‘ভালো বন্ধু’ টিউলিপকে বরখাস্ত করার মত কঠোর হতে পারবেন স্টারমার?
গত জুলাই মাসে ভোটে জয়ের পর লেবার নেতা কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে টিউলিপ সিদ্দিক। ফাইল ছবি
ব্রিটিশ লেবার পার্টির টিকেটে প্রথমবার এমপি হওয়ার পর কিয়ার স্টারমার তার প্রথম বিদেশ সফরে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স বা জার্মানির মত ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশে না গিয়ে বহু দূরের দেশ বাংলাদেশের ফ্লাইটে চড়ে বসেন।
২০১৬ সালের সেই সফরে তিনি ঢাকা আর সিলেট ঘুরে দেখেন। দামি স্যুট পরে তার বস্তির মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি হয়। এক সপ্তাহের সেই সফরে বস্তির গরিব মানুষের অদম্য মনোবল দেখে আপ্লুত হওয়ার গল্প নিয়ে পরে তিনি লন্ডনের পত্রিকায় কলামও লেখেন।
১২০০ পাউন্ডের সেই সফরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়েছিল তরুণ ব্রিটিশ এমপি স্টারমারের। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের একটি সই করা ছবি তিনি উপহার দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইল লিখেছে, কেউ হয়ত এটাকে সামান্য উপহার ভাবতে পারেন। কিন্তু ওই সাক্ষাতের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের তখনকার নেত্রীর সঙ্গে আজকের স্যার কিয়ার স্টারমারের দীর্ঘ বন্ধুত্বের সূচনা হয়েছিল।
কয়েক মাস পর হাসিনার দল আওয়ামী লীগের যুক্তরাজ্য শাখার একদল প্রতিনিধি স্টারমারের পরবর্তী নির্বাচনের জন্য তহবিল সংগ্রহের ডিনারে যোগ দেন। ২০১৯ সালের নির্বাচনে হাসিনার দলের প্রবাসী কর্মীরা মহা সমারোহে যোগ দেন স্টারমারের নির্বাচনি প্রচারে।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে রানির শেষকৃত্যে যোগ দিতে লন্ডনে যান শেখ হাসিনা। সে সময় হোটেল কক্ষে গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন লেবার নেতা স্টারমার। ওই সাক্ষাতেই দুজনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক একটি পোক্ত চেহারা পায়। পরে স্টারমারের বিবৃতিতেও এই সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় জানানো হয়।
ডেইলি মেইল লিখেছে, গতবছর জুলাই মাসে যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের যুক্তরাজ্য শাখার কর্মীরা স্টারমারের ভোটের প্রচারে নামেন। স্টারমারের ডাউনিং স্ট্রিটের বাসিন্দা হওয়ার পেছনে সেটাও বড় ভূমিকা রাখে।
সে সময় স্টারমারের জন্য পাঠানো অভিনন্দন বার্তায় শেখ হাসিনা তার দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে ব্রিটিশ লেবার পার্টি এবং এর নেতাদের ‘বিশেষ বন্ধুত্বের’ কথা স্মরণ করেন।
সব কিছুই ছিল চমৎকার। তবে কেউ কেউ স্টারমারের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ওই বন্ধুত্বের অংকে বড় ধরনের গলদ দেখতে পাচ্ছিলেন।
মেইল লিখেছে, এর কারণ হাসিনা নিজেই। মুখে সাম্যের কথা বলে এলেও বছরের পর বছর ধরে ‘দুর্নীতি, নির্বাচনে জালিয়াতি, বিরোধী মতের ওপর দমন-পীড়ন এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কর্মীদের হত্যার’ অভিযোগ নিয়ে তিনি বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন।
হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিরোধী দলের প্রায় ছয়শ নেতাকর্মীকে গুমের অভিযোগ এসেছে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে। আর এ বিষয়টি মানবাধিকার নিয়ে যুক্তরাজ্য কিংবা লেবার পার্টির অঙ্গীকারের ঠিক বিপরীত।
