গুনাহ থেকে বাঁচার ও নফসকে প্রতিহত করার ৪টি চমৎকার কৌশল
ঈমানদারমাত্রই এইকথা বিশ্বাস করে যে, আমাদের কামিয়াবি হল আল্লাহ তাআলার হুকুম মানার ভিতর এবং নবীﷺ–এর তরিকা মানার ভিতর। বিপরীতে যদি আমরা আল্লাহর হুকুম না মেনে নবীজির তরীকা অনুসরণ না করে গুনাহ করতে থাকি তাহলে আমাদের জন্য ব্যর্থতা অবধারিত। ড. ইকবাল আমাদের অবস্থা দেখে যথার্থ বলেছেন যে, তোমরা বিশ্বাস করো একরকম কাজ করো ভিন্নরকম।
قلب میں سوز نہیں، رُوح میں احساس نہیں
کچھ بھی پیغامِ محمّدؐ کا تمھیں پاس نہیں
‘তোমাদের হৃদয়ে অনুভূতি নেই, অন্তরে জ্বালা নেই, মুহাম্মদের পয়গামের মর্যাদার তোমাদের কাছে নেই।’
আমরা চার শ্রেণীতে বিভক্ত
একটু চিন্তা করলে দেখা যায়, আল্লাহর হুকুম মানা এবং না মানার দিক থেকে আমরা চার শ্রেণীতে বিভক্ত।
এক. আমাদের মধ্যে কিছু লোক এমন আছে যারা ইবাদত করে, গুনাহও করে অর্থাৎ কিছু ইবাদত করে, কিছু গুনাহ করে।
দুই. কিছু লোক এমন আছে, যারা ইবাদতও করে না, গুনাহও করে না। ইবাদত করে না অলসতার কারণে। গুনাহ করে না জানা না থাকার কারণে। এদের সংখ্যা সমাজে নিতান্তই কম।
তিন . সমাজের মধ্যে কিছু দুর্ভাগা এমনও আছে, যারা কেবল গুনাহ করে, গুনাহের মাঝে আকণ্ঠ ডুবে থাকে, নেক আমল করার তাওফিক এদের মোটেও হয় না।
চার. এর বিপরীতে আল্লাহ তাআলার কিছু বান্দা এমনও আছেন যাঁরা কেবল নেক আমল করেন এবং গুনাহ থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করেন। এঁরাই আল্লাহ তাআলার খাস বান্দা। এরা আল্লাহর অলি।
নফল ইবাদত উত্তম না গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা উত্তম?
এখন প্রশ্ন হলো, নফল ইবাদত করা উত্তম না গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা উত্তম? আমরা তো মনে করি, ইবাদত বেশি বেশি করা উত্তম। কিন্তু আমাদের মাশায়েখগণ তা মনে করতেন না। বরং তাঁরা মনে করেন, নফল ইবাদতের চেয়েও বহু গুণে উত্তম হলো, গুনাহ না করা। কেননা, নফল ইবাদতের জন্য ধন্যবাদ পাবেন। সাওয়াব পাবেন। আখেরাতে আপনার মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু এর বিপরীতে কোনো জবাবদিহিতা নেই। অর্থাৎ না করলে কোনো গুনাহ নেই। পক্ষান্তরে গুনাহর জন্য জবাবদিহিতা আছে, শাস্তি আছে, আখেরাতের নাজাত থেকে বঞ্চিত হওয়ার মতো জঘন্য ব্যাপার আছে। মনে করুন, এক ব্যক্তি ফরজ ওয়াজিব সুন্নাতে মুআক্কাদা ঠিকভাবে আদায় করেছে। এক্ষেত্রে সে অলসতা কিংবা উদাসীনতাকে স্থান দেয় নি। কিন্তু সে অন্যান্য নফল আমল যেমন নফল নামাজ, নফল রোজা, নফল হজ, নফল সাদাকা খুব একটা করে নি। তবে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার পরিপূর্ণ চেষ্টা সে করেছে। তাহলে আল্লাহ তাআলার রহমতের প্রতি পূর্ণ আস্থা রেখে বলা যায় যে, এ ব্যক্তির নাজাত নিশ্চিত। কেননা, আল্লাহ তাআলা এটা জিজ্ঞেস করবেন না যে, কেন অমুক নফল আমল কর নি? তবে আল্লাহ তাআলা এটা অবশ্যই জিজ্ঞেস করবেন যে, কেন তুমি দরজা-বন্ধ করে গুনাহ করেছ? কেন তুমি রাত জেগে ইউটিউবে, ফেসবুকে, ইনস্ট্রাগ্রামে, ইমুতে গুনাহ করেছ? কেন তুমি চোখের হেফাজত কর নি? কেন তুমি জবানের হেফাজত কর নি?
