ইসলামী ব্যাংকিং-এ শরীআহ্ বোর্ড: কিছু কথা
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ দীন। মানব জীবনের সকল সংকটের ভারসাম্য ও টেকসই সমাধান তাতে বিদ্যমান। বর্তমানে আধুনিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগ ব্যাংকিং ব্যবস্থা। পৃথিবীর নানা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাংকিং ব্যবস্থার সাথে যুক্ত। এতে সন্দেহ নেই, বিদ্যমান ব্যাংকিং কাঠামো বস্তুত পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার গর্ভ থেকে সৃষ্ট। এক পক্ষ থেকে সঞ্চয় গ্রহণ করে অপর পক্ষের কাছে সেটি বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে কেবল মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করা, মূল ব্যবসায় সম্পৃক্ত না হওয়া আদতে ইসলামী আর্থিক নীতিমালার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ইসলামী অর্থনীতির দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বিদ্যমান ব্যাংকিংয়ের যে বাস্তবিক প্রয়োজন রয়েছে, সেগুলো বহুমাত্রিক প্রক্রিয়ায় সমাধান করার কথা বলে। শুধু একক পদ্ধতি তথা ব্যাংকিং প্রক্রিয়ায় সমাধান করার চিন্তু ইসলামী অর্থনীতিতে সমর্থিত নয়। এ আলোচনাটি মূলত 'ব্যাংকিং কাঠামোর ইসলামী করণের সঠিক পদ্ধতি' শিরোনামের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই শিরোনামে ইনশাআল্লাহ সামনে কোনো এক সুযোগে আলোচনা করা যাবে।
বর্তমানে প্রচলিত ব্যাংকিং কাঠামোকে ইসলামী ব্যবস্থায় রূপান্তরের একটি বিশেষ প্রক্রিয়া 'ইসলামী ব্যাংকিং' নামে সুপরিচিত। এই প্রক্রিয়ায় মূলত ব্যাংকিং কাঠামোর মধ্যে থেকেই যতদূর সম্ভব ইসলামীকরণের চেষ্টা করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে বা ম্যাক্রো লেভেলে ইসলাম ও ইসলামী অর্থনীতি যেখানে প্রতিষ্ঠিত নেই, সেখানে উক্ত প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। তবে এই প্রচেষ্টাই যে চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়-সেটিও মাথায় রাখতে হবে।
বিদ্যমান ইসলামী ব্যাংকিং কাঠামো ও প্রক্রিয়ার সঙ্গে প্রচলিত সাধারণ ব্যাংকিংয়ের মূল পার্থক্য -ব্যাংকিং নীতিমালা ও কার্যক্রমে শরীআহ পরিপালন নিশ্চিত করা। ইসলামী ব্যাংক এজন্যই 'ইসলামী' যে, ব্যাংকিং নীতিমালা ও অপারেশন শরীআহসম্মত পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়। সাধারণ ব্যাংকিং ইসলামী নয়, কারণ তার নীতিমালা ও অপারেশনে শরীআহ অনুসৃত হয় না।
একটি ইসলামী ব্যাংকে শরীআহ্ পরিপালন নিশ্চিত করার জন্য পৃথিবীর নানা মুসলিম দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগে 'শরীআহ গভর্নেন্স ফ্রেমওয়ার্ক' (শরীআহ অনুশাসন কাঠামো নীতিমালা) প্রণয়ন করা হয়। ইসলামী ব্যাংকিংয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শরীআহ্ পরিপালন নিশ্চিত করার একটি বিস্তৃত রূপরেখা উক্ত নীতিমালায় বলা হয়ে থাকে। যেকোনো দেশের ইসলামী ব্যাংকিং সেক্টরে প্রকৃত শরীআহ্ চর্চা অগ্রসর করার জন্য উক্ত নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। মালয়েশিয়া, বাহরাইন, ওমান, ইন্দোনেশিয়া, আরব আমিরাত, কুয়েত, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানসহ নানা মুসলিম দেশে উক্ত নীতিমালা কেন্দ্রীয়ভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত। দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশে এই নীতিমালা এখনও অনুপস্থিত।
‘শরীআহ গভর্নেন্স ফ্রেমওয়ার্ক’ এর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইসলামী ব্যাংকিংয়ের শরীআহ বোর্ড-এ যারা অংশগ্রহণ করবেন, তাদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা কেমন হবে, তারা কীভাবে নির্বাচিত হবেন, তাদের কাজের পদ্ধতি কী হবে ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা প্রদান করা। সেই আলোকেই প্রতিটি ইসলামী ব্যাংক তার শরীআহ্ যো কাঠামো প্রতিষ্ঠা করে। কেন্দ্রীয়ভাবে উক্ত নির্দেশনা থাকার ফায়দা হলো, সকলে একটি আদর্শিক মানদণ্ড অনুসরণ করে বিশ্বাসযোগ্য ও কার্যকর শরীআহ্ বোর্ড প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।
এটি না থাকলে যা হয়, একেক ব্যাংক একেকভাবে শরীআহ্ বোর্ড গঠন করার সুযোগ থেকে যায়। এতে শরীআহ্ বোর্ডের মূল কার্যক্রম নানা কারণে ব্যাহত হয়। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। ধরা যাক, শরীআহ বোর্ড থেকে কোনো সদস্যকে বাদ দিতে হলে, সেটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইসলামী ব্যাংকিং বিভাগ থেকে অনুমোদন নিতে হয়। অন্যান্য দেশে এই নিয়ম রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে 'শরীআহ্ গভর্নেন্স ফ্রেমওয়ার্ক' না থাকায় ব্যাংক ম্যানেজম্যান্ট যে কাউকে যখন-তখন বাদ দিয়ে দিতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এর যথাযথ অনুমোদন নেওয়া কিংবা তাকে অবহিত করারও প্রয়োজন মনে করা হয় না।
'শরীআহ্ গভর্নেন্স ফ্রেমওয়ার্ক' একটি বিশদ বিষয়। তার গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ শরীআহ্ বোর্ড কাঠামো সংক্রান্ত নীতিমালা। সেটিরও নানা দিক আলোচনার আছে। তবে আপাতত শরীআহ্ বোর্ডের কেবল দুটি দিক নিয়ে আলোচনা করতে চাই :
এক. শরীআহ্ বোর্ড সদস্যদের যোগ্যতা।
দুই. অভিজ্ঞতা।
এর বাহিরে যে আলোচনাগুলো আজ করা হবে না—শরীআহ্ বোর্ড সদস্য নির্বাচন প্রক্রিয়া, তাদের দায়-দায়িত্ব, প্রতিষ্ঠানে তাদের কাঠামোগত অবস্থান, তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য শরীআহ্ বিভাগ ইত্যাদি। এগুলো মূলত একটি পূর্ণাঙ্গ 'শরীআহ্ গভর্নেন্স ফ্রেমওয়ার্ক' নীতিমালায় বিস্তারিতভাবে থাকে।
বাংলাদেশে কী হচ্ছে?
