বুধবার ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, মাঘ ২ ১৪৩১, ১৫ রজব ১৪৪৬

ব্রেকিং

দক্ষিণ আফ্রিকায় পরিত্যক্ত সোনার খনিতে অন্তত ১০০ শ্রমিকের মৃত্যু এস আলম পরিবারের ৬৮ ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ, সম্পদ জব্দের আদেশ অবৈধ সম্পদের মামলায় এস কে সুর চৌধুরী কারাগারে ভোটার তালিকা হালনাগাদে সহায়তা করবে ইউএনডিপি কখন মুক্তি পেতে পারেন বাবর? ১০ ট্রাক অস্ত্র: অস্ত্র আইনের মামলাতেও বাবর খালাস, মুক্তিতে ‘বাধা নেই’ তুরাগ তীরে ৩১ জানুয়ারি বিশ্ব ইজতেমা শুরু ‘ক্ষমতার অপব্যবহার করে’ পূর্বাচলে শেখ হাসিনা ও জয়ের প্লট, দুই মামলা দুদকের ‘আগের চেয়ে ভালো’ আছেন খালেদা জিয়া: ফখরুল খালেদা জিয়ার পরবর্তী চিকিৎসার পরিকল্পনা হবে শুক্রবারের মধ্যেই মডেল তিন্নি হত্যা মামলায় সাবেক এমপি অভি খালাস ক্ষমতা নেওয়ার আগেই বিশ্ব কূটনীতিতে ঝড় তুলছেন ট্রাম্প

সাহিত্য

বই পড়া: নতুন বছরের সেরা অঙ্গীকার

 প্রকাশিত: ১৪:১৩, ১২ জানুয়ারি ২০২৫

বই পড়া: নতুন বছরের সেরা অঙ্গীকার

‘বই কিনে কেউ কোনোদিন দেউলিয়া হয় না!’ সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রায় প্রবাদে পরিণত হওয়া উক্তি। মেঠো বক্তৃতায় বা অন্যকে সদুপদেশ দেওয়ার সময় অনায়াসে এই মহাজন উক্তিটি উদ্ধৃত করি আমরা। বছরদুয়েকের মধ্যে বইয়ের ছায়া মাড়াননি যিনি, তিনিও এ বাক্যটি ঝেড়ে দিতে একবারের বেশি দু’বার ভাবেন না। বই থেকে ক্রমশ দূরে চলে যাওয়া ঊষর এ সময়ে আরও অনেক কথার মতো এটিও স্রেফ কথার কথাই হয়ে গেছে। গ্যাজেটনির্ভর, সামাজিক যোগাযোগ নামের অসামাজিক মাধ্যমের দৌর্দণ্ডপ্রতাপের নষ্ট-ভ্রষ্ট এ সময়ে বইয়ের কথা বলা এখন নেহাতই উলুবনে মুক্তো ছড়ানো। যে বলে সে মানে না, যে শোনে সেও না। আরও অনেক ‘ভালো’ জিনিসের মতো একুশ শতকের দিকচিহ্নহীন অনিকেত এ সময়ে বইও হয়ে গেছে নেহাতই ব্রাত্য। বিশেষ করে আমাদের এ বঙ্গদেশে।

পশ্চিমের গুণগান করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলি আমরা। পশ্চিমকে সর্বক্ষেত্রে আদর্শ মানি। সেই পশ্চিম কিন্তু আমাদের মতো ছুঁড়ে ফেলে দেয়নি বইকে। এখনও ছেলে বুড়ো ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সেসব দেশের মানুষ বই পড়ে। একেবারে অখ্যাত অজানা লেখকের লেখা বইয়েরও হাজার-দুই হাজার কপি বিক্রি হওয়া কোনো ব্যাপারই নয় সেসব দেশে। অথচ বইকে ঘিরে আমাদের বৃহত্তম আয়োজনে (শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে রেকর্ড সংখ্যক পাক্কা এক মাস ধরে চলে) কারও বই দু’শো বিক্রি হওয়া মানেই বিরাট ব্যাপার। হাজারখানেক বিক্রি হলে তো তিনি সেলিব্রিটিই হয়ে যান। মাসব্যাপী বিরাট এই মেলায় হাজার হাজার বই ছাপা হয়, তার মধ্যে বিক্রির হিসাবে একশোর গণ্ডি পেরোতে পারে হাতে গোনা কিছু বই। আরও দুঃখজনক হলো, লেখকের বন্ধু-বান্ধব, ভাই বেরাদর যারা গাঁটের পয়সা খরচ করে (লেখককে খুশি করতে) এসব বই কেনে, তাদেরও সিংহভাগ বইগুলো কেনার পর আর ছুঁয়ে দেখে না। স্রেফ ফেলে রাখে, বা ফেলে দেয়। বই পড়াকে ঘিরে এমন অবিশ্বাস্য, অবিমৃশ্যকারী, অভূতপূর্ব অবহেলা বিশ্বের আর কোথাও আছে কিনা আমার জানা নেই।

