আলেমে রব্বানী হযরত মাওলানা আব্দুল হালীম রাহ.
ওলামাবাজারের হুজুর মাওলানা আব্দুল হালীম রাহ. একজন প্রাজ্ঞ আলেমে দ্বীন এবং সুন্নাহ্র অনুসারী আদর্শ ব্যক্তিত্ব হিসাবে দেশব্যাপী সুখ্যাত ছিলেন। লেখাপড়া শেষ করেন কোলকাতা আলিয়ায়। সরকারি প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে স্বাধীন কওমী মাদরাসাকে নিজের কর্মক্ষেত্ররূপে বেছে নেন। মন-মেযাজে ছিলেন আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের অনুসারী পাক্কা দেওবন্দী। তিনি হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী রাহ.-এর খলীফা শর্শদীর হযরত নূর বখশ রাহ. থেকে সুলূকের এজাযত লাভ করেন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ছিলেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সমর্থক।
মুফতী, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ইত্যাদি ভাবগম্ভীর ইলমী পরিভাষার অর্থ-গভীরতা, বিস্তৃতি ও ভারত্ব আমাদের অনুভব থেকে অনেকটা হারিয়ে গেছে। এই পরিভাষাগুলো এখন আমরা যত্রতত্র ব্যবহার করি। তাই প্রচলিত এসকল অবিধার কোন্টি দিয়ে হুজুরকে স্মরণ করব বুঝতে পারছি না। আসলে শুধু ‘আলেম’ শব্দের হাকীকত কত ব্যাপক ও গভীর, আমরা ভুলে গেছি। ‘আলিমু আহলিল মাদীনাহ’ শব্দবন্ধে ‘আলিম’ উপাধিটি কী পরিমাণ ওজনদার, আজকাল আমরা তা কল্পনাও করতে অক্ষম!
যাইহোক, ওলামাবাজারের হুজুর রাহ. ছিলেন একজন আলেমে রব্বানী, বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন আলেমেদ্বীন। সুন্দর সুষমামণ্ডিত চেহারা ও মাঝারি গড়নের দেহসৌষ্ঠবের অধিকারী, জাহেরী-বাতেনী সৌন্দর্যের আলোকআভায় উদ্ভাসিত এক নূরানী ব্যক্তিত্ব। তিনি ওলামাবাজার মাদরাসায় সহীহ মুসলিম পড়াতেন। মাদরাসার পরিচালনা, ইসলাহী কার্যক্রম ও ব্যক্তিগত ইবাদত-বন্দেগীতে অষ্টপ্রহর মগ্ন থাকতেন। তাঁর হাতে ওলামাবাজার মাদরাসার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। ইলমী, রূহানী ও তামিরী সব দিক থেকে মাদরাসার বুনিয়াদ পাকাপোক্ত হয়েছে। তাঁর ওসিলায় সারা দেশে মাদরাসার সুনাম ছড়িয়েছে।
ছাত্রজীবনে হুজুরকে কাছ থেকে দেখেছি, আদর-সোহাগও পেয়েছি। কিন্তু হুজুরের নিকট কোনো কিতাব পড়ার এবং হুজুরের ইলমী ব্যক্তিত্ব উপলব্ধি করার কোনো সুযোগ আমার হয়নি। সাদা চোখে হুজুরের হালাত যা দেখেছি, স্মৃতির পাতা থেকে কয়েকটি বিষয় তুলে ধরছি।
মশকে কেরাত
একেবারে ছোট বয়সে হুজুরের সাথে আমাদের চেনাজানা শুরু হয় মসজিদে, মশকে কেরাতের মজলিসে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যতম নববী দায়িত্ব ছিল কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা দেওয়া। ওয়ারিসে নবী হিসাবে এখন এই দায়িত্ব আলেমগণের উপর। এই অনুভূতি থেকে হুজুর প্রতিদিন আসরের পর ছাত্র-শিক্ষক ও সাধারণ মুসল্লিদের নিয়ে কুরআন মাজীদ মশক করতেন। মাখরাজ, সিফাত ও কাওয়ায়েদ সম্পর্কে আলোচনা করতেন। তিলাওয়াত সহীহ করার উপর গুরুত্বারোপ করতেন। নিয়মিত তিলাওয়াত করার জন্য তাকিদ করতেন। বলতেন, কুরআন তিলাওয়াত করলে কলব নরম হয়, দিল নূরানী হয়, আল্লাহ্র সাথে বান্দার সম্পর্ক গভীর হয়।
