ধর্ষণ-ব্যভিচার রোধে প্রচলিত আইন বনাম ইসলামী আইন

ধর্ষণ ও ব্যভিচার কী?
ধর্ষণ হল, জোরপূর্বক কোন নারীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা। আর ব্যভিচার হল, নারী পুরুষের সম্মতিতে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা।
তাহলে ধর্ষণ ও ব্যভিচারের মাঝে পার্থক্য হল, সম্মতি আর অসম্মতির উপর। অসম্মতিতে হলে যা ধর্ষণ, তা’ই সম্মতিতে হলে ব্যভিচার।
অবশ্য বাংলাদেশ আইনে ১৬ বছরের নিচের বয়সী মেয়ের সাথে যৌন সম্পর্ক সম্মতিতে হলেও ধর্ষণ হিসেবে ধর্তব্য হয়।
ব্যভিচার বিষয়ক বাংলাদেশের আইন
বাংলাদেশ দণ্ডবিধি আইনের ৪৯৭ ধারায় ব্যভিচারের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে,
“যদি কোনও ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির স্ত্রী অথবা যাকে সে অপর কোনও লোকের স্ত্রী বলে জানে বা তার অনুরূপ বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে এমন কোনও নারীর সঙ্গে উক্ত নারীর স্বামীর সম্মতি বা সমর্থন ব্যতিরেকে এরূপ যৌন সম্পর্ক করে যা নারী ধর্ষণের শামিল নহে, সে ব্যক্তি ব্যভিচারের অপরাধে দোষী এবং যেকোনও বিবরণে কারাদণ্ডে যার মেয়াদ পাঁচ বছর পর্যন্ত হতে পারে অথবা অর্থ দণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। তবে ব্যভিচারে অংশগ্রহণকারী নারী দুষ্কর্মের সহায়তাকারিণী হিসেবে দণ্ডিত হবে না”।
এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়
১– অন্যের স্ত্রীর সাথে ব্যভিচার নিষিদ্ধ। কিন্তু অবিবাহিত হলে বা বিধবা হলে ব্যভিচার কোন অপরাধ নয়।
২– স্বামীর অনুমোদনে বা সমর্থনে ব্যভিচার করলে তা কোন অপরাধ নয়।
৩– ব্যভিচারী হিসেবে সাজা পাবে কেবল পুরুষ।
৪– ব্যভিচারে নারী প্ররোচিতকারীনী হলেও কোন অপরাধ বলে গণ্য হবে না।
৫– ব্যভিচারবিরোধী বাংলাদেশের আইনে স্ত্রী ব্যভিচারী স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন না, তেমনি স্বামীও স্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারেন না। কেননা আইন কেবল নারীর স্বামীকে ব্যভিচারের পুরুষ সঙ্গীর বিরুদ্ধে মামলা করার অধিকার দিয়েছে।
উপরোক্ত অদ্ভুত আইন বাংলাদেশের সংবিধানের একাধিক ধারাকে লঙ্ঘণ করে করা হয়েছে। যেমন-
১
স্বামীর অনুমোদনে পর পুরুষের সাথে গণিকাবৃত্তির পথকে সুগম করেছে।
অথচ সংবিধানে গণিকাবৃত্তি একটি অপরাধ-
সংবিধানের ১৮(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন’।
২
কেবলমাত্র পুরুষ সঙ্গীর বিরুদ্ধে মামলা করার সুযোগ থাকায় এটি সংবিধানের ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদের সমতার বিধান লংঘন করেছে। ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ আর ২৮ (১) অনুচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনও নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’
৩
বাংলাদেশের মত ৯০/৯৫ পার্সেন্ট মুসলমানদের দেশে ধর্মীয়ভাবে কঠোর নিষিদ্ধ ব্যভিচারকে অবিবাহিত এবং বিধবার সাথে ব্যভিচারকে পরোক্ষ অনুমোদন দিয়ে এ দেশের জনগণের অভিপ্রায় ও মানসিকতাকে চরমভাবে অবজ্ঞা করা হয়েছে।
সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে, ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোনও আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসমঞ্জস হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে।
অন্যদিকে সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘(১) সংবিধানের তৃতীয় ভাগের (মৌলিক অধিকার) বিধানাবলীর সহিত অসমঞ্জস সকল প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, এই সংবিধান-প্রবর্তন হইতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।
(২) রাষ্ট্র এই ভাগের কোন বিধানের সহিত অসমঞ্জস কোন আইন প্রণয়ন করিবেন না এবং অনুরূপ কোন আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোন বিধানের সহিত যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।’
ব্যভিচারবিরোধী দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারা সংবিধানের একাধিক বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় এটি সাংবিধানিকভাবেই বাতিলযোগ্য।
এই হল, আমাদের দেশের ব্যভিচার বিষয়ক আইনের প্রকৃত চিত্র।
ব্যভিচার বিষয়ক ইসলামী আইন
ইসলাম মানুষের জীবনাচার সুন্দর ও সুশৃঙ্খল করার জন্য দুই প্রকারের আইন আরোপ করেছে। এক প্রকার আইন হল, যা প্রয়োগ হবে দুনিয়াতে। আরেক হল, আখেরাতে।
অন্য শব্দে বললে, অপরাধ দমনে এক ধরণের শাস্তি দিয়েছে দুনিয়াতে, আরেক প্রকার শাস্তি রেখেছে আখেরাতে।
ব্যভিচার একটি সামাজিক ব্যাধি। যার মাধ্যমে পারিবারিক জীবন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পরে। সামাজিক জীবনে নেমে আসে বিশৃঙ্খলা। সেই সাথে নানাভিদ যৌনবাহিত রোগের মাধ্যমে পুরো জাতিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়।
তাই ব্যভিচার রোধে ইসলামের বিধান খুবই সুষ্পষ্ট এবং কঠোর।
যেমন-
১– ব্যভিচারের কাছে যাওয়াও নিষেধ।
وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَا ۖ إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيلًا [١٧:٣٢]
আর ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ। [সূরা ইসরা-৩২]
২- নবীর প্রকৃত আনুগত্যশীল হবার জন্য ব্যভিচার না করা শর্ত।
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِذَا جَاءَكَ الْمُؤْمِنَاتُ يُبَايِعْنَكَ عَلَىٰ أَن لَّا يُشْرِكْنَ بِاللَّهِ شَيْئًا وَلَا يَسْرِقْنَ وَلَا يَزْنِينَ [٦٠:١٢]
হে নবী, ঈমানদার নারীরা যখন আপনার কাছে এসে আনুগত্যের শপথ করে যে, তারা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না,[সূরা মুমতাহিনা-১২]
৩– ব্যভিচার শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
وَالَّذِينَ لَا يَدْعُونَ مَعَ اللَّهِ إِلَٰهًا آخَرَ وَلَا يَقْتُلُونَ النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ وَلَا يَزْنُونَ ۚ وَمَن يَفْعَلْ ذَٰلِكَ يَلْقَ أَثَامًا [٢٥:٦٨]