অথচ শুনেছি পশ্চিমের আমজনতাই কেবল নয়, বিখ্যাত, মানগণ্য ব্যক্তিরাও বই পড়েন। যেনতেনভাবে নয়, রীতিমতো পরিকল্পনা করে পড়েন। একটা দুটো নয়, অসংখ্য বই। বিনিয়োগ-গুরু ওয়ারেন বাফেট শুনেছি প্রতিদিন নিয়ম করে আট ঘণ্টা বই পড়েন। বারাক ওবামা, রিচার্ড ব্র্যানসন, বিল গেটস, অপরাহ উইনফ্রে, মার্ক জাকারবার্গ, রিজ উইদারস্পুন, মার্ক কিউবান--নানা ক্ষেত্রের নানা বয়সের সফল এ মানুষগুলোর মধ্যে অভিন্ন বৈশিষ্ট্য একটিই: তাঁরা গোগ্রাসে বই পড়েন। কে জানে, আমাদের দেশের জ্ঞানীগুণীরাও হয়তো বই পড়েন, হয়তো পশ্চিমাদের মতো ঢাকঢোল পিটিয়ে জানান না, জানালে ভালো হতো। ওবামা, গেটস, জাকারবার্গ আর অপ্রাহরা যেভাবে নিয়মিত নিজেদের প্রিয় বইয়ের কথা জানান, তালিকা দেন, সেরকম আমাদের সেলিব্রিটিরাও তা করলে ভালো হতো। তরুণ তরুণীরা, যারা এদেরকে আইডল মানেন, মোবাইল ছেড়ে অল্প সময়ের জন্য হলেও বই পড়ার প্রেরণা খুঁজে পেত।


বৃটেনের ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় কেটি কানিংহাম নামে এক পাঠকের গল্পটি এক্ষেত্রে অনুপ্রেরণাদায়ী মনে হতে পারে। আরো অনেক স্বদেশীর মতোই কেটিরও ছোটবেলা থেকেই প্রচুর বই পড়ার অভ্যাস। সেদেশে ‘রিড-আ-থন’ নামে একটি প্রতিযোগিতা হয় যেখানে ছাত্রছাত্রীদের নির্দিষ্ট একটি সময়ে যতো বেশি সম্ভব বই পড়ার চ্যালেঞ্জ দেওয়া হয়। তো এই রিড-আ-থনের অংশ হিসেবে কোনো কোনো মাসে ৬০টিরও বেশি বই পড়তেন কেটি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বই পড়ার হার কমে এলেও বছরে পনের থেকে বিশটি বই পড়তেন তিনি। মুশকিল হলো, ততোদিনে মোবাইল ফোনের মজা পেয়ে গেছেন। ফলে অবসর সময়ের বড় একটা অংশ চলে যেত ফোন হাতে মগ্ন হয়ে। একসময় ছোটবেলার এতো প্রিয় শখ, মানে বই পড়া প্রায় ভুলেই যেতে বসলেন। ২০১৮ সালের শেষের দিকে কথা। কেটি ঠিক করলেন, নতুন বছরে তাঁর নিজের কাছে অঙ্গীকার হবে প্রতি সপ্তাহে একটি করে বই পড়া। সে বছরই ত্রিশ হবে তাঁর বয়স। তাঁর মনে হলো সপ্তাহে একটি করে বই পড়ার অঙ্গীকারটি বেশ প্রাপ্তবয়স্কজনোচিত হবে। তবে বই পড়ার নতুন করে শুরুর আগে একটি সিদ্ধান্ত নিলেন। হাতে ফোন তুলে নেওয়ার পুরনো অভ্যাসে যাতে ফিরে না যান সেজন্য ঠিক করলেন, যে বই পড়ে মজা পাবেন না সেটি বাদ দিয়ে নতুন একটা শুরু করবেন। জোর করে বই পড়াবেন না নিজেকে দিয়ে। এছাড়াও, মূলত আর্থিক কারণে, যে সিদ্ধান্তটি নিলেন তা হচ্ছে, সুযোগ পেলেই লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে পড়বেন। এতে পয়সা সাশ্রয় হবে। কিছু সমস্যাও হলো তাতে। লাইব্রেরিতে যে বইয়ের অনুরোধ পাঠালেন দেখা গেল তাঁর আগে আরও দশ/বিশ জন সেটির জন্য অনুরোধ পাঠিয়ে রেখেছে। ফলে বই তাঁর হাতে আসতে আসতে এক দেড় মাস কেটে গেল। এতে যা ঘটল, অনুরোধের বইগুলো আসতে শুরু করলে একসাথে আট-দশটা বই জমে যেতে লাগল, এদিকে ফেরত দেওয়ার সময় মাত্র তিন সপ্তাহ। এ কারণে দ্রুত বই পড়ার অভ্যাস করতে হলো। পড়তে গিয়ে পছন্দ না হওয়া বই সাথে সাথে পাল্টে ফেলতেন কেটি, কোনোটা প্রথম পৃষ্ঠা পড়ে, কোনোটা অর্ধেক পড়ে। এছাড়াও এ মুহূর্তে যে বইটি পড়ছেন সেটির কথা ইনস্টাগ্রামে নিজের অনুসারীদের জানাতেন এবং প্রতিটি বই শেষ হওয়ার পর তার একটি ছোট রিভিউ দিতেন। এতো বই পড়ার সময় কীভাবে বের করতেন? কেটির ভাষায়, ‘বই পড়ার জন্য সময় বের করা ছিল সহজ। ঘুমাতে যাওয়ার আধ ঘণ্টা আগে বই নিয়ে বিছানায় যেতাম, ফোনটাকে দূরে কোথাও সরিয়ে রাখতাম, এবং পড়তে শুরু করতাম। তাছাড়া শনিবার সকালে এক থেকে দুই ঘণ্টা পড়তাম।’ এভাবেই নিজের কাছে দেওয়া অঙ্গীকারমতো বছরে বাহান্নটি বই পড়ে শেষ করলেন কেটি। বইয়ের পৃষ্ঠা সংখ্যার ওপর নির্ভর করে পরের বছরগুলোতে সংখ্যাটি কম-বেশি হতো, তবে গড় সংখ্যা ৫০-এর আশেপাশে থাকত।

