মা-বাবাকে খুশি রাখো, সব জায়গায় সফল হবে

দুঃখজনক বিষয় হলো, পাশ্চাত্যের অশুভ প্রভাবে আমাদের সমাজেও এখন মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর প্রবণতা বাড়ছে। যাঁরা জীবনের সেরা সময়, সর্বোচ্চ শ্রম, ভালোবাসা ও ত্যাগ স্বীকার করে আমাদের বড় করেছেন, তাঁদেরই শেষ বয়সে পরিত্যক্ত করে দেওয়া হচ্ছে! বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে চোখ রাখলেই বোঝা যায় কতটা হৃদয়বিদারক এক পরিস্থিতি। সেখানে অনেক মা-বাবা একাকিত্ব, কষ্ট আর অশ্রু নিয়ে দিন কাটান। সন্তানের পথ চেয়ে অপেক্ষা করেন, কিন্তু কেউ আসে না। জীবনসায়াহ্নে এসে তাঁরা অনুভব করেন, যাদের জন্য সারাটা জীবন বিলিয়ে দিলেন, তারাই আজ অচেনা!
এমন অকৃতজ্ঞতা তখনই সমাজে দেখা দেয়, যখন মানুষ দীন থেকে দূরে সরে যায়, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য মূল্যহীন হয়ে যায় এবং আখেরাতের ভাবনা মন থেকে উঠে যায়। তখনই মা-বাবার প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ নিঃশেষ হয়ে যায়, তখনই মানুষ এমন নিষ্ঠুরতা করতে পারে!
আল্লাহ আমাদের এই বিভ্রান্তি ও অকৃতজ্ঞতা থেকে হেফাজত করুন, মা-বাবার হক আদায় করার তাওফিক দান করুন— আমীন।
اَلْحَمْدُ لِلّهِ وَكَفَى وَسَلَامٌ عَلَى عِبَادِهِ الَّذِيْن َاصْطَفَى اَمَّا بَعْدُ! فَاَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ. بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ. وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا
بَارَكَ اللهُ لِيْ وَلَكُمْ فِي الْقُرْآنِ الْعَظِيْمِ، وَنَفَعَنِيْ وَإِيَّاكُمْ بِمَا فِيْهِ مِنَ اْلآيَاتِ وَالذِّكْرِ الْحَكِيْمِ. وجَعَلَنِيْ وَإِيَّاكُمْ مِنَ الصَّالِحِينَ. أَقُوْلُ قَوْلِيْ هَذَا أَسْتَغْفِرُ اللهَ لِيْ وَلَكُمْ وَلِسَائِرِ الْمُسْلِمِيْنَ. فَاسْتَغْفِرُوْهُ، إِنَّهُ هُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ.اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّعَلَى آلِ سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّبَارِكْ وَسَلِّمْ
হামদ ও সালাতের পর!
তিনজন শিশু দোলনায় থেকে কথা বলেছিল
সাধারণত, একটি শিশু ১০ থেকে ১৩ মাসের মধ্যে একটি শব্দ উচ্চারণ করতে শেখে, যেমন আব্বু, আম্মু, দাদু, ইত্যাদি। পানিকে সাধারণত মাম বলে। দুইটি শব্দে কথা বলতে সাধারণত দুই বছর সময় লাগে। সম্পূর্ণ বাক্যে কথা বলার জন্য তিন বছর বা তার বেশি সময় লাগে।
কোনো শিশু হাঁটতে না পারলে তাকে দোলনায় রাখা হয়। হাঁটতে একজন শিশু এক থেকে দুই বছর সময় নেয়। কথা বলতে একজন শিশু এরচেয়ে বেশি সময় নেয়। তাই, যদি কেউ দোলনায় থাকার বয়সে কথা বলে ফেলে, তা অলৌকিক ঘটনা মনে করা হয়। তবে হাদীসে এসেছে, তিনজন শিশুর ব্যাপারে এই অলৌকিক ঘটনা-ই ঘটেছিল। তারা দোলনায় থেকেই কথা বলেছিল। [সহীহ বুখারী : ৩৪৩৬]
প্রথম শিশু : হযরত ঈসা আ.
প্রথম শিশু হযরত ঈসা আ.। তাঁর অলৌকিক জন্মের পর, লোকজন তাঁর মা মারইয়াম আ.-এর পবিত্রতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল। তখন দোলনায় শায়িত ঈসা আ. নিজেই মায়ের পবিত্রতার কথা বলে বলেছিলেন
إِنِّي عَبْدُ اللَّهِ آتَانِيَ الْكِتَابَ وَجَعَلَنِي نَبِيًّا وَجَعَلَنِي مُبَارَكًا أَيْنَ مَا كُنتُ وَأَوْصَانِي بِالصَّلَاةِ وَالزَّكَاةِ مَا دُمْتُ حَيًّا
আমি আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন, আমাকে নবী করেছেন। আমি যেখানেই থাকি, তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন এবং আমাকে নামায ও যাকাতের নির্দেশ দিয়েছেন যতদিন আমি জীবিত থাকি। [সূরা মারইয়াম : ৩০, ৩১]
দ্বিতীয় শিশু : এক অসাধারণ শিশু
দ্বিতীয় শিশুটিও ছিল এক অসাধারণ শিশু। এক নারী তার শিশুটিকে দুধ পান করাচ্ছিল। এমন সময় একটি সুদর্শন আরোহী পাশ দিয়ে গেল। নারীটি দোয়া করল, হে আল্লাহ! আমার ছেলেকে তার মতো করো।
শিশুটি সাথে সাথে স্তন ছেড়ে দিল, আরোহীর দিকে তাকিয়ে বলল, হে আল্লাহ! আমাকে তার মতো করো না।
তারপর সে আবার দুধ পান করতে লাগল।
পরবর্তীতে এক দাসীকে ধরে আনা হলো, যাকে অন্যায়ভাবে অপবাদ দেয়া হয়েছিল। নারীটি এবার বলল, হে আল্লাহ! আমার শিশুটিকে এর মতো করো না।
শিশুটি স্তন ছেড়ে দিয়ে বলল, হে আল্লাহ! আমাকে তার মতো করো।
তার মা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন?
শিশুটি জবাব দিল, সেই আরোহী ছিল একজন জালিম। তাই আমি বলেছি, হে আল্লাহ! আমাকে তার মতো করো না। আর এই দাসীকে অন্যায়ভাবে অপবাদ দেয়া হয়েছে— লোকে বলছে, সে চুরি করেছে, ব্যভিচার করেছে। অথচ সে কিছুই করেনি। তাই আমি বলেছি, হে আল্লাহ! আমাকে তার মতো করো।
তৃতীয় শিশু: জুরাইজের ঘটনা
বনী ইসরাঈলের এক পুণ্যবান ব্যক্তি ছিলেন, নাম ছিল জুরাইজ। তাঁর ইবাদতখানা ছিল একদম একান্ত, যেখানে তিনি আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকতেন। একদিন যখন জুরাইজ তাঁর ইবাদতরত অবস্থায় ছিলেন, তখন তাঁর মা এসে তাঁকে ডাকলেন, হে জুরাইজ!
জুরাইজ কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। তিনি ভাবলেন, আমি কি মায়ের ডাকে সাড়া দেব, নাকি নামায চালিয়ে যাব?
শেষে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি তাঁর ইবাদত অব্যাহত রাখবেন। তাই মায়ের ডাক উপেক্ষা করে তিনি নামায চালিয়ে গেলেন। অপরদিকে তাঁর মা কিছুটা দুঃখিত হয়ে ফিরে গেলেন। এমন ঘটনা পরবর্তী দুদিনও ঘটল।
তৃতীয় দিন জুরাইজের মা অভিমানী হয়ে আল্লাহর কাছে বদদোয়া করে বসলেন যে, হে আল্লাহ! ব্যভিচারিণীর মুখ না দেখা পর্যন্ত তুমি তাকে মৃত্যু দিও না।
কিছু দিন পর জুরাইজের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র শুরু হলো। এক নারী তার কাছে এসে কুপ্রস্তাব দিল। জুরাইজ তা অস্বীকার করলেন।
হতাশ হয়ে নারীটি এক রাখালের কাছে গিয়ে তার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করল। পরে নারীটি একটি পুত্র সন্তান জন্ম দিল।
সন্তানটি জন্মানোর পর লোকেরা লোকেরা তাকে প্রশ্ন করল, এটি কার সন্তান?
সে বলল, এটি জুরাইজের সন্তান।
এই কথা শোনার পর, শহরের লোকেরা বিভ্রান্ত হয়ে গেল এবং তারা বিশ্বাস করতে শুরু করল যে, জুরাইজ এই নারীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছে। তাই তারা এসে তার ইবাদতখানাটি ভেঙে দিল। তাকে ধরে নীচে নামিয়ে আনল। তাকে গালি-গালাজ করল। এভাবে লোকেরা তাকে চরমভাবে অপমানিত করল।
তখন জুরাইজ অযু করে নামাযে দাঁড়ালেন। তারপর তিনি নবজাতক শিশুটির কাছে গেলেন এবং শিশুটির পেটে টোকা দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হে শিশু, তোমার পিতা কে?