আমাদের হাল থেকে মনে হয়, কেমন যেন আমরা কুরআন মাজীদ মশক করানো, শিশুদেরকে আলিফ-বা-তা-ছা পড়ানো, আম মানুষকে তিলাওয়াত শেখানো ইত্যাদি কুরআনী খেদমতকে নিজেদের ‘শান-উপযোগী’ মনে করি না! একে আমরা কম পড়াশোনা করা লোকের কাজ মনে করি!-ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
দিলে যদি আফসোস থাকে আর ভিন্ন ব্যস্ততার কারণে ‘তিলাওয়াত’ শেখানোর নববী কাজে অংশ নিতে না পারি, তবে তো রক্ষা। অন্যথায় এই ‘হাল’ বড় খতরনাক! আল্লাহ তাআলা রক্ষা করুন। দ্বীনের যে কোনো কাজকে নিজের মাকামের চেয়ে অনেক অনেক বড় বলে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করার মতো ‘আকলে সালীম’ নসিব করুন-আমীন।
নামাযে খুশুখুযূ
সালাত সর্বোত্তম ইবাদত। সালাত সুন্দর হলে অন্য ইবাদতও সুন্দর হতে থাকে। সুন্দরের মাপকাঠি সুন্নত। নামায যেন সুন্নত মতো হয়, এজন্য হুজুরের চেষ্টার কমতি ছিল না। হুজুরের ইসলাহী কার্যক্রমের বিরাট অংশ হত সুন্নত মতো নামায আদায়ের প্রশিক্ষণ। সালাতের বাহ্যিক দিক তথা কিয়াম, কেরাত, রুকু, সাজদা হুজুর নিজেই অনুশীলন করাতেন। আর সালাতের রূহ এবং খুশুখুযূ, স্থিরতা-একাগ্রতা, বিনয় ও মনোযোগ ইত্যাদি কীভাবে অর্জিত হবে, এ বিষয়ে প্রায়ই বয়ান করতেন।
হুজুরের সালাত ছিল বড় জানদার। সাদা সুন্নতি জামা-পাগড়ি ও শুভ্র শ্মশ্রু-মণ্ডিত জ্যোতির্ময় মানুষটি যখন নামাযে দাঁড়াতেন, তখন মাহবুবে হাকীকীর ধ্যানে বিলকুল নিমগ্ন হয়ে যেতেন। সাজদায় গেলে মনে হত, হুজুরের দেহ-সত্তার সাথেসাথে আশপাশের সবকিছু আল্লাহ্র দরবারে লুটিয়ে পড়ছে। মাদরাসায় থাকলে প্রায়ই ইমামতি করতেন। তখন এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না। মসজিদ ছিল টিনের ছাপড়া। মনে পড়ে, গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমেও হুজুর প্রশান্তির সাথে ‘তিওয়ালে মুফাসসাল’ দিয়ে যোহর পড়াতেন। মসজিদ জুড়ে বিশেষ একটা সুকূন বিরাজ করত।
মাসনূন দুআর তালীম
ছাত্র-শিক্ষকের মজলিসে হুজুর মাসনূন দুআর তালীম দিতেন। খাসভাবেও বিভিন্নজনকে মাসনূন দুআ শেখাতেন। মুমিনের চব্বিশ ঘণ্টার জীবনে যত হালত আসে, সব হালতে নবীজী যেসমস্ত দুআ শিক্ষা দিয়েছেন, সেই নূরানী দুআগুলো ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুন ও সভ্যতার অন্যতম বুনিয়াদ। দুআগুলো মানুষকে আল্লাহমুখী করে। আল্লাহ্র সাথে বান্দার সম্পর্ক গাঢ় করে। হুজুর এই দুআগুলোর প্রতি খুব জোর দিতেন।
ইলমী ইনহিমাকের গল্প
ইলমী ইনহিমাক তথা গভীর মনোনিবেশ ছাড়া ইলমী মাকাম অতিক্রম করা যায় না। মনে পড়ে, এ বিষয়ে প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবী রাহ.-এর ঘটনা হুজুর ছাত্রদেরকে শোনাতেন। একবার লাখনবী রাহ. মুতালাআয় মগ্ন। এমন সময় পানি চাইলেন। লাখনবি রাহ.-এর বাবা মাওলনা আব্দুল হালীম রাহ. এই ভেবে মনক্ষুণ্ন হলেন যে, ছেলের পড়ায় মন নেই! মা বললেন, আচ্ছা পরীক্ষা করেই দেখি! তিনি পানির সাথে সিরকা মিশিয়ে দিলেন। লাখনবী রাহ. ঐ সিরকা-পানি বেমালুম গিলে ফেললেন, তাঁর ভিতর কোনো প্রতিক্রিয়া হল না। তখন বাবা শোকর আদায় করলেন-ছেলের পড়ায় মন আছে, আলহামদু লিল্লাহ। ওলামাবাজারের হুজুর রাহ. বলতেন, লেখাপড়ায় এরকম মনোযোগ থাকলে ইলম হাসিল হবে, অন্যথায় বিশেষ কোনো লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারবে না।
