যবানের হেফাজত জান্নাতের যামানত

এটা এমন একটি নেয়ামত, যার গুরুত্ব কেবল সেই অনুভব করতে পারে।
আল্লাহ না করুন, যদি যবান তার কাজ বন্ধ করে দেয়, বলার শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যদি বাশক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়—তখন কী মারাত্মক অবস্থা দেখা দেবে! মনের ভাব প্রকাশ করতে না পারার ব্যথা মানুষকে কুরে কুরে খাবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন
দীনদারী সবচেয়ে কম যেখানে
আল্লাহ তাআলার কাছে যবানের গুরুত্ব
আল্লাহর এক অসাধারণ নেয়ামত : যবান
মহান আল্লাহ আমাদের শরীরে কিছু আশ্চর্যজনক ব্যবস্থা বিনামূল্যে দান করেছেন। যেগুলো আমাদের শিশুকাল থেকে বৃদ্ধ হওয়া পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যায়। এ মেশিনগুলো কখনো সার্ভিসিং বা মেরামতের প্রয়োজন পড়ে না, কোনো ওয়ার্কশপে নেওয়ার দরকার হয় না, তবুও এগুলো সারাজীবন আমাদের সঙ্গেই থাকে এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ হলো জিহ্বা।
এটি আল্লাহর এক অসাধারণ নেয়ামত। এটি ব্যবহার করে আমরা সহজে আমাদের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারি। মহান আল্লাহ এটিকে একটি অটোমেটিক মেশিন বানিয়েছেন।
যবান কাজ করে যেভাবে
মানুষ যখন কথা বলতে চায়, প্রথমে অন্তরে ইচ্ছা জাগে। এই ইচ্ছা মস্তিষ্কে পৌঁছায়। মস্তিষ্ক তারপর জিহ্বাকে নির্দেশ দেয়। জিহ্বা নড়াচড়া শুরু করে এবং শব্দ তৈরি হয়। গলদেশের পুরো ব্যবস্থাপনা এখানে কাজ করে, এবং এই প্রক্রিয়া থেকে আমরা কথা বলি।
মনে করুন, যদি আমাদের প্রথমে টেলিফোনের মতো সুইচ অন করতে হত, তারপর নম্বর মিলিয়ে কথা বলতে হত, তাহলে মানুষ অনেক সমস্যায় পড়ত। মনের ভাব প্রকাশের জন্য মানুষকে অস্থির হয়ে পড়তে হত। এমনকি কথা বলার আগেই সুইচ অন এবং নাম্বার মিলানোর ঝামেলায় পড়তে হত।
কিন্তু মহান আল্লাহ আমাদের এমন কোনো ঝামেলা দেননি। তিনি আমাদের এমন এক সুবিধা দিয়েছেন, যার মাধ্যমে আমরা মনের ভাব তৎক্ষণাৎ প্রকাশ করতে পারি।
যারা বাক-শক্তিহীন
যবান নামক এ নেয়ামতের মূল্য তাদের জিজ্ঞেস করুন, যারা বাকশক্তিহীন—বোবা। যারা যবান থাকা সত্ত্বেও কথা বলতে পারে না। হৃদয়ে ভাব জাগে, কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারে না। তারা জানে, যবান আল্লাহর কত বড় নেয়ামত।
এটা এমন একটি নেয়ামত, যার গুরুত্ব কেবল সেই অনুভব করতে পারে।
আল্লাহ না করুন, যদি যবান তার কাজ বন্ধ করে দেয়, বলার শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যদি বাশক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়— তখন কী মারাত্মক অবস্থা দেখা দেবে! মনের ভাব প্রকাশ করতে না পারার ব্যথা মানুষকে কুরে কুরে খাবে।
কথা বলার এই যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ যদি মানুষের হাতে দেওয়া হতো, তাহলে প্রথমেই তাকে শিখতে হতো কিভাবে এটি চালাতে হয়। কোন দিকে ঘোরালে ‘আলিফ’ উচ্চারিত হবে, কোথায় চাপ দিলে ‘বা’ বের হবে—এসব শেখার দরকার হতো। এতে মানুষ কতই না বিড়ম্বনার শিকার হতো!
কিন্তু আল্লাহ মানুষকে সহজ করে দিয়েছেন। তিনি জন্মগতভাবে এক কুদরতি শক্তি দিয়ে দিয়েছেন। মানুষ যখন কথা বলতে চায়, এই শক্তির মাধ্যমে সহজেই বলতে পারে।
তাই ভাবা দরকার, এই যন্ত্র তো মানুষ নিজে কেনেনি। এটি তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। বরং এটি আল্লাহর দেয়া এক আমানত। এই আমানত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই ব্যবহার করা উচিত। যা মনে আসলো, তাই বলে দেওয়া ঠিক নয়।
কথা বলতে হবে চিন্তাভাবনা করে, আল্লাহর বিধানের মধ্যে থেকে। অনর্থক ও গুনাহের কথা অবশ্যই বর্জন করতে হবে।
এই যবান আল্লাহর দান। তাই এটি ব্যবহার করতে হবে আল্লাহরই নির্দেশ অনুযায়ী।
আল্লাহ তাআলা আমাদের কাছে কী চান?