এবং যারা আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্যের এবাদত করে না, আল্লাহ যার হত্যা অবৈধ করেছেন, সঙ্গত কারণ ব্যতীত তাকে হত্যা করে না এবং ব্যভিচার করে না। যারা একাজ করে, তারা শাস্তির সম্মুখীন হবে। [সূরা ফুরকান-৬৮]
৪- ব্যভিচারকারী নারী পুরুষ উভয়ে সমান শাস্তির উপযুক্ত। নারী পুরুষে শাস্তিতে কোন বৈষম্য নেই।
وَاللَّذَانِ يَأْتِيَانِهَا مِنكُمْ فَآذُوهُمَا [٤:١٦]
তোমাদের মধ্য থেকে যে দু’জন সেই কুকর্মে লিপ্ত হয়, তাদেরকে শাস্তি প্রদান কর। [সূরা নিসা-১৬]
৫- অবিবাহিত ব্যভিচারীদের প্রকাশ্য একশত বেত্রাঘাত করতে হবে।
الزَّانِيَةُ وَالزَّانِي فَاجْلِدُوا كُلَّ وَاحِدٍ مِّنْهُمَا مِائَةَ جَلْدَةٍ ۖ وَلَا تَأْخُذْكُم بِهِمَا رَأْفَةٌ فِي دِينِ اللَّهِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ۖ وَلْيَشْهَدْ عَذَابَهُمَا طَائِفَةٌ مِّنَ الْمُؤْمِنِينَ [٢٤:٢]
ব্যভিচারিণী নারী ব্যভিচারী পুরুষ; তাদের প্রত্যেককে একশ’ করে বেত্রাঘাত কর। আল্লাহর বিধান কার্যকর কারণে তাদের প্রতি যেন তোমাদের মনে দয়ার উদ্রেক না হয়, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক। মুসলমানদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে। [সূরা নূর-২]
৬–বিবাহিত ব্যভিচারীকে প্রকাশ্য পাথর মেরে হত্যা করা হবে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
«خُذُوا عَنِّي، فَقَدْ جَعَلَ اللهُ لَهُنَّ سَبِيلًا، الثَّيِّبُ بِالثَّيِّبِ، وَالْبِكْرُ بِالْبِكْرِ، الثَّيِّبُ جَلْدُ مِائَةٍ، ثُمَّ رَجْمٌ بِالْحِجَارَةِ، وَالْبِكْرُ جَلْدُ مِائَةٍ، ثُمَّ نَفْيُ سَنَةٍ»
তোমরা আমার নিকট থেকে জেনে নাও যে, আল্লাহ তাআলা ব্যভিচারীদের ব্যাপারে পন্থা বাতলে দিয়েছেন। বিবাহিত পুরুষ বিবাহিত নারীর সঙ্গে ব্যভিচার করলে এবং অবিবাহিত পুরুষ অবিবাহিতা নারীর সঙ্গে ব্যভিচার করলে তাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে। (সুতরাং শাস্তি হল যে,) বিবাহিতকে একশ’ বেত্রাঘাত করা হবে অতঃপর প্রস্তর নিক্ষেপ করে হত্যা করা হবে। আর অবিবাহিতকে একশ’ বেত্রাঘাত করা হবে অতঃপর এক বছরের জন্য দেশান্তর করা হবে। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৬৯০]
ব্যভিচার বন্ধে ইসলাম শুধু আইন করেই ক্ষান্ত হয়নি। তা যথার্থ বাস্তবায়ন করে এ ঘৃণ্য পাপকর্ম উচ্ছেদে ভূমিকা রেখেছে।
পক্ষান্তরে প্রচলিত আইন অদ্ভুত ও অবাস্তব আইন করে অনেকাংশে ব্যভিচারের পথকে উন্মুক্ত করেছে।
ইসলামে ধর্ষণের শাস্তি
ইতোপূর্বে আমরা ব্যভিচারের শাস্তির বিধান উদ্ধৃত করেছি। যেখানে ব্যভিচারের কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে। সুতরাং ব্যভিচারের শাস্তির মাধ্যমেই ধর্ষণের শাস্তির বিষয়টি জানা যায়।
ধর্ষণকারী যদি বিবাহিত হয়, তাহলে তাকে প্রকাশ্য পাথর মেরে হত্যা করা হবে।
আর যদি অবিবাহিত হয়, তাহলে তাকে প্রকাশ্য একশত বেত্রাঘাত করা হবে এবং এক বছরের জন্য দেশান্তর বা জেলবন্দী করা হবে।