‘শফীক’ মুহতামিম
ব্যক্তিত্বের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধার কারণে যে ভয়-বিহ্বলতা সৃষ্টি হয়, তাকে ‘হাইবত’ বলে। এটা আল্লাহ তাআলার নিআমত। এই রো‘ব ও হাইবত ওলামাবাজারের হুজুরের ব্যক্তিত্বের মাঝে যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান ছিল। মাদরাসার সকল ছাত্র-শিক্ষকের উপর হুজুরের প্রভাব ও প্রতাপ পরিদৃশ্যমান ছিল। সাথেসাথে হুজুর ছাত্র-শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখতেন। হুজুরের প্রতি সবাই একধরনের আপনত্ব অনুভব করত।
যুহদ ও কানাআত
মুমিন ব্যক্তি দুনিয়াবী বস্তু-সামগ্রী প্রয়োজনে ব্যবহার করে, কিন্তু এর প্রতি তাঁর আগ্রহ-আসক্তি থাকে না। শয়নে-স্বপনে তার উদ্দিষ্ট থাকে আখেরাত; এর নাম যুহদ (দুনিয়াবিমুখতা)। যুহদের বিভিন্ন স্তর আছে। দুনিয়ার লোভ-লিপ্সা না থাকলে ধনী হয়েও যাহিদ হওয়া যায়, যে তার ধন-সম্পদ আখেরাত সাজানোর কাজে ব্যয় করে। আবার একজন দরিদ্র হয়েও দুনিয়াদার হতে পারে, যে দুনিয়ার জন্য আখেরাত ভুলে যায়।
যুহদ একজন আলেমের আলেমানা-যিন্দেগীর অপরিহার্য অনুষঙ্গ। ওলামাবাজারের হুজুর রাহ.-এর জীবন এর ব্যতিক্রম ছিল না। বলতে গেলে কুঁড়ে ঘরে জীবন পার করেছেন। উপার্জনের নিশ্চিত কোনো মাধ্যম ছিল না। মাদরাসা থেকেও ওজিফা নিতেন না। ভক্তিপূর্ণ অল্পস্বল্প হাদিয়া-তোহফা যা আসত, তার উপরই দিনাতিপাত করতেন। দেশ-বিদেশে সফর করেছেন। তৎকালীন বাংলাদেশের বড় ধনকুবের জহুরুল ইসলাম সাহেব হুজুরের বিশেষ অনুরক্ত ছিল। কিন্তু হুজুরের অন্তর অর্থবিত্তের প্রতি কখনো আকর্ষিত হয়নি।
ইত্তিবায়ে সুন্নত
সুন্নাহ্র প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসা ছিল ওলামাবাজারের হুজুর রাহ.-এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সুনানে হুদা তো বটেই, হুজুর মেযাজে শরীয়ত অনুযায়ী সুনানে আদিয়ারও আশেক ছিলেন। মূলত আল্লাহ তাআলার মাহবুব বান্দা হওয়ার একমাত্র উপায় সুন্নাহ্র অনুসরণ। একবারের ঘটনা। আমার শ্বশুর মাওলানা উবায়দুল হক রাহ. ছিলেন হুজুরের আত্মীয়। তিনি জরুরি কিছু কথার জন্য আমাকে এবং হুজুরকে নিয়ে ফেনী শহরের একটি নিরিবিলি হোটেলে প্রবেশ করলেন। চেয়ার-টেবিলে সাজানো হোটেল, সমতলে বসার ব্যবস্থা নেই। এক পাশে লম্বা একটি বেঞ্চ ছিল। হুজুর পা তুলে ঐ বেঞ্চে বসলেন। নিজের রুমাল দিয়ে দস্তরখান বানালেন। চটজলদি কথা সেরে বের হয়ে আসলেন।
চেয়ার-টেবিলে আহার করা জায়েয। কিন্তু নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম সমতলে বসে আহার করতেন, চেয়ার-টেবিলে আহার করেননি। হাদীস শরীফে এসেছে-নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যু অবধি কখনো ‘খিওয়ান’ (টেবিল)-এ আহার করেননি। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪৫০) আমাদের আকাবির সুন্নতে নববীর সামান্য সামান্য তাকাজার উপর কতটা মজবুত ছিলেন!