আল্লাহ আমাদের কাছে একটি বিষয়ই চান—এই নেয়ামত সচেতনভাবে ব্যবহার করা। আমরা যা বলব, তা যেন ভেবে-চিন্তে বলি। সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির বিষয়টি বিবেচনা না করে যা মুখে এলো, তা-ই যেন না বলি। কারণ, একটি ভুল কথা মানুষকে শুধু দুনিয়াতেই নয়, আখেরাতেও বিপদের মুখে ফেলতে পারে। আল্লাহ তাআলা বলেন
কেবল আমাদের কথা নয়; বরং আমাদের মুখ থেকে বের হওয়া প্রতিটি শব্দও রেকর্ড হচ্ছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন
আগে, রেকর্ডিং এর ধারণা মানুষের কাছে বোঝা কঠিন ছিল। কিন্তু বর্তমানের আধুনিক প্রযুক্তি সেই ধারণাকে সহজ করে দিয়েছে। বর্তমানে আমরা যেকোনো ভালো বা খারাপ কথা সহজেই রেকর্ড করতে পারি।
ঠিক তেমনি, আল্লাহর দরবারে আমাদের প্রতিটি শব্দ রেকর্ড হচ্ছে। জন্মের দিন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এবং মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি শব্দ রেকর্ড হয়। সেদিন, যখন আমরা আল্লাহর সামনে উপস্থিত হবো, তখন প্রতিটি কথার জন্য আমাদের জবাবদিহি করতে হবে।
ধরা যাক, কিছু লোক একটি জায়গায় একত্রিত হয়েছে। এরা জানে, সেখানে সিআইডির টেপরেকর্ডার রাখা হয়েছে। এখন, প্রত্যেকেই সাবধান হয়ে কথা বলবে। কারণ, তারা জানে যে, তাদের কথাগুলো রেকর্ড হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে তা তাদের বিপদে ফেলতে পারে। এটি মনে রেখে, তারা সচেতন হয়ে কথা বলবে।
অথচ মহান আল্লাহ দেড় হাজার বছর আগেই ঘোষণা করে রেখেছেন— তোমাদের প্রতিটি কথা আল্লাহর কাছে রেকর্ড হবে। তাহলে, আমাদের উচিত চিন্তা-ভাবনা করে কথা বলা। দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে নির্বিচারে কথা না বলা। যতটুকু দরকার, ততটুকু বলা।
হাদীস শরিফে রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের এ-ই শিক্ষাই দিয়েছেন, তিনি বলেছেন
আমাদের বলা প্রতিটি কথা রেকর্ড হয়, আমলনামায় লিপিবদ্ধ হয়। প্রতিদিন সেই আমলনামা আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়। যাঁরা আল্লাহকে ভালোবাসেন, তাঁরা এটা সব সময় মনে রাখেন। তাই তারা অপ্রয়োজনীয় কথা কম বলেন, বেশি চুপ থাকেন। ইমাম আওযাঈ রহ. বলেন
ওয়াহাব ইবনু মুনাব্বিহ রহ. বলেন
তিনটি বিষয়ের উপদেশ
মালেক ইবনু দীনার রহ. বলেন, নেক মানুষেরা একে অপরকে তিনটি বিষয়ের উপদেশ দিতেন
আবু বকর সিদ্দীক রাযি. তো জিহ্বাকে শাস্তি দিতেন, যেন ভুল কিছু না বলে।
একবারের ঘটনা। উমর ইবনুল খাত্তাব রাযি. আবু বকর সিদ্দীক রাযি.-এর কাছে গেলেন এবং দেখলেন, তিনি নিজের জিহ্বা ধরে টানছেন। তখন উমর রাযি. বললেন
জবাবে আবু বকর রাযি. বললেন
কিছু বুজুর্গ তো এমন ছিলেন যে, যা বলতেন, তা কাগজে লিখে রাখতেন। পরে রাতে তা দেখে দেখতেন, কোথাও কোনো ভুল তো বলেননি! যদি ভুল পেতেন, সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর কাছে তাওবা করতেন।
আবার কিছু বুজুর্গ এত সতর্ক থাকতেন যে, তারা কুরআনের ভাষায় কথা বলতেন, যাতে যবান থেকে কোনো ভুল না হয়।
এভাবেই আল্লাহওয়ালারা তাদের যবান ঠিক রাখার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করতেন, যাতে তাদের কথা সঠিক ও সংযত হয়। যেমন—
খাজা বাকীবিল্লাহ রহ. ছিলেন কম কথার মানুষ, তাই তিনি অধিকাংশ সময় চুপ থাকতেন। এক ব্যক্তি তাঁকে বললেন, হযরত! আমাকে কিছু উপদেশ দিন, উপকৃত হব।
হযরত উত্তরে বললেন, যে ব্যক্তি আমার নিরবতা থেকে উপদেশ গ্রহণ করেনি, সে আমার কথা থেকেও কিছু নিতে পারবে না।
সুবহানাল্লাহ! কত চমৎকার উপদেশ!
কবি বলেন
যার গভীরতা যতবেশি, সে ততবেশি নিশ্চুপ থাকে।
হযরত মিয়াঁ আসগর হোসাইন রহ. ছিলেন একজন উচ্চমানের বুজুর্গ। তাঁর সঙ্গে মুফতী মুহাম্মাদ শফী রহ. এর গভীর সম্পর্ক ছিল। তাই তিনি তাঁর কাছে প্রায়ই আসা-যাওয়া করতেন। একদিন মুফতী শফী রহ. মিয়াঁ সাহেবের কাছে গেলেন। তখন মিয়াঁ সাহেব বললেন, আজ আমরা উর্দুতে নয়, বরং আরবীতে কথা বলবো।
মুফতী শফী রহ. বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হযরত! কেন আজ আরবীতে কথা বলবো?
