শনিবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

একটি ভিত্তিহীন কিসসা ইয়া সানাম! ইয়া সামাদ!

 প্রকাশিত: ১১:৪৭, ৩ অক্টোবর ২০২৩

একটি ভিত্তিহীন কিসসা ইয়া সানাম! ইয়া সামাদ!

লোকমুখে এ কিসসাটি বেশ প্রসিদ্ধ—

এক ব্যক্তি সত্তর বছর ধরে একটি মূর্তির পূজা করত। সে ইয়া সানাম! ইয়া সানাম! বলে প্রার্থনা করত।একদিন সে একটি প্রয়োজনে ইয়া সানাম! আগিছনী। হে মূর্তি আমাকে সাহায্য কর— এভাবে প্রার্থনা করছিল। কিন্তু মূর্তি কোনো সাড়া দিল না। একপর্যায়ে ভুলে মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল, ইয়া সামাদ! আগিছনী। হে ঐ সত্তা! সকলে যার মুখাপেক্ষী, যিনি কারো মুখাপেক্ষী নন; আমাকে সাহায্য করুন। অমনি আল্লাহ সাড়া দিলেন— গায়েব থেকে আওয়ায এল— লাব্বাইকা আবদী (বান্দা! আমি হাযির)। এবং সে যা প্রার্থনা করেছিল আল্লাহ তাকে তা দান করলেন।

ফিরিশতারা বলল, সে তো আপনাকে ডাকার উদ্দেশ্যে একথা বলেনি; তাহলে কেন তার ডাকে সাড়া দেবেন?

আল্লাহ বললেন, (মূর্তি তো তার ডাকে সাড়া দিতে পারে না।) আমিও যদি তার ডাকে সাড়া না দিই, তাহলে আমিও তো মূর্তির মতোই হয়ে গেলাম।

কেউ কেউ কিসসাটি এভাবেও বলে—সে যখন ‘ইয়া সামাদ!’ বলল, তখন আল্লাহ বললেন, বান্দা আমাকে ডেকেছে, আমি তার ডাকে সাড়া দিব। তার প্রার্থনা কবুল করব।

ফিরিশতারা বলল, সে তো আপনার সাথে শরীক করে। তাছাড়া সে ভুলে আপনাকে ডেকেছে।

তখন আল্লাহ বললেন, সে আমাকে ভুলক্রমে ডাকলেও আমি তার ডাকে সাড়া দিব। কারণ আমি ছাড়া আর কোনো ‘সামাদ’-এর অস্তিত্ব নেই।

এটি একটি ভিত্তিহীন কিসসা। নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্রে তা খুঁজে পাওয়া যায় না।

আবদুর রহমান সাফূরী রাহ. (মৃত্যু : ৮৯৯ হি.-এর পর) নিজ কিতাব ‘নুযহাতুল মাজালিস’-এ ‘হিকায়া’ (একটি ঘটনা) বলে এর কাছাকাছি একটি ঘটনা সনদবিহীন উল্লেখ করেছেন। সেখানে আছে—

হিন্দুস্তানে এক অশীতিপর বৃদ্ধ ছিল। সে দীর্ঘদিন থেকে একটি মূর্তির পূজা করত। একবার তার একটি প্রয়োজন দেখা দিল। সে মূর্তিটির কাছে কাকুতি-মিনতি করে সাহায্য প্রার্থনা করল; কিন্তু মূর্তিটি তার কোনো সাহায্য করতে পারল না। তখন সে বলল, হে মূর্তি! আমি দীর্ঘদিন থেকে তোমার পূজা করছি; আমার প্রতি দয়া কর...। তার পরও মূর্তিটি তার ডাকে সাড়া দিল না। সে মূর্তিটির কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার আশা ছেড়ে দিল। তার মনে উদিত হল, (এতদিন তো ‘সানাম’কে ডাকলাম), একটু ‘সামাদ’কে ডেকে দেখি।

সে আকাশের দিকে তাকায় এবং বলে, ইয়া সামাদ! সঙ্গে সঙ্গে গায়েব থেকে আওয়াজ আসে— বান্দা আমি হাযির। তোমার কী প্রয়োজন তুমি চাও। এরপর সে শিরক ছেড়ে দেয় এবং একত্ববাদে বিশ্বাসী হয়।

ফিরিশতারা বলে, হে আমাদের রব! সে দীর্ঘদিন ধরে তার মূর্তিকে ডেকেছে; কিন্তু তা সাড়া দেয়নি। আর মাত্র একবার ডাকতেই আপনি সাড়া দিলেন! তখন আল্লাহ বলেন, সে মূর্তিকে ডেকেছে; তা সাড়া দেয়নি। এখন আমাকে ডাকলেও যদি আমি সাড়া না দিই, তাহলে মূর্তি আর আমার মাঝে কী পার্থক্য হল!’ —নুযহাতুল মাজালিস, খ. ১, পৃ. ২৬

নুযহাতুল মাজালিস কিতাবটি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কিসসা-কাহিনীতে ভরপুর। এ কিতাব ও তার লেখক সাফূরী সম্পর্কে আমরা ইতিপূর্বে (শাওয়াল ১৪৪১/জুন ২০২০) এ বিভাগেই লিখেছি যে, এটি একটি অনির্ভরযোগ্য কিতাব। সুতরাং এর দ্বারা ঘটনাটি প্রমাণিত হয় না। 

এছাড়াও শামসুদ্দীন সাফীরী রাহ. (মৃত্যু : ৯৫৬ হি.) তার বুখারীর শরাহ ‘আলমাজালিসুল ওয়া‘যিয়্যাহ’-এ نقل الإخباريون ... (কিসসাকারগণ নকল করেছেন...) বলে সনদবিহীন কিসসাটি উল্লেখ করেন। (দ্রষ্টব্য : আলমাজালিসুল ওয়া‘যিয়্যাহ, খ. ১, পৃ. ২৮৬)

তার نقل الإخباريون ... (কিসসাকারগণ নকল করেছেন...) কথা থেকেই বুঝা যায়, এটি কিসসাকারগণ কতৃর্ক প্রসিদ্ধ একটি কিসসামাত্র। এর নির্ভরযোগ্য কোনো সনদ বা সূত্র নেই।

শায়েখ আবু ইসহাক আলহুওয়াইনী ‘ইসআফুল লাবীছ বিফাতাওয়াল হাদীস’ গ্রন্থে (বর্ণনা নং ২৫৫) আলোচ্য কিসসাটি উল্লেখ করার পর বলেন—

لا أصل له مرفوعا، وهو باطل.

নবীজীর হাদীস হিসেবে এর কোনো ভিত্তি নেই। এটি একটি বাতিল বর্ণনা।

যাইহোক, কিসসাটি হয়তো একটি প্রতিকী ঘটনা ছিল। পরবতীর্তে কেউ তাতে আরো কিছু বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে যে কথাটি মনে রাখা দরকার তা হল, শিরকযুক্ত দুআ ও শিরকযুক্ত ইবাদত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। দুনিয়াতে আল্লাহ তাআলা অমুসলিমের দুআও কবুল করতে পারেন; কিন্তু আখেরাতে সব বিচার ঈমান ও তাওহীদের ভিত্তিতে হবে।

Online News Portal 24