আল্লাহ্র দরবারে রোনাজারি
সম্ভবত কাফিয়া পড়ার বছর। খতীবে আযম সিদ্দীক আহমদ রাহ. তাশরীফ আনলেন। ছাত্র-শিক্ষকদের ভরা মজলিসে হযরতের বয়ান হল। দুআর মধ্যে খতীবে আযম রাহ. বড় ‘দিলছোয’ কণ্ঠে ইকবাল মরহুমের কয়েকটি শের আবৃত্তি করলেন-
تو غنی از ہر دو عالم من فقير + روز محشر عذرہائے من پذير
ور حسابم را بگيری ناگزير + از نگاه مصطفی پنہاں بگير
(আয় আল্লাহ! তুমি দোজাহানের অমুখাপেক্ষী বাদশাহ! আর আমি কপর্দকশূন্য নিতান্ত ফকির।/ হাশরের ময়দানে আমার ওজর কবুল করো।/ যদি হিসাব নেয়া শুরু করো তবে উপায় থাকবে না।/ নবীজীর সামনে আমাকে শরমিন্দা করো না।)
সেদিন দেখলাম, ওলামাজারের হুজুর রাহ. কাঁদতে কাঁদতে বেখুদ হয়ে গেলেন। কান্নার গমগমে গোটা মজলিস ভারী হয়ে গেলে।
আল্লাহ্র ভয় ও মহব্বতে রোনাজারি মুমিনের সিফাত। এই সিফাত আল্লাহ সবাইকে দান করুন।
يا الہی دے مجھے دے رونے والی آنكھ دے + تا كہ ميں روتا رہوں تيرے رضا كے واسطے
মাওয়ায়েযে হাসানা
ওয়ায-নসীহতের মৌলিক আদব হল ইখলাস ও দরদ। যে বয়ানে এ দুই গুণ থাকে, সে বয়ান শ্রোতার মনে রেখাপাত করে, জীবনে পরিবর্তন আনে। ওলামাবাজারের হুজুর রাহ. মানুষের হেদায়েত ও ইসলাহের উদ্দেশ্যে দেশ-বিদেশে বহু ওয়ায-নসীহত করেছেন। ওয়াযের জন্য নোয়াখালীর হাতিয়া অঞ্চলে গেলে একনাগাড়ে পনের-বিশ দিন অবস্থান করতেন। হুজুরের সান্নিধ্যে বহু মানুষ আল্লাহমুখী হয়েছে, দ্বীনী যিন্দেগী আপন করে নিয়েছে।
সুন্নতী জীবন গঠনের জন্য হুজুর ওয়ায করতেন। দ্বীনের বুনিয়াদী বিষয় ও জরুরি মাসআলা তুলে ধরতেন। আয়াত ও হাদীস প্রচুর পরিমাণে বলতেন। কিচ্ছা-কাহিনী বলতেন না। হুজুরের সুমধুর তিলাওয়াত শ্রোতাদের মুগ্ধ করত। মনে পড়ে, ‘এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি... খোদা তোমার মেহেরবানি’ এই হামদ-সঙ্গীতটিও আবেগাপ্লুত কণ্ঠে গাইতেন। শের-আশআরও বলতেন। হুজুরের যবানে শোনা কয়েকটি শের-
ايں درگہ ما درگہ نا اميد نيست + صد بار اگر توبہا شكستی باز آ باز آ
گر كفر و گبر و بت پرستی باز آ باز آ + ہر آنچہ ہستی باز آ باز آ
جاں ديدی تو دی ہوئی اسی كی ہے + حق تو يہ ہے كہ حق ادا نہ ہوا
তাযকিয়া ও তাসাওউফ
ভিতরের মন্দ স্বভাব নিয়ন্ত্রণ করা (তাখলিয়া) আর সৎ স্বভাব দ্বারা অন্তর্জগৎ সজ্জিত (তাহলিয়া) করার নাম তাযকিয়া। কুফর-শিরক ও যাবতীয় গোনাহের প্রতি ঘৃণা বোধ এবং দ্বীন-শরীয়তের প্রতি মহব্বত পোষণ, এখলাস, এহসান এবং তাযাক্কুরের সিফত অর্জন ইত্যাদি হল তাসাউফের উদ্দেশ্য। এক স্তর পর্যন্ত তাযকিয়া অর্জন করা সবার উর ফরয। এই তাযকিয়া ছিল নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যতম নববী দায়িত্ব। ওয়ারিসে নবী হিসাবে এই দায়িত্ব এখন আলেমগণের উপর।