মিয়াঁ সাহেব বললেন, এমনিতেই, আজ মনে হলো।
মুফতী শফী রহ. কারণ জানার জন্য পীড়াপীড়ি করলেন, তখন মিয়াঁ সাহেব বললেন, আসল কথা হলো, আমরা দুজন যখন কথাবার্তা শুরু করি, তখন অনেক সময় কথা দীর্ঘ হয়ে যায় এবং গলদ হয়ে যায়। তাই আমি ভেবেছি, যদি আজ থেকে আরবীতে কথা বলি, তাহলে যবান নিয়ন্ত্রণে থাকবে। কারণ, অনর্গল আরবী তুমিও বলতে পারো না, আমিও পারি না।
এরপর মিয়াঁ সাহেব একটি উপমা দিলেন যে, আমাদের অবস্থা ওই ব্যক্তির মতো, যে প্রচুর টাকা-পয়সা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়, কিন্তু গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর আগেই তার টাকা ফুরিয়ে যায়। এখন হাতে কিছু টাকা থাকে, যা সে হিসাব করে খরচ করে, একমাত্র প্রয়োজন ছাড়া আর কিছুই খরচ করে না। অনুরূপভাবে আল্লাহ তাআলা আমাদের জীবন দিয়েছেন। এটি আমাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর পাথেয়। কিন্তু আমরা অহেতুক কথাবার্তা, গল্পগুজব এবং নানা অপ্রয়োজনীয় কাজে সময় নষ্ট করছি। আমরা জানি না, আর কতদিন বাঁচব। তাহলে আমাদের উচিত, জীবনকে হিসাব করে ব্যবহার করা। এতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হবে।
সুবহানাল্লাহ! কত পবিত্র চিন্তা! আল্লাহ যাদেরকে এ ধরনের পবিত্র চিন্তা দান করেছেন, তাদের অবস্থাও এমনই হয়। তারা ভাবেন, আল্লাহ যবান দিয়েছেন, তাই এর যথাযথ মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। এটির সঠিক ব্যবহার হওয়া উচিত। গলদ স্থানে যেন এর ব্যবহার না হয়—এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত।
আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক রহ. বলেন, আমি একবার হজ্জের উদ্দেশ্য রওয়ানা হলাম পথে এক বৃদ্ধা মহিলার সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। তিনি উলের জামা ও ওড়না পরিহিত অবস্থায় রাস্তার উপর বসে আছেন। আমি তাকে সালাম দিলাম।
জবাবে বৃদ্ধা তেলাওয়াত করলেন
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আল্লাহ তাআলা আপনার উপর রহম করুন। আপনি এখানে কী করছেন?’ [সূরা ইয়াসিন : ৫৮]
বৃদ্ধা তেলাওয়াত করলেন
আমি বুঝে নিলাম যে, তিনি পথ হারিয়ে ফেলেছেন। তাই তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কোথায় যাবেন?’
জবাবে বৃদ্ধা তেলাওয়াত করলেন
আমি বুঝে নিলাম যে, মহিলা হজ্জের কাজ শেষ করেছেন। এখন তিনি বাইতুল মুকাদ্দাস যেতে চান। তাই জিজ্ঞেস করলাম, ‘কতক্ষণ এখানে বসে আছেন?’
তিনি তেলাওয়াত করলেন
বললাম, ‘আপনার কাছে আহারের কিছু দেখছি না। কী খেয়ে কাটাচ্ছেন?’
তিনি তেলাওয়াত করলেন
জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখানে তো পানি নেই। অযু করেন কিভাবে?’
তিনি তেলাওয়াত করলেন
আমি বুঝে নিলাম, তিনি তায়াম্মুম করেন। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমার কাছে কিছু খাবার আছে। খাবেন?’
তিনি তেলাওয়াত করলেন
আমি বুঝে নিলাম, তিনি রোজা রেখেছেন। তাই বললাম, ‘কিন্তু এটাতো রমজান মাস নয়!’
জবাবে তিনি তেলাওয়াত করলেন
আমি বুঝে নিলাম, তিনি নফল রোজা রেখেছেন। তাই বললাম, ‘মুসাফির অবস্থায় নফল রোজা না রাখলে অসুবিধা কোথায়?’
তিনি তেলাওয়াত করলেন
আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক রহ. বলেন, আমি অভিভূত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি আমার মত করে কথা বলছেন না কেন?’
জবাবে তিনি তেলাওয়াত করলেন
জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কোন গোত্রের লোক?’
তিনি তেলাওয়াত করলেন
আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক রহ. বলেন, আমি আরজ করলাম, ‘ভুল হয়ে গিয়েছে। আমি মাফ চাচ্ছি।’
উত্তরে তিনি তেলাওয়াত করলেন
আমি বললাম, ‘যদি চান তবে আমার উটনির পিঠে সওয়ার হয়ে আপনার দলের লোকের কাছে যেতে পারেন।’
তিনি তেলাওয়াত করলেন
আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক রহ. বলেন, এই আয়াত শোনার পরে আমি আমার উটনিকে বসালাম। কিন্তু মহিলা তার পিঠে সওয়ার হওয়ার আগে বললেন
তখন আমি আমার দৃষ্টিকে অবনত করে বললাম, ‘এবার সওয়ার হোন।’
মহিলা সওয়ার হতে গেলেন। কিন্তু উটনি ভয় পেয়ে পালাতে উদ্যত হলো। ধস্তাধস্তির ফলে বৃদ্ধা মহিলার কাপড় ছিড়ে গেল। তখন তিনি তেলাওয়াত করলেন
আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক রহ. বলেন, আমি তাকে বললাম, ‘একটু অপেক্ষা করুন। উটনি বেঁধে দিচ্ছি। তারপরে সওয়ার হোন।’
তিনি তেলাওয়াত করলেন
فَفَهَّمْنَاهَا سُلَيْمَانَ
‘এই সব বিষয়ের সমাধান আমি সুলাইমান আ.-কে শিখিয়ে দিয়েছি।’ [সূরা আম্বিয়া : ৭৯]
আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক রহ. বলেন, আমি উটনিকে ভাল করে বাঁধলাম। তারপর তাকে বললাম, ‘এবার সওয়ার হোন।’
তখন তিনি উটের পিঠে সওয়ার হয়ে এই আয়াত তেলাওয়াত করলেন
আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক রহ. বলেন, আমি উটনির লাগাম ধরে হাঁটতে লাগলাম। খুব জোরে হাঁটছিলাম আর চিৎকার করে করে উটনি তাড়াচ্ছিলাম। এই দেখে তিনি তেলাওয়াত করলেন
আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ. বলেন, এবার আমি আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগলাম এবং কবিতার কয়েকটি ছন্দ গুন গুন করে গাইতে লাগলাম। এই দেখে তিনি তেলাওয়াত করলেন
আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক রহ. বলেন, আমি তাকে বললাম, ‘আল্লাহ পাক সত্যি আপনাকে নেককার মহিলা হিসেবে সৃষ্টি করেছেন।
তখন তিনি এই আয়াত তেলাওয়াত করলেন
আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক রহ. বলেন, কিছুক্ষণ চুপচাপ চলার পর তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার স্বামী আছে?’
উত্তরে তিনি তেলাওয়াত করলেন
আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক রহ. বলেন, এবার আমি পুরোপুরি চুপ হয়ে গেলাম। যতক্ষণ কাফেলা না পাওয়া গেল আমি তার সঙ্গে কোনো কথা বললাম না। কাফেলা যখন সামনে দেখতে পেলাম তখন তাকে বললাম, ‘এই যে সামনে কাফেলা এসে গেছে। এই কাফেলায় আপনার কে আছে?’