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয়ভাবে 'শরীআহ্ গভর্নেন্স ফ্রেমওয়ার্ক' নেই। এ কারণে একেক ইসলামী ব্যাংক একেকভাবে শরীআহ্ বোর্ড গঠন করে। সাধারণত যাদের কিছুটা খ্যাতি আছে, মিডিয়ায় বিচরণ আছে, ভালো ওয়াজ করতে পারেন, ভালো-বক্তব্য দিতে পারেন, তাদেরকেই শরীআহ্ বোর্ডের সদস্য নির্বাচন করা হয়। আরও একটি সহজ পদ্ধতি হলো, যিনি কোনো ইসলামী ব্যাংকের শরীআহ্ বোর্ডে আছেন, তাকেই আবার অন্য আরেকটি শরীআহ্ বোর্ডের সদস্য হওয়ার দাওয়াত দেওয়া হয়। এতে দেখা যায়, একই ব্যক্তি ৪-৫টি ব্যাংকের শরীআহ্ বোর্ডে কাজ করছেন। ব্যাংকের পরিচালকদের এলাকার মসজিদের ইমাম সাহেবদেরকেও কেবল 'ইমাম' হওয়ার কারণে শরীআহ্ বোর্ডের সদস্য করতে দেখা গিয়েছে।
কিছু দিন আগে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ২১টি ইসলামী ব্যাংকের (পূর্ণাঙ্গ ও শাখা ইসলামী ব্যাংকিংসহ) শরীআহ্ বোর্ডের উপর একটি জরিপ করা হয়েছিল। তাতে দেখা যায়, ৩০% সদস্যই সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নানা পদের। প্রায় ৫০% সদস্য বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া। কওমী মাদরাসা পড়ুয়া সদস্য মাত্র ১৫% এর মতো। এর বাইরে আলিয়া মাদরাসা পড়ুয়াদের একটি বৃহৎ সংখ্যা রয়েছে। এর মানে মুফতী বা ফকীহ, যারা মূলত শরীআহ্ বোর্ডে প্রধান ভূমিকা রাখেন, তারা খুবই নগণ্য।
এককথায়, শরীআহ্ সদস্যদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় তাদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার প্রাথমিক যাচাইয়ের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড অনুসরণ করা হচ্ছে না। ফকীহ ও মুফতীগণ ব্যাপকভাবে শরীআহ্ বোর্ডসমূহে অনুপস্থিত। অথচ আন্তর্জাতিক জরিপে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শরীআহ্ বোর্ডে সংশ্লিষ্ট শরীআহ্ স্কলারদের সংখ্যা পৃথিবীর সকল দেশের তুলনায় অধিক। ICD এর Islamic Finance Development Report 2023 (ইসলামী ফাইন্যান্স উন্নয়ন প্রতিবেদন-২০২৩) এ দেখানো হয়েছে, সংখ্যায় শরীআহ্ স্কলারদের উপস্থিতি শীর্ষ ০৫টি মুসলিম দেশের মাঝে বাংলাদেশ সবার উপরে। মালয়েশিয়ায় শরীআহ্ স্কলার ১৮১ ইন্দোনেশিয়ায় ১৪৭, পাকিস্তানে ৯৯, সৌদি আরবে ৮৭। আর বাংলাদেশে ১৯০ জন। (পৃ. ৫৯)
আমাদের বাক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত জরিপে দেখানো হয়েছে উক্ত ১৯০ জনের মাঝে ব্যাংকার, ভার্সিটি পড়ুয়াগণই অধিক। পেশাগত মুফতী ও ফকীহদের উপস্থিতি খুবই কম। নিয়মনীতি অনুসরণ করা ছাড়াই এভাবে শরীআহ্ বোর্ডের সদস্য বৃদ্ধির কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ইসলামী ফাইন্যান্স সেক্টর নিয়ে অবান্তর তথ্য সৃষ্টি হয়েছে। যে দেশে ইসলামী ফাইন্যান্সের জন্য বিশেষায়িত ইউনিভার্সিটি নেই, মাদরাসামূহেও এ বিষয়ে পড়াশোনা অবহেলার শিকার, সেই দেশে ইসলামী ফাইন্যান্সে এতো অধিক শরীআহ্ স্কলার কীভাবে সৃষ্টি হলো—-তা বড় ভাবনার বিষয় বটে!!