অলৌকিকভাবে শিশুটি উত্তর দিল, আমার পিতা অমুক রাখাল।
এটা শোনার পর, লোকেরা অবাক হয়ে গেল এবং তারা বুঝতে পারল যে, জুরাইজ একদম নির্দোষ ছিল। তারা জুরাইজের কাছে এসে ক্ষমা চাইল এবং তাকে চুমো দিতে লাগল। তারা বলল, আমরা আপনার জন্য একটি সোনায় মোড়া ইবাদতখানা তৈরি করতে চাই।
তখন জুরাইজ বললেন, না, আমি সোনার ইবাদতখানা চাই না। তবে, মাটির ইবাদতখানা নিয়েই আমি সন্তুষ্ট। সুতরাং মাটি দিয়েই এটি তৈরি করতে পারেন।
অবশেষে লোকেরা তা-ই করল। [সহীহ বুখারী : ৩৪৩৬, সহীহ মুসলিম : ২৫৫০]
মা-বাবার দোয়া ও বদদোয়ার ওজন
এই ঘটনা আমাদের শিখিয়ে দেয় যে, মা-বাবার, বিশেষত মায়ের দোয়া ও বদদোয়া কতটা প্রভাবশালী। যদি কোনো মা ন্যায়সঙ্গত কারণে সন্তানের জন্য বদদোয়া করেন, তবে সে সন্তান নেককার হলেও আল্লাহ তাআলা তা কবুল করতে পারেন।
এ থেকে আমরা আরও বুঝতে পারি, সন্তানের জন্য মায়ের সন্তুষ্টি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রত্যেক সন্তানের উচিত মা-বাবাকে ভালোবাসা, সম্মান করা এবং কখনওই তাঁকে কষ্ট না দেওয়া, কারণ মা-বাবার হৃদয় থেকে উঠে আসা প্রতিটি বাক্যই মহান রবের দরবারে বিশেষ মূল্য রাখে।
একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
নিজের একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করি।
একবার আমি একটি কঠিন সমস্যায় জর্জরিত হয়ে বিষন্ন মনে বাসায় ফিরেছিলাম। আমার মায়ের দৃষ্টি আমার চেহারায় পড়ে, তিনি বুঝে গিয়েছিলেন যে কিছু একটা ঘটেছে।
তখন তিনি আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো, তোমার এত টেনশনের দরকার নেই। আমি হয়তো গুনাহগার, কিন্তু তোমার মা তো! তাই আমি তোমার জন্য আল্লাহর কাছে হাত পাতার জন্য আছি। আল্লাহ মায়ের দোয়া ফেরত দেন না, আমাকেও ফেরত দেবেন না।
বিশ্বাস করুন, মা যখন এই কথাগুলো বললেন, মনে হল যেন এক ঝরনা দিয়ে আমার হৃদয়ে প্রশান্তি ঢুকল। এভাবে প্রতিবার যখন কোনো সমস্যায় পড়েছি, মায়ের দোয়া ও তার সান্ত্বনাকে নিজের শক্তি হিসেবে ব্যবহার করেছি।
আজ থেকে খুব সতর্কভাবে চলবে
এক বুজুর্গের মায়ের ইন্তেকাল হয়েছিল। আরেক বুজুর্গ তাকে দেখতে গিয়েছিলেন। তখন দ্বিতীয় বুজুর্গ তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে এক পর্যায়ে বললেন, আজ থেকে খুব সতর্কভাবে চলবে। কারণ, যখন তোমার ওপর কোনো বিপদ আসার কথা ছিল, তখন তোমার পাশে ছিল দুটি হাত— তোমার মায়ের দুটি হাত।
তিনি আল্লাহর কাছে এই দুটি হাত তুলে ধরে তোমার জন্য দোয়া করতেন, আল্লাহ তাআলা বিপদ দূর করে দিতেন। এখন সে দুটি হাত আর নেই। সুতরাং আজ থেকে নিজের দেখভাল নিজেকেই করতে হবে। আজ থেকে খুব সতর্কভাবে চলতে হবে।
বাবা-মা আপনার জান্নাত
এ কারণে হাদীসে এসেছে, এক ব্যক্তি নবী ﷺ-কে যখন জিজ্ঞেস করেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল, পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের কী অধিকার রয়েছে?
নবী ﷺ তখন উত্তর দিয়েছিলেন
هُمَا جَنَّتُكَ وَنَارُكَ
তোমার মা-বাবা তোমার জান্নাত ও জাহান্নাম। [সুনান ইবন মাজাহ : ৩৬১০]
ত্বায়লাসা ইবনু মায়্যাস রহ. বলেন, ইবনু উমর রাযি. আমাকে লক্ষ্য করে বলেছেন
أَتَفْرَقُ النَّارَ، وَتُحِبُّ أَنْ تَدْخُلَ الْجَنَّةَ؟ قُلْتُ: إِي وَاللهِ، قَالَ: أَحَيٌّ وَالِدُكَ؟ قُلْتُ: عِنْدِي أُمِّي، قَالَ: فَوَاللهِ لَوْ أَلَنْتَ لَهَا الْكَلَامَ، وَأَطْعَمْتَهَا الطَّعَامَ، لَتَدْخُلَنَّ الْجَنَّةَ مَا اجْتَنَبْتَ الْكَبَائِرَ
তুমি কি জাহান্নামকে ভয় পাও এবং জান্নাতে প্রবেশ করতে পসন্দ কর?
আমি বললাম, আবশ্যই, আল্লাহর কসম!
তখন তিনি বললেন, তোমার পিতা কি জীবিত আছেন?
আমি বললাম, আমার তো শুধু মা বেচেঁ আছেন।
তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! যদি তুমি তার সঙ্গে নম্র ভাষায় কথা বল এবং তাকে খাবার খাওয়াও, তাহলে অবশ্যই তুমি জান্নাতে প্রবেশ করবে, যদি কবীরা গুনাহ পরিহার করতে পার। [আল-আদাবুল মুফরাদ : ৮]
মাতা-পিতার হক
বন্ধুগণ! এ পৃথিবীতে ভালোবাসার অভাব নেই, সম্পর্কেরও শেষ নেই। কিন্তু বিশ্বাস করুন, এসব সম্পর্কের মাঝে কোথাও না কোথাও স্বার্থ লুকিয়ে থাকে, থাকে কোনো না কোনো প্রত্যাশা। তবে একমাত্র মাতা-পিতার ভালোবাসাই একেবারে নিখাঁদ—সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ।
তাদের স্নেহ-মমতা স্বভাবজাত। এতে নেই কোনো শর্ত, নেই কোনো প্রত্যাশা। স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসায় থাকে আশা-ভরসা, ভাইয়ের ভালোবাসাতেও থাকে আদান-প্রদান। কিন্তু মাতা-পিতা শুধু দিয়ে যান, কিছুই চান না। সন্তানের জন্য তাদের ত্যাগ এত গভীর যে, প্রয়োজনে নিজের জীবনও উৎসর্গ করতে কুণ্ঠাবোধ করেন না।
মা এমনই হয়
আমেরিকার এক শহরে এক নাম-করা ব্যবসায়ী ছিল। টাকা পয়সা, নামে, দামে— কোনো কিছুরই তার অভাব ছিল না। কিন্তু তার মডার্ন সোসাইটিতে মুখ দেখাতে পারতো না শুধু তার মায়ের জন্য। কারণ তার মা ছিল অন্ধ। মায়ের মুখে ছিল আগুনে পোড়া দাগ। আর মাথায় কোনো চুল ছিল না। তাই মডার্ন সোসাইটিতে নিজের মান-সম্মান বজায় রাখার জন্য মাকে বাসা থেকে বের করে দিলো। বেচারি অন্ধ মা কেঁদে কেঁদে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। হঠাৎ একটি গাড়িতে ধাক্কা খেয়ে বৃদ্ধা মারা গেল। ছেলে শুনে কষ্ট পেলো না, ভাবলো, আপদ বিদায় হয়েছে। কিছু দিন পর কোনো একটি ডকুমেন্ট খুঁজতে খুঁজতে মায়ের ঘরে মায়ের লেখা একটা ডাইরি পেলো। ডাইরিতে লেখা ছিল।
০৫-১২-১৯৮০ = আজ আমি সুন্দরী মিস আমেরিকার এওয়ার্ড (award) পেয়েছি।
০২-০৫-১৯৮৩ = আজ আমার প্রেগন্যান্ট (pregnant) এর এব্রোশন (abortion) না করার জন্য আমার স্বামী আমাকে ডিভোর্স (divorce) দিয়েছে।
০৭-০৩-১৯৮৫ = আজ আমার বাড়িতে আগুন লেগেছিল। আমি বাহিরে ছিলাম। আর আমার কলিজার টুকরা ছেলে বাড়ির ভিতরে ছিল। নিজের জীবন বাজি রেখে শুধু ছেলের জীবন বাঁচাতে গিয়ে আগুন লেগে আমার চুল এবং মুখ পুড়ে আমার সমস্ত সৌন্দর্য পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তাতে আমার কোনো দুঃখ নেই। কিন্তু তবু আমার কলিজার টুকরা ছেলের চোখ দুটো আমি বাঁচাতে পারিনি।
০৭-১৫-১৯৮৫ = আজ আমার নিজের চোখ দু’টো আমার ছেলেকে দিতে যাচ্ছি।
The End Of My
LifeDiary!
