পবিত্র কুরআনের আলোকে নজর হেফাজতের কিছু পন্থা
পবিত্র কুরআনের আলোকে কুদৃষ্টি থেকে বাঁচার সাতটি পন্থা উল্লেখ করা হলো:
১. আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:
قُلۡ لِّلۡمُؤۡمِنِیۡنَ یَغُضُّوۡا مِنۡ اَبۡصَارِہِمۡ
মুমিন পুরুষদের বলে দিন তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি নিচু রাখে। (সূরা আন নুর - ২৪:৩০)
কুদৃষ্টি থেকে মুক্তির সর্বোত্তম ওষুধ হচ্ছে দৃষ্টি নিচু রাখা। সুতরাং আধ্যাত্মিক পথের পথিকদের উচিত রাস্তাঘাটে, বাজারে চলার সময় স্বীয় দৃষ্টি নিচু রাখার অভ্যাস গড়বে। পায়ে হেঁটে চলার সময় শুধু পথের দিকে দেখবে। বাহনে আরোহণ অবস্থায় দৃষ্টি এই পরিমাণ উঠাবে যাতে অন্যান্য বাহন ও পথিকদের অতিক্রমণ সম্পর্কে অবগত হতে পারে। কারও চেহারার দিকে দেখবে না। কেননা ফিতনার সূচনা এখান থেকেই হয়। যদি ভুলে দৃষ্টি পড়ে যায় তাহলে ইস্তেগফার পড়বে এবং পুনরায় দৃষ্টি নিচু করে নেবে। এতে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকবে, যাতে তা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যায়। যদি অফিসিয়াল কোনো কাজ বা কেনাকাটার সময় কোনো নারীর সাথে কথা বলার প্রয়োজন পড়ে তাহলে তার চেহারার দিকে দৃষ্টি দেবে না। যেমন পরস্পরের প্রতি অসন্তুষ্ট দুই ব্যক্তি কোনো অপারগতার কারণে কথা বললেও কেউ কারও মুখের দিকে তাকায় না, চোখে চোখ রেখে কথা বলে না। অনুরূপভাবে স্মরণ রাখতে হবে যে, পরনারীর প্রতি আল্লাহ তাআলার জন্য আমি অসন্তুষ্ট। সুতরাং তার চেহারা দেখা যাবে না।
২. আল্লাহ তাআলা বলেন:
فَانۡکِحُوۡا مَا طَابَ لَکُمۡ مِّنَ النِّسَآءِ
'নারীদের থেকে যাকে তোমাদের ভালো লাগে বিয়ে করে নাও। (সূরা আন নিসা - ৪:৩)
যত দ্রুত সম্ভব হয় দ্বীনদার, বাধ্যগত, সুন্দরী কোনো মেয়ে বিয়ে করে নেবে। যাতে জৈবিক প্রয়োজন পূরণ করা যায়। কোনো ক্ষুধার্ত ব্যক্তি যদি তার ক্ষুধা নিবারণের জন্য মনে করে দুই রাকাত নফল নামায পড়ে নিই, ক্ষুধা মিটে যাবে, তাহলে তার নিজের চিকিৎসা করানো উচিত। ক্ষুধার ওষুধ হলো আহার করবে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষুধা নিবারণের দুআ করবে।
অনুরূপ দৃষ্টি পবিত্র রাখার ওষুধ হলো বিয়ে করে নেবে এবং আল্লাহ তাআলার নিকট পবিত্র দৃষ্টি লাভের দুআ করবে। যখন সুযোগ হয় নিজ স্ত্রীকে মহব্বতের দৃষ্টিতে দেখবে। আর আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করবে যে, যদি এই নেয়ামত না পেতাম তাহলে কতই-না মুশকিল হয়ে যেত। যে লোলুপ দৃষ্টি অলিগলিতে, বাজারে বেপর্দা ঘুরে বেড়ানো নারীদের দিকে দিত, তা নিজ স্ত্রীর দিকে দেবে। স্ত্রীকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার তাগিদ দেবে, ভালো কাপড়- চোপড় কিনে দেবে।
পরনারীর কাছে যা আছে তা সবই স্ত্রীর কাছেও আছে। মনে মনে ভাববে, আমি যদি পরনারীকে দেখি তাহলে আল্লাহ তাআলা অসন্তুষ্ট হবেন। আর যদি নিজ স্ত্রীকে দেখি তাহলে আল্লাহ তাআলা সন্তুষ্ট হবেন। যা হালাল তা প্রাণভরে দেখে নেবে, যাতে হারামকে দেখার আগ্রহই না জাগে। যখনই চোখ পরনারীকে দেখার ইচ্ছা করবে তখনই কল্পনায় নিজ স্ত্রীর চেহারা ভাবতে থাকবে। (ইনশাআল্লাহ) গুনাহের খেয়াল দূর হয়ে যাবে।
৩. আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:
اِنَّ الَّذِیۡنَ اتَّقَوۡا اِذَا مَسَّہُمۡ طٰٓئِفٌ مِّنَ الشَّیۡطٰنِ تَذَکَّرُوۡا فَاِذَا ہُمۡ مُّبۡصِرُوۡنَ
