শিশুর যত্নে কৌশলী হতে হবে
নতুন শিশু একটি পরিবারে আনে আনন্দের স্রোত। ছোটমনিকে ঘিরে উৎসবের কমতি থাকেনা। সদ্য দাদি হয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আনন্দ ভাগাভাগি করতে দেখেও আমরা আনন্দ পাই। ঘুমিয়ে থাকা শিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে বাবা হয়তো স্বপ্ন দেখেন ভবিষ্যতের।
স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে অবশ্য বহুদূর। শিশুর লালন-পালনও যে চাট্টিখানি কথা নয়। এই যেমন খাওয়ানোর ব্যাপারেই ধরুন। ছোটবেলায় দুপুরে একটি-একটি করে ছোট মাছ পাতে তুলে দিয়ে খেতে শেখানোর জন্য বাবার নিদারুন চেষ্টার একেকটা স্মৃতি কীভাবে যেন মনে পড়ে যায়।
দুই বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর যত্ন কীভাবে নেবেন বা নিতে হবে সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে জেনে নেয়াটা সবার জন্যই উপকারে আসে।
ভাবতে হবে ক্ষুধা-তৃষ্ণা মেটানো নিয়ে: ছয় মাস বয়স পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধই যথেষ্ঠ। এক ফোটা পানি দেওয়ারও প্রয়োজন নেই। ক্ষুধা মিটছেনা ভেবে বাজারে পাওয়া কৌটার দুধ(ফর্মুলা মিল্ক) কিংবা গরুর দুধ দেওয়ার মতো ভুল একদম করা যাবেনা। এগুলো শিশুর জন্য ক্ষতিতকর।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নবজাতক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন খান জানালেন, ২৪ ঘন্টায় ৮-১০ বার দুধ পান করালে অন্তত ছয়বার শিশু প্র¯্রাব করলে, নিয়মিত ওজন বৃদ্ধি পেলে বুঝবেন শিশু পর্যাপ্ত দুধ পাচ্ছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের শিশু বিভাগের অধ্যাপক ইফফাত আরা শামসাদ জানালেন, শিশুর বয়স ছয় মাস পুর্ণ হলে বুকের দুধের পাশাপাশি অন্যান্য খাবার দিন। একটু-একটু খাবারের পরিমাণ বাড়ান। শিশুকে সবার সাথে ঘরে তৈরি করা শক্ত (সেমি সলিড) খাবার দিতে পারেন। ভাত, মাছ, ডাল, শাকসবজি সব মাখিয়ে মজা করে খাইয়ে দিন ওকে। মুঠোফোন বা টেলিভিশন দেখিয়ে নয়। শিশুকে খাওয়াতে জোরাজুরি করবেন না। সব কিছু সুন্দরভাবে গুছিয়ে নিয়ে ওকে বসিয়ে খাওয়ান। চাইলে আলাদা খাবার রান্না করতে পারেন, তবে অতিরিক্ত পাতলা করে নয়। প্রতিদিন একটি ডিম ও একটি ফল খেতে দিন। ডিম অবশ্যই তেলে ভালভাবে ভেজে নিন(রান্না করলে যেন পর্যাপ্ত সময় রান্না করা হয়)। না হলে জীবানু সংক্রমণ হতে পারে। দুই বেলা ভাত বা খিচুড়ি এবং সকালের নাস্তার পাশাপাশি আরো দুই বেলা পুষ্টিকর নাাস্তা দেওয়া ভাল(মোট পাঁচবার খাবার)। ছয় মাস বয়সের পর শিশুকে গ্লাসে করে পানি খেতে দিন, কোন মামপট বা ফিডারে নয়। কোমল পানীয়, চিপস, চানাচুরের অভ্যাস করবেন না।