ডায়েরিটি পড়ে ছেলে পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে দেয়ালে মাথা আছড়াতে লাগলো। [ইন্টারনেট]
এই ঘটনা তুলে ধরার মাধ্যমে সুন্দরী প্রতিযোগিতার প্রতি সমর্থন জানানো আমার উদ্দেশ্য নয়। কেননা এ জাতীয় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা নিঃসন্দেহে ঘৃণ্য কাজ। বরং উদ্দেশ্য হচ্ছে, মা মুসলিম হোক কিংবা অমুসলিম, সতীসাধ্বী হোক কিংবা অসতী নিজের সন্তানের প্রতি তার ভালোবাসা কতটা নিখাদ ও গভীর হয় তা তুলে ধরা। এজন্যই ইসলাম বলে, মা-বাবা সর্বাবস্থায় সদ্ব্যবহারের হকদার; এমন কি তারা অমুসলিম হলেও। আল্লাহ তাআলা বলেন
وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا
দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে সহঅবস্থান করবে। [সূরা লুকমান : ১৫]
وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا
ইবাদত কর আল্লাহর, শরীক করো না তাঁর সাথে অপর কাউকে। আর পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর । [সূরা নিসা : ৩৬]
সবচেয়ে প্রিয় আমল
এমনকি আল্লাহ তাআলা মাতা-পিতার হককে এত বেশি মর্যাদা দিয়েছেন, কখনো কখনো তাঁর পথে জিহাদ করাকেও তাদের খেদমতের তুলনায় গৌণ করেছেন।
হাদীসে এসেছে, আবু আব্দুর রহমান আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহ তাআলার নিকট সবচেয়ে প্রিয় আমল কোনটি?
তিনি বললেন
الصَّلاَةُ عَلَى وَقْتِهَا
যথাসময়ে নামায আদায় করা।
তারপর আমি জিজ্ঞেস করলাম, নামাযের পর কোন আমলটি তার কাছে সবচেয়ে প্রিয়?
উত্তর দিলেন
ثُمَّ بِرُّ الْوَالِدَيْنِ
মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করা।
আমি পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম, তারপর কোনটি?
প্রতি উত্তরে নবীজী ﷺ বললেন
الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ
আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। [সহীহ বুখারী : ৫২৭]
লক্ষ্য করুন, হাদীসটিতে দীনের কাজ বিন্যাস করা হয়েছে যথাক্রমে— এক. নামায আদায় করা। দুই. মাতা-পিতার সাথে উত্তম ব্যবহার করা। তিন. আল্লাহর রাহে জিহাদ করা।
ফিরে যাও, তাদের মুখে হাসি ফুটাও
এক সাহাবীর ঘটনা। তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে এসে বললেন, আমি আপনার নিকট দু'টি বিষয়ে বাইয়াত গ্রহণ করতে এসেছি। প্রথমটি হলো হিজরত, অর্থাৎ আমি নিজের মাতৃভূমি ত্যাগ করে মদিনায় বসবাস করতে চাই। দ্বিতীয়টি হলো জিহাদ, আমি আপনার সাথে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতে চাই, যাতে সওয়াব লাভ করতে পারি।
রাসূল ﷺ তখন তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার পিতা-মাতা কি জীবিত আছেন?
লোকটি উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, তারা উভয়ই জীবিত আছেন।
তখন রাসূল ﷺ বললেন, তাহলে, তুমি কি সত্যিই সওয়াব চাও?
লোকটি নিশ্চিতভাবে বললেন, হ্যাঁ, আমি সওয়াব চাই।
এ সময় রাসূল ﷺ তার দিকে তাকিয়ে বললেন
فَارْجِعْ إلى وَالِدَيْكَ فأحْسِنْ صُحْبَتَهُمَا
তাহলে তুমি মাতা-পিতার কাছে ফিরে যাও এবং তাদের খেদমত করো। তাদের খেদমতে যে সওয়াব পাও, তা জিহাদ করতে গিয়েও তুমি পাবে না। [সহীহ মুসলিম : ২৫৪৯]
অপর বর্ণনায় এসেছে, নবীজী ﷺ বলেছেন
ارْجِعْ إِلَيْهِمَا؛ فَأَضْحِكْهُمَا كَمَا أَبْكَيْتَهُمَا
ফিরে যাও, তাদের মুখে হাসি ফুটাও। যেমন তাদের কাঁদিয়েছিলে। আমার সঙ্গে তোমার জিহাদে শরীক হওয়ার অনুমতি নেই।
জিহাদের ফজিলত
দেখুন, আলোচ্য হাদীসগুলোতে জিহাদের ফজিলতকে মাতা-পিতার খেদমতের কাছে বিসর্জন দেওয়া হয়েছে। লোকটিকে মাতা-পিতার খেদমতে ফেরত দেওয়া হয়েছে।
অথচ জিহাদ ইসলামে এক মহৎ ইবাদত। হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে শহীদ হয়, আল্লাহ তাকে সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুর মতো পবিত্র করে দেন।
একজন মুমিন জান্নাতে পৌঁছে গেলে কখনও দুনিয়ায় ফেরার ইচ্ছে করবে না। কারণ তখন তার সামনে জান্নাতের চিরস্থায়ী সুখ ও দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবন স্পষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু শহীদগণ ব্যতিক্রম! শহীদ যখন জান্নাতের অপার নেয়ামত উপভোগ করবে, তখন তার মনে একটাই বাসনা জাগবে—
فَإِنَّهُ يَسُرُّهُ أَنْ يَرْجِعَ إِلَى الدُّنْيَا فَيُقْتَلَ مَرَّةً أُخْرَى
আহা! যদি আবার দুনিয়ায় ফিরে যেতাম, ফের আল্লাহর পথে জিহাদ করতাম, আবার শহীদ হতাম! [সহীহ বুখারী : ২৭৯৭]
রাসূলুল্লাহ ﷺ নিজেই বলেছেন
وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَوَدِدْتُ أَنِّي أُقْتَلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ ثُمَّ أُحْيَا، ثُمَّ أُقْتَلُ ثُمَّ أُحْيَا، ثُمَّ أُقْتَلُ ثُمَّ أُحْيَا، ثُمَّ أُقْتَلُ
সেই সত্তার কসম! যাঁর হাতে আমার প্রাণ, আমি চাই, আল্লাহর পথে জিহাদ করে শহীদ হই, তারপর আবার জীবিত হই, আবার শহীদ হই, আবার জীবিত হই, এবং ফের শহীদ হই! [সহীহ বুখারী : ২৭৯৫]
জিহাদের এত মর্যাদা থাকা সত্ত্বেও, রাসূল ﷺ এই সাহাবীকে যুদ্ধের পরিবর্তে মাতা-পিতার খেদমতে ফেরত পাঠিয়েছেন। কারণ, মাতা-পিতার খেদমত এমন এক ইবাদত, যার সওয়াব কারো কারো জন্য জিহাদের চেয়েও বড় হতে পারে!
যে দৃশ্য উমর রাযি.-কে কাঁদিয়েছিল
উমাইয়া কিনানি ছিলেন তাঁর জাতির এক সর্দার। তাঁর এক পুত্র ছিল, নাম কিলাব। কিলাব হিজরত করে মদিনায় আসেন উমর রাযি.-এর খেলাফতকালীন সময়ে। কিছুদিন মদিনায় থাকার পর, একদিন কিলাব সাহাবীদের কাছ থেকে জানতে চান, ইসলামে সেরা কাজ কোনটি? সাহাবিরা তাকে বলেন, জিহাদ। কিলাব তখন উমর রাযি.-এর কাছে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি চান। উমর রাযি. তাকে পারস্যের দিকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু কিলাবের বাবা যখন এই খবর শুনলেন, তখন তিনি কিলাবকে ধরে বললেন, তুমি কি আমাদের একা রেখে চলে যাবে? আমরা তোমাদের ছোটবেলায় লালন-পালন করেছি, এখন যখন আমরা বৃদ্ধ, তুমি আমাদের সাহায্য না করে চলে যাবে?
কিলাব উত্তরে বলেন, আমি আপনাদের ছেড়ে যাচ্ছি, কারণ এটি আমার জন্য ভালো হবে।
এভাবে কিলাব বাবা-মাকে রাজি করিয়ে যুদ্ধের জন্য বের হয়ে গেলেন। কিছু দিন যুদ্ধের ময়দানে থাকার পর একদিন কিলাবের বাবা-মা ছায়ায় বসে ছিলেন। হঠাৎ একটি পাখি তার ছোট ছানাকে ডাকছিল এবং খেলা করছিল। এ দৃশ্য দেখে কিলাবের বাবা কাঁদতে লাগলেন, তার মা তাকে কাঁদতে দেখে চোখে পানি চলে এলো। এর কিছু দিন পর কিলাবের বাবা দৃষ্টিহীন হয়ে যান।
এই পরিস্থিতিতে কিলাবের বাবা উমর রাযি.-এর কাছে গিয়ে বলেন, যদি আপনি আমার ছেলেকে ডেকে না পাঠান, তবে আমি আরাফার ময়দানে আপনার জন্য বদ দোয়া করব।
তখন উমর রাযি. কিলাবকে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দেন। কিলাব ফিরে আসলে উমর রাযি. তাকে প্রশ্ন করেন, তোমার বাবার প্রতি তোমার আচরণ কেমন?