'নিশ্চয়ই যারা আল্লাহকে ভয় করে, শয়তানের কোনো দল যখন তাদের ঘিরে ধরে, তারা আল্লাহকে স্মরণ করে। সুতরাং তাদের অনুভূতি চলে আসে। (সূরা আল আ'রাফ - ৭:২০১)
এই বরকতপূর্ণ আয়াত থেকে এই রহস্য উদ্ঘাটিত হয় যে, যখনই শয়তান মানুষের ওপর হানা দেয় বা অন্তরে গুনাহের কুমন্ত্রণা ঢেলে দেয়, মানুষ যেন আল্লাহ তাআলার যিকিরের মাধ্যমে তা প্রতিহত করে। সুতরাং বাজার দিয়ে অতিক্রমের সময় যিকিরের প্রতি গুরুত্ব দেয়া উচিত। সম্ভব হলে হাতে তাসবীহ রাখবে। অন্যথায় মনে মনে তো যিকির করতেই থাকবে। উদাসীনতা গুনাহের ভূমিকা। যিকিরের দ্বারা উদাসীনতাকে দূর করবে। যিকিরের নূর ধীরে ধীরে অন্তরে এমন প্রশান্তি আনয়ন করবে যে, অন্যের দিকে দৃষ্টি দিতে ইচ্ছে করবে না।
دو عالم سے کرتی ہے بیگانہ دل کو
عجب چیز ہے لذت آشنائی
'দোজাহান থেকে অপিরিচিত করে অন্তর
বন্ধুত্বের স্বাদ বড় আশ্চর্যকর।'
৪. আল্লাহ তাআলা বলেন:
أَلَمْ يَعْلَمُ بِأَنَّ اللَّهَ يَرَى
'সে কি জানে না আল্লাহ তাআলা দেখছেন? (সূরা আল আলাক - ৯৬:১৪)
আধ্যাত্মিক সাধনাকারীর মন যখনই পরনারীর দিকে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করবে তৎক্ষণাৎ সে ভাবতে থাকবে, আল্লাহ তাআলা আমাকে দেখছেন। দৃষ্টি সংযত রাখা সহজ হয়ে যাবে। বিষয়টি এই দৃষ্টান্ত থেকে বুঝে নাও, যদি ওই নারীর বাবা অথবা স্বামী আমাদেরকে দেখতে থাকে তাহলে এমতাবস্থায় আমরা কি ওই নারীর দিকে তাকিয়ে থাকতে পারব? আমাদের অস্বস্তিবোধ হবে। মনে হবে এই নারীর বাবা বা স্বামী আমাদের ওপর মারাত্মক রেগে যাবে। এমনইভাবে এরূপ ভাবা চাই যে, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দেখছেন এবং পরনারীর প্রতি দৃষ্টি দিতে আমাদেরকে নিষেধও করেছেন। এতৎসত্ত্বেও যদি আমরা দেখতে থাকি তাহলে নিশ্চিত আল্লাহ তাআলার রাগ আসবে। আর যদি আমাদের পাকড়াও করেই ফেলেন তাহলে আমাদের কী অবস্থা হবে?
৫. আল্লাহ তাআলার বাণী:
وَالَّذِیۡنَ جَاہَدُوۡا فِیۡنَا لَنَہۡدِیَنَّہُمۡ سُبُلَنَا
'যারা আমার রাস্তায় পরিশ্রম করে আমি অতি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথসমূহের দিশা দান করি। (সূরা আল আনকাবুত - ২৯:৬৯)
মুফাসসিরীনে কেরাম লিখেছেন, শরীয়ত অনুযায়ী আমল করার ক্ষেত্রে প্রবৃত্তিবিরোধী কাজ করাকে মুজাহাদা বলে। এটা বাস্তব যে, মুজাহাদার দ্বারা মুশাহাদা তথা আল্লাহর সরাসরি সাক্ষাৎ লাভ হয়। এ কারণেই মন যখনই পরনারী দেখার প্রতি ধাবিত হবে, নিজের ইচ্ছাশক্তি দ্বারা তার বিরুদ্ধাচরণ করবে। এ কথা স্মরণ করবে যে, এই মুজাহাদার দরুন আমার প্রকৃত প্রেমাস্পদের দর্শন লাভ হবে। তা ছাড়া এই পরিশ্রম তো স্বল্প সময়ের। পক্ষান্তরে আল্লাহর দর্শন লাভের স্বাদ হবে চিরদিনের জন্য। মনে রাখবে, অনুশাসনের নূর দ্বারা অন্তর খুব দ্রুত পরিষ্কার হয়ে যায়। তাসবীহদানা এর সমকক্ষ হতে পারে না। হিম্মত ছেড়ে দেয়ার দ্বারা সমস্যা সমাধান হয় না; বরং হিম্মত করার দ্বারা সমাধান হয়। সুতরাং স্বীয় প্রবৃত্তির ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে এবং তাকে শরীয়তের লাগাম পরিয়ে দিতে হবে। যাতে করে কেয়ামতের দিন সৌভাগ্যের মালা পরিধান করা যায়।
৬. আল্লাহ তাআলার বাণী:
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَن تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَىٰ أَهْلِهَا