যদি ধর্ষণের সাথে আরো অতিরিক্ত কোন শারিরীক নির্যাতন করে থাকে, তাহলে এর শাস্তির মাত্রা বিচারক কর্তৃক নির্ধারণ করার এখতিয়ার ইসলাম প্রদান করে।
সমকামিতা ও আইন
সমকামিতা। একটি নিকৃষ্ট ও বিকৃত যৌনতার নাম। ধর্মীয়ভাবে যেমন তা ধিকৃত ও অভিশপ্ত হিসেবে বিবেচিত, তেমনি রাষ্ট্রীয় আইনেও তা নিষিদ্ধ।
বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারায় বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি স্বেচ্ছাকৃতভাবে কোনো পুরুষ, নারী বা জন্তুর সঙ্গে প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে যৌন সহবাস করেন, সেই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা দশ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং তদুপরি অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
ইসলাম সমকামিতার শাস্তির ক্ষেত্রে আরো কঠোর বিধান আরোপ করেছে। ইসলামে সমকামীতাকে হত্যাযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করেছে। যেমন-
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «مَنْ وَجَدْتُمُوهُ يَعْمَلُ عَمَلَ قَوْمِ لُوطٍ، فَاقْتُلُوا الْفَاعِلَ وَالْمَفْعُولَ بِهِ»
হযরত ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম ইরশাদ করেন, যাকে তোমরা কওমে লুতের কাজ করতে দেখো [সমকামিতা], তাহলে যে করে এবং যার সাথে করে উভয়কে হত্যা কর। [সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-২৫৬১, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৪৪৬২, সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-১৪৫৬]
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي الَّذِي يَعْمَلُ عَمَلَ قَوْمِ لُوطٍ قَالَ: «ارْجُمُوا الْأَعْلَى وَالْأَسْفَلَ، ارْجُمُوهُمَا جَمِيعًا»
হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত। কওমে লুতের মত কার্যসম্পাদনকারী তথা সমকামীদের ব্যাপারে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন যে, এদের উপরের এবং নিচের উভয়কে পাথর মেরে হত্যা কর। [সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-২৫৬২]
ধর্ষণ–ব্যভিচার রোধে কার্যকরী ব্যবস্থা!
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ধর্ষণের শাস্তি প্রচলিত আইনে নির্ধারিত হলেও ধর্ষণ প্রলুব্ধকারী বিষয় বন্ধের বিষয়ে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেই প্রচলিত আইনে।
কোন আইন বা শাস্তি বিধান অপরাধ সমূলে নির্মূল করতে সক্ষম নয়। কিন্তু কমাতে সক্ষম।
যেমন খুনের শাস্তি ফাঁসি হবার আইন আছে। তাই বলে কি খুন খারাবী বন্ধ হয়ে গেছে? হয়নি।
আইনের পাশাপাশি অপরাধ দমনে অপরাধ সৃষ্টির সহায়ক ইস্যুগুলোকেও বন্ধ করতে পারলে বহুলাংশে সেই অপরাধ কমানো সম্ভব।
তেমনি ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার দ্বারাই কিন্তু ধর্ষণ বন্ধে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে মনে করার সুযোগ নেই।