ওলাবাজারের হুজুর রাহ. তাযকিয়ার জন্য তাসাওউফের মোবাহ তরীকার পরিবর্তে প্রধানত মাসনূন তরীকা অবলম্ব করতেন। মুরিদানকে ফরয ইবাদতগুলোর সাথে নফল ইবাদতসমূহের প্রতি মনোযোগ দান, হারাম ও গুনাহ থেকে বাঁচা, কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত, সুন্নতের অনুসরণ, মাসনূন দুআ-দরূদ পাঠ ইত্যাদির তালকীন করতেন। তালীমের জন্য কখনো কখনো বাদ আছর এজতেমায়ী জিকির করতেন। হুজুরের প্রধান খলীফা মাওলানা আহমদ করীম মুহাদ্দিস ছাহেব রাহ. জিকিরের মজলিস পরিচালনা করতেন। তিনি মাঝেমাঝে বেদনাবিধূর কণ্ঠে খাজা আযীযুল হাসান মাজযূব রাহ.-এর শেরগুলো আবৃত্তি করতেন-
تيرے سوا معبود حقيقی كوئی نہيں ہے كوئی نہيں + تيرے سوا محبوب حقيقی كوئی نہيں ہے كوئی نہيں
تيرے سوا مقصود حقيقی كوئی نہيں ہے كوئی نہيں + تيرے سوا موجود حقيقی كوئی نہيں ہے كوئی نہيں
ہر تمنا دل سے رخصت ہوگئی + اب تو آجا اب تو خلوت ہوگئی
তখন হৃদয়-সরোবরে এশকে মাওলার এক অনির্বচনীয় ঢেউ জাগত। চোখে অশ্রুর বন্যা নামত।
হুজুরের খলীফাগণ
হযরত মাওলানা আহমদ করীম মুহাদ্দিস ছাহেব রাহ. ছিলেন হুজুরের প্রধান খলীফা। মাদরাসার তালীম-তরবিয়ত, অভ্যন্তরীণ প্রশাসন তাঁর উপর ন্যস্ত ছিল। তাঁর ইলমের গভীরতা, বিচক্ষণতা এবং তাকওয়া-তাহারাতের উপর হুজুরের আস্থা ছিল। দ্বিতীয় খলীফা মাদরাসার বর্তমান মুহতামিম ও শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা নুরুল ইসলাম আদীব ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম। হুজুর তাঁর মেধা-মনন, আরবী-উর্দু সাহিত্য, বিস্তৃত মুতালাআ ও রুচিশিলতার প্রশংসা করতেন। আরেকজন বিশিষ্ট খলিফা মধুপুরের পীর মাওলনা আব্দুল হামীদ দামাত বারাকাতুহুম। তিনি হুজুরের একজন আশেক, হুজুরের নামে মধুপুরে একটি বড় মাদরাসা করেছেন।
পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের খেদমত
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা ইসলামের অনেক বড় শিক্ষা। কাছের-দূরের এবং বংশগত ও বৈবাহিক-সকল আত্মীয়ের খোঁজখবর রাখা ইসলামী সমাজ ও সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য। ওলামাবাজারের হুজুর রাহ. তাঁর সকল আত্মীয়ের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হতেন। ভাই-বেরাদার, নাতি-নাতনি, নাতিন জামাই সবার জন্য অকাতরে খরচ করতেন, সফরে গেলে হাদিয়া আনতেন। সব আত্মীয়কে হুজুর নিজের পরিবারের সদস্যের মতো জানতেন। সবাইকে স্নেহ-মমতা দিয়ে সিক্ত রাখতেন।
হুজুর ছিলেন বিনয়ী মানুষ। ছোট ছোট অনেক কাজ নিজ হাতেই করতেন। পরিবারের কাজে অংশ নিতেন। সোনাগাজি-ওলামাবাজারের রাস্তার পাশে যে খাল, ঐ খালে লুঙ্গি-গেঞ্জি আর টুপি পরে কখনো কখনো জাল মারতেন, মাছ ধরতেন! আমি নিজে সে দৃশ্য দেখেছি। অথচ তখন তিনি পীরে কামেল! হাজারো মানুষের মুরব্বী! বিশাল মাদরাসার প্রতাপশালী মুহতামিম!