স্টারমারের সর্বশেষ নির্বাচনের সময় বাংলাদেশের পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে থাকে। ছাত্রদের আন্দোলন এক পর্যায়ে হাসিনাবিরোধী গণ অভ্যুত্থানে পরিণত হয়। সংঘাত সহিংসতায় অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে গেলে, তার সরকারি বাসভবনের দখল নেয় জনতা।
ডেইলি মেইল লিখেছে, এর পরের ঘটনাপ্রবাহ স্যার কিয়ার স্টারমারের জন্যও দুটো মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এর একটি কূটনৈতিক মাথাব্যথা। আগে যাই ঘটে থাকুক, যুক্তরাজ্যকে এখন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে মনোযোগ দিতে হবে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে স্টারমারের সুসম্পর্ক এখন বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে কি না, এখনো তা স্পষ্ট হয়নি।
আরেকটি মাথাব্যথার কারণ রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত। বাংলাদেশে হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে যেসব কেলেঙ্কারি এখন বেরিয়ে আসছে, তাতে নাম জড়িয়ে স্টারমারের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক মিত্র, ব্রিটেনের আর্থিক সেবা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের ক্যারিয়ার হুমকির মুখে পড়েছে।
স্টারমারের মত টিউলিপও প্রথম এমপি হয়েছিলেন ২০১৫ সালে। তাদের দুজনের নির্বাচনি আসনও পাশাপাশি। আর টিউলিপের খালা হলেন বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনার মত টিউলিপের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত শুরু হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ঘুষ আর অনিয়মের মাধ্যমে পাওয়া বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার তারা অবৈধভাবে অন্য দেশে পাচার করেছেন।
পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলেছে লন্ডনের কয়েকটি বাড়ি, যেগুলো টিউলিপ এবং তার পরিবারের সদস্যদের উপহার দেওয়া হয়েছে কিংবা বিনা পয়সায় থাকতে দেওয়া হয়েছে। আর সেগুলো তাদের দিয়েছেন ধনাঢ্য বাংলাদেশিরা, যাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার যোগ আছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় রয়েছে কিংস ক্রসের একটি ফ্ল্যাট, যেটা ২০১৪ সালে টিউলিপকে উপহার দিয়েছিলেন আবদুল মোতালিফ নামের এক ব্যবসায়ী, যিনি শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ। এখন ওই ফ্ল্যাটের দাম ৭ লাখ পাউন্ড। ওই ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে টিউলিপ থাকেন অন্য বাসায়।
ডেইলি মেইল লিখেছে, পার্লামেন্ট সদস্য হওয়ার পরও দীর্ঘদিন ওই ফ্ল্যাটের মালিকানা নিয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করতে পারেননি টিউলিপ। ২০২২ সালের মে মাসে যখন প্রথম ওই ফ্ল্যাটের বিষয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছিল, এক সাংবাদিকের প্রশ্নে ‘অসত্য’ তথ্য দিয়েছিলেন তিনি। টিউলিপ দাবি করেছিলেন, ওই ফ্ল্যাট তাকে উপহার দিয়েছেন তার বাবা-মা। এমনকি ওই সাংবাদিককে তিনি মামলা করার হুমকিও দিয়েছিলেন।
তার ওই হুমকির পর বিষয়টি একপ্রকার চাপাই পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু গত সপ্তাহে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস এক প্রতিবেদনে তথ্যপ্রমাণ হাজির করে জানায়, ওই ফ্ল্যাট টিউলিপ উপহার পেয়েছেন একজন আওয়ামী লীগ সমর্থকের কাছ থেকে।
