তাদাব্বুরে কুরআন : গুরুত্ব ও ফায়েদা

[করাচির জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া বানুরী টাউন-এর উস্তায মাওলানা ইয়াসির আবদুল্লাহ ছাহেব মারকাযুদ দাওয়াহ যিয়ারতে আসেন। তিনি কিছুদিন মারকাযে অবস্থান করছেন।
মেহমান আলকাউসারকে মহব্বত করেন। আলকাউসার পত্রিকা উর্দূ ভাষায় অনুবাদ করে পড়েন। ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তিনি আলকাউসারের সম্পাদকীয় বিভাগ পরিদর্শনে আসেন। আলকাউসারে প্রকাশিত আমীনুত তালীম ছাহেব দা. বা.-এর বিভিন্ন প্রবন্ধ-নিবন্ধ সম্পর্কে খোঁজ নেন এবং লিংক সংগ্রহ করেন। আলকাউসারের সাপ্লিমেন্টগুলোও উল্টেপাল্টে দেখেন। কয়েক কপি নিজের সাথে নেন। নানান আলাপচারিতার মাঝে দুদেশের ইসলামী পত্রিকার নানান খুঁটিনাটি বিষয়েও আলাপ হয়।
আমীনুত তালীম ছাহেবের ইশারায় রমযান সংখ্যার জন্য তিনি তাদাব্বুরে কুরআনের ওপর বক্ষমাণ প্রবন্ধটি লেখেন। উর্দূ ভাষায় লেখা প্রবন্ধটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন, মাওলানা ওয়ালিউল্লাহ আব্দুল জলীল।]
কুরআন কারীম আল্লাহ তাআলার কালাম। যার সম্পর্ক সরাসরি আল্লাহ তাআলার সাথে। শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর নাযিলকৃত সর্বশেষ এ রাব্বানী পয়গামের যেসব হক আমাদের ওপর রয়েছে, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হক হল, হেদায়েতপূর্ণ এই কিতাবে গভীর মনোযোগ ও তাদাব্বুরের মাধ্যমে জীবনের পথ খুঁজে নেওয়া।
খোদ কুরআন কারীমেরই বিভিন্ন স্থানে এ ব্যাপারে উৎসাহ ও তাগিদ দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে–
اَفَلَا یَتَدَبَّرُوْنَ الْقُرْاٰنَ اَمْ عَلٰی قُلُوْبٍ اَقْفَالُهَا.
তারা কি কুরআন সম্পর্কে চিন্তা করে না, নাকি অন্তরে লেগে আছে তার (সংশ্লিষ্ট) তালা? –সূরা মুহাম্মাদ (৪৭) : ২৪
اَفَلَا یَتَدَبَّرُوْنَ الْقُرْاٰنَ وَ لَوْ كَانَ مِنْ عِنْدِ غَیْرِ اللهِ لَوَجَدُوْا فِیْهِ اخْتِلَافًا كَثِیْرًا.
তারা কি কুরআন সম্বন্ধে চিন্তা করে না? এটা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো পক্ষ থেকে হলে এর মধ্য বহু অসঙ্গতি পেত। –সূরা নিসা (০৪) : ৮২
كِتٰبٌ اَنْزَلْنٰهُ اِلَیْكَ مُبٰرَكٌ لِّیَدَّبَّرُوْۤا اٰیٰتِهٖ وَ لِیَتَذَكَّرَ اُولُوا الْاَلْبَابِ.
(হে রাসূল!) এটি এক বরকতময় কিতাব, যা আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতের মধ্যে চিন্তা করে এবং বোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ উপদেশ গ্রহণ করে। –সূরা ছদ (৩৮) : ২৯
সেসব মুমিনের প্রশংসা করা হয়েছে, যারা বুঝেশুনে কুরআনের উপদেশ ও হেদায়েত গ্রহণ করে। আল্লাহ তাআলা বলেন–
وَ الَّذِیْنَ اِذَا ذُكِّرُوْا بِاٰیٰتِ رَبِّهِمْ لَمْ یَخِرُّوْا عَلَیْهَا صُمًّا وَّ عُمْیَانًا.