ইসলামী ব্যাংকিং সেক্টরে যে ক্ষতি হচ্ছে
এভাবে নিয়মনীতি অনুসরণ না করে নিছক সংখ্যায় শরীআহ স্কলার বৃদ্ধি করায় দেশের ইসলামী ব্যাংকিং সেক্টরে যে ক্ষতি হচ্ছে তা হলো,
ক. যোগ্য শরীআহ সদস্যগণ কাজ করার সুযোগ হারাচ্ছেন। যে সকল তরুণ আলেম, মুফতীগণ আধুনিক ফাইন্যান্স বোঝেন, ব্যাংকিং বোঝেন, ইংরেজি ভাষাও জানেন, তারা অবদান রাখার সুযোগ পাচ্ছেন না। এতে ইসলামী ব্যাংকিং সেক্টর শরীআহ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
খ. নিয়মনীতি অনুসরণ না করে যারা নিয়োগ পাচ্ছেন, তাদের দ্বারা শরীআহ পরিপালন অগ্রসর হচ্ছে না। এতে ইন্ডাস্ট্রিতে আলেম-উলামাদের ব্যাপারে একটি নেতিবাচক ধারণা ছড়িয়ে পড়ছে।
গ. ইসলামী ব্যাংকিংয়ের মূল পরিচয় তথা শরীআহ পরিপালন পিছিয়ে পড়ছে। এতে বড় পর্যায়ে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন ইসলামী ব্যাংকের সাধারণ ডিপোজিটর ও বিনিয়োগকারীগণ। যে ইসলাম ও শরীআহকে ভালোবেসে তারা এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন, তাদের সেই প্রত্যাশা অনেকাংশেই পূরণ হচ্ছে না।
তবে এটিও বাস্তব যে, বিদ্যমান শরীআহ বোর্ড কাঠামোতে যোগ্য শরীআহ্ সদস্য যে একেবারে নেই তাও নয়। এই অগোছালো কাঠামোতেও ভালো, দক্ষ, সৎ ও নির্ভীক শরীআহ আলেম সদস্যও আছেন। যদিও তাদের সংখ্যা খুবই কম। আমাদের এই আলোচনার উদ্দেশ্য এই সংখ্যাটি বৃদ্ধি করা।
অভিজ্ঞ শরীআহ্ সদস্য কীভাবে বৃদ্ধি করা যায়?
বিদ্যমান ইসলামী ব্যাংকসমূহের শরীআহ বোর্ডে দক্ষ শরীআহ সদস্য বৃদ্ধি করতে হলে কেন্দ্রীয়ভাবে ‘শরীআহ্ গভর্নেন্স ফ্রেমওয়ার্ক’ তৈরি করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। একটি ইসলামী ব্যাংকের শরীআহ্ বোর্ডে দক্ষ শরীআহ্ সদস্য যুক্ত করার জন্য প্রাথমিকভাবে দুটি বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় নিতে হয় :
এক. শরীআহ সদস্যের যোগ্যতা।
দুই. অভিজ্ঞতা।
এ বিষয়গুলো 'শরীআহ্ গভর্নেন্স নীতিমালায়' বিশদাকারে থাকবে। তাদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা কেমন থাকা উচিত; এ নিয়ে আলোচনার আগে শরীআহ্ বোর্ডের মূল কাজ ও দায়িত্ব কী এবং কেন এই বোর্ড দরকার তা আলোচনা করা হলো।
শরীআহ্ বোর্ডের মূল কাজ কী?
শরীআহ বোর্ডের মূল কাজ হলো, সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেন বিষয়ে ফতওয়া প্রদান করা। এ প্রসঙ্গে ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য শরীআহ্ মানদণ্ডপ্রণেতা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান অ্যাওফি (AAOIFI) স্পষ্ট বলেছে,
The tasks assigned to Shariah Supervisory Boards: Fatwa it is one of the tasks assigned to Shariah Supervisory Boards (Board/Boards) of the Islamic Financial Institutions (Institution/ Institutions.) (AAOIFI, SS, 29,C.3/2)
'শরীআহ্ সুপারভাইজরি বোর্ডের কাঁধে যে সকল দায়িত্ব ন্যস্ত রয়েছে, তন্মধ্যে অন্যতম ফত্ওয়া ইস্যু করা। ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শরীআহ্ সুপারভাইজরি বোর্ডের অন্যতম দায়িত্ব ফত্ওয়া ইস্যু করা।'
অ্যাওফি তাদের শরীআহ গভর্নেন্স মানদণ্ডে শরীআহ্ সুপারভাইজরি বোর্ডের পরিচয় গিয়ে লিখেছে,
A Shariah Supervisory Board is an independent bodz of specialized jurists in Fiqh AL-Muamalat (Islamic Commercial jurisprudence.) (GS. 01, C2)
'একটি শরীআহ সুপারভাইজরি বোর্ড মূলত একটি স্বাধীন বডি। যা ফিকহুল মুআমালাতে বিশেষজ্ঞ ফকীহদের সমন্বয়ে গঠিত হয়।'
সুতরাং এটি স্পষ্ট যে, শরীআহ্ সুপারভাইজরি বোর্ডের অন্যতম দায়িত্ব ফত্ওয়া প্রদান করা। এজন্য এখানে যারা শরীআহ সদস্য হবেন, তাদেরকে অবশ্যই ফকীহ হতে হবে। অতএব শরীআহ সদস্যদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা মূলগতভাবে ফিকহ ফত্ওয়া কেন্দ্রিক থাকতে হবে। বিশেষত ফিকহুল মুআমালাত বিষয়ে ফতওয়া প্রদানের যোগ্যতা থাকতে হবে। দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের শরীআহ্ বোর্ডসমূহে এই যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি তুলনামূলক কম। তবে একটি বাস্তবতা হলো, পুরো পৃথিবীতেই শরীআহ বোর্ডের সদস্য নির্বাচন প্রক্রিয়া বেশ জটিল। এখানে কে আসলে যোগ্য ফকীহ, কে যোগ্য নয় তা নির্ণয় করা সহজ ব্যাপার নয়। কারণ, দেখা যায়, কারও প্রাতিষ্ঠানিক অনেক ডিগ্রি রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ফিকহী যোগ্যতা অনুপস্থিত। আর কারও হয়তো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি তেমন নেই, তবে ফিকহের ক্ষেত্রে তার দক্ষতা প্রশ্নাতীত। তাই এক্ষেত্রে ন্যূনতম একটি মানদণ্ড থাকা উচিত। যা আমাদের দেশে অনুপস্থিত। সেই ন্যূনতম মানদণ্ড নিয়ে একটি প্রস্তাবনা থাকবে প্রবন্ধের শেষে।
