারোর সরকার এবং গত ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকারও এটা করতে চেয়েছিল, পারেনি। বিএনপি বিএনিপি হয়েই আছে জনগণের মনিকোঠায়।”
তারেকের যত মামলা
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পটপরিবর্তনের পর ঢাকা সেনানিবানের শহীদ মইনুল সড়কের বাসা থেকে তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করে প্রথম দফায় ১৭টি মামলা দেওয়া হয়। সেগুলোর সবই ছিল দুর্নীতির মামলা।
এরপর আওয়ামী লীগের সময়ে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ, অর্থ পাচার, মানহানি মামলাও করা হয়। তাকে পলাতক দেখিয়ে বিচারকাজ শেষ করে পাঁচটি মামলায় তাকে সাজা দেওয়া হয়।
এর মধ্যে ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় তাকে দেওয়া হয়েছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আপিল করার সুযোগ না পেলেও হাই কোর্ট তাকে এবং দণ্ডিত সব আসামিকে খালাস দিয়েছে।
বিভিন্ন আদালতে আরো কয়েকটি মামলায় তারেকের খালাসের রায় এসেছে।কর ফাঁকি, চাঁদাবাজির ১৫টি মামলা উচ্চ আদালতে স্থগিত রয়েছে। কিন্তু এখনো বহু মামলা বাকি।
বিভিন্ন সময় থানা ও আদালতে দায়ের হওয়া এসব মামলার সঠিক পরিসংখ্যান বিএনপির আইনজীবীদের কাছেও নেই।
তারেক রহমানের আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, “তারেক রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের জন্য রাজনীতি পতাকা বহন করছেন তিনি। দেশে আসার বিষয়ে উনি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ যথাসময়ে নেবেন।”
তবে বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের কেউ কেউ মনে করেন, সব মামলা প্রত্যাহারের আগে তারেকের দেশে ফেরাটা ‘নিরাপদ’ নাও হতে পারে।
আমিনুর রহমান নামে এক আইনজীবী বলেন, “দেশে একটা অন্তবর্তীকালীন সরকার আছে, তারপরও পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক বলা যাবে না। প্রশাসনের সর্বত্র পতিত স্বৈরাচারের দোসররা ঘাপটি মেরে আছে। এরকম পরিস্থিতিতে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলাগুলো প্রত্যাহারের আগে তারেক রহমানের দেশে আসাটা ইতিবাচক নাও হতে পারে।”
একই রকম কথা বললেন সুইডেন বিএনপির সদস্য রকীব উদ্দিন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “অন্তবর্তীকালীন সরকার এখনো প্রশাসন ঠিক করতে পারেনি, পুলিশ পুরোপুরি অ্যাকটিভ নয়। আমাদের নেতা অবশ্যই দেশে ফিরে যাবেন, তবে পরিবেশ ঠিক হওয়ার পর।
“কারণ কোনো রিস্ক ফ্যাক্টর রেখে তারেক রহমান দেশে গিয়ে বিপদে পড়ুন– আমরা প্রবাসীরা তা চাই না। বিএনপির একমাত্র্র বাতিঘর এখন তারেক রহমান, এটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে।”