এবং যখন তাদের প্রতিপালকের আয়াত দ্বারা তাদেরকে উপদেশ দেওয়া হয়, তখন তারা বধির ও অন্ধরূপে তার ওপর পতিত হয় না। –সূরা ফুরকান (২৫) : ৭৩
সালাফের বাণী
এক. ইবনে সিনান সুলামী একবার আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-কে বললেন, আমি আজ রাতে এক রাকাতে মুফাসসাল তিলাওয়াত করেছি। একথা শুনে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বললেন–
هَذًّا مِثْلَ هَذِّ الشِّعْرِ، أَوْ نَثْرًا مِثْلَ نَثْرِ الدَّقَلِ؟ إِنَّمَا فُصِّلَ لِتُفَصِّلُوا.
কবিতা আওড়ানোর মতো আওড়িয়েছ? বা কাঁদি থেকে পাকা খেজুর (টপটপ করে) পড়ার মতো দ্রুত পড়েছ? (কুরআনের) মুফাসসাল অংশ তো এজন্যই ছোট ছোট অংশে নাযিল হয়েছে, যাতে তোমরা ধীরে-সুস্থে থেমে থেমে তারতীলের সঙ্গে তিলাওয়াত কর। (অবশ্য পুরো কুরআন কারীমই এই আদবের দাবি রাখে।) –মুসনাদে আহমাদ, বর্ণনা ৩৯৫৮; শরহু মাআনিল আছার, বর্ণনা ২০৩৩
দুই. হাসান ইবনে আলী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন–
إِنَّ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ رَأَوُا الْقُرْآنَ رَسَائِلَ مِنْ رَبِّهِمْ، فَكَانُوا يَتَدَبَّرُونَهَا بِاللَّيْلِ، وَيَتَفَقَّدُونَهَا بِالنَّهَارِ.
তোমাদের পূর্ববর্তীরা কুরআনকে আপন রবের বার্তা জ্ঞান করতেন। রাতে তারা চিন্তা ও মনোযোগসহ তা পাঠ করতেন। এবং দিনে নিজেদের জীবনযাত্রায় ওই বিষয়গুলোর খেয়াল রাখতেন –আততিবয়ান ফী আদাবি হামালাতিল কুরআন, অধ্যায় ৫, পৃ. ৫৪
তিন. প্রসিদ্ধ তাবেয়ী হাসান বসরী রাহ. বলেন–
نَزَلَ الْقُرْآنُ لِيَتَدَبَّرُوا وَيَعْمَلُوا بِه، فَاتَّخِذُوا تِلَاوَتَه عَمَلًا.
