সংবিধান পরিবর্তন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে সংসদ: ফখরুল
সংবিধান বা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যে কোনো মৌলিক পরিবর্তন সংসদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ এবং প্রশাসনে ‘ন্যূনতম সংস্কার’ করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়ে তিনি অভিযোগ করেন অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘অনির্দিষ্টকালের জন্য’ রাখার চেষ্টা হচ্ছে। এটি জনগণ ‘মেনে নেবে না’ বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।
সোমবার দুপুরে রাজধানীতে এক আলোচনায় বিএনপি নেতা এসব কথা বলেন।
সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির এই আলোচনার আয়োজন করে ‘দ্বি-কক্ষ পার্লামেন্ট: উচ্চ কক্ষের গঠন’ বিষয়ে এই আয়োজনে ফখরুল বলেন, “যে কোনো সংস্কার, যে কোনো পরিবর্তন এটা জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব না, উচিতও না।”
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “এরা এসেছেন ‘আপাতত’ রাষ্ট্র পরিচালনা করার এবং নির্বাচনের ব্যবস্থা করবার জন্যে। আমি যেটা বিশ্বাস করি, আমার দল যেটা বিশ্বাস করে যে, এই ধরনের মেজর সমস্যাগুলো অর্থাৎ পরিবর্তনগুলো, মৌলিক যে পরিবর্তন আসবে সেই পরিবর্তনগুলো বা সংশোধনী যেটাই বলি না, সেটা কখনই জনগণের মতামত ছাড়া সম্ভব নয়। তার জন্য একমাত্র জায়গা হচ্ছে পার্লামেন্ট।”
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি নিয়ে বিএনপির অবস্থান তুলে ধরে দলের মহাসচিব বলেন, “এখন নিরপেক্ষ সরকার আছে। নির্বাচন কমিশন ভেঙে দেওয়া হয়েছে, এই কমিশন গঠন করতে হবে নিরপেক্ষতার সঙ্গে এবং নির্বাচন করার জন্যে।”
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সংবিধান সংশোধন বা নতুন করে লেখা নিয়ে যে আলোচনা একটি পক্ষ থেকে উঠেছে সে প্রসঙ্গেও নিজের অবস্থান তুলে ধরেন ফখরুল। বলেন, “সত্যিকার অর্থেই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনটা হতে হবে। এই নির্বাচনের পরেই যারা নির্বাচিত হবেন, তারা সিদ্ধান্ত নেবেন কোন পরিবর্তনগুলো দরকার।
“শুধু পরিবর্তন দরকার নাকি বাতিল করে নতুন করে লিখতে হবে, সেটা পার্লামেন্টই সিদ্ধান্ত নেবে কী করতে হবে।”
আওয়ামী লীগ সরকার দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষতি করেছে অভিযোগ এনে তিনি বলেন, “গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো কে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনিক দলীয়করণ করা হয়েছে, বিচার বিভাগকে কুক্ষিগত করে, দলীয়করণ করে সেটাকেও ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে গেছে।
“কোনো একটা সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচন করতে গেলে যে একটা ন্যূনতম যে পরিবর্তনগুলো দরকার, ব্যবস্থা নেয়া দরকার সেটা নিতে হবে। অর্থাৎ নির্বাচন কমিশন যে পরিবর্তন ও সংস্কার সেটা করতে হবে, প্রশাসনের যে পরিবর্তন ও সংস্কার সেটা করতে হবে। একই সঙ্গে জুডিশিয়ারিতে যেটা দরকার সেটা করতে হবে। তবে আল্টিমেটলি নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।”
‘অনির্দিষ্টকালের’ অন্তর্বর্তী সরকার মানবে না জনগণ
বেশ কিছু সংগঠন ও গোষ্ঠী অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘অনির্দিষ্টকালের জন্য’ রাখার কথা বলছে মন্তব্য করে ফখরুল বলেন, “তারা (অন্তবর্তীকালীন সরকার) একেবারেই পরিবর্তন করে দেবে….সমস্ত সংস্কার-টংস্কার তারাই করে দেবে। তাহলে জনগণের তো দরকার নাই, পার্লামেন্টের দরকার নাই।
“একটা পত্রিকা দিয়েছে জরিপের ফল দিয়ে… এই জরিপ কারা করেছে আমি ঠিক বলতে পারব না। নাম দিয়েছে ব্র্যাক ইনস্টিটিটিউট… আমি জানি না তারা কীভাবে জরিপটা করেছে। তারা বলেছে যে, বেশিরভাগ নাকি চায় যতদিন দরকার এই সরকার থাকুক।
“এটা আমি জানি না তারা এই কথাগুলো কোত্থেকে পেল, কীভাবে পেল? কিন্তু জনগণ এটা কোনোদিন মেনে নেবে না।”
অনির্বাচিত সরকারের অনির্দিষ্টকাল থাকলে সেটি জনগণ মেনে নেবে না বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মির্জা ফখরুল।
অনির্বাচিত সরকারের অনির্দিষ্টকাল থাকলে সেটি জনগণ মেনে নেবে না বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মির্জা ফখরুল।
এই ধরনের কথা ও এই ধরনের প্রতিবেদন থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “আমার মনে হয় যে, ভেবে চিন্তে-করা উচিত যাতে কোনো বিভ্রান্তি সৃষ্টি না হয়… সেই বিষয়টাও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।”
ছাত্র-জনতার বিপ্লবের ‘আকাঙ্ক্ষাকে’ নস্যাতের চক্রান্ত শুরু হয়েছে অভিযোগ করে বিএনপি নেতা বলেন, “নষ্ট করবার জন্য ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করেছে। আমি অবাক হই যখন দেখি যে, আমাদের শিক্ষিত মানুষেরা, সমাজে যাদের গুরুত্ব আছে তারা যখন বিভিন্ন কথা বলেন, তা অত্যন্ত বিভ্রান্তিমূলক।
“যারা দায়িত্ব পেয়েছেন, এই সরকার যাদেরকে দায়িত্ব দিয়েছে… তাদের মধ্যেই অনেকে যখন বলেন যে নতুন দল তৈরি করতে হবে, তখন বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না।”
‘এই এখতিয়ার উনাকে কে দিয়েছে?’- এই প্রশ্ন রেখে ফখরুল বলেন, “উনি এই দায়িত্ব পেলেন কোথায় যে উনি বলবেন যে, নতুন দল তৈরি হবে? তাহলে আমরা কী করে, জনগণ কী করে ভাববে যে, এরা নিরপেক্ষভাবে কাজ করছে?”
