একটি ভিত্তিহীন কাহিনী ॥ শিশু অবস্থায় নবীজীর সাথে পূর্ণিমার চাঁদ খেলা করা এবং কান্না থামানোর জন্য কথা বলা
কিছু অসতর্ক বক্তাকে খুব চটকদার ভঙ্গিতে এ কিসসাটি বলতে শোনা যায়। একজনকে এভাবে বলতে শোনা গেল, একদিন আব্বাস রা.-কে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, চাচা! আপনি কেন আমার প্রতি ঈমান আনলেন? তখন আব্বাস রা. বললেন, আমি তো আপনার প্রতি সেই সময়ই বিশ্বাস স্থাপন করেছি, যখন আমি এই আশ্চর্য ঘটনা দেখেছি।
একদিন আমি দেখলাম, পূর্ণিমার চাঁদ নামতে নামতে একেবারে কাছে নেমে এসেছে। আমার ভয় হল, তা আমাদের ওপর পতিত হয় কি না। তারপর দেখলাম, চাঁদ স্থির নেই; একবার ডানে যায়, একবার বামে যায়।
এর কারণ খোঁজ করতে গিয়ে দেখলাম, আপনার হাত-পা নাড়ানোর সাথে সাথে চাঁদও নড়ছে। আপনার হাত ডানদিকে গেলে চাঁদও ডানদিকে যায়, আপনার হাত বামদিকে গেলে চাঁদও বামদিকে যায়। অর্থাৎ চাঁদ আপনার সাথে খেলা করছে। এ ঘটনা দেখার পরই আমি বুঝে গেলাম, আমার ভাই অব্দুল্লাহর সন্তান কোনো সাধারণ সন্তান নয়, নিশ্চয়ই তার মাঝে কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে। সেদিনই আমি আপনার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি।
এরপর এই বক্তা বললেন, নবীজীর মা যেহেতু অভাবের কারণে নবীজীকে খেলনা কিনে দিতে পারেন না; তাই আল্লাহ তাআলা আসমানের চাঁদকে নবীজীর খেলনা বানিয়ে দিয়েছেন।
আরেক বক্তা বলেন, আব্বাস রা.-এর কথা শুনে নবীজী মুচকি হাসেন আর বলেন, আপনি তো সেদিন শুধু চাঁদকে নড়াচড়া করতে দেখেছেন; সেদিন আর কী ঘটেছিল, শুনুন। চাঁদ আমাকে গান শোনাচ্ছিল, আমার সাথে কথা বলছিল আর আমার কান্না থামানোর চেষ্টা করছিল।
এটি একটি ভিত্তিহীন কিসসা। নির্ভরযোগ্য সূত্রে তা পাওয়া যায় না। আব্দুর রহমান সাফূরী রাহ. (মৃত্যু ৮৯৯ হিজরির পর) নুযহাতুল মাজালিস কিতাবে সনদবিহীন কিসসাটি উল্লেখ করেছেন। সেখানে একটি দীর্ঘ বর্ণনায় একটু ভিন্ন আন্দাজে তা উল্লেখ করা হয়েছে। (সম্ভবত এই বর্ণনাটিকেই এই বক্তাগণ নিজেদের মতো করে পেশ করেছেন।) সেখানে আছে—
আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব রা. বলেন, আমি একবার নবীজীর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তা দেখে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, চাচাজান! কিছু বলতে চাচ্ছেন? তখন আমি বললাম, আপনার বয়স যখন চল্লিশ দিন তখন এক রাতে আমি দেখলাম, চাঁদ আপনার সাথে কথা বলছে, আপনি চাঁদের সাথে কথা বলছেন। আপনাদের ভাষা আমি বুঝতে পারছিলাম না।
নবীজী তখন বললেন, চাচাজান! (সেদিন কী ঘটেছিল, জানেন!) দোলনার কারণে আমি ডান পাশে ব্যথা পেয়ে কাঁদছিলাম, তখন চাঁদ আমাকে বলেছিল, আপনি কাঁদবেন না। আপনার অশ্রুর একটি ফোঁটা যদি যমীনে পড়ে, তাহলে আল্লাহ আসমান-যমীন উলটপালট করে দেবেন।
তারপর বাম পাশে ব্যথা পেয়ে আমি কান্না শুরু করলে চাঁদ বলে, আল্লাহর হাবীব! আপনি কাঁদবেন না। আপনার অশ্রুর একটি ফোঁটা যদি যমীনে পড়ে, তাহলে কিয়ামত পর্যন্ত যমীনে আর কোনো ফসল উৎপন্ন হবে না।...
নুযহাতুল মাজালিস কিতাবটি বিভিন্ন জাল বর্ণনায় ভরপুর। সে কিতাবেও সাফূরী রাহ. কিসসাটি উল্লেখ করার পর বলেন—
ذكره في شوارد الملح، وهو موضوع.
(ইবনুল জাওযী রাহ.) ‘শাওয়ারিদুল মুলাহ’ কিতাবে তা উল্লেখ করেছেন। আর এটি একটি জাল বর্ণনা। (দ্র. নুযহাতুল মাজালিস, খ. ২, পৃ. ৮৪)
আব্দুর রহমান সাফূরী রাহ.-এর কিতাব নুযহাতুল মাজালিসের বেশ কিছু বর্ণনা সম্পর্কে সুয়ূতী রাহ.-কে প্রশ্ন করা হয়; যার মধ্যে আমাদের আলোচ্য বর্ণনাও ছিল। তিনি কিছু বর্ণনার হুকুম আলোচনা করেন। এরপর এ বর্ণনাসহ আরো কিছু বর্ণনা সম্পর্কে বলেন—
وَمَا عَدَا ذلِكَ مِنَ الْأَحَادِيثِ الْمَسْؤُولِ عَنْهَا فَمَقْطُوعٌ بِبُطْلَانِهِ وَاللهُ أَعْلَمُ.
এছাড়া যেসকল বর্ণনা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছে, সেগুলো নিশ্চিতভাবে বাতিল ও ভিত্তিহীন বর্ণনা। (অর্থাৎ তাঁর মতে আমাদের আলোচ্য বর্ণনাও বাতিল ও ভিত্তিহীন।) (দ্রষ্টব্য : আলহাবী ফিল ফাতাবী, খ. ২, পৃ. ৪১-৬৪)
হাফেজ ইবনে হাজার হাইতামী রাহ. (মৃত্যু : ৯৭৪ হি.)-কে আমাদের আলোচ্য বর্ণনা এবং আরো কিছু বর্ণনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন—
هذِه الْأَحَادِيث كلهَا كذب مَوْضُوعَة، لَا يحل رِوَايَة شَيْء مِنْهَا،إِلَّا لبَيَان أَنَّهَا كذب مفترى على النَّبِي صلى الله عَلَيْهِ وَسلم.
এই বর্ণনাগুলো সবই মিথ্যা ও জাল। এগুলোর মিথ্যা ও বানোয়াট হওয়ার কথা প্রকাশের উদ্দেশ্যে ছাড়া তা বর্ণনা করা জায়েয নেই। (দ্র. আলফাতাওয়াল হাদীসিয়্যাহ, পৃ. ১২৪)
আলকাউসার