কুরআন কারীম নাযিল করা হয়েছে, যেন তোমরা তাদাব্বুর ও চিন্তা-ভাবনা কর এবং এর ওপর আমল কর; সুতরাং আমলের উদ্দেশ্যে তিলাওয়াত করতে থাক। –মাদারিজুস সালিকীন, ইবনুল কায়্যিম ১/৪৫২
চার. তাদাব্বুরে কুরআনের গুরুত্ব ও ফায়েদার ব্যাপারে ইবনুল কায়্যিম রাহ. লিখেছেন, দুনিয়া ও আখেরাতে বান্দার জন্য সবচেয়ে কল্যাণকর এবং মুক্তি পাওয়ার সবচেয়ে বেশি নিকটবর্তী করে– দীর্ঘ সময় কুরআন কারীমের তাদাব্বুর ও একেকটি আয়াতের অর্থে গভীর মনোযোগসহ চিন্তা করা। এর চেয়ে কার্যকরী আর কিছু নেই। কারণ কুরআন মানুষকে–
১. কল্যাণ-অকল্যাণ সম্পর্কে সবিস্তারে ধারণা দেয়।
২. কল্যাণ-অকল্যাণের পথ দেখায়, এর কারণ ও ফলাফলসহ উভয়ের পরিণতি সম্পর্কে বাতলে দেয়।
৩. সৌভাগ্যের চাবিকাঠি ও উপকারী জ্ঞানের দিশা দেয়।
৪. ঈমানের ভিত্তিমূলকে তার অন্তরে প্রোথিত করে দেয়।
৫. তাকে দুনিয়া-আখেরাতের বাস্তবতা দেখিয়ে অন্তরে জান্নাত-জাহান্নামের ভাবনা গেঁথে দেয়।
৬. বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর ইতিহাস সম্পর্কে অবগত করে এবং শিক্ষণীয় বিষয় সম্পর্কে বলে।
৭. আল্লাহর অনুগ্রহ ও ইনসাফ সম্পর্কে বলে।
৮. আল্লাহ তাআলার সত্তা, নাম ও গুণাবলি এবং কর্মপন্থা, তাঁর পছন্দ-অপছন্দ, তাঁর পর্যন্ত পৌঁছার পথের দিশা দেয়। (দ্র. মাদারিজুস সালিকীন ১/৪৫৩)
চিন্তা-ফিকির করে কুরআন তিলাওয়াতের দ্বারা অন্তরের ব্যাধি দূর হয়। যাহের ও বাতেন সংশোধনের ওসিলা হয়।
পাঁচ. তাবেয়ী ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. বলেন, পাঁচটি বিষয় দিলের ঔষধ–
ক. তাদাব্বুরের সাথে কুরআন তিলাওয়াত করা।
খ. কম খাওয়া।
গ. রাতে ইবাদত করা।
ঘ. শেষ রাতে রোনাজারি করা।
ঙ. নেককারদের সোহবত গ্রহণ করা। –হিলইয়াতুল আউলিয়া ১০/৩২৬
ছয়. মালেক ইবনে দীনার রাহ. বলতেন–
يَا حَمَلَةَ الْقُرْآنِ! مَاذَا زَرَعَ الْقُرْآنُ فِي قُلُوبِكُمْ؟ فَإِنَّ الْقُرْآنَ رَبِيعُ الْمُؤْمِنِينَ، كَمَا أَنَّ الْغَيْثَ رَبِيعُ الْأَرْضِ، فَقَدْ يَنْزِلُ الْغَيْثُ مِنَ السَّمَاءِ فَيُصِيبُ الْحُشَّ فِيهِ الْحَبَّةُ، وَلَا يَمْنَعُه نَتْنُ مَوْضِعِهَا أَنْ تَهْتَزَّ وتَخْضَرَّ وتَحْسُنَ فِيهِ، حَمَلَةُ الْقُرْآنِ مَاذَا زَرَعَ الْقُرْآنُ فِي قُلُوبِكُمْ؟ أَيْنَ أَصْحَابُ سُورَةٍ؟ أَيْنَ أَصْحَابُ سُورَتَيْنِ؟ مَاذَا عَمِلْتُمْ فِيهَا.