ভারতে হবে পোষাক নিয়ে বজায়ে রাখতে হবে পরিচ্ছন্নতা: শিশুকে পরিচ্ছন্ন শীত পোশাকতো দেবেনই, অবশ্যই মাথা ঢেকে রাখুন। জন্মের অন্তত তিন দিন পার হলে গোসল করান। একদিন অন্তর গোসল করান(শীতের সময়)। বয়স এক মাস পার হলে প্রতিদিন গোসল করান। ফুটানো পানি কুসুম গরম অবস্থায় তা দিয়ে শিশুকে গোসল করাবেন। আর্দ্রতার জন্য গোসলের আগে তেল মালিশ করলে সমস্যা নেই। আর সর্ষের তেল ঝাঁজালো, তাই মুখে ও মাথায় তা দেওয়ার দরকার নেই। যেকোন তেল অতিরিক্তি দেওয়া হলে মাথার ত্বকে প্রলেপ পড়তে পারে। শিশুর ত্বকের উপযোগী কম ক্ষারের সাবান ব্যবহার করতে পারেন প্রতিদিন। সোনামনির চুলের উপযোগী শ্যাম্পু ব্যবহার করুন সপ্তাহে দুইদিনই যথেষ্ট। গোসলের পর বেবি লোশন দিতে পারেন। তবে বয়স ১৫ দিনের আগে তেল, লোশন কিছুই দেওয়ার প্রয়োজন নেই। শীতে ছোট শিশুর চুল না ফেলাই ভালো। নবজাতকের প্রথম চুল ফেলতে দেড়-দুই মাস অপেক্ষা করুন।
নিরাপদ ঘুমের ব্যবস্থা করতে হবে: প্রচলিত নিয়মে বিছানায় নবজাতকের মাথা রাখতে পাগড়ির মতো গোল করে কিছু তৈরি করা হয়, যার কোন প্রয়োজন নেই। নবজাতকের জন্য এক ইঞ্চি উচ্চতার নরম ও পাতলা বালিশ ভালো, খেয়াল রাখুন যেন ঘাড়ে ভাজ না পড়ে। চাইলে শিশুর জন্য চারকোনা কাপড় প্যাচানো ছাড়া ভাঁজ করে এক ইািঞ্চ উচ্চতা করে নিতে পারেন। ছয় মাসের পর বয়স অনুযায়ী বালিশের উচ্চতা বাড়ানো যায়। দুই বছর বয়সে এই উচ্চতা দুই ইঞ্চি করতে পারেন। শিশু মায়ের কাছেই ঘুমাবে। তবে খেয়াল রাখুন, কম্বল, কাঁথা, বিছানার চাদর, বালিশ এমনকি মায়ের শরীরের কোন অংশ যেন শিশুর নাক, মুখ চেপে না যায়, কিংবা শিশু বিছানা থেেেক পড়ে না যায়।
যত্নবান হতে হবে শিশুর বেড়ে ওঠার বিষয়ে: প্রতিদিন শিশুকে অন্তত ৩০ মিনিট রোদ্দুরে রাখুন। সকাল নয়টার আগে বিকেল চারটার পর রোদে রাখা ভাল। সঙ্গে থাকুন মা-ও। দু’জনের শরীরেই ভিটামিন ডি তৈরি হবে। তিন মাস পর্যন্ত খুবই সাবধানে কোলে নিন, যেন ঘারের পিছনে শক্তভাবে ধরা থাকে। অর্থাৎ কোনভাবেই যেন শিশুর মাথা ঝুলে না পড়ে। হাত ধরে টেনে শিশুকে কোলে নেওয়া উচিৎ নয়, কাঁধের জয়েন্ট বা জোড়া আলগা হয়ে হাত ঝুলে পড়তে পারে। হাঁটা শেখাতে ওয়াকার দেওয়া নিষেধ।
প্রাকৃতিক নিয়মে শিশু একেক ধাপে একেক কাজ শেখে। নিয়মের বাইরে গেলে উল্টো ফল হতে পারে(হাঁটা শিখতে দেরি হতে পারে)। অনেক সময় মায়ের অফিসে শিশুকে নিয়ে দুধপান করিয়ে আনার সুযোগ থাকে, শিশুকে রাখার ব্যবস্থাও থাকে। প্রয়োজনে শিশুকে বাইরে নিতে ক্ষতি নেই। বুকের সামনে শিশুকে ঝুলিয়ে বহন করলেও ক্ষতি নেই। শুধু সে যেন পুরোপুরি ‘সাপোর্ট’ পায়, মানে ওর শরীর যেন পুরোপুরিভাবে সমর্থিত থাকে।