শুক্রবার ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, পৌষ ২০ ১৪৩১, ০৩ রজব ১৪৪৬

ইসলাম

আদর্শ মুসলিম নেতার বৈশিষ্ট্য

মুফতি জাওয়াদ তাহের

 আপডেট: ১১:৫৭, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪

আদর্শ মুসলিম নেতার বৈশিষ্ট্য

নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ এক দায়িত্ব। সবাই এ কাজ পারে না বা সবার দ্বারা সম্ভব হয় না। ইসলামেও এর গুরুত্ব অপরিসীম এবং এটি গুরুত্বপূর্ণ আমানতও বটে। একজন নেতার মধ্যে নির্দিষ্ট গুণাবলি থাকা জরুরি।


কারণ তার নেতৃত্বের ওপর একটি সমাজ, জাতি বা সম্প্রদায়ের সাফল্য ও কল্যাণ নির্ভর করে। কোরআন ও হাদিসে নেতৃত্বের গুণাবলি সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নিচে ইসলামের আলোকে একজন আদর্শ নেতার গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলি উল্লেখ করা হলো—

আল্লাহভীতি ও নৈতিকতা

ইসলামে একজন নেতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণ হলো আল্লাহভীতি। তিনি যেন সব সময় আল্লাহর বিধান মেনে চলেন এবং মানুষের প্রতি ন্যায়পরায়ণ হন। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘প্রকৃত পক্ষে তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা বেশি মর্যাদাবান সে-ই, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি মুত্তাকি।’ (সুরা : আল-হুজুরাত, আয়াত : ১৩)

ন্যায়পরায়ণতা

একজন নেতার জন্য ন্যায়পরায়ণতা অপরিহার্য। তিনি যেন ধনী-গরিব, বন্ধু-শত্রু, আত্মীয়-পরের মধ্যে কোনো পক্ষপাতিত্ব না করেন। ইনসাফবিহীন পৃথিবী অচল।

দেশের উন্নতি ও অবনতি নির্ভর করে শাসকের ইনসাফ ও ন্যায়বিচারের ওপর। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফ, দয়া ও আত্মীয়-স্বজনকে (তাদের হক) প্রদানের হুকুম দেন আর অশ্লীলতা, মন্দ কাজ ও জুলুম করতে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ করো।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৯০)

আবু সাঈদ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় এবং সবচেয়ে নিকটে উপবেশনকারী মানুষ হলো ন্যায়নিষ্ঠ শাসক।

আর সবচেয়ে ঘৃণ্য ও দূরের হলো অত্যাচারী শাসক। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ১৩২৯)

অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ন্যায়বিচারকরা (কিয়ামতের দিন) আল্লাহর কাছে নুরের মিম্বারে মহিমান্বিত দয়ালু (আল্লাহ)-এর ডানপাশে উপবিষ্ট থাকবেন। আর উভয় হাতই ডান হাত (অর্থাৎ সমান মহিমান্বিত)। (সেই ন্যায়পরায়ণ হচ্ছে) ওই সব লোক, যারা তাদের শাসনকার্যে তাদের পরিবার-পরিজনের ব্যাপারে এবং তাদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্বসমূহের ব্যাপারে সুবিচার করে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪৫৭০)

দায়িত্বশীলতা ও আমানতদারিতা

নেতৃত্ব একটি আমানত। একজন নেতাকে অবশ্যই দায়িত্বশীল হতে হবে এবং তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘(হে মুসলিমরা!) নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের আদেশ করছেন যে তোমরা আমানত তার হকদারকে আদায় করে দেবে এবং যখন মানুষের মধ্যে বিচার করবে, তখন ইনসাফের সঙ্গে বিচার করবে। আল্লাহ তোমাদের যে বিষয়ে উপদেশ দেন, তা কতই না উত্কৃষ্ট। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছু শোনেন, সব কিছু দেখেন।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৫৮)

আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছেন, তোমরা প্রত্যেকেই রক্ষক। আর প্রত্যেকেই তার অধীনদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। নেতা (ইমাম) একজন রক্ষক, সে তার অধীনদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। পুরুষ তার পরিবারের রক্ষক, সে তার পরিবারের লোকজন সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। স্ত্রী তার স্বামীর ঘরের রক্ষক, তাকে তার রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৪০৯)

জ্ঞান ও প্রজ্ঞা

নেতৃত্বের জন্য জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অপরিহার্য। একজন নেতাকে অবশ্যই ইসলামের শিক্ষা ও শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যাকে জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও বিচারশক্তি দেওয়া হয়েছে, তাকে অনেক কল্যাণ দেওয়া হয়েছে।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২৬৯)