এজন্যই আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি.-কে যখন জিজ্ঞেস করা হলো যে, এক ব্যক্তির ইবাদত কম, গুনাহও কম। আরেক ব্যক্তির ইবাদতও বেশি গুনাহও বেশি। এই দুই ব্যক্তির মাঝে উত্তম কে? তিনি উত্তর দিলেন,
لا أَعْدِلُ بِالسَّلامَةِ شَيْئًا
‘গুনাহ থেকে নিরাপদ থাকার মত সমকক্ষ আমল আমি কোনটিকে মনে করি না।’ (আদাবুদদুনয়া ওয়াদদীন ১/৯৮)
গুনাহ রিসিভ করার চার কাউন্টার
মুহতারাম হাজিরিন! সুতরাং এ পর্যায়ে আমাদের জানা প্রয়োজন ইবলিসের সরবরাহকৃত গুনাহগুলো রিসিভ করার জন্য আমাদের কোন কোন অঙ্গকে নফস কাউন্টার হিসেবে ব্যবহার করে?
এরকম অঙ্গ প্রধানত চারটি। ১. চোখ ২. জবান ৩. কান ৪. মস্তিষ্ক। সুতরাং যদি আমরা এই চারটি অঙ্গের হেফাজত করতে পারি তাহলে ব্যভিচার ও গীবত কিংবা হারাম খাদ্য গ্রহণ করা থেকে শুরু করে কুফরি পর্যন্ত কোন গুনাহই আমাদের দ্বারা ইবলিস কিংবা নফস করাতে পারবে না, ইন শা আল্লাহ। একারণেই আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِۦ عِلْمٌ ۚ إِنَّ ٱلسَّمْعَ وَٱلْبَصَرَ وَٱلْفُؤَادَ كُلُّ أُوْلَٰٓئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْـُٔولًا
যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, অযথা তার পিছনে পড়ো না। কেননা, কেয়ামতের দিন কান, চোখ ও অন্তর; এসব কয়টির ব্যবহার সম্পর্কে তোমাকে জিজ্ঞেস করা হবে। (সূরা ইসরা ৩৬)
১. চোখের হেফাজত করুন
দৃষ্টির লাগামহীনতা বহু অপরাধের প্রধান উৎস। ইবলিস পরনারীর চেহারা, সুদের টাকা ঘুষের পয়সা ইত্যাদিকে খুব নয়নলোভন পদ্ধতিতে উপস্থাপন করে। নফস তা চোখের মাধ্যেমে রিসিভ করে মজা ভোগ করে এবং নিজের মধ্যে পুষে রাখে। সুযোগ পেলেই তা ফুলে-ফেঁপে বিশাল হয়ে ওঠে। দেখুন, কাবিল হাবিলের স্ত্রীর রূপ-যৌবনের প্রতি কুদৃষ্টি দিয়েছিল। পরিণামে তার কাঁধে এমনই ভূত চড়ে বসেছিল, আপন ভাইকে হত্যা করতেও তার কলিজা কাঁপে নি। এজন্যই ইসলাম বলে, পরনারীর প্রতি, তার ফটো কিংবা ভিডিওর প্রতি; অনুরূপভাবে অন্যের সম্পদের প্রতি, অন্যের ঘরের প্রতি দৃষ্টি দিবে না। তোমার দৃষ্টির এই হেফাজত তোমার নফসের জন্য শাসন। কেমন যেন সে যা চেয়েছে তা তুমি তাকে দাও নি; বরং তুমি তার উপর চপেটাঘাত করলে। এতে ইবলিস নিরাশ হয়েছে আর অপরদিকে তোমার মালিক খুশি হয়েছেন। এজন্যই রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,
اَلنَّظْرَةُ سَهْمٌ مَسْمُوْمٌ مِنْ سِهَامِ اِبْلِيْسَ
দৃষ্টি হল ইবলিসের বিষাক্ত তীরসমূহের অন্যতম। (আলজাওয়াবুলকাফী ২০৪)
তুমি যদি এই তীর থেকে আত্মরক্ষা করতে পার তাহলে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, হাদিসে কুদসি–