কিলাব বলেন, আমি তাকে সবসময় সম্মান করি, তার প্রয়োজন পূরণের জন্য সবসময় পাশে থাকি, তার জন্য ভালো উট খুঁজে দুধ এনে দিই।
এরপর উমর রাযি. কিলাবের বাবাকে ডেকে আনেন এবং তাকে জিজ্ঞেস করেন, আজ সবচেয়ে ভালো কী চান?
কিলাবের বাবা বলেন, আজ আমি কিছুই চাই না, তবে আমি চাই যে আমার ছেলে কিলাব ফিরে আসুক, আমি একবার তার শরীরের গন্ধ নিতে এবং তাকে জড়িয়ে ধরতে চাই।
উমর রাযি. এই কথা শুনে কাঁদতে থাকেন এবং বলেন, আপনার আশা আল্লাহর ইচ্ছায় পূর্ণ হবে। পরে উমর রাযি. কিলাবকে নির্দেশ দেন, যেন সে তার বাবার জন্য দুধ সংগ্রহ করে তার হাতে এনে দেয়। কিলাব তা করে এনে উমর রাযি.-এর কাছে পৌঁছান। উমর রাযি. দুধের পাত্রটি হাতে নেন এবং বলেন, বাবা, আপনার দুধ খান।
অন্ধ বাবা হাত দিয়ে উমর রাযি.-এর হাত থেকে দুধ নেন। এরপর তিনি পাত্রটি মুখের কাছে আনতেই বলেন, আমিরুল মুমিনীন! আল্লাহ শপথ, আমি এখানে কিলাবের হাতের গন্ধ পাচ্ছি।
এটি দেখে উমর রাযি. কাঁদতে থাকেন এবং কিলাবকে জড়িয়ে ধরে তার বাবার হাতে তুলে দিয়ে বলেন, এই নিন, আপনার ছেলে কিলাব।
উপস্থিত সবাইও কাঁদতে থাকে।
উমর রাযি. তখন কিলাবকে বলেন, তোমার মা-বাবার পাশে থেকো এবং তাদের সেবা করো। যতক্ষণ তারা বেঁচে আছেন, তাদের জন্য যত্নশীল হও, তারপর নিজের কাজের দিকে মনোযোগ দাও। [মুজামুল বুলদান : ১/৪১৩]
হযরত ওয়াইস করনী রহ. : মায়ের খেদমতের অনন্য দৃষ্টান্ত
ওয়াইস করনী রহ. নবীজির যুগে জীবিত ছিলে। তাঁর একান্ত ইচ্ছা ছিল নবীজি ﷺ-এর দরবারে গিয়ে সরাসরি মোলাকাত করা। নবীজিকে দেখার সৌভাগ্যই ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় চাওয়া। কিন্তু তাঁর মা অসুস্থ ছিলেন, যাঁর সেবা করা অত্যন্ত জরুরি ছিল। তাই তিনি নবীজিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার হৃদয়ের একমাত্র বাসনা আপনার দরবারে হাজির হওয়া। কিন্তু আমার মা অসুস্থ, তাঁকে ফেলে কি আসতে পারি? নবীজি ﷺ তাঁকে নির্দেশ দিলেন, তুমি আমার সাক্ষাতে এসো না, বরং বাড়িতে থেকে তোমার মায়ের খেদমত করো।
এ কেমন পরীক্ষা! যার হৃদয় নবীজির প্রেমে তীব্রভাবে ব্যাকুল, তিনি কেমন করে নিজেকে থামিয়ে রাখবেন? আজকের দিনে কত মানুষ নবীজির রওজা শরীফ জিয়ারতের জন্য আকুল হয়ে ওঠে! অথচ ওয়াইস করনী রহ. তখন জীবিত ছিলেন, নবীজির সাথে সরাসরি সাক্ষাতের সুযোগও ছিল। তবুও তিনি নিজের ইচ্ছাকে কুরবান করে দিলেন। ফলে তিনি সাহাবী হওয়ার মর্যাদা পেলেন না, যদিও সাহাবীগণের স্থান এত উচ্চ যে, দুনিয়ার সবচেয়ে বড় অলি-আউলিয়াও তাদের সমকক্ষ হতে পারেন না।
সাহাবাদের মর্যাদা
একবার প্রসিদ্ধ বুজুর্গ ও মুহাদ্দিস আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক রহ.-কে জিজ্ঞাসা করা হলো, মুয়াবিয়া রাযি. উত্তম, নাকি হযরত ওমর ইবনু আব্দুল আজিজ?
তিনি উত্তরে বললেন, হযরত মুয়াবিয়ার ব্যক্তিত্ব তো অনেক দূরের কথা! বরং নবীজির সাথে জিহাদে যে ধূলিকণা তাঁর নাকের ছিদ্রে প্রবেশ করেছিল, সেটাও হাজারো ওমর ইবন আব্দুল আজিজের চেয়েও উত্তম। কারণ, আল্লাহ তাঁকে সাহাবী হওয়ার মর্যাদা দান করেছেন।
মায়ের খেদমতের জন্য বিরল ত্যাগ
নবীজি ﷺ ওয়াইস করনী রহ.-কে সাহাবী হওয়ার সুযোগের চেয়েও বড় এক কাজে ব্যস্ত থাকতে বলেছেন—মায়ের খেদমত।
আজ যদি আমাদের কেউ থাকতো, হয়তো বলতো—সাহাবী হওয়া আরেকবার সম্ভব হবে না! মা অসুস্থ, কিন্তু নবীজির সাক্ষাত অনেক বড় প্রয়োজন! আমি নবীজির কাছে গিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো।
কিন্তু ওয়াইস করনী রহ. এমনটি করেননি। তিনি নিজের আবেগকে দমন করে নবীজির হুকুম পালন করেছেন।
মায়ের খেদমতের পুরস্কার
ওয়াইস করনী রহ. নবীজির সাথে সাক্ষাতের সৌভাগ্য লাভ করতে পারেননি, কারণ তিনি মায়ের সেবায় ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু আল্লাহ তাঁকে এমন পুরস্কার দিলেন, যা বহু সাহাবীও পাননি! নবীজি ﷺ উমর রাযি.-কে বলে গিয়েছিলেন, ‘করন নামক স্থান থেকে এক ব্যক্তি মদিনায় আসবে। যদি তুমি তাকে পাও, তাহলে তার কাছে দোয়া চাইবে, কারণ আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেন।’ উমর রাযি. প্রতিদিন অপেক্ষা করতেন। যখনই ইয়ামানের কোনো কাফেলা মদিনায় আসতো, তিনি ছুটে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতেন, তোমাদের মাঝে কি ওয়াইস করনী আছেন?
একদিন সত্যিই তিনি এলেন! হযরত উমর রাযি. তাঁকে দেখে আনন্দিত হলেন এবং নবীজির কথা স্মরণ করে বললেন,‘আমার জন্য দোয়া করুন!’
ওয়াইস করনী রহ. অবাক হয়ে বললেন, ‘আমি একজন সাধারণ বান্দা, আমার দোয়ার জন্য আপনি কেন এত ব্যাকুল?’ হযরত উমর রাযি. উত্তরে বললেন, ‘এটা আমার নবীজি ﷺ-এর নির্দেশ!’ তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহ আপনার দোয়া কবুল করেন।’
এই কথা শুনে ওয়াইস করনী রহ. কেঁদে ফেললেন। তাঁর চোখ বেয়ে অঝোরধারায় পানি ঝরতে লাগল।
সুবহানাল্লাহ! মায়ের খেদমতের কারণে নবীজির সরাসরি সাক্ষাত থেকে বঞ্চিত হলেও, নবীজির দোয়া কবুল হওয়ার সুসংবাদ তিনি পেয়ে গেলেন!
মা-বাবার খেদমত : আমাদের অজ্ঞতা
আমরা তো এটাও বুঝিনা যে, মা-বাবার খেদমত কীভাবে করতে হয়? আমরা বুঝিনা, কারণ আমাদের মন ও চিন্তাধারা ভিন্ন দিকে ব্যস্ত থাকে। আমরা তাদের চাওয়া-পাওয়া বোঝার চেষ্টা করি না। আমরা মনে করি, কেবল টাকাপয়সা খরচ করাই যথেষ্ট। অথচ মা-বাবার খেদমত মানে শুধু তাদের জন্য খাবার এনে দেওয়া বা চিকিৎসার ব্যবস্থা করাই নয়, বরং তাদের মন রক্ষা করা, তাদের প্রতি বিনয়ী ও শ্রদ্ধাশীল থাকা, এবং তাদের ভালোবাসা ও মানসিক প্রশান্তির ব্যবস্থা করা। এগুলোও খেদমতের অংশ। এইজন্যই আমাদের শেখা দরকার মা-বাবার খেদমত কীভাবে করতে হয়?
কীভাবে মা-বাবার খেদমত করবেন?