এরপর টিউলিপের মুখপাত্র ডেইলি মেইলের প্রশ্নের যে উত্তর দেন, তা আরো অদ্ভুত। মুখপাত্র বলেন, ওই ফ্ল্যাটের উৎস নিয়ে টিউলিপের আগে যে ধারণা ছিল, তা এখন ‘বদলেছে’।
ওই ফ্ল্যাটই সব নয়, ২০২২ সালের জুলাই থেকে উত্তর লন্ডনে ২০ লাখ পাউন্ডের যে বাড়িতে স্বামী জন পার্সি আর দুই সন্তানকে নিয়ে টিউলিপ থাকেন, সেই বাড়ির মালিক হলেন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতা আবদুল করিম।
গতবছর শেখ হাসিনার সরকার করিমকে সিআইপি (কমার্শিয়ালি ইমপরট্যান্ট পারসন) খেতাব দেয়। এর ফলে তিনি রাষ্ট্রীয় অনেক অনুষ্ঠানে দাওয়াত পান, বাংলাদেশের ভেতরে প্রথম শ্রেণিতে ভ্রমণ করতে পারেন এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তরের দেওয়া পরিচিতিমূলক পত্র নিয়ে বিদেশে ভ্রমণ করতে পারেন।
টিউলিপ পরিবার নিয়ে উত্তর লন্ডনের ওই বাড়িতে ওঠার পর বাংলাদেশে একটি ব্যাংকের (শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক) ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান আবদুল করিম।
ডেইলি মেইল লিখেছে, কোনো ধরনের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা না থাকার পরও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের কথায় করিমকে ওই দায়িত্ব দেওয়া হয়।
টিউলিপ ও তার স্বামী ওই বাড়িতে থাকার জন্য করিমকে ভাড়া দেন কি না, ব্রিটিশ সাংবাদিকরা সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেননি। বাজার দর অনুযায়ী ওইরকম একটি বাড়ির ভাড়া হওয়ার কথা মাসে পাঁচ হাজার পাউন্ড।
তবে একটি বিষয় নিশ্চিত, সেটি হল, করিমের বাড়িতে থাকার ফলে উত্তর লন্ডনের আরেকটি ফ্ল্যাট তাদের ভাড়া দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে, যেখানে তারা আগে থাকতেন।
ওই বাসা ভাড়া দিয়ে যে আয় হয়, সে কথা এক বছরের বেশি সময় পার্লামেন্টারি কর্তৃপক্ষের কাছে গোপন করে গেছেন টিউলিপ। পরে সাংবাদিকদের খোঁচাখুঁচিতে বিষয়টি বেরিয়ে আসে।
আরো একটি ফ্ল্যাটের খবর সম্প্রতি সামনে এসেছে। নিজের নির্বাচনি এলাকা হ্যাম্পস্টেডের ওই বাসায় ২০১০ সালেও থাকতেন টিউলিপ। ওই বাড়ির মালিক এখন টিউলিপের বোন আজমিনা সিদ্দিক; তিনি আবার ওই ফ্ল্যাট উপহার পেয়েছেন মঈন গণি নামের এক বাংলাদেশি আইনজীবীর কাছ থেকে, যিনি শেখ হাসিনার সরকারের পক্ষে মামলা লড়েছেন।
আর টিউলিপের মা শেখ রেহানা (শেখ হাসিনার বোন) উত্তর লন্ডনের গোল্ডার্স গ্রিনের যে বাড়িতে থাকেন, সেটার মালিক লেডিবার্ড প্রোপার্টিজ নামে একটি অফশোর কোম্পানি। আর সেই কোম্পানির আসল মালিক শায়ান এফ রহমান, যিনি শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের ছেলে।
কাছেই আরেকটি বাড়িতে আগে থাকতেন রেহানা, সেই বাড়ির মালিক হলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা কাজী জাফরউল্লাহ।
ডেইলি মেইল লিখেছে, এসব সম্পত্তির সঙ্গে টিউলিপ এবং তার পরিবারের যোগাযোগ ‘খুবই অস্বাভাবিক’, যা তার ভাবমূর্তির জন্য মোটেও ভালো কিছু নয়, কারণ ব্রিটিশ সরকারের সিটি মিনিস্টার হিসেবে দুর্নীতি প্রতিরোধের বিষয়টিও তার দেখার কথা। সেখানে বিদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের লোকজনের কাছ থেকে দামি দামি উপহার নেওয়া স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন তৈরি করে।