مَنْ تَرَكَهَا مِنْ مَخَافَتِىْ اَبْدَلْتُهُ إِيْمَاناً يَجِدُ حَلَاوَتَه فِىْ قَلْبِه
যে আমার ভয়ে তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিবে, আমি অন্তরে এমন ঈমান সৃষ্টি করব, যাতে সে তার স্বাদ পাবে। (আততারগীব ওয়াততারহীব ২/৩৭)
২. জবানের হেফাজত করুন
জবানের লাগামহীনতাও অসংখ্য গুনাহেকে ডেকে আনে। মিথ্যা বলা, গীবত করা, গালি দেয়া, ঝগড়া করা, হারাম খাওয়া থেকে শুরু করে কোন অপরাধটা এই জবান দ্বারা করা যায় না! এ অপরাধগুলো ইবলিস লবণ মরিচ মাখিয়ে নফসের সামনে পেশ করে। নফস তা জবানের মধ্যমে গ্রহণ করে। এজন্যই হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
إِذَا أَصْبَحَ ابْنُ آدَمَ فَإِنَّ الأَعْضَاءَ كُلَّهَا تُكَفِّرُ اللِّسَانَ فَتَقُولُ اتَّقِ اللَّهَ فِينَا فَإِنَّمَا نَحْنُ بِكَ فَإِنِ اسْتَقَمْتَ اسْتَقَمْنَا وَإِنِ اعْوَجَجْتَ اعْوَجَجْنَا
আদম সন্তান যখন সকালে উপনীত হয়, তখন তার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জিভকে অত্যন্ত বিনীতভাবে নিবেদন করে যে, তুমি আমাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। কারণ, আমাদের ব্যাপারসমূহ তোমার সাথেই সম্পৃক্ত। যদি তুমি সোজা সরল থাক, তাহলে আমরাও সোজা-সরল থাকব। আর তুমি যদি বাঁকা পথে যাও তাহলে আমরাও বাঁকা পথে যেতে বাধ্য হব। (তিরমিযী ২৪০৭)
সুতরাং জবানকে হারাম কথা ও হারাম খানা থেকে হেফাজত করুন। এটাও নফসের উপর একপ্রকার শাসন। এর কারণেও ইবলিস নিরাশ হয় আর অপরদিকে আল্লাহ তাআলা খুশি হন। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, কোন বান্দার ঈমান দুরস্ত হয় না; যতক্ষণ পর্যন্ত না তার অন্তর দুরস্ত হয় এবং তার অন্তরও দুরস্ত হয় না যতক্ষণ পর্যন্ত না তার জবান দুরস্ত হয়। (মুসনাদে আহমাদ ১০৪০৮)
৩. কানের হেফাজত করুন
ইসলামের মূলনীতি হল, যা বলা হারাম, তা শোনাও হারাম। অবলীলায় যে কোনো কিছু শোনা অন্তরে মুনাফেকি সৃষ্টির অন্যতম কারণ। যেমন গান সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাযি. বলেন,
الْغِنَاءُ يُنْبِتُ النِّفَاقَ فِى الْقَلْبِ كَمَا يُنْبِتُ الْمَاءُ الزَّرْعَ
পানি যেমন ভূমিতে তৃণলতা উৎপন্ন করে তেমনি গান মানুষের অন্তরে নিফাক সৃষ্টি করে। (বাইহাকী ২১৫৩৬ তাফসীরে কুরতুবী ১৪/৫২)
কোরআন মজীদে আছে, ইবলিস আদম-সন্তানকে ধোঁকা দেওয়ার আরজি পেশ করলে আল্লাহ তাআলা ইবলিসকে সম্বোধন করে বলেন,
وَاسْتَفْزِزْ مَنِ اسْتَطَعْتَ مِنْهُمْ بِصَوْتِكَ
তোমার আওয়াজ দিয়ে তাদের মধ্যে যাকে পারো প্ররোচিত কর, সত্য থেকে বিমুখ করে দাও। (সূরা ইসরা ৬৪)