১. ভালো ব্যবহার করবেন
কুরআন মাজিদে এই প্রসঙ্গে একাধিক আয়াত রয়েছে
وَوَصَّيْنَا الْإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ إِحْسَانًا
আমি মানবসম্প্রদায়কে উপদেশ দিয়েছি যে, তারা যেন নিজেদের মাতা-পিতার সঙ্গে সদাচরণ করে। [সূরা আহকাফ : ১৫]
অন্য আয়াতে এসেছে
وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا
আপনার প্রভূ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত আর কারো ইবাদত করবে না এবং মাতা-পিতার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে। [সূরা ইসরা : ২৩]
এখানে মাতা-পিতার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার বিষয়টি তাওহীদের সাথে আলোচিত হয়েছে। তাওহীদের পর সর্বপ্রথম দায়িত্ব ও কর্তব্য কী হবে; তা বলে দেয়া হয়েছে। আর তাহল, মাতা-পিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা।
মাতা-পিতা যখন বৃদ্ধ হবে
তারপর মহান আল্লাহ উপদেশের ভঙ্গিতে বলেন
إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِندَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلاَهُمَا فَلاَ تَقُل لَّهُمَآ أُفٍّ
তোমাদের জীবদ্দশায় যদি মাতা-পিতা বার্ধক্যে উপনীত হন, তবে কখনও তাদের ‘উফ’ বলো না। [সূরা ইসরা : ২৩]
আল্লাহ তাআলা বিশেষভাবে বার্ধক্যের কথা উল্লেখ করেছেন, কারণ এই সময়ে মানুষ শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। অনেক সময় তাদের আচরণে রুক্ষতা আসতে পারে, ভুল করতে পারেন, এমনকি অহেতুক কথাবার্তাও বলতে পারেন। কিন্তু সন্তান হিসেবে আমাদের কর্তব্য হলো— ধৈর্যধারণ করা, কোমল ব্যবহার করা এবং বিরক্তি প্রকাশ না করা। তাদের সঙ্গে কখনও উঁচু স্বরে কথা বলবেন না এবং সবসময় হাসিমুখে কথা বলুন।
একটি শিক্ষণীয় ঘটনা
একজন বৃদ্ধ ছেলেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছিলেন। একদিন বৃদ্ধ বারান্দায় বসে ছিলেন, হঠাৎ একটি কাক উড়ে এসে দেয়ালে বসলো। বৃদ্ধ ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, বাবা, এটা কী?
ছেলে উত্তর দিল, এটা একটি কাক।
কিছু সময় পরে, বৃদ্ধ আবার একই প্রশ্ন করলেন। এবার ছেলে বলল, এটা কাক।
একটু পর আবার একই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে ছেলে ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলল এবং চটে গিয়ে বলল, এটা কাক, কাক, কাক! আমি কতবার বলব?
এখন বৃদ্ধ কিছু সময় পর ঘরে গিয়ে একটি পুরানো ডাইরি বের করলেন। তারপর ছেলের কাছে এসে বললেন, বাবা, তুমি এই পাতাটি একটু পড়ো।
ছেলে পড়তে শুরু করল এবং দেখল, বৃদ্ধ বাবা একটি পাতায় লিখেছেন—
আজ বারান্দায় বসে ছিলাম। সঙ্গে ছিল আমার ছোট ছেলে। একটি কাক আসলো। আমার ছেলে আমাকে পঁয়ত্রিশ বার জিজ্ঞেস করল, ‘এটা কী?’ আমি পঁয়ত্রিশ বারই আনন্দের সাথে উত্তর দিলাম, ‘এটা কাক।’ ছেলেটা যতবারই প্রশ্ন করল, আমি ততবারই শান্তভাবে উত্তর দিয়েছি।
পড়া শেষ করে ছেলে চুপ হয়ে গেল। বৃদ্ধ বাবা বললেন, বৎস, পিতা আর সন্তানের মধ্যে পার্থক্য এখানেই। তুমি যখন ছোট ছিলে, তখন তুমি পঁয়ত্রিশ বার আমাকে একই প্রশ্ন করেছিলে এবং আমি শান্তভাবে উত্তর দিয়েছিলাম। কিন্তু আজ, যখন আমি মাত্র পাঁচ বার প্রশ্ন করলাম, তুমি রেগে গেলে!
মাতা-পিতা অমুসলিম হলে
এজন্য আল্লাহ তাআলা আমাদের বলেছেন, বৃদ্ধ বয়সে মা-বাবার মেজাজ খিটখিটে হয়ে যেতে পারে—এটা স্বাভাবিক। তাঁদের অনেক কথা তখন অহেতুক ও বিরক্তিকর মনে হতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, শৈশবে এর চেয়েও বেশি বিরক্তিকর ও অপ্রয়োজনীয় কথা তাঁরা আমাদের কাছ থেকে শুনেছেন, তবু ধৈর্য্য ধরে সহ্য করেছেন। তাই আমাদেরও উচিত তাঁদের অসংলগ্ন কথাবার্তা ধৈর্য্যরে সঙ্গে শোনা, সহ্য করা এবং ভালো ব্যবহার করা। এমনকি যদি তাঁরা কাফেরও হন, তবুও তাঁদের প্রতি সদাচরণ বজায় রাখতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন
وَإِن جَاهَدَاكَ عَلَىٰ أَن تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا ۖ وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا
তোমার মা-বাবা যদি তোমাকে আমার সঙ্গে শিরক করার জন্য বাধ্য করে, যার সম্পর্কে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তবে তাদের আনুগত্য কোরো না। কিন্তু দুনিয়ার জীবনে তাদের সঙ্গে সদাচরণ করো। [সূরা লোকমান: ১৫]
অর্থাৎ মা-বাবা যদি কাফেরও হন, তবুও তাঁদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও ভালোবাসা কমে যাবে না। কারণ তাঁরা আমাদের জন্মদাতা, আমাদের জন্য অগণিত কষ্ট স্বীকার করেছেন। তাই তাঁদের প্রতি সহনশীলতা ও ভালো ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই।
মায়ের প্রতি সদাচরণের পুরস্কার
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, এক রাতে আমি ঘুমাচ্ছিলাম এবং স্বপ্নে দেখলাম যে আমি জান্নাতে আছি। তখন আমি একজন কারীর তেলাওয়াতের আওয়াজ শুনলাম, তাই আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটি কে পড়ছে?
ফেরেশতারা বলল, এটি হারিসাহ ইবনু নু'মান পড়ছেন।
এরপর রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন
كَذَاكَ الْبِرُّ كَذَاكَ الْبِرُّ
সদাচারণ এমনই হয়, সদাচারণ এমনই হয়।
আর হারিসাহ ছিল নিজের মায়ের প্রতি অধিক সদাচারণকারী ব্যক্তি। [মুসনাদে আহমদ : ২৪৬৫৬]
২. শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেখান
আল্লাহ তাআলা বলেন
وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُل رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِى صَغِيراً
তাদের সামনে বিনয়ের ডানা বিছিয়ে দাও এবং দোয়া করো, হে আমার প্রতিপালক! তুমি তাদের প্রতি রহম করো, যেমন তারা শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছেন। [সূরা ইসরা: ২৪]
অর্থাৎ মা-বাবার প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা শুধু দায়িত্ব নয়, বরং এটি আল্লাহর আদেশ। তারা যতই বয়সে ভারী হোক, তাদের প্রতি কোমলতা বজায় রাখা, বিনয়ের সঙ্গে আচরণ করা এবং তাদের জন্য দোয়া করাই সন্তানের সত্যিকারের খেদমত।
বৃদ্ধকালে মেজাজে রুক্ষতা চলে আসে তাই বিশেষভাবে বৃদ্ধকালের অবস্থার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। অন্যথায় মাতা-পিতা সর্বাবস্থায়ই ভক্তি-শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র। তাঁদের কার্যকলাপে কখনও অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা উচিত নয়।
মুহাম্মদ ইবনু মুনকাদির রহ.
বিশিষ্ট তাবিয়ী মুহাম্মদ ইবনু মুনকাদির রহ. নিজের গালকে মাটিতে রাখতেন, তারপর তার মায়ের কাছে বলতেন
মা! আপনি একটু দাঁড়ান, ضَعِي قَدَمَكِ عَلَى خَدِّي আপনার পা-টা আমার গালে রাখেন। [হিলয়াতুল আউলিয়া : ৩/১৫০]
মুহাম্মদ ইবনু মুনকাদির রহ. বলেন
بِتُّ أَغْمِزُ رِجْلَ أُمِّي وَبَاتَ - عمر يُصَلِّي ، وَمَا يَسُرُّنِي أَنَّ لَيْلَتِي بِلَيْلَتِهِ
রাতে আমি আমার মায়ের পা মাসাজ করে দিতাম, আর আমার ভাই উমর নামায পড়তেন। আমি কখনওই চাইতাম না যে, আমার রাতটি তার রাতের মতো হোক। [হিলয়াতুল আউলিয়া : ৩/১৫০]
৩. তাদের অপছন্দের কিছু এড়িয়ে চলুন
মা-বাবার প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান প্রকাশের অন্যতম উপায় হলো, তাদের অপছন্দের কাজ থেকে দূরে থাকা। এমন কিছু করবেন না, যা তাদের মনে কষ্ট দেয়, যা তাদের চোখে অশ্রু এনে দেয়। বরং এমন কিছু করুন, যা তাদের মুখে হাসি ফোটায়, যা তাদের হৃদয়কে প্রশান্তিতে ভরে দেয়।
তাদের পছন্দ-অপছন্দের প্রতি যত্নশীল হোন, যেন আপনার কোনো আচরণ বা সিদ্ধান্ত তাদের ব্যথিত না করে। তাঁদের ইচ্ছাকে সম্মান করুন, তাঁদের অনুভূতিকে গুরুত্ব দিন। এতে তাঁদের হৃদয়ে প্রশান্তি থাকবে, আর আপনিও দুনিয়া ও আখেরাতে লাভবান হবেন।
ইমাম জায়নুল আবেদিন রহ.-এর মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা
ইমাম জায়নুল আবেদিন রহ. ছিলেন মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধাশীলতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি তাঁর মায়ের প্রতি এতটাই সম্মান প্রদর্শন করতেন যে, একবার এক ব্যক্তি তাঁকে বললেন, আপনি তো মা-বাবার প্রতি সবচেয়ে বেশি সদাচারী ও শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তি। কিন্তু আমরা কখনও আপনাকে আপনার মায়ের সঙ্গে একসঙ্গে খেতে দেখিনি!