শরীআহ্ সদস্যের যোগ্যতা: বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশের উদাহরণ
বাংলাদেশে কেন্দ্রীয়ভাবে ‘শরীআহ্ গভর্নেন্স ফ্রেমওয়ার্ক’ না থাকলেও শরীআহ্ সদস্যের যোগ্যতা কেমন হবে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি নির্দেশিকা রয়েছে। ২০০৯ এ প্রকাশিত সে নির্দেশিকার নাম- Guidelines for Islamic Banking (ইসলামী ব্যাংকিং পরিচালনার জন্য নির্দেশিকা)। এর সংযুক্তি-০১ (Appendix-1)-এ Fit and proper criteria for selection of Members of Shariah Supervisory Committee (শরীআহ্ সুপারভাইজরি বোর্ডের সদস্য নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত এবং সঠিক মানদণ্ড) নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। তাতে (পৃ. ২৯) শরীআহ বোর্ডের শরীআহ্ সদস্যের শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
শরীআহ্ সদস্যকে অবশ্যই কামিল অথবা দাওরা পাশ হতে হবে। অথবা ইসলামিক স্টাডিজ, অ্যারাবিক, ইসলামিক আইন, ইসলামিক ইকনোমিকস অথবা ইসলামিক ব্যাংকিং-এ পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রি থাকতে হবে। সাথে আরবী ভাষায় গভীর জ্ঞান থাকতে হবে।
অভিজ্ঞতার ব্যাপারে বলা হয়েছে—
ক. ইসলামী ফিক্হ/ইসলামিক আইন/ ইসলামিক ব্যাংকিং বিষয়ক কোনো সাবজেক্টে অন্তত তিন বছর পড়ানো বা গবেষণা কর্মের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
খ. ইসলামিক ব্যবসা-বাণিজ্য অথবা ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্স বিষয়ে শরীআহ বিধি-বিধান বা ফত্ওয়া প্রদানের জন্য কোনো দারুল ইফতা বা ফতওয়া বোর্ডের সদস্য হিসাবে কাজ করার অন্তত তিন বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
গ. অথবা ইসলামিক ব্যবসা-বাণিজ্য, ইসলামী ব্যাংকিং, ইসলামী অর্থনীতি এবং ইসলামী ফাইন্যান্স (ফিকহুল মুআমালাত) বিষয়ে স্বীকৃত কোনো জার্নালে তিনটি বিশেষ আর্টিকেল প্রকাশিত হতে হবে। অথবা উপরোক্ত বিষয়ে তিনটি বই প্রকাশিত হতে হবে।
বাস্তবতা হলো, বিদ্যমান ইসলামী ব্যাংকসমূহের শরীআহ বোর্ডে বাংলাদেশ ব্যাংকের উপরোক্ত নির্দেশনাসমূহ খুব কমই অনুসৃত হচ্ছে। বরং শরীআহ বোর্ডগুলোতে এমন শরীআহ্ সদস্যদের সংখ্যাই বেশি, আধুনিক ফিকহুল মুআমালাত সম্পর্কে যাদের জানাশোনার পরিমাণ খুবই কম। যেসব অভিজ্ঞতা থাকার কথা বলা হয়েছে, সেগুলো নিদারুণভাবে অবহেলিত। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে তদারকি শুরু করেছে বলে জানা গিয়েছে, যা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। তবে এ কথা বলার সুযোগ আছে যে, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় ১৬ বছর আগে এ বিষয়ে যে নির্দেশনা দিয়েছিল, বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেটি আরও উন্নত করার সুযোগ আছে। এ প্রসঙ্গে অন্যান্য মুসলিম দেশের উদাহরণগুলো এক নজর দেখা যেতে পারে।
অন্যান্য দেশের শরীআহ্ বোর্ডের শরীআহ্ সদস্য হওয়ার যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা
গবেষণার প্রয়োজনে ১০টি মুসলিম দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক ইসলামী ব্যাংকসমূহের শরীআহ্ বোর্ডের সদস্য হওয়ার যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করা হয়েছে। এর মধ্যে ০৬টি দেশের নির্দেশনা তুলনামূলক অধিক সমৃদ্ধ। এর মাঝে পাকিস্তানের নির্দেশনা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অধিক মানানসই। বস্তুত ইসলামী ব্যাংকিংসহ ইসলামী ফাইন্যান্সের নানা তত্ত্ব ও প্রয়োগ বাস্তবায়নে বাংলাদেশের জন্য মালয়েশিয়া ও অন্যান্য দেশের তুলনায় পাকিস্তানের মডেল ও কাঠামো তুলনামূলক অধিক যুৎসই। আলোচনা সংক্ষেপ করার জন্য আমরা কেবল প্রথম ০৬টি দেশের সংশ্লিষ্ট নীতিমালা নিয়ে আলোচনা করব। তাদের নির্দেশনা তুলনামূলক সমৃদ্ধ।
০১. পাকিস্তান
শিক্ষাগত যোগ্যতা: যে কোনো স্বীকৃত মাদরাসা বোর্ড (দরসে নিজামি অর্থাৎ কওমি মাদরাসা) থেকে ন্যূনতম ৭০% নম্বর পেয়ে উচ্চতর ডিগ্রি (দাওরায়ে হাদীস/তাকমিল) লাভ করতে হবে এবং ফযীলত/স্নাতকে ন্যূনতম ২য় স্থানে উত্তীর্ণ হতে হবে। অথবা শরীআহ্ অনুষদ বা উসূলুদ্দিন অনুষদ অথবা এল.এল.এম. (শরীআহ)-এ ন্যূনতম জিপিএ ৩.০ সহ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি থাকতে হবে। অথবা স্বীকৃত কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমমানের ডিগ্রি থাকতে হবে।
প্রাসঙ্গিক যোগ্যতা: ক. সাধারণ ব্যাংকিং ও অর্থনীতি এবং বিশেষভাবে ইসলামী ফাইন্যান্সে পর্যাপ্ত জানাশোনা থাকতে হবে।