এজন্য ধর্ষণ করার মনোবৃত্তি জাগ্রত করে এমন সব বিষয়গুলো বন্ধেও কার্যকরী পদক্ষেপ জরুরী।
ইসলাম শুধু ধর্ষণ ব্যভিচার প্রতিরোধে আইন ও শাস্তির বিধানই করেনি। বরং এর সাথে সাথে ধর্ষণ ব্যভিচারকে প্রলুব্ধ করে এমন বিষয়ের উপরও বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।
ধর্ষণে প্ররোচনাদানকারী বিষয়াবলী
এ বিষয় নিয়ে কথা বলা আগে আমরা বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত ধর্ষণ কোন কোন রাষ্ট্রে বেশি হয় সেটি একটু দেখে নিবো।
জাতীয় পত্রিকার রিপোর্ট অনুপাতে শীর্ষ দশ ধর্ষণ সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের তালিকা দেখলে রীতিমত চমকে উঠতে হয়।
১- আমেরিকা। যেখানে ৯১% নারী ধর্ষণের শিকার।
২- দক্ষিণ আফ্রিকা।
৩- সুইডেন। প্রতি বছরই প্রায় ৫৮% হারে যৌন নির্যাতনের ঘটনা বাড়ে সুইডেনে।
৪- ভারত। প্রতি ২২ মিনিটে ভারতে একটি করে ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের হয়।
৫- ব্রিটেন। প্রতি ৫ জন মহিলার (১৬-৫৯ বছর বয়সী) মধ্যে একজন করে ধর্ষণের শিকার হন।
৬- জার্মানী। প্রতি বছর জার্মানিতে ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের হয় ৬৫ লাখ ৭ হাজার, ৩৯৪।
৭- ফ্রান্স। ফ্রান্সের সরকারী গবেষণায় দেখা গেছে প্রতি বছরে এই দেশে ধর্ষণের শিকার হন অন্তত ৭৫ হাজার নারী।
৮- কানাডা। প্রতি ১৭ জন মহিলার মধ্যে ১ জন করে মহিলা এই দেশে ধর্ষিতা হন। যাদের মধ্যে ৬২% শারীরিকভাবে আহত হন।
৯- শ্রীলংকা। ধর্ষণে অভিযুক্তদের ৬৫.৮% ধর্ষণের মত নারকীয় কর্মকান্ডে লিপ্ত থেকেও কোনও প্রকার অনুশোচনা তাদের মধ্যে হয় না।
১০- ইথিউপিয়া। এই দেশের ৬০% নারী ধর্ষণের শিকার। [দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৬ অক্টোবর, ২০১৬ ইং, দৈনিক জনকণ্ঠ, অক্টোবর ২৭, ২০১৬]
আনন্দবাজার পত্রিকার রিপোর্ট অনুপাতে ১০ ধর্ষণ শীর্ষ রাষ্ট্রের তালিকাটা এমনঃ-
১- দক্ষিণ আফ্রিকা।
২- সুইডেন।
৩- আমেরিকা।
৪- ইংল্যান্ড।
৫- ভারত। এখানে প্রতি ২০ মিনিটে একজন নারী ধর্ষিতা হয়।
৬- নিউজিল্যান্ড। এখানে প্রতি দুইঘন্টার মাঝে একজন নারী যৌন হয়রানীর শিকার হয়।
৭- কানাডা। প্রতি চার জনে একজন ধর্ষিতা হয়।
৮-অস্ট্রেলিয়া। প্রতি ৬জনে একজন নারী ধর্ষিতা হয়।
৯- জিম্বাবুয়ে।
১০- ডেনমার্ক ও ফিনল্যান্ড।
[দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬ ইং]
উপরের তালিকা এবং ধর্ষণের মাত্রা রীতিমত ভড়কে যাবার মত। প্রশ্ন হল, অতি আধুনিক এবং নারীদের অধিকারে সবচে’ বেশি সোচ্চার, পৃথিবী জুড়ে মানুষের অধিকার আর নারীবাদ মুক্তির স্লোগান ফেরী করে বেড়ানো কথিত সভ্য রাষ্ট্রের এমন অসভ্য বাস্তবতা কেন?
এ বিষয় কি আমাদের খতিয়ে দেখা উচিত নয়?
দশটি শীর্ষ ধর্ষণ রাষ্ট্রের তালিকায় একটি রাষ্ট্রও ধর্মীয় শালীন পোশাকধারী বা রক্ষণশীল রাষ্ট্র নয়। বরং উদ্দাম খোলা পোশাক, যৌনতা ডালভাত এমন রাষ্ট্র।
প্রশ্ন হল, এরপরও তাদের দেশে এতো ধর্ষণ কেন?