জবাবে ইমাম জায়নুল আবেদিন রহ. বললেন
أَخَافُ أَنْ آكُلَ مَعَهَا، فَتَسْبِقَ عَيْنُهَا إِلَى شَيْءٍ مِنَ الطَّعَامِ وَأَنَا لَا أَدْرِي، فَآكُلُهُ، فَأَكُونُ قَدْ عَقَقْتُهَا
আমি ভয় পাই, যদি আমি মায়ের সঙ্গে একসঙ্গে খাই, আর তাঁর চোখ কোনো নির্দিষ্ট খাবারের দিকে চলে যায়, অথচ আমি তা বুঝতে না পারি, আর আমি সেটি খেয়ে ফেলি তাহলে আমি তাঁর হক আদায়ে ত্রুটি করে ফেলব, যা তাঁকে কষ্ট দিতে পারে। আমি কখনও চাই না, আমার কারণে আমার মা সামান্যতম কষ্ট পান! [ইবনুল জাওযী, র্বিরুল ওয়ালিদাইন : ১৬]
এই ঘটনাটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়-সন্তানের জন্য মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধা কেবল বড় বড় কথা বলায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা হতে হবে হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত। তাঁদের অনুভূতি, চাহিদা ও স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি সংবেদনশীল হওয়া— এটাই প্রকৃত ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার প্রকাশ।
৪. তাদের আরামের ব্যবস্থা করুন
অনুরূপভাবে মা-বাবার খেদমত কেবল তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিনয় দেখানো বা ভালো ব্যবহার করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তাঁদের আরাম-আয়েশ নিশ্চিত করাও সন্তানের অন্যতম দায়িত্ব। সাধ্য অনুযায়ী তাঁদের প্রয়োজন পূরণ করুন, যেন কোনো অভাব অনুভব না করেন। তাদের প্রয়োজন বোঝার চেষ্টা করুন— তারা হয়তো সরাসরি কিছু বলবেন না, কিন্তু আপনি তাদের চাহিদা আগে থেকেই বোঝার চেষ্টা করুন। যদি অসুস্থ হন, তবে ভালোবাসা ও আন্তরিকতার সঙ্গে সেবা করুন, আর সুস্থ থাকলে তাঁদের দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করুন। যেন তাঁরা কখনও একাকিত্ব বা বোঝা হয়ে যাওয়ার অনুভূতিতে না ভোগেন।
আবূ হুরায়রা রাযি.-এর মায়ের খেদমত
আবূ হুরায়রা রাযি. সম্পর্কে এসেছে, তিনি যখন তার বাড়ি থেকে বের হতে চাইতেন, তখন তিনি তার মায়ের দরজায় দাঁড়িয়ে বলতেন
السَّلاَمُ عَلَيْكِ يَا أُمَّهُ وَرَحْمَةُ اللَّهِ وَبَرَكَاتُهُ
‘তোমার ওপর শান্তি, মা, আল্লাহর রহমত ও বরকত হোক।’
মায়ের উত্তর আসত
وَعَلَيْكَ السَّلاَمُ يَا وَلَدِي وَرَحْمَةُ اللَّهِ وَبَرَكَاتُهُ
‘তোমার ওপরও শান্তি, আমার প্রিয় সন্তান, আল্লাহর রহমত ও বরকত হোক।’
তারপর তিনি বলতেন
رَحِمَكَ اللَّهُ كَمَا رَبَّيْتَنِي صَغِيرًا
‘আল্লাহ তোমাকে রহমত করুন, যেমন তুমি আমাকে ছোটবেলায় পালন করেছিলে।’
মাও বলতেন
رَحِمَكَ اللَّهُ كَمَا بَرَّرْتَنِي كَبِيرًا
‘আল্লাহ তোমাকে রহমত করুন, যেমন তুমি আমাকে বড় হয়ে সম্মানিত করেছো।’
যখন তিনি বাড়িতে ফিরে আসতেন, তখন তিনি আবার একইভাবে তার মায়ের সাথে কথা বলতেন।
এছাড়া, আবূ উমামা রাযি. থেকে বর্ণিত, আবূ হুরায়রা রাযি. তার মাকে কাঁধে তুলে নিয়ে যেতেন এবং তাকে নামিয়ে দিতেন, কারণ তার মা দৃষ্টিহীন ছিলেন। [ইবনুল জাওযী, র্বিরুল ওয়ালিদাইন : ৫]
৫. তাদের জন্য সাদকা করুন
বাবা-মায়ের জন্য সাদকা—এটাও তাদের এক অমূল্য খেদমত। সুতরাং আপনি যদি সামর্থ্যবান হন, তাহলে এই সুযোগ হাতছাড়া করবেন কেন! এই খেদমত হতে পারে দুই ধরনের—
১. সাধারণ সাদকা : যেমন- গরিব-অসহায়দের খাদ্য বিতরণ বা আর্থিক সহায়তা দান।
২. সাদকায়ে জারিয়াহ বা চিরস্থায়ী দান : এটি এমন দান, যার সওয়াব চলতে থাকে, যতদিন মানুষ এর উপকার পেতে থাকে। যেমন—
মসজিদে দান— যেখানে মানুষ নামায পড়বে, ইলম শিখবে, আর সওয়াব পৌঁছাতে থাকবে।
মাদরাসায় দান— যেখান থেকে জ্ঞান ছড়িয়ে পড়বে, যতদিন মানুষ শিখবে, ততদিন সওয়াব জমা হবে।
টিউবওয়েল বা পানির সুব্যবস্থা— যতদিন কেউ এক ফোঁটা পানি পান করবে, ততদিন সওয়াব চলবে।
কুরআন মাজিদ বা ইসলামিক বই বিতরণ— যতবার কেউ তা পড়বে, সওয়াব পৌঁছাবে।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন
إِذَا مَاتَ الْإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلا مِنْ ثَلاثَةٍ : إِلا مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ ، أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ ، أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ
যখন মানুষ মৃত্যুবরণ করে তখন তার সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায় তিন প্রকার আমল ছাড়া। ১. সাদকাহ জারিয়াহ্ অথবা ২. এমন ইলম যার দ্বারা উপকার হয় অথবা ৩. পুণ্যবান সন্তান যে তার জন্যে দোয়া করতে থাকে। [সহীহ মুসলিম : ১৬৩১]
একটি ভুল ধারণা
আমাদের সমাজে অনেকের ধারণা, জীবিত বাবা-মায়ের জন্য সাদকা করা যায় না। মূলত এই ধারণা সঠিক নয়। বরং ইসলামি ফিকহের গ্রন্থসমূহে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, কোনো ব্যক্তি যদি নফল রোযা রাখে, নফল নামায আদায় করে বা নফল সাদকা দেয় এবং এর সওয়াব জীবিত বা মৃত ব্যক্তির জন্য দান করে, তাহলে তা বৈধ। [রাদ্দুল মুহতার : ১/৬০৫]
সুতরাং বাবা-মা জীবিত থাকুক বা না থাকুক, তাদের জন্য সাদকা করা, নেক আমল করে সওয়াব দান করা— এটি একটি বরকতময় আমল এবং তাদের এক মহৎ খেদমত।
৬. তাদের জন্য নিয়মিত দোয়া ও ইস্তিগফার করুন
যেমন رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا (অর্থাৎ প্রভু, তাদের প্রতি দয়া করুন, যেমন তারা আমাকে ছোটবেলায় দয়া করেছিল)।
অনুরূপভাবে আল্লাহ তাআর কাছে তাদের জন্য মাগফিরাত ও সুস্থতার দোয়া করুন।
৭. আজমতের ক্ষেত্রে পিতা এগিয়ে, খেদমতের ক্ষেত্রে মা
বুজুর্গানে দীন একটি মূলনীতি বলেছেন, আজমতের ক্ষেত্রে পিতা এগিয়ে, আর খেদমতের ক্ষেত্রে মা।
আজমত মানে শ্রদ্ধা ও মর্যাদা— পিতার প্রতি গভীর ভক্তি ও সম্মান রাখা। যেমন— তার সামনে পা ছড়িয়ে না বসা, মাথার কাছাকাছি বসা, সর্বদা বিনয় ও আদব বজায় রাখা। এসব বিষয়ে পিতার হক বেশি। খেদমতের মানে সেবা ও ভালো আচরণ— এ ক্ষেত্রে মায়ের অধিকার সবচেয়ে বড়। এমনকি পিতার চেয়েও তিনগুণ বেশি। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন
أُمُّكَ، ثُمَّ أُمُّكَ، ثُمَّ أُمُّكَ، ثُمَّ أَبُوكَ
তোমার মা, তোমার মা, তোমার মা, তারপর তোমার বাবা। [সহীহ মুসলিম : ২৫৪৮]
মা তিনগুণ বেশি খেদমতের হকদার কেন?