খ. উসুলুল ফিকহ-এ বিশেষ দক্ষতা থাকতে হবে। যেন ফিকহী বিষয়ে মতামত প্রদানের ক্ষেত্রে ফিকহ মেথডোলজি সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা থাকে।
গ. আরবী ও ইংরেজি ভাষায় ভালো দক্ষতা থাকতে হবে।
অভিজ্ঞতা: ক. শরীআহ সদস্যদের অবশ্যই তাখাসসুস ফিল ইফতার মেয়াদসহ ফতওয়া প্রদানে কমপক্ষে ৪ (চার) বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে অথবা কমপক্ষে ৫ (পাঁচ) বছর ইসলামী ব্যাংকিং এবং ফিন্যান্সে শিক্ষাদান বা উন্নয়ন বা গবেষণার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তবে তাখাসসুস ফিল ফিকহ/তাখাসসুস ফিল ইফতা-এর সার্টিফিকেটধারীগণ বিশেষ অগ্রাধিকার পাবেন।
খ. শরীআহ্ বোর্ডের অধিকাংশ শরীআহ্ সদস্যের ('আরএসবিএম'সহ) ইসলামী কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শরীআহ্ অ্যাডভাইজর বা শরীআহ বোর্ড সদস্য হিসেবে তিন বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। অথবা একটি ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠানে শরীআহ টিমের সহকারী অ্যাডভাইজর বা সদস্য হিসেবে কাজ করার কমপক্ষে ৩ (তিন) বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
এছাড়া গভর্নেন্স নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, শরীআহ্ বোর্ডের শরীআহ্ সদস্য সংখ্যা ন্যূনতম ৩ (তিন) জন থাকতে হবে। শরীআহ্ সদস্যদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে ব্যাংকিং, আইন, অর্থনীতি এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ে শরীআহ্ বোর্ডকে সহায়তা ও পরামর্শ দেওয়ার জন্য আইনজীবী, হিসাবরক্ষক, অর্থনীতিবিদ এবং এই জাতীয় অন্যান্য পেশাদারদের নিযুক্ত করা যেতে পারে। এ ধরনের সদস্যদের শরীআহ্ বিষয়ে কোনো ভোটাধিকার থাকবে না।
অন্যান্য: সকল সদস্যগণ ৩ (তিন) বছর মেয়াদে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। তাদের নিয়োগ প্রাথমিক পর্যায়ে বোর্ড অব ডাইরেক্টর্স অনুমোদন করবে। এরপর চূড়ান্ত অনুমোদন প্রদান করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গভর্নেন্স নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, শরীআহ বোর্ড সদস্যরা ‘আরএসবিএম’ ব্যতীত সর্বাধিক তিনটি ইসলামী ব্যাংকিং-এর শরীআহ্ বোর্ডে যুক্ত থাকতে পারবেন। কোনো সদস্যকে বাদ দিতে হলে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য বোর্ড অব ডাইরেক্টর্স-এ তার বক্তব্য প্রদানের সুযোগ দিতে হবে। পাশাপাশি তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে হতে হবে।
০২. বাহরাইন
বাহরাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট নির্দেশনায় বলা হয়েছে, শরীআহ্ সদস্যের ইসলামী শরীআহ্ বিষয়ে অন্তত স্নাতক বা এর সমমানের কোনো ডিগ্রি থাকতে হবে। পাশাপাশি ফিকহুল মুআমালাত বিষয়ে কোনো সার্টিফাইড ডিগ্রি থাকতে হবে। প্রাসঙ্গিক যোগ্যতা হিসাবে বলা হয়েছে, উসূলে ফিকহ সম্পর্কেও গভীর জ্ঞান থাকতে হবে। ব্যাংকিং, ইসলামিক ফাইন্যান্স এবং একাউন্টিং সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকতে হবে। আরবী ভাষায় দক্ষতা থাকতে হবে। যেন শরীয়তের মূল উৎসসমূহের সঙ্গে ভালো পরিচয় থাকে। অভিজ্ঞতার ব্যাপারে বলা হয়েছে, শরীআহ্ সম্পর্কিত বিষয়ে শিক্ষাদান, গবেষণা ও ফতওয়া প্রদানের ন্যূনতম ৭ (সাত) বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
০৩. মালয়েশিয়া
মালয়েশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট নির্দেশনায় বলা হয়েছে, শরীআহ্ সদস্যের উসূলুল ফিকহ (ইসলামী আইনশাস্ত্রের মূলনীতি) বা ফিকহুল মুআমালাত (ইসলামী লেনদেন/বাণিজ্যিক আইন)-এ ন্যূনতম স্নাতক ডিগ্রী থাকতে হবে। পাশাপাশি আরবী ভাষায় লেখা ও বলার দক্ষতা থাকতে হবে। মাতৃভাষা বা ইংরেজি ভাষায়ও দক্ষতা থাকতে হবে। অভিজ্ঞতার ব্যাপারে কেবল এতটুকু বলা হয়েছে যে, শরীয়ত বিষয়ক গভীর জ্ঞান এবং ইসলামী অর্থনীতিতে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তবে অভিজ্ঞতার কোনো মানদণ্ড তাঁরা উল্লেখ করেননি।
০৪. কুয়েত
কুয়েতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট নির্দেশনায় বলা হয়েছে, শরীআহ সদস্যের ইসলামী শরীআহ বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি থাকতে হবে। বিশেষত ফিকহুল মুআমালাত বিষয়ে। অথবা শরীয়াহ বোর্ডের সদস্যদেরকে ফিকহুল মুআমালাতের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ এবং দক্ষ হতে হবে। প্রাসঙ্গিক যোগ্যতা হিসাবে বলা হয়েছে,