'আল্লাহ তাআলা তোমাদের আদেশ দিচ্ছেন তোমরা যেন আমানতসমূহ যাথাযথ হকদারদের নিকট পৌঁছে দাও। (সূরা আন নিসা - ৪:৫৮)
আধ্যাত্মিক পথিক নিজ মনে এ কথা গেঁথে নেবে যে, আমার চোখ আল্লাহ তাআলার দেয়া আমানত। আমাকে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী এই আমানত ব্যবহার করতে হবে। যদি তার বিপরীত করি, তাহলে আমানতের খেয়ানত হবে। নিয়ম হলো কেউ যখন একবার কোনো জিনিসে খেয়ানত করে ফেলে তার কাছে দ্বিতীয়বার অন্য কোনো জিনিস আমানত রাখা হয় না। এমন না হয়ে যায় যে, দুনিয়াতে আমি আল্লাহর দেয়া দৃষ্টিশক্তি পরনারী দেখায় ব্যবহার করে খেয়ানত করে ফেললাম। যার ফলে কেয়ামতের দিন আমাকে সেই দৃষ্টিশক্তি পুনরায় আর দেয়াই হলো না। যদি সেদিন অন্ধ করে উঠানো হয় তাহলে আমার কী অবস্থা হবে?
কুরআন মাজীদে বর্ণিত হয়েছে, কেয়ামতেন দিন কিছু মানুষকে অন্ধ করে উঠানো হবে। তখন তারা প্রশ্ন করবে:
قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرۡتَنِیۡۤ اَعۡمٰی وَقَدۡ کُنۡتُ بَصِیۡرًا
'হে আমার রব, আমাকে অন্ধ করে কেন উঠানো হলো? অথচ আমি তো দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন ছিলাম।' (সূরা ত্বা-হা - ২০:১২৫)
এটিও চিন্তার বিষয় যে, আমরা এমন সময় দুনিয়াতে এসেছি যখন আল্লাহ তাআলার প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দর্শন আমাদের ভাগ্যে জুটেনি। যদি কেয়ামতের দিনও অন্ধ করে উঠানো হয় তাহলে সেদিনও আমরা আল্লাহর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখতে পারব না। দ্বিতীয় সুযোগেও এরূপ বঞ্চিত হওয়া থেকে আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন। সুতরাং দৃষ্টির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা খুবই জরুরি বিষয়। যাতে কেয়ামতের দিন দৃষ্টির এই আমানত পুনরায় নসীব হয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
إِنَّ اللَّهَ تَعَالَى جَمِيلٌ
'নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা সুন্দর।' (মিশকাতুল মাসাবীহ - হাদিস নং: ৫১০৮)
এ বিষয়টি মাথায় রেখে চিন্তা করো, যদি আমি দুনিয়ার সুন্দরীদের কুনজরে দেখি, তাহলে কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা স্বীয় রূপ ও সৌন্দর্য দেখা থেকে আমাকে বঞ্চিত করে দেবেন।
৭. আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:
اَلَمۡ یَاۡنِ لِلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَنۡ تَخۡشَعَ قُلُوۡبُہُمۡ لِذِکۡرِ اللّٰہِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الۡحَقِّ
'যারা ঈমান এনেছে, তাদের জন্য কি এখনো সেই সময় আসেনি যে, আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাতে তাদের অন্তর বিগলিত হবে?' (সূরা আল হাদীদ - ৫৭:১৬)
আধ্যাত্মিক পথের পথিকের প্রবৃত্তি যখনই কুদৃষ্টির গুনাহে লিপ্ত হতে চাইবে, তৎক্ষণাৎ মনে মনে এই আয়াতের শিক্ষা নিয়ে চিন্তা করবে। মুমিনদের জন্য কি এখনো সময় হয়নি যে, তাদের অন্তর আল্লাহকে ভয় করবে। যতবারই চোখ তুলে দেখার ইচ্ছা জাগবে ততবারই নিজেকে সম্বোধন করে বলবে, মুমিনদের কি এখনো আল্লাহকে ভয় করার সময় হয়নি? প্রতি পলকে এই বিষয়টি ভাবতে থাকবে আর আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে থাকবে। আল্লাহ তাআলা তার অন্তরে স্বীয় ভয় ঢেলে দেবেন এবং কুদৃষ্টি থেকে খাঁটি তাওবা নসীব হয়ে যাবে।
[এখন যৌবন যার - বই থেকে]
মুসলিম বাংলা