মানুষের প্রতি দয়া ও সহানুভূতি

একজন নেতাকে তার অধীনদের প্রতি দয়া এবং সহানুভূতিশীল হতে হবে। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, দয়াশীলদের প্রতি রহমানও রহম করেন। তোমরা পৃথিবীবাসীদের প্রতি রহম করবে, তাহলে আকাশবাসী তোমাদের ওপর রহম করবেন। রেহেম হলো রহমান শব্দ থেকে উদগত। যে ব্যক্তি রেহেমের বন্ধন মেলাবে আল্লাহ তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন আর যে ব্যক্তি রেহেমের বন্ধন ছিন্ন করবে আল্লাহও তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবেন। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ১৯২৪)

পরামর্শ গ্রহণ

ইসলামে নেতৃত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ হলো পরামর্শ গ্রহণ। সিদ্ধান্ত গ্রহণে নেতাকে তার দল বা সমাজের মানুষের সঙ্গে শলাপরামর্শ করতে হবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা তাদের কাজ শুরার মাধ্যমে পরিচালনা করে।’ (সুরা : আশ-শুরা, আয়াত : ৩৮) রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেও বিভিন্ন বিষয়ে সাহাবিদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন।

ধৈর্যশীল

একজন নেতার মধ্যে ধৈর্যশীলতা থাকতে হবে। কঠিন পরিস্থিতিতে তিনি যেন ধৈর্য ধরে সঠিক সিদ্ধান্ত নেন। আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! ধৈর্য ধারণ করো এবং দৃঢ় থাকো।’ (সুরা : আল-ইমরান, আয়াত : ২০০)

রাসুলুল্লাহ (সা.) কঠিন সময়েও অত্যন্ত ধৈর্য ধারণ করেছেন, যা নেতৃত্বের জন্য উদাহরণ।

আত্মত্যাগ ও জনকল্যাণের মানসিকতা

একজন নেতাকে নিজের স্বার্থের চেয়ে মানুষের কল্যাণকে প্রাধান্য দিতে হবে। কথা ও কাজে বাস্তবসম্মত হতে হবে। যা বলবে তা নিজেও অনুসরণ করতে হবে, নিজেই এর উদাহরণ স্থাপন করতে হবে। কর্ম ছাড়া নিছক কথার ফুলঝুড়ি ছাড়তে হবে।

দৃঢ় চরিত্র ও নৈতিকতা

একজন নেতার নৈতিকতা ও চরিত্র যদি মজবুত হয়, তবে তার নেতৃত্ব বিশ্বস্ত এবং গ্রহণযোগ্য হয়। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ওই ব্যক্তি পরিপূর্ণ মুমিন, যার স্বভাব-চরিত্র ভালো। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৬৮২)

সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা

একজন নেতাকে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে জানতে হবে। তিনি যেন ভীত বা দ্বিধাগ্রস্ত না হন। আমাদের নবীজি (সা.) যুদ্ধ, শাসন বা দৈনন্দিন জীবনের নানা বিষয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণের উদাহরণ রেখে গেছেন।

কর্মীদের কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা

দেশের উন্নয়নে কর্মীরা যেন কাজে আত্মনিয়োগ হয়, প্রত্যেকে নিজের প্রতিভা যেন দেশের কল্যাণে ব্যয় করে সে জন্য তাদের উৎসাহ দেওয়া প্রয়োজন। এভাবে প্রত্যেকের ভেতরের যোগ্যতাকে বের করে আনতে সক্ষম হবে। দেশে যখন ভালো কাজ ও প্রতিভার যথাযথ মূল্যয়ন হবে তখন কর্মীরা কাজে আগ্রহী হয়ে উঠবে। কোরআনে আল্লাহ তাআলা জুলকারনাইন বাদশাহর কথা বলেছেন। তিনি কর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘তবে যে ঈমান আনবে ও সৎকাজ করবে, সে উত্তম প্রতিদানের উপযুক্ত হবে এবং আমিও আদেশ দানকালে তাকে সহজ কথা বলব।’ (সুরা : কাহফ, আয়াত : ৮৮)

একজন নেতার ভেতর এসব গুণ থাকলে তখন সে আদর্শ হয়ে উঠবে। এবং ধীরে ধীরে মানুষের আস্থাভাজন হবে। নেতৃত্বের ক্ষেত্রে সফল ও অনুসরণীয় হয়ে থাকবে।

মুসলিম বাংলা