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন, যে সকল বস্তু পাপাচারের দিকে আহ্বান করে তাই ইবলিসের আওয়াজ। সুতরাং আপনি যদি সকল পাপাচার থেকে কানের হেফাজত করেন তাহলে এটাও হবে নফসের উপর শক্তিশালী শাসন এবং ইবলিসের জন্য বিশাল পেরেশানির কারণ। আর এতে আল্লাহ তাআলা খুশি হয়ে যাবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَاتَّقُوا اللّهَ وَاسْمَعُواْ
আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর। আর তোমাদেরকে যে উপদেশ দেয়া হচ্ছে তা ভালভাবে শোনো। (সূরা মায়েদা ১০৮)
৪. মস্তিষ্কের হেফাজত করুন
মুমিন বান্দা চাইলে তার ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সব কাজকেই মস্তিস্ক তথা চিন্তাশক্তির হেফাজতের মাধ্যমে নেকির কাজে পরিণত করতে পারে। দুনিয়ার কাজকেও ইতিবাচক নিয়তের মাধ্যমে ‘দীন’ করে নিতে পারে। আরেফ বিল্লাহ ডাঃ আব্দুল হাই আরেফী রহ. বলতেন,
دین زاویہ نگاہ کو بدلنے کا نام ہے
‘দীন দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের নাম।’
ইমাম বুখারি রহ. তাঁর বিখ্যাত হাদিস গ্রন্থ নিয়তের হাদিস দ্বারাই শুরু করেছেন। বিখ্যাত হাদিস গ্রন্থ বুখারি- হযরত আলক্বামাহ ইবনু ওয়াক্কাস আল-লাইসি থেকে বর্ণিত, আমি হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাযি.-কে মিম্বরের ওপর দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছি, আমি আল্লাহর রাসূল ﷺ–কে বলতে শুনেছি,
إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى، فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى دُنْيَا يُصِيبُهَا أَوْ إِلَى امْرَأَةٍ يَنْكِحُهَا فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ
নিশ্চয় প্রত্যেক কাজের প্রতিদান পাবে নিয়ত অনুযায়ী। আর মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী প্রতিফল পাবে। তাই যার হিজরত হবে দুনিয়া অথবা কোনো মহিলাকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে- তবে তার হিজরত সে উদ্দেশ্যেই হবে, যে জন্যে সে হিজরত করেছে। (সহীহ বুখারি ০১)
সুতরাং আপনি যদি মস্তিস্কের হেফাজত করেন, সব যা কিছু ভালো ও নেক আমল তা নিয়ে ভাবেন তাহলে এটাও হবে নফসের উপর শক্তিশালী শাসন এবং ইবলিসের জন্য বড় পেরেশানির কারণ।
আল্লাহ আমাদেরকে নেক নিয়ত, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, সুন্দর চিন্তা, কল্যাণমুখী মানসিকতা লালন করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
وَآخِرُ دَعْوَانَا اَنِ الْحَمْدُ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ
মুসলিম বাংলা