উত্তরে তিনি তেলাওয়াত করলেন
আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক রহ. বলেন, আমি বুঝে নিলাম এই কাফেলায় তাঁর ছেলে আছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই কাফেলায় কী কাজ করে সে?’
তিনি তেলাওয়াত করলেন
আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক রহ. বলেন, বুঝতে পারলাম তার ছেলে এই কাফেলার পথ নির্দেশক—গাইড। মহিলাকে নিয়ে কাফেলার তাবুতে গেলাম। সেখানে গিয়ে বললাম, ‘এইবার বলুন, এখানে আপনার কে আছে?’
তখন তিনি এই আয়াতগুলো তেলাওয়াত করলেন
আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক রহ. বলেন, এই আয়াতগুলো শোনার পরে আমি চিৎকার করে ডাকতে লাগলাম, ‘হে ইবরাহীম! হে মূসা! হে ইয়াহইয়া!’
কিছুক্ষণ পর চাঁদের মত সুন্দর কয়েকজন নওজোয়ান আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আমরা যখন স্থির হয়ে আসন গ্রহন করলাম তখন মহিলা তার ছেলেদের বললেন
আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ. বলেন, এই আয়াত শুনে তাদের মধ্যে থেকে একটি ছেলে উঠে গেল এবং কিছুক্ষণ পরে খাবার নিয়ে আসলো। খাবার আমার সামনে যখন রাখা হলো তখন তিনি বললেন
আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক রহ. বলেন, আমি আর থাকতে পারলাম না। ছেলেদের বললাম, ‘এই খাবার আমার জন্য হালাল হবে না যতক্ষণ না তোমরা এই মহিলার রহস্য বলছো।’
তখন ছেলেরা আমাকে জানালো, ‘চল্লিশ বছর যাবত আমাদের মায়ের এই অবস্থা। তাঁর ভয় হল, কেয়ামতের দিন প্রতিটি কথার জবাব তাঁকে দিতে হবে। এ কারণে এই চল্লিশ বছরে তিনি কুরআন মজিদের আয়াত ছাড়া একটি বাক্যও বলেন নি। এই নিয়ম তিনি এই জন্য পালন করছেন যেন যবান থেকে কোনো অপ্রয়োজনীয় কথা বের না হয়ে পড়ে। তাহলে আল্লাহ নারাজ হবেন।’
আমি বললাম
[সূত্র : আল মুসতাতারফু ফি কুল্লি ফান : ১/৫৬,৫৭]
কেয়ামতের দিন সবাইকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। সেদিন আল্লাহর দরবারে এসব বান্দাও উপস্থিত হবেন, যারা যবান সংযত রাখতে কত সাধনা করেছেন! এমনকি কেউ কেউ জীবনের চল্লিশটি বছর কেটেছেন কেবল কুরআনের ভাষায় কথা বলে।
আর আমাদের মতো মূর্খ ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ বাক্যবাগীরা? সেদিন আল্লাহ যদি জিজ্ঞেস করেন—
অমুককে অপমান কেন করেছিলে?
অমুককে ‘ইতর’ বলে গালি দিলে কেন?
অমুককে ‘বেঈমান’ বললে কেন?
আজ আমরা হয়তো কথার খৈ ফুটিয়ে চলেছি, কিন্তু সেদিন কী জবাব দেব? ভেবে দেখেছি কি? নবীগণও যেদিন আল্লাহর ভয়ে থরথর কাঁপবেন, সেদিন আমাদের কী অবস্থা হবে?
সেদিন মুক্তির চিন্তায় দিশেহারা থাকবে
কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা নিজ শান ও শওকতের সঙ্গে উপস্থিত থাকবেন। তখন প্রত্যেকে মুক্তির চিন্তায় দিশেহারা থাকবে। আল্লাহ তাআলা খ্রিস্টানদের জিজ্ঞেস করবেন, তোমরা আমার সৃষ্টিকে আমার সঙ্গে শরিক করলে কেন?
তারা নিজেদের বাঁচানোর জন্য ঈসা আ.-এর নাম নেবে— তিনি আমাদের বলেছিলেন।
তখন আল্লাহ ঈসা আ.-কে জিজ্ঞেস করবেন
এ প্রশ্ন শুনে ঈসা আ.-এর শরীরের প্রতিটি লোমকূপ থেকে ঘামের বদলে রক্ত ঝরবে!
ভেবে দেখুন, যখন সত্যবাদীদের অবস্থা এত ভয়াবহ হবে, তখন আমাদের মত মিথ্যাবাদীদের কী পরিণতি হবে?
আজ আমরা অবাধে যবান চালাই, কিন্তু সেদিন এসবের জবাব দিতে পারবো তো?
