গ্রীষ্মকালীন ফল পর্ব – ৩: তরমুজ

তরমুজ
গ্রীষ্মকালীন ফলের মাঝে সবচেয়ে স্নিগ্ধ ও সতেজকর ফল হিসেবে পরিচিত তরমুজ। প্রচণ্ড গরমের ক্লান্তি আর তৃষ্ণা মেটাতে তরমুজের মত ফল খুব কমই আছে। রসালো, মিষ্টি ও ঠাণ্ডা স্বাদের এই ফল গ্রীষ্মের অসহনীয় উত্তাপের মাঝে এনে দেয় এক ফোটা প্রশান্তি।
তরমুজের পরিচয় ও ইতিহাস
তরমুজের ইংরেজি নাম Watermelon। এটি একটি গ্রীষ্মকালীন গাছজাতীয় ফল, যা মূলত আফ্রিকার মরুভূমি অঞ্চলে প্রথম জন্ম নিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায়ও তরমুজের চাষের ইতিহাস পাওয়া যায়। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে নানা জাত ও স্বাদের তরমুজ চাষ হয়। বাংলাদেশেও এটি একটি জনপ্রিয় ও বহুল উৎপাদিত গ্রীষ্মকালীন ফল।
তরমুজের জাত ও বৈচিত্র্য
বাংলাদেশে চাষ হওয়া কিছু জনপ্রিয় তরমুজের জাত হলো:
সুগার বেবি – ছোট আকৃতির, গাঢ় সবুজ খোসা ও রসালো লাল ভেতর
কালো তরমুজ – বাইরের অংশ কালো-সবুজ, স্বাদে অতিমিষ্ট
গোল্ডেন ক্রাউন – কিছুটা হলদে খোসাযুক্ত, মিষ্টি ও ঘ্রাণযুক্ত
লাল চাঁদ – আকৃতিতে বড় ও লাল ভেতরে, বাজারে চাহিদা বেশি
বীজহীন তরমুজ – আধুনিক জাত যা খাওয়ার সময় বিড়ম্বনা কমায়
তরমুজ শুধু লালই নয়—আধুনিক কৃষি গবেষণায় এখন হলুদ, কমলা এমনকি সাদা ভেতরযুক্ত তরমুজও পাওয়া যাচ্ছে।
পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্য উপকারিতা
তরমুজ মূলত পানিতে ভরপুর – প্রায় ৯২% পানি, তাই এটি শরীরকে হাইড্রেট রাখতে অসাধারণ। এ ছাড়া এতে আছে:
ভিটামিন এ ও সি – রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
লাইকোপেন – একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ক্যান্সার ও হৃদরোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে
পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম – রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে
ফাইবার – হজমে সহায়ক
শরীর শীতল রাখা, গরমে ক্লান্তি দূর করা, ডায়েট সাপোর্ট ও ত্বক উজ্জ্বল রাখতে তরমুজ অনেক কার্যকর।
চাষাবাদ ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব
বাংলাদেশে কক্সবাজার, ভোলা, পটুয়াখালী, খুলনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি তরমুজ চাষ হয়। বর্তমানে চরাঞ্চল ও উপকূলীয় এলাকায় বড় আকারে বাণিজ্যিকভাবে তরমুজ চাষ হচ্ছে। এতে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন এবং স্থানীয় অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হচ্ছে।
তরমুজ চাষে মূলত বেলে দোআঁশ মাটি ও পর্যাপ্ত রোদ প্রয়োজন। এখন আধুনিক চাষে পলিহাউজ, জৈব সার এবং হাইব্রিড বীজের ব্যবহার তরমুজ উৎপাদন আরও বাড়িয়েছে।
তরমুজের ব্যবহার ও রূপান্তর
১. তরমুজ শুধু কাটা খেয়েই খাওয়া হয় না, বরং তা দিয়ে তৈরি হয়:
২. তরমুজ জুস
৩. সালাদ ও স্মুদি
৪. তরমুজ আইসক্রিম বা শারবত
৫. তরমুজের খোসা দিয়ে আচার বা তরকারিও হয়
এছাড়া তরমুজের বীজ ভেজে খাওয়া যায়, যা পুষ্টিতে সমৃদ্ধ এবং আয়রন ও প্রোটিনের উৎস।
সতর্কতা
যদিও তরমুজ উপকারী, অতিরিক্ত খাওয়া কিছু ক্ষেত্রে ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য সমস্যার কারণ হতে পারে। কারণ এতে প্রাকৃতিক চিনি থাকে যা রক্তে গ্লুকোজ বাড়িয়ে দিতে পারে।
তরমুজ কেনার সময় লক্ষণীয়:
খোসা যেন চিটচিটে বা ফাটা না থাকে
হাত দিয়ে টোকা দিলে ফাঁপা আওয়াজ হলে বুঝবেন এটি পাকা
নিচের অংশে হলুদ দাগ থাকলে বুঝবেন এটি মাটির উপর পেকে গেছে – মানে এটি সুস্বাদু হবে
তরমুজ শুধু একটি গ্রীষ্মকালীন ফল নয়, এটি একটি অভিজ্ঞতা – যা তৃষ্ণা মেটায়, ক্লান্তি দূর করে এবং গরমে শরীর ও মনকে এনে দেয় শান্তির পরশ। এতে পুষ্টিগুণ যেমন আছে, তেমনি রয়েছে অর্থনৈতিক গুরুত্ব, সামাজিক আবেগ ও ঋতুর স্বাদ। তরমুজ মানেই গ্রীষ্মের সবচেয়ে সতেজ এক ঘ্রাণ আর রসালোতা!
পরবর্তী পর্বে আসছে: কাঁঠাল – বাংলাদেশের জাতীয় ফল ও মিষ্টি ঐতিহ্য