মামলা প্রত্যাহার হোক
বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে করা ‘মিথ্যা, হয়রানিমূলক ও গায়েবি মামলা’ প্রত্যাহার করতে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “আর স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে যারা নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন তাদেরকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।”
যারা আওয়ামী লীগের শাসন দীর্ঘস্থায়ী করতে কাজ করেছে, ‘দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়নে’ মদদ দিয়েছে, তাদেরকে এখন পর্যন্ত অপসারণ করা হয়নি অভিযোগ এনে তিনি বলেন, “অতি সত্বর তাদের চিহ্নিত করে সরিয়ে দিয়ে এমন একটা নিরপেক্ষ কাঠামো তৈরি করুন, যাতে একটা অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে।”
জেএসডি কী চায়
মূল প্রবন্ধে জেএসডির প্রস্তাবনায় চার বছর মেয়াদি দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট জাতীয় সংসদ গঠন করার দাবি জানানো হয়। এর নিম্নকক্ষ হবে তিনশ আসনের, উচ্চকক্ষে থাকবে দুইশ আসন।
জেএসডি চায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ। সংখ্যানুপাতিক ভোটের ব্যবস্থা চায় বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে থাকা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি।
জেএসডি চায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ। সংখ্যানুপাতিক ভোটের ব্যবস্থা চায় বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে থাকা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি।
নিম্ন কক্ষে দলীয় প্রতিনিধি এবং উচ্চ কক্ষে শ্রেণি-পেশা-কর্মজীবীর প্রতিনিধিরা থাকবেন। উচ্চ কক্ষ থেকেই নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে।
প্রস্তাবে এক ব্যক্তির দুই ভোট, এলাকাভিত্তিক সাধারণ ভোট এবং শ্রম-কর্ম-পেশাভিত্তিক ভোটের ব্যবস্থা এবং নির্বাচনে ‘না’ ভোটের বিধান করার কথাও বলা হয়েছে।
জেএসডির সভাপতি আসম আবদুর রব বলেন, “একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন অবশ্যই করতে হবে। এই নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের মালিকানা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে।”
লড়াই নাকি ঐক্য চান?
স্টিয়ারিং এখন অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে মন্তব্য করে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, “হতেই পারে এই সরকারের সঙ্গে আপনার একটা লড়াই হতে হবে। সেই লড়াই চান নাকি ঐক্যমত্য চান?
“ঐক্যমত্য যদি চান তাহলে আমি বলব তাহলে আমাদের মধ্যে ধারণা আদান-প্রদান এবং সেটা যতদূর সম্ভব এক জায়গায় নিয়ে আসার জন্য যতদূর সম্ভব নিরন্তর সংগ্রাম করতে হবে। বাকি জায়গায় যদি জোর করে যেতে চাই। সেই বিতর্ক চলতে থাকবে এবং দেশের শান্তি স্থিতিশীলতা পুরোপুরি নষ্ট হবে।”
নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ঐক্য নাকি লড়াই হবে।
নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ঐক্য নাকি লড়াই হবে।
সংবিধান সংশোধন নিয়ে মির্জা ফখরুলের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, “এই সরকারের একটা ‘টার্মস অব রেফারেন্স’ থাকা উচিত…. মানে তারা এতো দূর যেতে পারবে, এতদূর পারবে না।
“আমাদের মূল সংগ্রাম কীসের? আমাদের ‘ভোট দেওয়ার অধিকার ছিল না, গণতন্ত্র ছিল না’। গণতন্ত্রের জন্য ভোট লাগবে, যাতে সবাই অংশগ্রহণ করতে পারে, সেই ভোটের একটা ব্যবস্থা করতে হবে… এটাই তাদের (অন্তবর্তীকালীন সরকারের) প্রধান কাজ।”
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক দুই কক্ষ বিশিষ্ট সংসদের পাশাপাশি সংখ্যানুপাতিক ভোটের ব্যবস্থা করার দাবি জানান। অর্থাৎ কোনো দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সংসদে তারা তত শতাংশ আসন পাবে।
জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামাল উদ্দীন পাটোয়ারির সঞ্চালনায় আলোচনায় জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, বাংলাদেশ জাসদের শরীফ নুরুল আম্বিয়া, গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক সুব্রত চৌধুরী, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের হাসনাত কাইয়ুম, গণসংহতি আন্দোলনের নির্বাহী সমন্বয়ক আবুল হাসান রুবেল, এবি পার্টির আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, ভাসানী অনুসারী পরিষদের আবু ইউসুফ সেলিম বক্তব্য রাখেন।
গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকী, জেএসডির মোহাম্মদ সিরাজ মিয়া, তানিয়া রব, কে এম জাবিরও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।