রাসূল ﷺ বলেছেন, অনেক মানুষ জিহ্বার গুনাহের কারণে জাহান্নামে যাবে। যেমন— মিথ্যা বলা, গীবত করা, কারও মনে কষ্ট দেওয়া, খারাপ বা অশ্লীল কথা বলা, অন্যের দুঃখ দেখে আনন্দ পাওয়া। এগুলো জিহ্বার গুনাহ। এসব গুনাহর পরিণতি জাহান্নাম। হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূল ﷺ বলেন
তাই আমাদের উচিত জিহ্বাকে সংযত রাখা। ভালো কথা বলো, না হলে চুপ থাকো। কারণ, খারাপ কথা বলার চেয়ে চুপ থাকাই ভালো।
আমাদের শায়খ ও মুরশিদ মাহবুবুল ওলামা মাওলানা পীর যুলফিকার আহমদ নকশবন্দী দা. বা. একটি ঘটনা প্রায় বলে থাকেন যে, হযরত হাসান বসরী রহ. তাঁর মজলিসে প্রায় বলতেন, ছোট একটি মেয়ে তাকে উপদেশ দিয়েছিল। কেউ জানতে চাইল, হযরত, কী উপদেশ দিয়েছিল? তিনি বললেন, একবার বৃষ্টি হয়েছিল এবং রাস্তায় কাদা জমে গিয়েছিল। সবাই সাবধানে হাঁটছিল। আমি যেতেই ছিলাম, এমন সময় ছোট একটি মেয়ে দেখতে পেলাম। আমি তাকে বললাম, সাবধানে চলো, নাহয় পড়ে যাবে।
মেয়েটি দ্রুত উত্তর দিল, আমি পড়ে গেলে কোন অসুবিধা নেই, আবার উঠে দাঁড়াব। কিন্তু আপনি নিজের প্রতি খেয়াল রাখুন। আপনি যদি পড়ে যান, উম্মতের কী হবে? আপনি তো তাদের জন্য এক অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। খেয়াল রাখবেন, যেন আপনি পিছলে না পড়েন।
হাসান বসরী রহ. বলতেন, ছোট্ট মেয়েটি আমাকে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিল।
সুতরাং মনে রাখবেন, যবানের ভুল পা পিছলে পড়ে যাওয়ার থেকেও বেশি বিপজ্জনক। পা পিছলে পড়ে গেলে মানুষ আবার দাঁড়াতে পারে, কিন্তু যবানে ভুল হয়ে গেলে তা ঠিক করা যায় না।
যবানের সঠিক ব্যবহার জান্নাতের পথে নিয়ে যাবে
যদি এর মোড় সামান্য পরিবর্তন করা যায়, একে যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে যথাযথভাবে ব্যবহার করা যায়, তাহলে দেখতে পাবেন, আপনার আমলনামায় নেকীর পাহাড় গড়ে উঠছে। আপনার জন্য জান্নাতে মহল তৈরি হচ্ছে। সর্বোপরি আল্লাহ তাআলার রেজামন্দি লাভে ধন্য হচ্ছেন। নবীজী ﷺ বলেন
প্রথমটি হলো, তার দুই চোয়ালের মাঝখানে থাকা বস্তু, অর্থাৎ—যবান। সে এই যবানের মাধ্যমে মন্দ কাজ করবে না। মিথ্যা বলবে না, গীবত করবে না, কারো মনে কষ্ট দিবে না, ইত্যাদি।
দ্বিতীয়টি হলো, তার দুই পায়ের মাঝখানে অবস্থিত বস্তু, অর্থাৎ—লজ্জাস্থান। সে একে অপব্যবহার করবে না, হারাম কাজ থেকে বিরত থাকবে। যদি সে এই দুটি ব্যাপারে নিশ্চয়তা দেয়, তবে আমি তাকে জান্নাতের নিশ্চয়তা দিচ্ছি।
একারণে প্রখ্যাত তাবিয়ী ইউনুস ইবন উবাইদ রহ. বলেন
মানবদেহ যবানের নিয়ন্ত্রণে থাকে
হাদীস শরিফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন যখন ভোর হয়, তখন মানুষের দেহের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যবানকে উদ্দেশ করে বলে
অর্থাৎ, মানবদেহ যবানের নিয়ন্ত্রণে থাকে। যদি যবান ভালো কথা বলে, তাহলে পুরো দেহ সঠিক পথে চলে। আর যদি যবান মন্দ কথা বলে, তাহলে গোটা দেহ গুনাহের পথে অগ্রসর হয়।
এজন্যই সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যবানকে অনুরোধ করে— তুমি সঠিক থাকো, কারণ তুমি যদি অন্যায় করো, তাহলে আমরাও বিপদে পড়বো।
কীভাবে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কথা বলে?
প্রশ্ন হলো, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কথা বলে কীভাবে?
এই প্রশ্নের উত্তর হলো, আল্লাহ চাইলে যবানকে এমন শক্তি দিতে পারেন, যার মাধ্যমে সে অন্যান্য অঙ্গ—প্রত্যঙ্গের সঙ্গে কথা বলে।
তাছাড়া কেয়ামতের দিন তো সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই কথা বলবে, যেমন হাত-পা সাক্ষ্য দেবে। তাহলে দুনিয়াতেও আল্লাহ চাইলে এই ক্ষমতা দিতে পারেন, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই।
এক ব্যক্তি হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী রহ.-কে প্রশ্ন করলেন, হযরত! কুরআনে বলা হয়েছে, কেয়ামতের দিন হাত, পা ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সাক্ষ্য দেবে। কিন্তু এগুলো তো কথা বলতে পারে না! তাহলে কীভাবে কথা বলবে?
হযরত থানবী রহ. পাল্টা প্রশ্ন করলেন, যবানের তো আরেকটি যবান নেই! তাহলে সে কীভাবে কথা বলে?
তারপর তিনি বলেন, যবানও তো মাংসের একটি টুকরো মাত্র, তবুও কথা বলতে পারে। কারণ, আল্লাহ তাকে বাকশক্তি দিয়েছেন। যদি তিনি এই শক্তি কেড়ে নেন, তাহলে যবানও কথা বলতে পারবে না। তেমনিভাবে, যদি আল্লাহ হাত-পা ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে বাকশক্তি দান করেন, তবে সেগুলোও কথা বলতে পারবে।
মোটকথা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কথা বলতে পারা হাকীকতও হতে পারে। বাস্তবেই প্রতিদিন ভোরে সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যবানকে সম্বোধন করে কথা বলে। অথবা রূপক অর্থেও হতে পারে। সকল অঙ্গ যেহেতু যবানের অধীন, তাই যবানের অপব্যবহার করা যাবে না। একে সরল পথে চালনার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে।
যবানের সঠিক ব্যবহারের উপায়সমূহ
মুহতারাম হাজেরীন! এতক্ষণের আলোচনা থেকে নিশ্চয় আমরা বুঝে গিয়েছি যে, যবান এমন একটি বস্তু, যা মানুষকে জান্নাতের দিকে নিয়ে যেতে পারে, আবার তা জাহান্নামেও নিক্ষেপ করতে পারে। তাই যবানের নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি, যেন কোনো অযথা কথা না বের হয়।
প্রশ্ন হল, এর কী কী উপায় হতে পারে? কোন পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করলে যবান হেফাজতের এই মহান ইবাদত আমরা করতে পারবো?
