বৃহস্পতিবার ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, পৌষ ৫ ১৪৩১, ১৭ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

ইসরাইলের পাশে আমেরিকা ॥ নেপথ্যের কারণ: কয়েকটি বিশ্লেষণধর্মী কলাম

ওয়াসআতুল্লাহ খান

 প্রকাশিত: ১৫:৫০, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪

ইসরাইলের পাশে আমেরিকা ॥ নেপথ্যের কারণ: কয়েকটি বিশ্লেষণধর্মী কলাম

আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধের ইহুদী নায়ক

আমেরিকার বিপ্লবে অনন্য অবদান ছিল খায়েম সলোমান (Haym Salomon) নামক জনৈক ইহুদী ধনকুবের। সে না থাকলে হয়তো স্বাধীনতা আন্দোলন ও পরবর্তী আমেরিকার চিত্র ভিন্ন হত।

মার্চ ১৪৯২ সালে সম্রাজ্ঞী ইসাবেলা ও সম্রাট ফার্ডিনান্ড-এর পক্ষ থেকে স্পেনের মুসলমান ও ইহুদীদেরকে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতে নতুবা দেশত্যাগের জন্য চার মাসের সময় বেধে দেওয়া হলে দেশান্তরিতদের মধ্যে খায়েম সলোমানের পিতৃপুরুষও ছিল। প্রথমে তারা উত্তর আফ্রিকায় বসতি গড়ে তোলেন। এরপর তাদের উত্তরপ্রজন্ম ঝায়ঝামেলা পার হয়ে সবশেষে পূর্ব ইউরোপে থিতু হয়। ১৭৪০ সালে সেখানকার পোল্যান্ড-লিথুয়ানিয়ান কমনওয়েলথ (Polish–Lithuanian Commonwealth)-এর অন্তর্গত লেজনু (Leszno) অঞ্চলে খায়েম সলোমানের জন্ম।

শৈশবেই খায়েমের তার পরিবারের সাথে জীবিকার খোঁজে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাওয়া-আসা ছিল। এসব সফরের সুবাদে খায়েম একাধিক ভাষা ছাড়াও ব্যবসা ও বিনিয়োগের বিভিন্ন কৌশল রপ্ত করে নেয়। ১৭৭০ সালে তার পরিবার আবার পোল্যান্ডে ফিরে আসে। কিন্তু ২ বছরের মাথায় পোল্যান্ড রাষ্ট্রটি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর বৈষম্যমূলক বিভাজনের শিকার হলে তারা ব্রিটেন চলে আসে।

৩ বছর পর খায়েম আমেরিকা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। নিউইয়র্ক গিয়ে সমুদ্রউপকূলীয় বিভিন্ন কোম্পানির পক্ষে দালালির কাজ শুরু করে। পাশাপাশি ব্রিটেনের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত স্বাধীনতাকামী দলগুলোর প্রতি সমর্থন ও সংহতি প্রকাশ করে এবং নিউইয়র্কে আন্দোলনকারী দল ‘সেনস অব লিবার্টি’র সাথে যুক্ত হয়। গুপ্তচর সন্দেহে ব্রিটিশ প্রশাসন তাকে গ্রেফতার করে নেয়। এই সময়ে আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতা ফাদাররা ৪ জুলাই ১৭৭৪ সালে ব্রিটেন থেকে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তবে যুদ্ধ তখনো চলমান ছিল।

দেড় বছর পর নতুন ব্রিটিশ সরকার খায়েমকে মুক্তি দিলেও কয়েক বছর পর গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আবারও গ্রেফতার করা হয়। বিদ্রোহীদের সাথে যোগাযোগ থাকার অভিযোগে একটি সামরিক ট্রাইবুনাল তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। কিন্তু স্বাধীনতাকামীদের প্রতি সংহতি প্রদর্শনকারী কিছু কারা-কর্মকর্তার সহযোগিতায় কোনোভাবে জেল থেকে পালিয়ে ফিলাডেলফিয়ার স্বাধীন অঞ্চলে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। যেখানে তার অন্য আত্মীয়রাও ব্রিটেন থেকে দেশান্তরিত হয়ে বসতি গড়ে তুলেছিল।