এটি আল্লাহর এক বিশেষ কুদরত যে, সন্তানের সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। মা-সন্তানের মাঝে এমন এক স্বাভাবিক ঘনিষ্ঠতা রয়েছে, যা পিতার সঙ্গে হয় না। ফলে এমন অনেক কথা আছে, যা পিতার সামনে বলা কষ্টকর, কিন্তু মায়ের সামনে সহজেই বলা যায়।
তাছাড়া মা—একজন নারী নন শুধু, তিনি ভালোবাসার সর্বোচ্চ প্রতীক, ত্যাগের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। আমাদের এই পৃথিবীতে আসার পেছনে যে যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে, তার গভীরতা কেবল একজন মা-ই অনুভব করতে পারেন।
একজন মা যখন সন্তান জন্ম দেন, তখন তিনি মৃত্যুর দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছে যান।
গবেষণায় বলা হয়, প্রসব বেদনার তীব্রতা প্রায় ৫৭ ইউনিট ডেল, যেখানে মানুষ সাধারণত ৪৫ ডেলের বেশি ব্যথা সহ্য করতে পারে না। তুলনাস্বরূপ, একসঙ্গে বিশটি হাড় ভেঙে যাওয়ার যন্ত্রণা এর চেয়ে কম!
এই অসহনীয় ব্যথা সহ্য করেও মা সন্তানের জন্ম দেন, তবু তাঁর মুখে থাকে ভালোবাসার হাসি। সন্তানের প্রথম কান্নার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সব কষ্ট ভুলে যান, শুধু এই একটিই প্রার্থনা করেন— আমার সন্তান সুস্থ থাকুক!
এই যে সীমাহীন ত্যাগ, এই যে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা— এ কারণেই মা বাবার তুলনায় তিনগুণ বেশি খেদমতের হকদার!
প্রসববেদনার একটি মাত্র কষ্টের বদলাও তুমি দিতে পারবে না
একজন ইয়ামানি ব্যক্তি কাবা ঘরের তওয়াফ করছিলেন। তিনি নিজের মাকে নিজের পিঠে বহন করছিলেন এবং বলছিলেন
إِنِّي لَهَا بَعِيْرُهَا الْمُذَلَّلْ
إِنْ أُذْعِرَتْ رِكَابُهَا لَمْ أُذْعَرْ
‘আমি তার জন্য আজ্ঞাবহ উট,
যদি তার কাফেলা ভয় পায়, তবুও আমি ভয় পাব না।’
এরপর তিনি হযরত ইবনু উমর রাযি.-এর দিকে ফিরে বললেন, হে ইবনু উমর! আপনি কি মনে করেন, আমি কি এভাবে আমার মায়ের হক পরিশোধ করতে পেরেছি?
তখন ইবনু উমর রাযি. উত্তর দিলেন
لاَ، وَلاَ بِزَفْرَةٍ وَاحِدَةٍ
না, এমনকি তার প্রসববেদনার একটি মাত্র কষ্টের বদলাও তুমি দিতে পারোনি। [আল-আদাবুল মুফরাদ : ১১]
কুরআন মাজিদেও আছে কেবল মায়ের কষ্টের কথা
কুরআন মাজিদেও আল্লাহ তাআলা কেবল মায়ের কষ্টের কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন
وَ وَصَّیۡنَا الۡاِنۡسَانَ بِوَالِدَیۡهِ اِحۡسٰنًا ؕ حَمَلَتۡهُ اُمُّهٗ كُرۡهًا وَّ وَضَعَتۡهُ كُرۡهًا
আমি মানুষকে তার বাবা-মায়ের প্রতি সদাচারের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে তাকে গর্ভে ধারণ করেছে। [সূরা আহকাফ : ১৫]
দেখুন, আল্লাহ তাআলা মা-বাবা দু’জনের সাথেই সদাচরণের আদেশ করেছেন, এরপর আর বাবার কথা নেই, আছে শুধু মায়ের কথা।
এর দ্বারা বোঝা যায়, বাবা যা কিছু পাচ্ছেন মায়ের সঙ্গে থাকার কারণে পাচ্ছেন। যেহেতু তিনি মাকে অর্থ দিয়ে, শক্তি দিয়ে সাহায্য করেছেন তাই তিনি কিছু পাচ্ছেন।
সুতরাং কোনো বাবা যদি মায়ের সাথে ভালো আচরণ না করেন, তাহলে সন্তান বাবাকে শ্রদ্ধা করলেও স্বাভাবিক মহব্বত পাবে না। তবে সুসন্তান হলে কুরআন যে আনুগত্যের কথা বলেছে সে আনুগত্য করবে। তার সঙ্গে বেআদবী করবে না, আদব রক্ষা করবে। তবে সন্তানের হৃদয়ে ভালোবাসা কেবল তখনই আসবে, যখন বাবা মায়ের হক আদায় করবেন, তার প্রতি সদয় হবেন। সন্তানের ভালোবাসা পেতে হলে, বাবাকে মায়ের মাধ্যমে সন্তানের হৃদয়ে প্রবেশ করতে হবে।
হে আল্লাহ! আমাদের পিতার আজমত ও মায়ের খেদমতের তাওফিক দান করুন— আমীন।
মা-বাবার অধিকার বনাম আধুনিক সমাজের অকৃতজ্ঞতা
মুহতারাম হাজেরীন! মা-বাবার প্রতি আনুগত্য ও তাঁদের সঙ্গে উত্তম আচরণের ব্যাপারে ইসলামে এভাবে অত্যন্ত জোর দিয়ে বলা হয়েছে। অথচ দুনিয়ার স্রোত আজ উল্টোদিকে প্রবাহিত হচ্ছে। চলছে নিয়মতান্ত্রিক প্রশিক্ষণ— যেখানে সন্তানের হৃদয় থেকে মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ মুছে ফেলার শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে।
শেখানো হচ্ছে— মা-বাবা মানুষ, আমরাও মানুষ। আমাদের ও তাঁদের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। তাহলে আমাদের ওপর তাঁদের আবার কিসের অধিকার?
মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর প্রবণতা
আরও দুঃখজনক বিষয় হলো, পাশ্চাত্যের অশুভ প্রভাবে আমাদের সমাজেও এখন মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর প্রবণতা বাড়ছে। যাঁরা জীবনের সেরা সময়, সর্বোচ্চ শ্রম, ভালোবাসা ও ত্যাগ স্বীকার করে আমাদের বড় করেছেন, তাঁদেরই শেষ বয়সে পরিত্যক্ত করে দেওয়া হচ্ছে! বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে চোখ রাখলেই বোঝা যায় কতটা হৃদয়বিদারক এক পরিস্থিতি। সেখানে অনেক মা-বাবা একাকিত্ব, কষ্ট আর অশ্রু নিয়ে দিন কাটান। সন্তানের পথ চেয়ে অপেক্ষা করেন, কিন্তু কেউ আসে না। জীবনসায়াহ্নে এসে তাঁরা অনুভব করেন, যাদের জন্য সারাটা জীবন বিলিয়ে দিলেন, তারাই আজ অচেনা!
এমন অকৃতজ্ঞতা তখনই সমাজে দেখা দেয়, যখন মানুষ দীন থেকে দূরে সরে যায়, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য মূল্যহীন হয়ে যায় এবং আখেরাতের ভাবনা মন থেকে উঠে যায়। তখনই মা-বাবার প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ নিঃশেষ হয়ে যায়, তখনই মানুষ এমন নিষ্ঠুরতা করতে পারে!
আল্লাহ আমাদের এই বিভ্রান্তি ও অকৃতজ্ঞতা থেকে হেফাজত করুন, মা-বাবার হক আদায় করার তাওফিক দান করুন— আমীন।
ইউরোপিয়ান একজন মা যে কারণে ইসলাম গ্রহণ করেছেন
একবার একজন দাঈ ইউরোপে সফর করতে গিয়েছিলেন। রেলস্টেশনে বসে ছিলেন, এমন সময় তিনি দেখতে পেলেন একজন বৃদ্ধা মহিলা, বয়স প্রায় সত্তর। হাতে একটি আপেল নিয়ে তিনি তা খেতে চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু দাঁত তেমন ছিল না, তাই খেতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল।
দাঈ মহিলার কাছে গিয়ে বসেন এবং আপেলটি কেটে তাকে খেতে সাহায্য করেন। এটা দেখে বৃদ্ধা মহিলার চোখে পানি চলে আসে। দাঈ অবাক হয়ে তাকে প্রশ্ন করেন, আপনি কেন কাঁদছেন?
বৃদ্ধা বলেন, দশ বছর হয়ে গেল, আমার সন্তানরা আমাকে একা রেখে চলে গেছে। তুমি কেন আমার সঙ্গে এমন করলা?
দাঈ তখন উত্তর দেন, এটাই আমার ধর্মের শিক্ষা। আমাদের ধর্ম বাবা-মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সেবা করতে বলে।
তিনি আরও বলেন, আমার দেশে আমার মা বয়সে আপনার মতো, আমি তাকে খুব ভালোভাবে রেখেছি। আমি, আমার পরিবার সবাই তাকে সম্মান করি। তার আগে কিছু খাই না, তার অনুমতি ছাড়া কোথাও যাই না এবং সবসময় তার সেবা করি।
বৃদ্ধা তাকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি কোন ধর্মে বিশ্বাসী?