ক. সাধারণ অর্থনীতি এবং ইসলামী অর্থনীতির পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকতে হবে।
খ. ফিকহের মতামত (ফাতওয়া) নির্ধারণে ফিকহের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান থাকতে হবে।
গ. ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ইসলামী শরীয়াহ বিধি-বিধান সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে।
ঘ. তার দায়িত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইন ও নিয়ম সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান থাকতে হবে।
ঙ. আরবী ও ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা থাকতে হবে। আরবী ভাষায় এতটুকু দক্ষতা থাকতে হবে যেন শরীআর মূল সোর্স থেকে সরাসরি উপকৃত হতে পারেন।
অভিজ্ঞতার ব্যাপারে বলা হয়েছে, শরীআহ্ সুপারভিশনের ক্ষেত্রে কমপক্ষে পাঁচ বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কুয়েতের সংশ্লিষ্ট নীতিমালায় শরীআহ্ সদস্যদের মূল্যায়নের ব্যাপারে একটি চমৎকার দিক উঠে এসেছে। বোর্ড অব ডাইরেক্টর্স এর প্রতিনিধি নমিনেশন ও রেমুনারেশন (মনোনয়ন ও সম্মানি প্রদান) কমিটি এবং শরীআহ্ বোর্ড যৌথভাবে মূল্যায়ন করবে। ১০০ নম্বরের মাঝে শরীআহ বোর্ড সদস্যগণ একে অপরের মূল্যায়ন নম্বর থাকবে ৬৫%। আর প্রশাসনিকভাবে মূল্যায়ন নম্বর থাকবে ৩৫%। উভয় মূল্যায়ন দ্বারা শরীআহ্ সদস্যদের নিয়োগ ও সম্মানী পুনঃনির্ধারিত হবে। তাঁরা আরও বলেছেন, সবসময় সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিবেচনায় শরীআহ্ সিদ্ধান্ত হবে না। সকলের ঐকমত্যে হতে হবে। তবে সময়ের স্বল্পতার কারণে কখনো ঐকমত্যে উপনীত না হলে, কেবল সেক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ মত গ্রহণ করা যেতে পারে। শরীআহ বোর্ড সভায় সদস্যদের উপস্থিতি বছরে ৭৫% এর কম না হতে হবে। শরীআহ্ বোর্ড সদস্য সর্বাধিক তিনটি ইসলামী ব্যাংকিং-এর শরীআহ বোর্ডে যুক্ত থাকতে পারবেন। শরীআহ্ সদস্যদের প্রাথমিক নির্বাচন করবে পরিচালনা পর্ষদ। তবে চূড়ান্ত নিয়োগ হবে সাধারণ সভা থেকে।
০৫. ওমান
ওমানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট নির্দেশনায় বলা হয়েছে, শরীআহ্ সদস্যের স্বীকৃত কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে ইসলামী শরীআহ্ বিষয়ে অন্তত স্নাতক ডিগ্রি থাকতে হবে। যা 'উসূলে ফিকহ' ও ফিকহুল মুআমালাত বিষয়ক পড়াশোনাকেও অন্তর্ভুক্ত করবে। পাশাপাশি সাধারণ ব্যাংকিং বা ফাইন্যান্স বিষয়ক ধারণা থাকতে হবে। বিশেষত ইসলামী ব্যাংকিং বা ফাইন্যান্স বিষয়ে। সংশ্লিষ্ট দেশীয় আইন-কানুন সম্পর্কেও অবগত থাকতে হবে। আরবী ভাষায় বিশেষ দক্ষতা থাকতে হবে। আর ইংরেজি ভাষায় প্রয়োজনীয় জ্ঞান থাকতে হবে।
অভিজ্ঞতার ব্যাপারে বলা হয়েছে, একজন শরীআহ্ বিশেষজ্ঞের অবশ্যই পাঠদান, গবেষণা ও ফতওয়া প্রদানে ১০ (দশ) বছর বা তার বেশি অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। যারা নন-শরীআহ সদস্য হবেন, তাদেরকে নিজ ক্ষেত্রে যেমন: অর্থনীতি, আইন, ব্যাংকিং, একাউন্টিং, ফাইন্যান্স ইত্যাদিতে দক্ষ হতে হবে। এসব বিষয়ে তাদের অন্তত মাস্টার্স ডিগ্রি থাকতে হবে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাদের ১৫ বছর বা তার বেশি অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। আরবী ভাষায় তাদের কিছুটা হলেও ধারণা থাকতে হবে। শরীআহ্ বোর্ডের প্রত্যেক সদস্য পরপর দুই টার্মের বেশি থাকতে পারবেন না। প্রতি টার্মের মেয়াদ হবে তিন বছর। প্রতিযোগী আর্থিক প্রতিষ্ঠানে একের অধিক শরীআহ্ বোর্ডে থাকা যাবে না। তবে অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ একটিতে থাকা যাবে। তবে সামগ্রিকভাবে দেশের চারটির অধিক শরীআহ্ বোর্ডে থাকা যাবে না। শরীআহ্ সদস্যদের প্রাথমিক প্রস্তাব পরিচালনা পর্ষদ প্রদান করবে, তবে তা চূড়ান্ত হবে বার্ষিক সাধারণ সভায়।
০৬. আরব আমিরাত
আরব আমিরাতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট নির্দেশনায় বলা হয়েছে, শরীআহ্ সদস্যের ইসলামী শরীআহ্; বিশেষত ফিকহ ও উসূলে ফিকহ শাস্ত্রে বিশেষ করে ফিকহুল মুআমালাতে স্বীকৃত কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ন্যূনতম স্নাতক ডিগ্রি থাকতে হবে। অথবা মুআমালাত সংক্রান্ত ফতওয়া প্রদানে অন্তত ১০ (দশ) বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। প্রাসঙ্গিক যোগ্যতা বিষয়ে বলা হয়েছে, সাধারণ ফাইন্যান্স ও বিশেষ করে ফিকহুল মুআমালাত বিষয়ে বিশেষ ধারণা থাকতে হবে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের আর্থিক এবং ব্যাংকিং কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট আইন-কানুন সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকতে হবে। আরবীতে দক্ষতা এবং ইংরেজিতে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকতে হবে। অভিজ্ঞতার ব্যাপারে বলা হয়েছে, ইসলামী ফাইন্যান্স বা শরীআহ্ পর্যবেক্ষণে (নিয়োগপ্রাপ্ত বা অ্যাডভাইজর হিসেবে) অন্তত ১০ (দশ) বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। অথবা ফিকহুল মুআমালাতে গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী অন্তত ১৫ (পনেরো) বছর শিক্ষাদান ও গবেষণার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