ফলে এই বিতর্ক স্টারমারের জন্য অন্য জটিলতা তৈরি করছে, কারণ ধারণা করা হয়, টিউলিপ হলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর গুটিকয় ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন, যারা পরিবার নিয়ে একসঙ্গে ছুটিও কাটাতে যেতেন।
২০২০ সালে স্টারমার যখন লেবার পার্টির নেতা নির্বাচিত হলেন, টিউলিপ নিজেই তখন বলেছিলেন, তারা কতটা ভালো বন্ধু।
আর ২০১৮ সালে টিউলিপের পক্ষে ভোটের প্রচারে নেমে স্টারমার তাকে বর্ণনা করেছিলেন ‘ভালো বন্ধু এবং সহকর্মী’ হিসেবে।
গত ডিসেম্বরেও যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে ক্যামেরাবন্দি হন প্রধানমন্ত্রী স্টারমার। আনোয়ারুজ্জামান পরে ইন্সটাগ্রামে এক পোস্টে বলেন, বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার কথা হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশের আর্থিক খাতের গোয়েন্দা বিভাগ বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) গত সপ্তাহেই দেশের ৬১ ব্যাংকে চিঠি দিয়ে বলেছে, টিউলিপ বা তার পরিবারের কারো নামে কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট কোথাও থেকে থাকলে তার বিস্তারিত তথ্য যেন জানানো হয়।
কোনো ধরনের অনিয়ম করার কথা অস্বীকার করে আসা টিউলিপ সিদ্দিক দাবি করেছেন, বিদেশে তার কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই।
তবে সরে যাওয়ার দাবি জোরালো হয়ে ওঠায় টিউলিপ ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তের জন্য ব্রিটিশ সরকারের ইনডিপেনডেন্ট এথিকস অ্যাডভাইজর (স্ট্যান্ডার্ডস ওয়াচডগ) স্যার লাউরি ম্যাগনাসকে অনুরোধ জানিয়েছেন।
ডেইলি মেইল লিখেছে, সম্পদ নিয়ে হয়ত এখন তদন্তের মুখোমুখি হতে হবে টিউলিপকে; তিনি কোথাও মিথ্যা বলেছেন কি না, সেটাও দেখা হবে। তবে তাকে ঘিরে নানা প্রশ্ন ঘুরছে ২০১৩ সাল থেকেই।
পার্লামেন্ট নির্বাচন করার জন্য ওই বছর প্রথমবারের মত লেবার পার্টির মনোনয়ন পান ক্যামডেনের সাবেক কাউন্সিলর টিউলিপ। এর কয়েক দিনের মধ্যে তার সাবেক সহকর্মীরা একটি ইমেইল পান, যেখানে বলা হয়, টিউলিপ ও তার পরিবার বাংলাদেশে দুর্নীতিতে জড়িত।
ওই ইমেইলে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে শেখ হাসিনা ও টিউলিপ সিদ্দিকের একটি ছবিও যুক্ত করে দেওয়া হয়। বাংলাদেশে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য চুক্তি করতে সে সময় রাশিয়ায় গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।
টিউলিপ সে সময় পুরো বিষয়টিকে ‘হাসিনাবিরোধীদের অপপ্রচার’ বলে উড়িয়ে দেন। ওই ইমেইলের বিষয়টি তিনি পুলিশকেও জানান।
পুতিনের সঙ্গে ছবির বিষয়ে তার ব্যাখ্যা ছিল, তার খালা যখন রাশিয়া সফরে গেলেন, তার সঙ্গে দেখা করতেই তিনি মস্কো গিয়েছিলেন, কারণ লন্ডন থেকে ঢাকা যাওয়ার চেয়ে মস্কো যেতে কম সময় লাগে। সেখানে গিয়ে তিনিও খালার সঙ্গে ক্রেমলিনে আমন্ত্রণ পান এবং প্রেসিডেন্ট পুতিনের অনুরোধে ছবির জন্য ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান।
অবশ্য ওই উড়ো ইমেইল বা পুতিনের সঙ্গে ছবি টিউলিপের মনোনয়ন পাওয়া ঠেকাতে পারেনি। বরং উত্তর লন্ডনের সেলিব্রেটিদের একটি বড় অংশ তাকে সমর্থন দিয়েছেন। পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে, লন্ডনের ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড লিখেই ফেলেছিল, টিউলিপের মধ্যে তারা ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রীর ছায়া দেখতে পাচ্ছে।