সিয়াসত ও রাজনীতি
জাতির ভিতর ইসলামী শাসনের চেতনা তৈরি এবং বিদ্যমান শাসক ও শাসনপদ্ধতির উপর প্রভাব বিস্তারের চিন্তা থেকে ওলামাবাজারের হুজুর রাহ. সত্তুরের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেন এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের পক্ষ থেকে খেজুর গাছ মার্কায় প্রার্থী হন। বাংলাদেশ হওয়ার পর জাতীয় রাজনীতি ও দ্বীনী কাজে হুজুর কায়েদে জমিয়ত মাওলনা শামসুদ্দীন কাসেমী রাহ.-এর উপর আস্থা রাখতেন। বিভিন্ন সভা-সমাবেশেও অংশ নিতেন।
খণ্ডখণ্ড ব্যক্তিগত স্মৃতি
১. পাঁচ বোন এক ভাই আমরা। চার বোনই বড়। আব্বাজান রাহ. বলতেন, ওলামাবাজারের হুজুর রাহ.-এর দুআর বরকতে আমার একমাত্র ছেলের জন্ম হয়েছে, তিনিই নাম রেখেছেন আবু সাবের আব্দুল্লাহ।
২. আমাদের ঘর-বাড়ি ওলামাবাজার মাদরাসার দেয়াল ঘেঁষে। শুরু থেকে লেখাপড়া ওলামাবাজার মাদরাসায়। ভালই চলছিল পড়ালেখা। কিন্তু আমি অনুভব করলাম, যত বেড়ে উঠছি, তত লেখাপড়ায় ব্যাঘাত বাড়ছে। কারণ দিন দিন আব্বাজান রাহ.-এর ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে আঁটকে যাচ্ছি। তখনও তো ছোটই, আমার দ্বারা কী আর দোকানদারি হবে! আসল ব্যাপার ছিল, আব্বাজান রাহ. আমাকে চোখের আড়াল হতে দিতেন না। খেলাধুলা বা ঘোরাঘুরির অভ্যাস-আগ্রহ মোটেই ছিল না। তবু দরস শেষ হওয়া মাত্রই দোকানে হাজির হওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। অথচ আমার মন চাইত মাদরাসায় পড়ে থাকি, নিরিবিলি পড়ি লিখি। কিন্তু আব্বাজান কোনো কথা শুনতেন না। এই পরিবেশ বদলানোর জন্য কাফিয়ার বছর পালিয়ে গিয়ে হাটহাজারী ভর্তি হলাম।
আব্বাজান মরহুম বিচ্ছেদ সইতে পারলেন না। তিনি ওলামাবাজারের হুজুর রাহ.-এর দরবারে এসে অশ্রুসিক্ত হয়ে গেলেন। হুজুর তৎক্ষণাৎ বড় ভগ্নিপতি হযরত মাওলনা আহমদ করীম মুহাদ্দিস ছাহেব রাহ.-কে পাঠিয়ে আমাকে নিয়ে আসলেন। হুজুর বললেন, ‘আমরা আর কত দিন থাকব, তোমরাই তো মাদরাসার হাল ধরবে!’