বাংলাদেশে গুণগত মানসম্পন্ন শরীআহ্ বোর্ড গঠনে বাস্তবিক সমস্যা
একটি গুণগত মানসম্পন্ন শরীআহ্ বোর্ড গঠনের জন্য বাংলাদেশে যে একাডেমিক পরিবেশ ও সংশ্লিষ্ট পেশার চর্চা হওয়া দরকার ছিল, বাস্তবে তা অনেকাংশেই অনুপস্থিত। বিষয়টা অনেকটা 'বৃক্ষের চারা রোপণ না করেই ফল আশা করার মতো'। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, আরবী ভাষায় গভীর জ্ঞান থাকতে হবে। বাস্তবতা হলো, সাধারণত কওমী মাদরাসা পড়ুয়া আলেম ছাড়া বাকিদের আরবী ভাষায় খুব একটা জ্ঞান থাকে না। বিদ্যমান আলিয়া মাদরাসার সিলেবাসে তো আরবী পড়াশোনা এখন যথেষ্ট অবহেলিত। আর কলেজ-ভার্সিটির কথা তো বলাই বাহুল্য। কওমী মাদরাসা ছাড়া বাংলাদেশে অন্য কোনো সিলেবাসে অ্যারাবিক মিডিয়াম নেই। আর এটি নিছক ভাষা জ্ঞানেরও বিষয় নয়। এর উদ্দেশ্য হলো, শরীআহর মূল উৎস গ্রন্থসমূহ পড়া ও বোঝার দক্ষতা থাকা। যা সহজ ব্যাপার নয়।
আমরা জরিপে দেখেছি, বিদ্যমান শরীআহ্ বোর্ডসমূহে কওমী আলেমদের উপস্থিতি খুবই নগণ্য। এর অর্থ এটা নয় যে, কওমী মাদরাসায় যোগ্য আলেম/মুফতী নেই। যোগ্য ব্যক্তি অবশ্যই আছেন। তবে তারা এই সেক্টরে যুক্ত হতে খুব একটা আগ্রহী হন না। এর পেছনেও নানা কারণ ও বিশ্লেষণ রয়েছে। আলেমগণ শরীআহ্ পরিপালনে গুরুত্ব দিতে চান, এ বিষয়ে অবহেলা তারা বরদাশত করতে পারেন না। আর একজন আলেমের এ চরিত্র তো এমনই হওয়া উচিত। কিন্তু গত কয়েক যুগেও ইসলামী ব্যাংকার থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেউই শরীআহ্ পরিপালনের বিষয়টি অগ্রসর করার ব্যাপারে আলেমদেরকে আশ্বস্ত করার এ কাজটি যথাযথভাবে করেননি।
পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগে সেখানের বিভিন্ন মাদরাসায় ইসলামী ব্যাংকিং নিয়ে সেশন, মতবিনিময়, প্রশিক্ষণ হয়। ব্যাংকারগণ আলেমদের নিয়ে মতবিনিময় করেন। আলেমদের মাদরাসায় যাতায়াত করেন। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে বেশ বিরল।
'বৃক্ষের চারা রোপণ না করেই ফল আশা করার' আরও উদাহরণ আছে। যেমন: বলা হয়েছে— 'ইসলামিক আইন, ইসলামিক ইকনোমিকস অথবা ইসলামিক ব্যাংকিং-এ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি থাকতে হবে'। বাংলাদেশে এ ধরনের পিজিডি (পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা) করার সুযোগ কি অবারিত? অভিজ্ঞতার ব্যাপারে বলা হয়েছে, 'কোনো দারুল ইফতা বা ফতওয়া বোর্ডের সদস্য হিসাবে কাজ করার অন্তত তিন বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।' শুধু ঢাকা শহরেই না হলেও শ'খানেক দারুল ইফতা আছে। এর মাঝে মানসম্পন্ন দারুল ইফতা আছে ২০-২৫ এর মতো। কিন্তু পাঠক অবাক হবেন, মানসম্পন্ন দারুল ইফতায় কর্মরত বা একসময় মুফতী হিসাবে কাজ করেছেন, এমন ব্যক্তি শরীআহ বোর্ডে আছেন কেবল ৩-৪ জন। অথচ তারাই হলেন বাস্তব অর্থে একাডেমিক দিক থেকে ফকীহ/মুফতী, যারা শরীআহ্ বোর্ডের সদস্য হওয়ার প্রধান যোগ্যতার অধিকারী। তাহলে শীর্ষ ০৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ শরীআহ্ স্কলারের সংখ্যায় প্রথম হয়ে আছে কাদের দ্বারা? অনেক বড় প্রশ্ন এটি। এ প্রশ্নের উত্তর ও সমাধান না করার দায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এড়াতে পারে না।
ইসলামী আইন, ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে পড়ানোর অভিজ্ঞতা থাকার কথা বলা হয়েছে। অথচ আমাদের ইউনিভার্সিটিগুলোতে এসব সাবজেক্ট খুবই অবহেলিত। ইসলামী ব্যাংকিং আংশিক থাকলেও ইসলামী আইন ও ফিকহ একেবারেই নেই। তাহলে অভিজ্ঞতা কীভাবে তৈরি হবে? মাদরাসাসমূহে সম্প্রতি ফিকহুল মুআমালাত, ইসলামী ব্যাংকিং, ইসলামী ফাইন্যান্স নিয়ে পড়াশোনা ও চর্চা শুরু হয়েছে। বিশেষত মানসম্পন্ন দারুল। ইফতাসমূহে এখন এ বিষয়ে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ দারুল ইফতায় এখনো এর প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয় না। দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত পড়াশোনায় তা