ইউরো সফরের গল্প: পর্ব-৩ | প্যারিস আর ডাচ শহরে অভিযান

বৃষ্টিভেজা দিনে প্যারিসের পথে, দোতলা ট্রেন থেকে আইফেল টাওয়ার পর্যন্ত এক ভ্রমণ-রোমাঞ্চ।
ভোরবেলা সময়মতো পৌঁছে গেলাম স্টুটগার্ট স্টেশনে। প্যারিসের ট্রেন আসতে তখনো ঘণ্টাখানেক দেরি। ভাবলাম, মালপত্র রেখে কাছাকাছি পুরোনো স্টুটগার্টটা একটু ঘুরে দেখি। কিন্তু প্রকৃতির বাধা—ঝরঝরে বৃষ্টিতে পুরো সময়টাই কাটল স্টেশনের অপেক্ষা কক্ষে।
অল্প কিছুটা ঘুমিয়ে নিয়ে উঠে পড়লাম ফ্রান্সের বিখ্যাত টিজিভি দোতলা দ্রুতি ট্রেনে। ঝকঝকে পরিপাটি ট্রেন, সঙ্গে ফ্রি ওয়াই-ফাই। আমার আসন পড়েছিল দোতলার জানালার পাশে—দারুণ ভিউ! তবে আমার দুই ভ্রমণসঙ্গী জায়গা পেয়েছে অন্য বগিতে, তাই একা একাই ফেসবুকিং করতে করতে জানালা দিয়ে পথের দৃশ্য উপভোগ করছিলাম। সামনের আসনে বসা একদল মার্কিন তরুণ-তরুণী প্রাণ খুলে আড্ডা দিচ্ছিল, যাদের হাসি-ঠাট্টা দেখে মনটা আরও ফুরফুরে লাগছিল। ওদের দেখে নিজের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক টাকার বাসযাত্রার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল।
এভাবে ভাবতে ভাবতেই পৌঁছে গেলাম প্যারিস।
গারে দ্য এস্ট স্টেশনে নেমে কিনে নিলাম দুই দিনের ‘প্যারিস পাস’। মেট্রো ধরে রওনা হলাম আমাদের এয়ারবিএনবির দিকে। বাইরে তখনো টিপটিপ বৃষ্টি, তাই ভিজেই পৌঁছাতে হলো থাকার জায়গায়।
সামান্য বিশ্রাম আর পোশাক বদলেই বেরিয়ে পড়লাম প্যারিস অভিযানে। প্রথম গন্তব্য—মঁমার্ত্রের উঁচু টিলায় অবস্থিত বিখ্যাত Sacre-Coeur Basilica। বিশাল সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পুরো প্যারিস দেখা যায়। বৃষ্টি উপেক্ষা করে শত শত পর্যটক তখনও ব্যস্ত ছবি তুলতে।
বৃষ্টির কারণে গির্জার ভেতরে প্রায় ঘণ্টাখানেক কাটাতে হলো। টিলার নিচে গড়ে উঠেছে চিত্রশিল্পীদের বসতি। এখানেই দেখা মিলল ঐতিহাসিক ক্যাবারে মুলাঁ রুজ আর তার বিখ্যাত ঘূর্ণায়মান লাল বায়ুকলের।
এরপর মেট্রো ধরে গেলাম প্যারিসের নামকরা শপিং মল গ্যালারি লাফায়েত-এ। ছাদ থেকে সূর্যাস্ত দেখার আশায় গিয়েছিলাম, কিন্তু বৃষ্টির কারণে ছাদ ছিল বন্ধ। তাই নিচে বসেই চকলেট আর কফির স্বাদে কাটল সন্ধ্যা।
সন্ধ্যার পর ছাতা মাথায় বেরিয়ে পড়লাম আইফেল টাওয়ার দেখতে। বৃষ্টির জন্য ওপরে ওঠার অনুমতি না থাকলেও পাশের ট্রোকাডেরো চত্বর থেকে রাতের ঝলমলে আইফেল টাওয়ারের অসাধারণ দৃশ্য উপভোগ করলাম। আশপাশে ক্লাবের গগনবিদারী শব্দে যেন পুরো এলাকা গমগম করছিল, সেটাও একধরনের পরিবেশ তৈরি করেছিল।
এরপর হাঁটতে হাঁটতে এলাম প্যারিসের বিখ্যাত Champs-Élysées Avenue ধরে Arc de Triomphe-এর কাছে। অনেকটা আমাদের দিল্লি গেটের মতো, এটি প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত ফরাসি সৈনিক এবং উপনিবেশের সেনাদের স্মরণে নির্মিত। এখান থেকেই ছয়-সাতটি রাস্তা ছড়িয়ে গেছে প্যারিসের নানা প্রান্তে।
রাতের শ্যঁজে এলিজে মুগ্ধ করার মতো। রঙিন আলো, ভিড় আর সেই চিরচেনা প্যারিসিয়ান প্রাণচাঞ্চল্য। এক চকলেটের দোকান থেকে অল্প কিছু চকলেট কিনলাম, আর পাশের ম্যাকডোনাল্ডস-এ সাশ্রয়ী রাতের খাবার সেরে নিলাম।
এই রাজপথের এক প্রান্ত গিয়ে মিশেছে বিখ্যাত ল্যুভর জাদুঘর এলাকায়, আরেক প্রান্ত ছুটে গেছে আধুনিক La Défense অঞ্চলের সুউচ্চ ভবনের দিকে।
রাত বাড়ছিল, শহরের কোলাহল থেমে আসছিল। আমরাও সেই রাতের জন্য বিদায় জানালাম প্যারিসের পথ থেকে।