এরপর আগের মতো আবার সবক-তাকরারের সময় মাদরাসায়, বাকি সময় দোকানে। ঐসময় ছোট্ট বাজারের মুদি দোকানে অত খরিদদার ছিল না। টুকটাক বেচাবিক্রি করতাম, আর মুতালাআয় মগ্ন থাকতাম। ক্রেতা আসলে বিরক্তও হতাম। দোকানে বসেই দারুল মুতালাআর বহু কিতাব ও রেসালা পড়েছি। এমনকি সোনাগাজি থেকেও বই আনিয়ে পড়েছি। এভাবে দরস, দোকানদারি আর এজাফী মোতালা-এই তিন কাজে কেটে গেল কাফিয়া, শরহে জামি, শরহে বেকায়া ও হেদায়ার বছর।
এতদিন আমি ছিলাম দোকানে আব্বার অতি সামান্য সহযোগী। কিন্তু আব্বা ধীরেধীরে পুরো দোকান আমার উপর ছেড়ে দিতে লাগলেন, বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া প্রায়ই গায়রে হাজির হতে লাগলেন। এদিকে আমি যত উপরে উঠছি, লেখাপড়ার চাপও বাড়ছে, প্রতিযোগিতা বাড়ছে। তখন কোনো দিশা না পেয়ে জালালাইনের বছর আবার না জানিয়ে, মুছাপুরী হুজুর দামাত বারাকাতুহুমের ছেলে মাওলানা আব্দুর রহমান ছাহেবের সঙ্গে ঢাকায় চলে এলাম। মালিবাগ মাদরাসায় ভর্তি হলাম।
এবারও আব্বাজান রাহ. ওলামাবাজারের হুজুরের দ্বারস্থ হলেন। হুজুর বললেন, ‘কয়বার আনবেন? ছেলে আকেল-বালেগ হয়েছে, দুআ করেন, পছন্দমতো লেখাপড়া করতে দেন।’ কিচ্ছা শুনে মুহতারাম মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম বললেন, ‘হুজুরের উভয় ফায়সালা আপনার জন্য কল্যাণকর হয়েছে।’ আলহামদু লিল্লাহ।
آناں كہ خاك را بنظر كيميا كنند + آيا بود كہ گوشہ چشمےۓبما كنند
৩. হযরত সায়্যিদ আসআদ মাদানী রাহ.-এর আগমন উলক্ষে ফেনীর মিজান ময়দানে মাহফিল। আমি তখন মালিবাগ মাদরাসায় মেশকাত জামাতে পড়ি। আব্বাজান হাজী আব্দুর রব সওদাগর রাহ. তখনই পুরোদমে আমার বিবাহের তোড়জোড় শুরু করলেন। ওলামাবাজারের হুজুর রাহ.-এর পরামর্শে এক জায়গায় আলোচনা অনেক দূর অগ্রসর করে ফেললেন। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে আমি হযরত কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রাহ.-কে ওলামাবাজারের হুজুর রাহ.-এর নিকট সুপারিশ করার অনুরোধ করলাম, যেন একটি বছরের জন্য হলেও বিয়ের সিদ্ধান্ত মুলতবি করা হয়। কাজী সাহেব হুজুর বিষয়টি তুলে ধরলেন। কিন্তু মাহফিলে উপস্থিত হযরত আব্দুল করীম শায়খে কৌড়িয়া রাহ. এবং ওলামাবাজারের হুজুর রাহ. দুজনেই বললেন, বিশেষ কোনো সমস্যা না থাকলে উপযুক্ত ছেলে-মেয়ের বিবাহ বিলম্বিত না করা সুন্নত। উপরন্তু পরিবারে বৃদ্ধ মা-বাবা ছাড়া কেউ নেই, এই বিয়ে তাদেরও প্রয়োজন। কাজী সাহেব রাহ.-কে হুজুর বললেন, ‘ইনশাআল্লাহ, অনেক খায়র ও বরকত হবে!’
বিয়ের বেশ কিছু দিন পর হুজুরের সাথে দেখা করার সুযোগ হল। হুজুর মুচকি হেসে বললেন, ‘বাবু! ঠগাইছি তোমাকে?!’ সত্যি বলতে কি, এটাও ছিল আমার প্রতি হুজুরের অনেক বড় ইহসান।
১৯৯১ সনের দোসরা ডিসেম্বর হুজুর ইন্তেকাল করেন। জানাযায় হাজির হতে পারিনি। দূর থেকে দুআ করেছি। হুজুরকে বহুবার স্বপ্নে দেখেছি। হাসিখুশি ও প্রফুল্ল অবস্থায় দেখেছি। একবার দেখলাম, হুজুর আপন কবরের উপর বসে জিকির করছেন।
আল্লাহ তাআলা হুজুরকে জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম নসিব করুন। তাঁর আলেমানা গুণাবলি আমাদেরকেও দান করুন-আমীন। হ
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العلمين.
অনলাইন নিউজ পোর্টাল