এর মানে আমাদের আরো গভীরে গিয়ে এ জঘন্য ধর্ষণকাণ্ডের কারণ বের করা উচিত।
যৌনতা মানুষের একটি সহজাত এবং প্রাকৃতিক চাহিদা। প্রাপ্ত বয়স্ক হবার সাথে সাথে যা প্রতিটি মানুষের মাঝেই তৈরী হয়।
প্রাকৃতিক এ ক্ষুধা নিবারণে মানবস্রষ্টা বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে তা শালীন ও সামাজিক পন্থায় পূর্ণ করার বিধান দিয়েছেন।
অতি আধুনিক এবং কথিত রাষ্ট্রগুলোর এ নোংরা চেহারা আমাদের জানান দেয় যে, ধর্ষণ রোধে শুধু আইন নয়, শুধুমাত্র সুন্দর সুন্দর স্লোগান নয়, বরং এর প্ররোচনাদানকারী অন্যান্য বিষয়গুলো রোখাও আবশ্যক।
ধর্ষণে প্ররোচনাদানী বিষয়গুলো কি?
এক নাম্বার কথাতো হল, ধর্ষণ একটি অসুস্থ্য মনোবৃত্তির পরিচায়ক। নোংরা ও নিচ ব্যক্তিদের কাজ। অনেক কারণেই এ নিকৃষ্ট কাজে ব্যক্তি জড়িত হতে পারে।
তবে কিছু বিষয় উক্ত কাজের প্ররোচনাদানকারী হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। যেমন-
১- অশালীন পোশাক
এটা একটি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। নারীদের শরীর প্রদর্শনমূলক অশালীন পোষাক বখাটেদের মনে কাম বাসনা জাগ্রত করে। যা তাদের ধর্ষণের মত জঘন্য কাজে লিপ্ত হতে প্ররোচিত করে। তবে পোশাকই একমাত্র ধর্ষণ বৃদ্ধির কারণ নয়। তবে এটি অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে ধর্ষনবৃদ্ধির প্রধানতম কারণ এটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
২- সিনেমা নাটকে ধর্ষণ-অশালীনভাবে নারীদেহ প্রদর্শন
বর্তমান জমানায় সবার বাড়িতেই কম্পিউটার বা টিভি রয়েছে। যার মাধ্যমে বিনোদন নামে যা কিছু দেখানো হয়, তাতে নারীদের যেভাবে উত্তেজকভাবে উপস্থাপন করা হয়। আইটেম সং, উদ্দাম নৃত্যের নামে শরীর প্রদর্শন, বিছানায় প্রেমের দৃশ্য, ধর্ষণ দৃশ্য ইত্যাদি। এসব বেলেল্লাপনা বিনোদনের নামে যেভাবে প্রতিটি বাড়িতে, প্রতিটি পরিবারে স্বাভাবিক হিসেবে প্রদর্শিত হয়। তা অবশ্যই বিব্রতকর।
এসব অশালীন নাটক ও সিনেমাও বখাটেদের ধর্ষণে প্রলুব্ধ করে থাকে।
৩- পর্নোগ্রাফীর ছড়াছড়ি।
স্মাটফোনের দুনিয়ায় পর্নোগ্রাফী বা নীল ছবি এখন সহজলভ্য। বাংলাদেশী যুবকদের একটি বৃহৎ গোষ্ঠি পর্নো রোগে আক্রান্ত। যা তাদের হস্তমৈথুনসহ ধর্ষণেও উদ্বুদ্ধ করে থাকে।
৪– পত্রিকার পাতায় অর্ধ উলঙ্গ নারীর ছবি এবং রাস্তায় টানানো নারীর উত্তেজক ছবি সম্বলিত বিলবোর্ডও কম দায়ী নয়।
৫– আল্লাহর ভয় , আখেরাতের ভয় না থাকা।
৬– বিয়ের ক্ষেত্রে বাবা মায়ের গড়িমসি করা।
৭– একাধিক বিয়েকে সামাজিক ও পারিবারিকভাবে খারাপ দৃষ্টিতে দেখা।
৮– বিচারহীনতা।
ইত্যাদি অনেক কারণই ধর্ষণে প্ররোচনাদানে ভূমিকা রাখে। কিছু বেশি ক্ষতিকর আর কিছু কম।
পর্দানশীল নারী ধর্ষিতা বা ছেলেরা বলৎকারের শিকার কেন হয়?