২০১৫ সালের ওই নির্বাচনে জিতে টিউলিপ এমপি হওয়ার পর লন্ডনে উড়ে এসেছিলেন তার খালা শেখ হাসিনা। পার্ক লেইনের শেরাটন হোটেলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে টিউলিপের কপালে হাসিনার চুম্বনের ছবি পত্রিকাতেও ছাপা হয়েছিল।
গর্বিত খালা শেখ হাসিনা পরদিন পার্লামেন্টে হাজির হয়েছিলেন টিউলিপের প্রথম সংসদীয় বক্তৃতা শুনতে।
এত এত সমর্থনের পরও টিউলিপ পরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার সম্পর্কের বিষয়টি আড়ালে রাখার চেষ্টা করে গেছেন। নিজের ওয়েবসাইট আপডেট করার সময় তিনি আওয়ামী লীগের মুখপাত্র হিসেবে ২০১১ সাল পর্যন্ত কাজ করার তথ্যটি মুছে ফেলেন। নিজের লেখা একটি ব্লগও তিনি সরিয়ে ফেলেন, যেখানে বাংলাদেশের ২০০৮ সালের নির্বাচনে খালার সঙ্গে ভোটের প্রচারে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা তিনি বর্ণনা করেছিলেন।
খালার সঙ্গে তার সম্পর্কের আরো একটি দিক উন্মোচিত হয় ২০১৭ সালে, যখন গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ইরানে আটক ব্রিটিশ নাগরিক নাজানিন জাঘারি-র্যাটক্লিফের মুক্তির দাবিতে বড় ধরনের প্রচারাভিযানের নেমেছিলেন টিউলিপ।
সে সময় যুক্তরাজ্যে লেখাপড়া করা এক বাংলাদেশি আইনজীবীকে গুমের অভিযোগ নিয়ে ব্রিটেনের চ্যানেল ফোরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তার স্বজনরা।
মীর আহমেদ বিন কাসেম নামের সেই আইনজীবী বাংলাদেশের জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর ছেলে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তিনি তার বাবার আইনজীবী দলের সদস্য ছিলেন।
তিনি ২০১৬ সালে ‘গুমের’ শিকার হয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত ৬ অগাস্ট তিনি পরিবারের কাছে ফিরে আসেন।
আহমেদের হদিশ পেতে তার মা তখন টিউলিপকে চিঠি দিয়েছিলেন। তিনি অনুরোধ জানিয়েছিলেন, টিউলিপ যেন তার অবস্থান কাজে লাগিয়ে আহমেদের মুক্তির জন্য কথা বলেন।
চ্যানেল ফোর পরে টিউলিপের কাছে জানতে চেয়েছিল, তিনি নাজানিন র্যাটক্লিফের জন্য সোচ্চার হলেও বাংলাদেশে আটক ওই আইনজীবীর পক্ষে কেন দাঁড়াননি।
জবাবে টিউলিপ পুলিশ ডাকেন, চ্যানেল ফোরের রিপোর্টার অ্যালেক্স টমসনের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী মন্তব্য করার অভিযোগ আনেন। পরে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হয় এবং পুলিশ ওই অভিযোগ নাকচ করে দেয়।
তবে বাংলাদেশে ঘটনা চলে অন্যভাবে। চ্যানেল ফোর যেদিন টিউলিপের ওই ভিডিও প্রচার করে, সেদিনই ঢাকায় আহমেদের বাড়ি যায় র্যাব। তারা আহমেদের পরিবারকে হুমকি দেয় বলে অভিযোগ ওঠে।
ডেইলি মেইল লিখেছে, কিয়ার স্টারমার যখন টিউলিপকে তার সরকারে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দিলেন এবং টিউলিপের খালা শেখ হাসিনার ‘স্বৈরাচারী’ সরকারের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখে চলছিলেন, তখনও তিনি হয়ত ভাবছিলেন, কোনো অন্যায় টিউলিপ করেননি। কিন্তু সেই পরিস্থিতি এখন পাল্টে গেছে।
টিউলিপ সরে যেতে বাধ্য হলে তার উত্তরসূরি কে হবেন, প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের জ্যেষ্ঠ সহযোগীরা তা বিবেচনা করে দেখছেন বলে ইতোমধ্যে খবর এসেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে।
এখন প্রশ্ন হল, স্যার কিয়ার স্টারমার কি রাজনীতিতে তার সবচেয়ে ভালো বন্ধুকে বরখাস্ত করার মত কঠোর হতে পারবেন?