ফিলাডেলফিয়ায় তখন স্বাধীনতার শপথগ্রহণকারী তেরোজন মার্কিন নেতার সমন্বয়ে গঠিত আইনসভা— কংগ্রেসও ছিল। খায়েম সেখানে আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলনে সহযোগিতাকারী দেশ ফ্রান্সের ব্যবসায়ীদের জন্য ব্রোকারি শুরু করে। এ থেকে অর্জিত বেশিরভাগ মুনাফা আমেরিকার স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের জন্য উৎসর্গ করে।

আগস্ট ১৭৮১ সালে জর্জ ওয়াশিংটনের স্বাধীনতাকামী দল ও ফ্রান্সের মিত্ররা ভার্জিনিয়ার উপকূলীয় শহর ইয়র্কটাউনে ব্রিটেনের জেনারেল চার্লস কারনুয়ালিস (Charles Cornwallis)-এর বাহিনীকে অবরুদ্ধ করে। তখন জর্জ ওয়াশিংটনের সামরিক অবস্থাও ছিল খুব দুর্বল। অস্ত্র, খাদ্য, যুদ্ধপোশাক এমনকি জুতারও ছিল তীব্র সংকট। পূর্ণ প্রস্তুতি ছাড়া যুগান্তকরী এই যুদ্ধে জয়লাভ করা প্রায় অসম্ভবই মনে হচ্ছিল।

খায়েম সলোমানের সহযোগিতায় পুঁজিবাজার থেকে বিশ হাজার ডলার সংগ্রহ করা হয়। যথাসময়ের ওই আর্থিক সহায়তার কারণে জর্জ ওয়াশিংটন ফরাসি মিত্রদের সহযোগিতায় ব্রিটিশদের পর্যুদস্ত করতে সক্ষম হয়। এর পর থেকেই আমেরিকার উপকূল থেকে ব্রিটিশ সৈন্যদের প্রত্যাহার শুরু হয়।

৩ সেপ্টেম্বর ১৭৮৩-এর প্যারিস চুক্তির মধ্য দিয়ে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও আমেরিকার মাঝে শান্তি স্থাপিত হয়। জর্জ ওয়াশিংটন প্রশাসনকে ব্রিটেন আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করে। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অর্থ ও উপকরণের বড় অভাব ছিল। আমেরিকার অস্থায়ী সরকার স্বাধীনতাযুদ্ধের সাড়ে চার বছরে ফ্রান্স থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়েছিল, যা পরিশোধ করার সক্ষমতাও তাদের ছিল না।

যুদ্ধপরবর্তী সময় খায়েম সলোমান নতুন কংগ্রেসের অনেক সদস্যকেও আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। আর কোনো অর্থ ফেরত দেওয়ার কথাও কখনো মুখে আনেনি।

১৭৮১ ও ১৭৮৪-এর মধ্যমেয়াদে খায়েম সলোমান আর্থিক বন্ড কেনার নামে জর্জ ওয়াশিংটন সরকারকে পঁচাত্তর কিস্তিতে সাড়ে ছয় লক্ষ ডলার ঋণ প্রদান করে। বর্তমান হিসাবে যার মূল্যমান ছিল প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার।

১৭৮৫-এর জানুয়ারিতে ৪৪ বছর বয়সে খায়েম সলোমান আকস্মিক মৃত্যুবরণ করে। মৃত্যুর সময় তার কাছে একটি কড়িও অবশিষ্ট ছিল না। নিজের অর্জিত অধিকাংশ সম্পদ সদ্যস্বাধীন দেশের নতুন সরকারের জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছিল। আর কাঙালি সরকার থেকে অর্থ ফেরত পাওয়ার কোনো আশাও খায়েমের ছিল না।

রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় খায়েমকে ফিলাডেলফিয়ার একটি ইহুদী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। কবরস্থানটির নাম বদল করে খায়েম সলোমান মেমোরিয়াল পার্ক রাখা হয়। তার মৃত্যুর এক শ সাত বছর পর ১৮৯৩ সালে ৫২তম মার্কিন কংগ্রেস খায়েম সলোমানের নামে একটি বিশেষ স্বর্ণপদক প্রবর্তন করে। বিভিন্ন যুগে শিকাগো, লস এঞ্জেলস ও নিউইয়র্কের বিভিন্ন পার্কে তার প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত আমেরিকার সামরিক নৌজাহাজ ইউএসএস লিবার্টির নাম পরিবর্তন করে ইউএসএস সলোমান রাখা হয়।