দাঈ উত্তর দেন, ইসলাম।
এই কথার পর বৃদ্ধা মহিলার মন পরিবর্তন হয়ে যায় এবং তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। [ইন্টারনেট]
মা-বাবার আনুগত্যের সীমারেখা
ইসলামের শিক্ষা হলো, মা-বাবার আনুগত্য করা সন্তানদের ওপর ওয়াজিব। তাঁদের আদেশ-নিষেধ মানা যেমন ফরজ, তেমনি এর অবহেলা করাও মারাত্মক গুনাহ। ঠিক নামায-রোযার মতোই এটি ইসলামের একটি অপরিহার্য বিধান। তবে এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত রয়েছে— তাঁদের আদেশ অবশ্যই ইসলামের সীমার ভেতরে হতে হবে। যদি তাঁরা এমন কোনো আদেশ দেন যা ইসলাম-বিরোধী, তাহলে সে ক্ষেত্রে আনুগত্য করা জায়েয হবে না। কেননা রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন
فَإِنْ أُمِرَ بِمَعْصِيَةٍ، فَلَا سَمْعَ وَلَا طَاعَةَ
অসৎকাজে আনুগত্য নয়; আনুগত্য কেবলমাত্র সৎকাজের ক্ষেত্রেই হতে হবে। [সহীহ বুখারী : ৭১৪৫]
হাসান বসরী রহ. বলেন
إِنْ مَنَعَتْهُ أُمُّهُ عَنِ الْعِشَاءِ فِي الْجَمَاعَةِ شَفَقَةً لَمْ يُطِعْهَا
যদি মা সন্তানের প্রতি মায়া দেখিয়ে ইশার জামাতে যাওয়ায় বাধা দেন, তাহলে এ ক্ষেত্রে তাঁর আনুগত্য করা যাবে না। [সহীহ বুখারী : ১/২৩০]
তবে যেসব ক্ষেত্রে তাঁদের আনুগত্য করা সম্ভব নয়, সেসব ক্ষেত্রেও তাঁদের প্রতি সদ্ব্যবহার করতেই হবে, যেন তাঁরা কষ্ট না পান।
মা-বাবার অবাধ্যতা : ভয়াবহ পরিণতি
আর যদি মা-বাবা ইসলামসম্মত কোনো নির্দেশ দেন, তবে তা পালন করা সন্তানের জন্য বাধ্যতামূলক। এটি অমান্য করলে ঠিক সেই ধরনের গুনাহ হবে, যেমন নামায ইচ্ছাকৃতভাবে ছেড়ে দিলে হয়। একেই বলা হয় মা-বাবার নাফরমানি।
বুযুর্গানে দীন বলেছেন, মা-বাবার অবাধ্যতার শাস্তি অত্যন্ত ভয়াবহ। এমনকি এর কারণে মৃত্যুর সময় কালিমা নসিব না-ও হতে পারে।
আল্লাহ আমাদের এই গুনাহ থেকে হেফাজত করুন।
উপদেশমূলক কাহিনী
ঘটনাটি বলেছেন শাইখুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী দা. বা.। এক ব্যক্তি মৃত্যুশয্যায় শায়িত ছিলেন। উপস্থিত লোকজন বারবার চেষ্টা করছিলেন যেন তিনি কালিমা পাঠ করেন, কিন্তু তার মুখ থেকে কালিমার শব্দ বের হচ্ছিল না। সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন, কীভাবে তাকে কালিমা পড়ানো যায়!
অবশেষে তারা এক বুজুর্গের কাছে গিয়ে ঘটনা খুলে বললেন। বুজুর্গ পরামর্শ দিলেন, যদি তার মা-বাবা জীবিত থাকেন, তাহলে তাদের কাছে নিয়ে যাও এবং তাঁদের মাধ্যমে ক্ষমা ও দোয়া চাও। মনে হচ্ছে, সে জীবনে মা-বাবার অবাধ্যতা করেছে, যার ফলে আজ তার এ করুণ অবস্থা। যতক্ষণ পর্যন্ত তার মা-বাবা তাকে ক্ষমা না করবেন, ততক্ষণ হয়তো তার মুখে কালিমা আসবে না।
এ ঘটনা থেকে বোঝা যায়, মা-বাবার অবাধ্যতা করা ও তাঁদের হৃদয়ে আঘাত দেওয়া কত বড় অপরাধ! এটি এমন জঘন্য গুনাহ, যার শাস্তি দুনিয়াতেই মিলতে পারে।
জান্নাত লাভের সহজ পথ
মনে রাখবেন, মা-বাবা জীবিত থাকা সন্তানের জন্য আল্লাহর এক মহান নেয়ামত। যতদিন তাঁরা বেঁচে থাকবেন, ততদিন তাঁদের খেদমত করার মাধ্যমে জান্নাতের পথ সহজ হবে। হাদীসে আছে— যদি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার সাথে একবার মা-বাবার দিকে তাকাও, তবে এর বিনিময়ে এক হজ ও এক উমরাহর সওয়াব লাভ করবে। [বাইহাকী, শুআবুল ঈমান : ১০/২৬৫]
অন্য এক হাদীসে রাসুলুল্লাহ ﷺ তিন বার বলেছেন
رَغِمَ أَنْفُهُ، ثُمَّ رَغِمَ أَنْفُهُ، ثُمَّ رَغِمَ أَنْفُهُ
ধ্বংস হোক সেই ব্যক্তি, ধ্বংস হোক সেই ব্যক্তি, ধ্বংস হোক সেই ব্যক্তি!
সাহাবিগণ জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল ﷺ! কে সে ব্যক্তি?
তিনি বললেন
مَنْ أَدْرَكَ أَبَوَيْهِ عِنْدَ الْكِبَرِ، أَحَدَهُمَا أَوْ كِلَيْهِمَا، ثُمَّ لَمْ يَدْخُلِ الْجَنَّةَ
যে তার মা-বাবাকে বৃদ্ধ বয়সে পেল-তাদের একজনকে বা উভয়কে—তবুও জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না। [সহীহ মুসলিম : ২৫৫১]
এ থেকে বোঝা যায়, সন্তানের জন্য মা-বাবার খেদমত জান্নাতের অন্যতম সহজ মাধ্যম। তাঁদের সামান্য সেবাও আখেরাতকে নূরান্বিত করে দিতে পারে। তাই তাঁরা জীবিত থাকলে এই নেয়ামতের যথাযথ মূল্যায়ন করুন।
যখন তাঁরা দুনিয়া থেকে চলে যাবেন, তখন তাঁদের কদর বুঝতে পারবে, কিন্তু তখন আফসোস ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না।
জীবদ্দশায় যেটা ছিল সহজ, তাঁদের না থাকার পর সেটা হয়ে যাবে কঠিন। তাই এখনই সময়—তাঁদের ভালোবাসো, তাঁদের খেদমত করো, তাঁদের দোয়া লাভ করো।
মাতা-পিতার মৃত্যুর পর ক্ষতিপূরণের দুটি ব্যবস্থা
অনেকেই মা-বাবার মৃত্যুর পর আক্ষেপ করে বলেন, হায়! কত বড় নেয়ামত আমরা হারিয়ে ফেললাম! তাঁদের যথাযথ কদর করতে পারলাম না।
যারা এ ধরনের অনুভূতির মধ্যে আছেন, আল্লাহ তাআলা তাঁদের জন্য একটি সুযোগ রেখেছেন ক্ষতিপূরণের।
ইসলামে এমন কিছু ব্যবস্থা আছে, যার মাধ্যমে মা-বাবার প্রতি যথাযথ কর্তব্য পালন না করা হলেও কিছুটা ক্ষতিপূরণ করা যায়। এর দুটি প্রধান পথ—
১. ইসালে সওয়াব : মাতা-পিতার জন্য নিয়মিত ইসালে সওয়াব করা একটি উত্তম পন্থা। আপনি তাঁদের জন্য দান-খয়রাত করতে পারেন, নফল নামায পড়তে পারেন, অথবা অন্য কোনো নেক আমল করে তাদের উদ্দেশ্যে সওয়াব পাঠাতে পারেন। এতে পূর্বে করা অবহেলা বা ভুলের ক্ষতি কিছুটা হলেও পূর্ণ হবে।
২. আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদাচরণ: মাতা-পিতার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং অন্যান্য আপনজনদের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা ও সদাচরণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমনটি মা-বাবার সাথে সদাচরণ করা উচিত ছিল, তেমনভাবেই তাদের আত্মীয়দের সাথে সদাচরণ করলে আল্লাহ তাআলা আপনার পূর্বের ভুলের ক্ষতিপূরণ করবেন।
এই দুটি উপায়ে আপনি আপনার দুঃখ বা আফসোসের ক্ষতিপূরণ করতে পারবেন এবং আল্লাহ তাআলা আপনার পরবর্তী আমলগুলো কবুল করবেন।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আমল করার তাওফিক দান করুন— আমীন।
وَاخِرُ دَعْوَانَا أَنِ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
--ইসলাহী বয়ান অবলম্বনে
মুসলিম বাংলা