একেবারেই নেই। ওই দিকে ভার্সিটিগুলোতে ইসলামী ব্যাংকিং, ইসলামী ফাইন্যান্স, ফিকহ নেই বা খুবই নগণ্য। আরবী ভাষা জানার সুযোগও কম। আলিয়া থেকে কিংবা পিজিডি দিয়ে আরবী ভাষার জ্ঞানই হয় না। বাকিগুলো কিভাবে হবে। আর এদিকে কওমী মাদরাসায় আরবী ভাষা, ফিকহুল মুআমালাত থাকলেও তা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নেই। ইংরেজি ভাষার চর্চা এখনো অনেক পিছিয়ে। মডার্ন ইকোনোমিকস ও ফাইন্যান্সের চর্চা আরও অগ্রসর হওয়ার দাবি রাখে। তাহলে সামগ্রিকভাবে সকল সেক্টরই কম-বেশি নানা দুর্বলতার শিকার। কেন্দ্রীয়ভাবে ও সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এসব দুর্বলতা কাটিয়ে উঠার উদ্যোগ গ্রহণ না করা হলে বড় বড় নির্দেশনা তৈরি করা যাবে, তবে বাস্তবে তা 'কাজীর গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই'-এর দশা তৈরি করবে। হচ্ছেও তাই।
সমাধান ও প্রস্তাবনা
ইসলামী ব্যাংকিংসহ দেশের সকল ইসলামী আর্থিক সেক্টরে যোগ্য শরীআহ জনবল তৈরির জন্য বহুমুখী উদ্যোগ দীর্ঘ ও স্বল্প মেয়াদে গ্রহণ করা উচিত। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসাবে স্কুল, কলেজ ও মাদরাসায় ইসলামী ফাইন্যান্স, ব্যাংকিং ও অর্থনীতিকে সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা। ইসলামী অর্থনীতির জন্য বিশেষায়িত ইউনিভার্সিটি গড়ে তোলা। প্রতিটি ইউনিভার্সিটিতে ইসলামী ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্সে স্বতন্ত্র বিভাগ করা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামী ফাইন্যান্সে স্বতন্ত্র রিসার্চ ইনস্টিটিউশন ও ইউনিভার্সিটি গড়ে তোলা।
বড় বড় মাদরাসা কর্তৃপক্ষ স্বতন্ত্রভাবে ফিকহুল মু'আমালাত বিষয়ে তাখাসসুস বিভাগ চালু করা। সকল মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড মাদরাসার মূল সিলেবাসে ইসলামী অর্থনীতি ও ফাইন্যান্সকে প্রাথমিক লেভেলে হলেও অন্তর্ভুক্ত করা। এককথায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড সকল পক্ষ যৌথভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা।
স্বল্প মেয়াদী পরিকল্পনা হিসাবে-কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্রুত একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করত একটি সমৃদ্ধ ও সুদৃঢ় 'শরীআহ্ গভর্নেন্স ফ্রেমওয়ার্ক' নীতিমালা প্রণয়ন করা। এক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের ভালো উদাহরণসমূহ বিশেষত পাকিস্তানের মডেলকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করা। সকল ইসলামী ব্যাংকের শরীআহ্ বোর্ডসমূহ তদারকি শুরু করা। নন-শরীআহ্ সদস্যদেরকে যথাসম্ভব বাদ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া। তবে যারা বিশেষ পারদর্শিতা রাখেন, তাদেরকে বহাল রাখা। শরীআহ আলেমদেরকে গুরুত্বের সাথে যুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগে শরীআহ্ বোর্ড সদস্যদের জন্য ব্যাংকিং ও শরীআহ্ উভয় বিষয়ে সময়ে সময়ে বিশেষ সেশন/মতবিনিময়ের আয়োজন করা। সেখানে তাদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক রাখা। যে সকল আলেম বা অন্য বিষয়ে এক্সপার্টগণ নতুন করে শরীআহ বোর্ডে যুক্ত হতে চাইবেন, তাদেরকে অবশ্যই এ ধরনের সেশনে অংশগ্রহণ করত সার্টিফিকেট গ্রহণ করতে হবে। বস্তুত স্বল্প মেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সিংহভাগ দায়িত্ব-ই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাঁধে বর্তাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছাড়া স্বল্প মেয়াদে এ বিষয়ে বাধ্যতামূলক সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা অন্য কারও পক্ষে সম্ভব নয়।
শেষ কথা
অর্থনীতিতে সামগ্রিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলামী অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। সমগ্র বিশ্বেই ইসলামী অর্থনীতির কেবল মাইক্রো তথ্য অংশবিশেষ প্রয়োগ নিয়ে কথা হয়।
মেক্রো বা পূর্ণ লেভেলেও ইসলামের ফাইন্যান্স ও ইকনোমিকস প্রতিষ্ঠা নিয়ে কথা বলা জরুরি। তাহলে মাইক্রো পর্যায়ে যেগুলো আছে যেমন: ব্যাংক, বীমা ইত্যাদি, সেগুলো সহজেই শরীআর অনুগত হয়ে যাবে। এ বিষয়ে উলামায়ে কেরাম ও দীনদার সকলকে সচেষ্ট হতে হবে।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন।
লেখক: সহকারী মুফতী, আমিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ, ঢাকা
পরিচালক, আইএফএ কনসালটেন্সি
বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে শরীআহ্ সদস্য হিসাবে কর্মরত
ই-মেইল: [email protected]
মুসলিম বাংলা