এক. বেশি কথা না বলি
এর সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, বেশি কথা না বলা। কারণ, যত বেশি কথা বলবে, ততই গুনাহের ফাঁদে পড়ার ঝুঁকি বাড়বে। অধিক বকবক করলে যবান নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। আর লাগামহীন যবানে অন্যায় কথা চলে স্বাভাবিক।
বিশেষ করে যাদের ভাষা-ব্যবহার ভালো নয় তাদের সাথে কম কথা বলুন। কারণ, তাদের খারাপ কথার উত্তর দিতে গেলে তাদের কাছে আরো জঘন্য ভাষার মজুদ আছে যা তারা আপনার বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে।
উমর রাযি. বলতেন
অন্তর হল হাঁড়ির মত এবং জিহ্বা হল চামচের মত
যেমননিভাবে ডাক্তাররা জিহ্বার রঙ দেখে শরীরের রোগ নির্ণয় করতে সক্ষম হন, অনুরূপভাবে ওলামায়েকেরাম মুখের ভাষা শুনে অন্তরের রোগ নির্ণয় করতে সক্ষম হন। ইয়াহইয়া ইবনু মুআয রহ. বলতেন
সুতরাং অন্তরে অন্ধকার থাকলে যবান মন্দ কথা বলবে। পক্ষান্তরে অন্তরে নূর থাকলে যবান বের করবে পবিত্র ও মার্জিত কথা।
দুই. প্রথমে মাপুন তারপর বলুন
জনৈক বুযুর্গ বলতেন, পহলে তোলো, ফের বোলো। অর্থাৎ, আগে মাপুন, তারপর বলুন। আপনি যদি প্রতিটি কথার ওজন নির্ণয় করে বলার অভ্যাস গড়ে তোলেন, তাহলে আপনার যবান নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
বলা হয়ে থাকে, নির্বোধকে চেনাতে গলায় ঘণ্টা বাঁধার প্রয়োজন হয় না; সে নিজেই মুখ চালিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে ফেলে।
জ্ঞানীরা বলেন, বুদ্ধিমান আগে ভাবে, তারপর কথা বলে; পক্ষান্তরে নির্বোধ আগে বলে, তারপর ভাবে। এটাই বুদ্ধিমান ও নির্বোধের মূল পার্থক্য।
কিন্তু আজকাল আমরা উল্টোটা করি— আগে বলে ফেলি, তারপর ভাবি। অনেক সময় তো ভাবার সুযোগই নিই না; শুধু বলে যাই, কিন্তু একবারও পরিমাপ করি না— কথাগুলো আসলেই ঠিক হলো কিনা! এজন্য হাসান বসরী রহ. বলতেন
আর অজ্ঞের হৃদয় থাকে তার জিহবার পেছনে। তাই সে যখনই কোনো কথা বলার ইচ্ছা করে চিন্তা ভাবনা করা ছাড়াই বলে ফেলে। [আলবায়ান ওয়াততাবয়ীন : ১/১৫৫]
তিন. নিজের কথা নিজের কানে শোনার অভ্যাস করুন
নিজের কথা নিজের কানে শোনার অভ্যাস করতে হবে। যে ব্যক্তি নিজের কথা শোনে না, সে কীভাবে অন্যের কথা শুনবে!
কবি চমৎকার বলেছেন
আল্লাহ তো যবান দিয়েছেন এক, কান দিয়েছেন দুটি।
সুতরাং হে মানুষ! কথা দু’টা শোনার পর জবাব দিবে একটি।
চার. কাউকে নিয়ে ঠাট্টা-উপহাস করবেন না
এখন মানুষ বিনোদনের জন্যও অন্যকে নিয়ে ঠাট্টা-উপহাস করে। বিদ্রুপ করে। কষ্ট দিয়ে অন্তর পুড়িয়ে দেয়। মনে রাখবেন, তরবারির আঘাত শরীরে লাগে, কিন্তু কথার আঘাত লাগে অন্তরে।
আল্লাহ তাআলা বলেন
নবীজী ﷺ বলেছেন
وَيْلٌ لِلّذِي يُحَدِّثُ الْقَوْمَ، ثُمّ يَكْذِبُ لِيُضْحِكَهُمْ وَيْلٌ لَهُ. وَوَيْلٌ لَهُ
ধ্বংস ওর! যে মানুষকে হাসানোর জন্য মিথ্যা বলে। ধ্বংস ওর! ধ্বংস ওর জন্য! [মুসনাদে আহমাদ : ২০০২১]
ঠাট্টা-উপহাস নিষিদ্ধ কেন? কারণ, এতে মানুষ অনর্থক কথা বলে। সহজেই অন্যের অন্তরে আঘাত করে। কিন্তু কেয়ামতের দিন এসব কথার জবাব দিতে হবে। আর সেটা হবে অনেক কঠিন!
পাঁচ. গোস্বা নিয়ন্ত্রণ করার অভ্যাস করুন
যে লোকটির দাবি হল, সে সঠিকভাবে বলে, স্বাভাবিক কথা বলে, সে লোকটি গোস্বার সময় কিভাবে কথা বলে তা দেখলেই বোঝা যাবে যে, তার দাবি আসলে কতটা সত্য। সাধারণ সময়ে মানুষ যখন খুশি থাকে, তখন তো তাকে কেউ বিরক্ত করেনি, তাই সে কোন খারাপ কথা বলবে না। কিন্তু যখন কিছু বিরক্তিকর ঘটবে, তখন তার মুখ ও শরীরের ভাষা কেমন হবে, সেটা বোঝা যাবে। রাগের সময়েই বুঝা যায়, মানুষ কতটা ধৈর্যশীল।
আমাদের শায়খ ও মুরশিদ মাহবুবুল ওলামা মাওলানা পীর যুলফিকার আহমদ নকশবন্দী দা. বা. প্রায় বলে থাকেন— সাধারণত, পুরুষেরা রাগের সময় হাত নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না, আর মহিলাদের যবান নিয়ন্ত্রণে থাকে না। অনেক মহিলার মুখে এমন কথা থাকে, যা তরবারির মতো, কখনো মরিচা ধরে না, সবসময় চালু থাকে। অথচ লোহার তরবারি যে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারে না, মুখের তরবারি তা ছিন্ন করে দেয়।
সালমান ফার্সী রাযি.-এর উপদেশ
এক ব্যক্তি সালমান ফার্সী রাযি.-এর কাছে এসে বলল, হে আবু আবদুল্লাহ! আমাকে উপদেশ দিন।
তিনি বললেন, কম কথা বলো।
লোকটি বলল, মানুষের মাঝে বসবাস করে কেউ কি একেবারেই কথা না বলে থাকতে পারে?