অনেকে অশালীন পোশাক ও নারীদেহের খুল্লামখোলা প্রদর্শনকে কিছুতেই ধর্ষণে প্ররোচনাদানের অন্যতম কারণ হিসেবে মানতে নারাজ।
তারা যুক্তি পেশ করেন যে, যদি অশ্লীল পোশাকই দায়ী হয়, তাহলে শালীন পোশাক পরিহিতারা কেন ধর্ষিতা হয়?
কেন ছেলেরা বলৎকারের শিকার হয়?
এ প্রশ্নটি অনেকটা অশালীনতাকে সাপোর্ট করার জন্য একটি প্রতারণামূলক প্রশ্ন।
কারণ, ধর্ষণে-বলৎকারে আমরা কখনোই শুধু অশালীন পোশাকই একমাত্র দায়ী বলে দাবী করি না।
বরং এটি অন্যতম একটি কারণ বলে উল্লেখ করি। যার প্রমাণ ইউরোপ আমেরিকার মত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডার মত প্রথম সারির রাষ্ট্রগুলো ধর্ষণ শীর্ষ হওয়া পরিস্কার প্রমাণ করে যে, অশালীন পোশাক ধর্ষণে প্ররোচনায় কতোটা ভয়াবহ আকারে দায়ী।
তাছাড়া অশ্লীল ছবি দেখে, রাস্তায় অর্ধ নগ্ন নারী দেখে, কিংবা পত্রিকা, বিলবোর্ডের পাতায় অশালীন পোশাক পরিহিতা মডেলদের যৌন উদ্দীপক দৃশ্য দেখে বখাটেদের মনে যে কামভাব জাগ্রত হয়, তা নিবারণে তার কাছে যাকে পায়, তার মাধ্যমেই যৌন ক্ষুধা নিবারণে নেকড়ে হয়ে হামলে পড়ে।
এক্ষেত্রেও ঐ নগ্নতাতাই দায়ী থাকে।
ভদ্র ও শালীন পোশাকধারী ধর্ষণের শিকার হওয়া বা শিশু বলৎকারের ঘটনায়ও অনেকাংশে সেই নগ্ন পোশাকধারীদেরই প্ররোচনা থাকে।
সুতরাং এসবের ধোয়া তুলে নগ্ন পোশাক, নারীদেহ প্রদর্শনকে সাপোর্ট করা মানে দেশকে আমেরিকার মত ধর্ষণের অঙ্গরাজ্য বানানোর ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছু নয়।
শেষ কথা
আমাদের শেষ কথা হল, ধর্ষণ-ব্যভিচার রোধে শুধু আইন নয়, ইসলামী রীতিনীতি এবং শরয়ী বিধানাবলীর সঠিক ও যথার্থ বাস্তবায়নই পারে ধর্ষণের এ মহামারী সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে বিদূরিত করতে। নতুবা শুধু আইন করে, সাথে সাথে নারীদের উলঙ্গপনার সার্টিফিকেট প্রদান করে যুক্তরাষ্ট্র আর কানাডা, জার্মানীর ধর্ষণ শীর্ষ রাষ্ট্র হবার পথকেই সুগম করবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের হেফাযত করুন। আমীন।
মুসলিম বাংলা