হে কুরআনের বাহকগণ! কুরআন তোমাদের অন্তরে কী বপন করেছে? নিশ্চয়ই কুরআন মুমিনের বসন্ত, যেমন বৃষ্টি জমিনের জন্য বসন্তের ওসিলা হয়। আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হলে তা এমন এক স্থানে পড়ে, যেখানে কিছু বীজ থাকে। স্থানটি দুর্গন্ধযুক্ত হলেও, তা বীজকে অঙ্কুরিত হওয়া, সতেজ হওয়া এবং সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠা থেকে বিরত রাখতে পারে না।
হে কুরআনের বাহকগণ! কুরআন তোমাদের অন্তরে কী বপন করেছে? কোথায় সেই ব্যক্তি, যে এক সূরার অধিকারী? কোথায় সেই ব্যক্তি, যে দুই সূরার অধিকারী? তোমরা এ অনুযায়ী কী আমল করেছ? –আযযুহ্দ, আহমাদ, বর্ণনা ১৮৬১
পূর্বসূরিগণের অনেক বাণী ও প্রবচনের মধ্য থেকে কিছু উল্লেখ করা হল। সর্বযুগের বুযুর্গদের কিতাবেই এমন বহু বাণী রয়েছে। মূল বিষয় হল, মানুষ কুরআনের সাথে নিজের সম্পর্ক মজবুত করবে, তিলাওয়াত করবে, চিন্তা-ভাবনা সহকারে কুরআনের বিষয়বস্তুর প্রতি খেয়াল রাখবে এবং কুরআনী শিক্ষা অনুযায়ী আমল করবে, তাহলে সত্যের পথে অটল-অবিচল থাকতে পারবে। গোমরাহী থেকে বাঁচতে পারবে। শয়তানের আক্রমণ প্রতিহত করতে পারবে।
যে ব্যক্তি কুরআন থেকে দূরে সরে যায় এবং মুখ ফিরিয়ে নেয়, সে পথভ্রষ্টতার চোরাবালিতে আটকে যায়। শয়তানের খেলনায় পরিণত হয়। আর শয়তান তাকে ধ্বংস ও অপমানের দিকে নিয়ে যায়। ফলে এ ধরনের মানুষ দুনিয়ার জীবনে পেরেশানি এবং আখেরাতে বঞ্চনার শিকার হয়।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন–
وَ مَنْ اَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِیْ فَاِنَّ لَهٗ مَعِیْشَةً ضَنْكًا وَّ نَحْشُرُهٗ یَوْمَ الْقِیٰمَةِ اَعْمٰی.
যে আমার উপদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবন হবে বড় সংকটময়। আর কিয়ামতের দিন আমি তাকে অন্ধ করে উঠাব। –সূরা ত্ব-হা (২০) : ১২৪
অন্যত্র বলেন–
وَ مَنْ یَّعْشُ عَنْ ذِكْرِ الرَّحْمٰنِ نُقَیِّضْ لَهٗ شَیْطٰنًا فَهُوَ لَهٗ قَرِیْنٌ، وَ اِنَّهُمْ لَیَصُدُّوْنَهُمْ عَنِ السَّبِیْلِ وَ یَحْسَبُوْنَ اَنَّهُمْ مُّهْتَدُوْنَ.
যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর যিকির থেকে অন্ধ হয়ে যাবে, তার জন্য নিয়োজিত করি এক শয়তান, যে তার সঙ্গী হয়ে যায়। তারা (শয়তান) তাদেরকে সৎপথ থেকে বিরত রাখে আর তারা মনে করে– আমরা সঠিক পথেই আছি। –সূরা যুখরুফ (৪৩) : ৩৬
কুরআন উপলব্ধি এবং উম্মতের পূর্বসূরিগণ
বিভিন্ন কিতাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম এবং পূর্বসূরিগণের এমন বহু ঘটনা রয়েছে, যা থেকে পাথেয় লাভ করা যায় এবং জযবা ও উদ্দীপনা বাড়ে।
১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার সারা রাত একটি আয়াত তিলাওয়াত ও তাদাব্বুর করে কাটিয়ে দিয়েছিলেন। সে আয়াতটি হল–
اِنْ تُعَذِّبْهُمْ فَاِنَّهُمْ عِبَادُكَ وَ اِنْ تَغْفِرْ لَهُمْ فَاِنَّكَ اَنْتَ الْعَزِیْزُ الْحَكِیْمُ.