তিনি বললেন, যদি কথা বলো, তবে সত্য বলো। না হলে চুপ থাকো।
লোকটি আবার বলল, আরও উপদেশ দিন।
তিনি বললেন, রাগ কোরো না।
লোকটি বলল, আপনি আমাকে রাগ না করতে বলছেন, কিন্তু কখনো কখনো রাগ চলে আসে, যা আমি আটকাতে পারি না!
তিনি বললেন
ছয়. মিথ্যা বলার অভ্যাস ছেড়ে দিন
মিথ্যা বলা শুধু একটি গুনাহ নয়, এটি অন্যান্য অনেক গুনাহের দিকে ধাবিত করে। সত্য বলার অভ্যাস একজন ব্যক্তিকে গীবত, চোগলখোরি (একজনের কথা অন্যজনের কাছে লাগানো), অতিরঞ্জন, প্রতারণা এবং অপ্রয়োজনীয় কথা বলা থেকে রক্ষা করতে পারে।
রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন
إنَّ الصدقَ يَهدي إلى البرِّ وإنَّ البرَّ يَهدي إلى الجنَّةِ وإنَّ الرَّجلَ ليصدقُ حتَّى يكونَ صدِّيقًا وإنَّ الكذبَ يَهدي إلى الفجورِ وإنَّ الفجورَ يَهدي إلى النَّارِ وإنَّ الرَّجلَ ليكذبُ حتَّى يُكتبَ عند اللَّهِ كذَّابًا
নিশ্চয়ই সত্য কথা মানুষকে সৎকর্মের দিকে ধাবিত করে এবং সৎকর্ম জান্নাতের পথপ্রদর্শন করে। আর একজন ব্যক্তি সত্যবাদী হতে হতে আল্লাহর নিকট সিদ্দীক (অর্থাৎ মহাসত্যবাদী) হিসেবে লিখিত হয়ে যান। [সহীহ মুসলিম : ২৬০৭]
আর নিশ্চয়ই মিথ্যা মানুষকে গুনাহের দিকে করে এবং অসৎকর্ম জাহান্নামের পথপ্রদর্শন করে। আর এক ব্যক্তি মিথ্যা বলতে বলতে অবশেষে আল্লাহর কাছে ‘ মহা মিথ্যাবাদী’ হিসেবে লিখিত হয়ে যায়।
মজা করে মিথ্যা বলা
অনেকে মজা করে মিথ্যা বলেন। তারা মনে করেন যে, মিথ্যা যদি হাস্যরস বা কৌতুকের জন্য বলা হয়, তাহলে তা ক্ষতি করে না। অথচ এটাও হারাম।
উমর রাযি. বলতেন
মিথ্যার নিকৃষ্টতম বাহন: ‘লোকে বলে’
আমাদের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। রাসূলুল্লাহ ﷺ এক হাদীসে বলেছেন
এই সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর অর্থবোধক হাদীসে রাসূলুল্লাহ ﷺ মানুষের একটি বড় দুর্বলতার দিক তুলে ধরেছেন। তা হল এই যে, কিছু মানুষ আছে, যারা কোনো সংকোচ ছাড়াই মিথ্যা বলে। এরা প্রকাশ্য মিথ্যাবাদী।
আবার কিছু মানুষ আছে, যারা ‘মিথ্যুক’ হিসেবে প্রমাণিত হওয়ার ভয় পায়। তারা সরাসরি মিথ্যা বলে না, বরং অন্যের কাঁধে দোষ চাপিয়ে দেয়। তারা বলেÑ লোকে বলে..., অনেকে বলছে..., শুনেছি...,অনেকের মুখেই শুনলাম...।
এভাবে তারা মিথ্যার দায় নিজের ওপর না নিয়ে, সমাজে ভিত্তিহীন কথা ছড়িয়ে দেয়।
কিন্তু কথা হল, যদি আমরা এসব কথা মিথ্যা মনে করি, তাহলে তা অন্যদের কাছে প্রচার করার কোনো দরকার নেই। আর যদি সত্য মনে করি, তাহলে আমাদের কাছে কোনো প্রমাণ আছে কি? যদি প্রমাণ না থাকে, তাহলে এটি ভিত্তিহীন ও মিথ্যার অন্তর্ভুক্ত।
তাই অন্যের সম্পর্কে ‘লোকে বলে’ জাতীয় বাক্যের মাধ্যমে কথা বলা মিথ্যার শামিল এবং এটি হারাম।
রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের সতর্ক করেছেন যে, মিথ্যার অন্যতম বড় বাহন হলো ‘লোকে বলে’ ধরনের কথা। তাই আমাদের উচিত সত্য যাচাই ছাড়া কোনো কথা না বলা এবং গুজব ছড়ানো থেকে বিরত থাকা।
আল্লাহ আমাদের সত্য বলার এবং মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কথা থেকে দূরে থাকার তাওফিক দান করুনÑআমীন।
সকল বিবাদ মিটে যাবে
এই কথাগুলো মাথায় রেখে চারপাশে একটু চোখ বুলিয়ে দেখুন। তা হলে অনুভব করতে পারবেন, বর্তামান সমাজে কী হচ্ছে! কতভাবে গুজব ছড়াচ্ছে! ভিত্তিহীন কথার উপর ভিত্তি করে অন্যের প্রতি কত কুধারণা জন্ম নিচ্ছে! এভাবে হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতা কী পরিমাণে তৈরি হচ্ছে! আল্লাহর রাসূল ﷺ -কে পরিত্যাগ করার কারণেই এসব কিছু হচ্ছে।
যদি আমরা রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর শিক্ষামালাকে আপন করে নিতে পারি, যদি তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী জীবন চালাতে পারি, তাহলে বহু সামাজিক সমস্যা এমনিতেই দূর হয়ে যাবে।
মামলায় হারলো মুসলমান জিতলো ইসলাম
ভারতের একটি ঘটনা। একটি জমি নিয়ে মুসলমান ও হিন্দু—উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ দেখা দিল। মুসলমানদের দাবি ছিল, জমিটি তাদের, সেখানে মসজিদ হবে। হিন্দুরা বলল, জমিটি তাদের, সেখানে মন্দির হবে। এ নিয়ে উত্তেজনা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দেয়। সে সময় মামলার বিচারক ছিলেন একজন ইংরেজ। বিষয়টি অত্যন্ত জটিল হওয়ায় তিনিও চিন্তিত হয়ে পড়লেন— কীভাবে এর সমাধান করা যায়?