সেই অঙ্গীকারের ছয় বছর পার করে কেটি জানাচ্ছেন, ব্যক্তিগত জীবনের নানা উত্থানপতনের পরও বই পড়ার অভ্যাসটাকে ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘সত্যি সত্যি ভালো বই পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে এখন, যেহেতু বিশ্ব সাহিত্যের সেরা বইগুলো প্রথম দিকেই পড়ে ফেলেছি। এখন বেশি পড়া হয় ই-বুক রিডারে। আমার ছেলেবন্ধু যখন ঘুমায় তখনও অন্ধকারে বই পড়ার সুযোগ পাওয়া যায় এতে। তবে যে বই একঘেয়ে লাগে সেটাকে নির্মমভাবে পাশে সরিয়ে রাখি। ২০১৯ থেকে এ পর্যন্ত ৪৭টি বই শুরু করেও শেষ করিনি। সব ক্ষেত্রেই নিয়ম একটাই: যখনই মনে হয়েছে বইটি টানছে না, রেখে দিয়েছি। হাতে তুলে নিয়েছি নতুন একটি। রাতের ঐ বই পড়ার সময়টাই এখন আমার সবচেয়ে প্রিয় সময়। জোর করে পড়তে হয় এমন কিছুর পেছনে নষ্ট করতে চাই না সময়টা।’


কেটি কানিংহাম একা নন। নিশ্চয়ই বই থেকে দূরে সরে যাওয়ার এই বিষন্ন-করুণ সময়েও এমন অনেকেই আছেন যাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আবার বইয়ের কাছে ফিরে যাওয়ার। কেউ হয়তো কেটির মতো বছরে নির্দিষ্ট সংখ্যক বই পড়ার পরিকল্পনা করছেন, কেউ প্রতিদিন নির্দিষ্ট সংখ্যক পৃষ্ঠা পড়ার লক্ষ্য স্থির করছেন, কেউবা অন্য কিছু। ইনস্টাগ্রামে Bookstagram নামে একটি কমিউনিটি আছে যার সদস্যরা নিজেদের প্রিয় বইয়ের নান্দনিক ও আকর্ষণীয় ছবি তুলে পোস্ট করেন। এ কমিউনিটির সদস্য হওয়া যেতে পারে। এছাড়া গুডরিডস, স্টোরিগ্রাফ, লাইব্রেরিথিং-এর মতো অনলাইন কমিউনিটির অংশ হয়ে বিশ্বজুড়ে বইপ্রেমী ও ভালো ভালো বইয়ের সাথে যুক্ত হওয়া যায়।

আরেকটি কথা। কেবল বই পড়লেই হবে না, ভালো বই পড়তে হবে। সময় অল্প, কিন্তু সময়ের তুলনায় ভালো বইয়ের সংখ্যা বিপুল। কাজেই মূল্যবান এ সময় বইয়ের নামে ‘অ-বই’ আর ‘কু-বই’ পড়ে নষ্ট করার মানে হয় না। জীবনের নানাবিধ বিঘ্ন, আলস্যজনিত অনভ্যস্ততা, গ্যাজেটের হাতছানি এসবকে উপেক্ষা করে চলুন কেটি কানিংহামের মতোই নতুন বছরে অঙ্গীকার করি সপ্তাহে একটি না হোক, দুই সপ্তাহে একটি, অন্তত মাসে একটি বই পড়ার। এর চেয়ে সুন্দর “নিউ ইয়ারস’ রেজল্যুশন” আর কী হতে পারে!