আপনি তাদেরকে শাস্তি দিলে তারা তো আপনারই বান্দা আর তাদেরকে ক্ষমা করে দিলে নিশ্চয়ই আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। [সূরা মায়েদা (০৫) : ১১৮] –সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৩৫০
এই ঘটনায় উম্মতের প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরদের পাশাপাশি তাদাব্বুরে কুরআনের একটি আলোকিত দিক উঠে আসে।
রাতভর একই আয়াত তিলাওয়াত ও ফিকির করা অবস্থায় কেটেছে, রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং এই উম্মতের নেককার পূর্বসূরিদের এমন বহু ঘটনা রয়েছে।
২. উসমান ইবনে আফফান রা. বলতেন–
لَوْ طُهُرَتْ قُلُوبُكُمْ مَا شَبِعْتُمْ مِنْ كَلَامِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ.
যদি তোমাদের অন্তর নিষ্কলুষ হত, তোমরা আল্লাহর কালাম তিলাওয়াত করে পরিতৃপ্ত হতে পারতে না। –আযযুহ্দ, আহমাদ, পৃ. ১৬৮, বর্ণনা ৬৮০
৩. হাসান বসরী রাহ. একবার সারা রাত এই আয়াত পড়ে কাটিয়ে দিয়েছিলেন–
وَ اِنْ تَعُدُّوْا نِعْمَةَ اللهِ لَا تُحْصُوْهَا .
যদি আল্লাহর নিআমত গণনা কর, শেষ করতে পারবে না। –সূরা নাহ্ল (১৬) : ১৮
এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন–
إِنَّ فِيهَا مُعْتَبَرًا، مَا نَرْفَعُ طَرَفًا وَلَا نَرُدُّه إِلَّا وَقَعَ عَلَى نِعْمَةٍ، وَمَا لَا نَعْلَمُه مِنْ نِعَمِ اللهِ أَكْثَرُ.
এই আয়াতে অনেক বড় শিক্ষা ও উপদেশ রয়েছে। আমরা চোখ মেললেই তো অনেক অনেক নিআমত দেখতে পাই। আর যা দেখি না এর সংখ্যাও তো অনেক বেশি। –মুখতাসারু কিয়ামিল লাইল, মারওয়াযী, পৃ. ১৪৮
৪. ফযলুর রহমান গঞ্জেমুরাদাবাদী রাহ. একদিন তিলাওয়াত করছিলেন। তাঁর মধ্যে বিশেষ অবস্থা পরিলক্ষিত হলে মৌলভী সায়্যিদ তাজাম্মুল হুসাইন রাহ. বলেন, যে স্বাদ আমি কুরআনে পাই, তুমি তা পেলে আমার মতো বসে থাকতে পারতে না। জঙ্গলে বের হয়ে যেতে।
মৌলভী সায়্যিদ মুহাম্মাদ আলী সাহেব বলেন, শুরুর দিকে আমি হযরতকে আরজ করেছিলাম, কবিতার মধ্যে আমি যে মজা পাই, তা কুরআন কারীমে পাই না!
তিনি বলেছিলেন, এখনো (কুরআনের সাথে, আল্লাহর সাথে) দূরত্ব রয়েছে। নৈকট্য অর্জন করতে পারলে কুরআনে যে স্বাদ পাবে, তা অন্য কোথাও পাবে না।
একদিন তিনি বলেছিলেন, নিসবতে কুরআন হল, সুলুকের সর্বোচ্চ পর্যায় অর্থাৎ আত্মশুদ্ধির সর্বোচ্চ স্তর। অর্থাৎ তাযকিয়া ও সুলূকের চূড়ান্ত মাকসাদ কুরআন কারীমের নিসবত হাসিল হওয়া। –তাযকিরায়ে মাওলানা ফযলুর রহমান গঞ্জেমুরাদাবাদী রাহ., সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ., পৃ. ৫৬
৫. মাওলানা মুহাম্মাদ মানযূর নুমানী রাহ. বলেন, মাওলানা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী রাহ. একবার বলেছিলেন, আমি রমযানে কুরআন শুরু করি। এরপর তাদাব্বুর ও তাফাক্কুরের সাথে পুরো শেষ করতে চাই, কিন্তু কখনোই শেষ হয় না। যখন দেখি, আজ রমযান শেষ হতে যাচ্ছে, তখন নিজের বিশেষ পদ্ধতি বাদ দিয়ে যা বাকি থাকে, তা ওই দিনই শেষ করে ফেলি এবং খতম পুরো করে ফেলি। –তাসবীরে আনওয়ার, পৃ. ৩১৪
কাশ্মীরী রাহ.-এর কাছে কেউ জিজ্ঞেস করেছিল, আপনার স্মরণশক্তি তো অনেক প্রখর, কয়েকদিনের মধ্যেই তো হিফয করে ফেলতে পারেন; তা সত্ত্বেও করেন না কেন?