এক পর্যায়ে, শুনানির সময় হিন্দুরা বলল, আমরা একটি উপায় বলতে পারি, যাতে আদালতের রায় ছাড়াই সমস্যাটির সমাধান হয়ে যেতে পারে।
বিচারক জানতে চাইলেন, কী সেই উপায়?
হিন্দুরা বলল, আমরা একজন মুসলমান আলেমের নাম বলছি। আপনি তাঁকে ডেকে পাঠান। তিনি যা রায় দিবেন, আমরা তা মেনে নেব। যদি তিনি বলেন, জমিটি হিন্দুদের, তাহলে সেটি আমাদের হবে। আর যদি বলেন, জমিটি মুসলমানদের, তাহলে তারা তা নিয়ে নেবে। তবে আমরা আলেমের নাম কেবল আপনাকে বলব, জনসাধারণকে জানাব না।
বিচারক প্রস্তাবে রাজি হয়ে মামলার পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করলেন।
পরবর্তীতে বিষয়টা কোনোভাবে সাধারণ হিন্দুরাও জেনে যায়। তখন হিন্দুদের সাধারণ জনগণ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলল, তোমরা কী করেছ! এমন একজন লোককে সালিশ বানালে, যে মুসলমানই শুধু নয়, বরং তাদের ধর্মীয় গুরু! সে নিশ্চয়ই মুসলমানদের পক্ষেই কথা বলবে!
অপরদিকে মুসলমানরা আনন্দিত—একজন মুসলমান আলেম সালিশ হবেন? তাহলে তো আমাদের জয় নিশ্চিত! মসজিদ নির্মাণের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবেই!
নির্ধারিত দিনে আদালত কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেল। সবাই চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষায়। হিন্দুরা সেই আল্লাহওয়ালা আলেমকে নিয়ে এলো এবং বিচারকের উদ্দেশ্যে বলল, আপনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করুন, জমিটির প্রকৃত মালিকানা কার?
বিচারক আলেমকে প্রশ্ন করলেন, এই জমির প্রকৃত মালিক কারা?
আলেম নির্ভীকভাবে উত্তর দিলেন, জমিটি হিন্দুদের।
বিচারক আবার প্রশ্ন করলেন, তাহলে এখানে হিন্দুরা মন্দির তৈরি করতে পারবে কি?
আলেম বললেন, জমির প্রকৃত মালিক হিন্দুরা। সেখানে তারা কী করবে, তা সম্পূর্ণ তাদের ব্যাপার।
এই উত্তরের ভিত্তিতে বিচারক চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করলেন, আজ মামলায় হারলো মুসলমান, কিন্তু জিতলো ইসলাম।
এ কথা শুনে হিন্দুরা বিস্মিত হয়ে বলে উঠল, জজ সাহেব! আপনি রায় তো আমাদের পক্ষেই দিলেন, কিন্তু তবুও আমরা কালিমা পড়ে মুসলমান হচ্ছি! মুসলমান হয়েই আমরা এখানে মসজিদ নির্মাণ করব।
সত্য কথা বলার বরকতে হিন্দুরা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করল। আল্লাহর রহমতে সেই জমিতে একটি সুন্দর মসজিদও নির্মিত হলো। সত্যের জয় হলো।
কবি চমৎকার বলেছেন
অনন্তকাল থেকে আল্লাহপ্রেমিকদের পথ ছিল এটাই।
মুহতারাম হাজেরীন! সারকথা, যবানকে নেকপথে পরিচালিত করুন। আল্লাহর বাতলানো পদ্ধতিতে কাজে লাগান। তারপর দেখুন, আপনার আমলনামায় কীভাবে নেকী জমা হতে থাকে।
গল্প—গুজবে ব্যস্ততা : একটি বিপজ্জনক অভ্যাস
অথচ আমাদের সমাজে যবানের জিহ্বার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কথার স্রোত অবলীলায় চলতেই থাকে—যা অত্যন্ত ভয়াবহ বিষয়। দেখা যায়, সময় পেলেই আমরা বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে বসে পড়ি, বলি—এসো, বসে একটু গল্প-গুজব করি।
কিন্তু সেই গল্পের আসরে কী হয়? মিথ্যা বলা হয়। গীবত করা হয়। অন্যের চরিত্র হনন করা হয়। বিদ্রূপ ও ঠাট্টা-মশকরা চলে। এভাবে গল্প করার নামে গুনাহের পাহাড় জমতে থাকে।
এই অভ্যাস থেকে আমাদের বের হতে হবে। জিহ্বাকে সংযত রাখা আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
যবানকে জিকিরের মাধ্যমে সতেজ রাখুন
বন্ধুগণ! অনুষ্ঠান-আসরে বসে নিজের সম্পর্কে যবান চালাবেন না। যবানকে জিকিরের মাধ্যমে সতেজ রাখুন, তাহলে দ্রুত আপনার অবস্থার উন্নতি ঘটবে।
একবার এক সাহাবী বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ইসলামের নিয়ম-কানুন তো অনেক বেশি মনে হয়। আমাকে এমন কিছু বলুন, যা আমি দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরতে পারি।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন
আল্লাহ আমাদেরকে যবান সঠিকভাবে ব্যবহার করার তাওফীক দান করুন। এ পর্যন্ত যবান দ্বারা যত গুনাহ করেছি, হে আল্লাহ! সবগুলো মাফ করে দিন। আমীন।
মুসলিম বাংলা