উত্তরে তিনি বলেছিলেন, শৈশবে বাবা-মা ওদিকে খেয়াল করেননি। এখন এটি সম্ভব নয়। কারণ যে আয়াতই পাঠ করি, কুরআনের উলূম ও মাআরিফের তুফান আমায় ঘিরে ধরে। শব্দ মাথা থেকে বের হয়ে যায় আর অর্থ ও মর্মের উপত্যকায় হারিয়ে যাই। –তাসবীরে আনওয়ার, পৃ. ২৭-২৮
কিছু করণীয় ও বর্জনীয়
কুরআন কারীম থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য কিছু বিষয় আছে করণীয়, কিছু বিষয় আছে বর্জনীয়। কুরআন কারীমের সম্মান ও আদব, তাকওয়া ও তাহারাত, ইখলাস, দুআ, রাতের নামায, আন্তরিক চাওয়া, অনুসরণের জযবা, আল্লাহর ভয়, গায়েবের প্রতি ঈমান, গভীর চিন্তা-ভাবনা, নফসের মুজাহাদা ইত্যাদি আমল তাদাব্বুরে কুরআনের ক্ষেত্রে সহায়ক ও করণীয়।
তেমনি বেয়াদবি ও অসম্মান, বক্রতা ও কুসংস্কারে বিশ্বাসী হওয়া, অহংকার, দম্ভ, কুরআন বুঝতে অবহেলা, গুনাহ, দলীল-প্রমাণ ছাড়াই তর্কবিতর্ক করা, পরকাল অস্বীকার ও দুনিয়ামুখিতা ইত্যাদি তাদাব্বুরে কুরআনের ক্ষেত্রে বড় বাধা।
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য আলেম-তালিবুল ইলম নিম্নোক্ত কিতাব দেখতে পারেন। নিম্নে এ সংক্রান্ত কিছু উপকারী কিতাবের তালিকা দেওয়া হল–
১. التبيان في آداب حملة القرآن، للإمام النووي رحمه الله
২. الفوائد المشوق الى علوم القرآن، لابن قيم الجوزية رحمه الله
৩. بدائع الفوائد، لابن قيم الجوزية رحمه الله
৪. مطالعۂقرآن کی اصول و مبادی از مولانا ابو الحسن علی ندوی رح
৫. قرآن کے مطالعہ کیسے؟ از مولانا اویس نگرامی ندوی رح
রমযান ও কুরআন
রমযান ও কুরআনের মাঝে রয়েছে গভীর সম্পর্ক। এটি কুরআন নাযিলের মাস। এই মাসের দিকেই কুরআনকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এজন্য এই মাসে বেশি বেশি তিলাওয়াত করা, তারাবীর নামাযে কুরআন শোনা ও শোনানো, কুরআনের মজলিসে অংশ নেওয়া এবং উলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে তাফসীর অধ্যয়ন করা। সেইসাথে কুরআনের বিষয়বস্তুর ওপর চিন্তা-ভাবনার চেষ্টা করা।
আল্লাহ তাআলা আমাদের কুরআন কারীমের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক নসীব করুন। কুরআনের শিক্ষা অনুযায়ী আমল করার তাওফীক দান করুন– আমীন।
আলকাউসার