১৯৭৫ সালে ইউএস পোস্টাল সার্ভিস খায়েম সলোমানের স্মরণে এক বিশেষ ডাকটিকেট প্রবর্তন করে। যার পিঠে মুদ্রিত ছিল ‘অর্থনৈতিক হিরো, বিজনেস ম্যান ও ব্রোকার খায়েম সলোমান আমেরিকার বিপ্লব আন্দোলন সফল করার জন্য সবচেয়ে বেশি অর্থ প্রদান করে। বিপ্লব পরবর্তী সময় একটি নতুন জাতিকে আত্মনির্ভর হওয়ার জন্য সহযোগিতা করে।’

স্বাধীন আমেরিকা বিনির্মাণে খায়েম সলোমানের অসামান্য অবদান আমেরিকার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গের ওপর এত প্রভাব বিস্তার করেছিল যে, পরবর্তী দশকগুলোতেও গোটা দেশের ইহুদী কমিউনিটির প্রতি বিশেষ সমীহ তৈরি হয়েছে।  পৌনে তিন শ বছরের নানা চড়াই-উতরাইয়ের পরও তা এতটুকুও ম্লান হয়নি।

খায়েম সলোমান আমেরিকার ইহুদী কমিউনিটির এক মহানায়ক। কমিউনিটির অন্য লোকেরা আগামী দিনগুলোতে কোন্ কোন্ গুরুত্বপূর্ণ পদ ও মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছে এবং নিজ কমিউনিটির শক্তি বৃদ্ধি করেছে, তার আলোচনা পরবর্তী প্রবন্ধে হবে। যেন আপনার জন্য আমেরিকার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আয়ত্ত করা সহজ হয়।

আড়াই শতাব্দীর প্রসিদ্ধ মার্কিন ইহুদী

গত প্রবন্ধে আলোচনা হয়েছিল— কীভাবে একজন ইহুদী ব্রোকার খায়েম সলোমান আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে সফলতার জন্য পুঁজিবাট্টাসহ নিজের সর্বস্ব উৎসর্গ করে দিয়েছিল। খায়েমের পর আমেরিকার ইহুদী কমিউনিটি বিগত আড়াই শ বছর কীভাবে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও রাষ্ট্রগঠনে নিজেদেরকে সক্রিয় রেখেছে— এ প্রসঙ্গে আরো কিছু কথা নিবেদন করছি। আমেরিকান-ইসরাইলী কো-অপারেটিভ এন্টারপ্রাইজ (american-israeli cooperative enterprise (AICE)-এর একটি কাজ হল আমেরিকান জীবনযাত্রায় ইহুদীদের অংশিদারিত্ব নিশ্চিত করা। প্রতিষ্ঠানটির গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্ত থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়—

আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণার এক বছর আগে দেশটির দক্ষিণ কেরুলায়েনার (South Carolina) আইনসভার সদস্য হিসেবে ফ্রান্সিস স্লোয়াডোর নামক প্রথম ইহুদী নির্বাচিত হয়। পরবর্তী বছর আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে লড়াই করে ফ্রান্সিস স্লোয়াডোর জয় লাভ করে।

চার্লস লিওন প্রথম ইহুদী রাজনীতিবিদ, ১৮৪৫ সালে যাকে কংগ্রেসের হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের জন্য নির্বাচন করা হয়। একই বছর ডেভিড  লেভি (David Levy Yulee) প্রথম আমেরিকান ইহুদী সিনেটর হওয়ার গৌরব অর্জন করে।

১৮৬৯ সালে বার্নার্ড গোল্ড স্মিথ কোনো আমেরিকান শহর (পোর্টল্যান্ড)-এর প্রথম ইহুদী মেয়র হন। ওয়াশিংটন বার্টলেট (Washington Montgomery Bartlett ) প্রথম ইহুদী রাজনীতিক, যে ১৮৮৭ সালে আমেরিকার কোনো প্রদেশের (ক্যালিফোর্নিয়া) গভর্নর নির্বাচিত হয়।

আমেরিকার মন্ত্রীপরিষদে প্রথমবার (১৯০৬) কোনো ইহুদী রাজনীতিবিদ মন্ত্রিত্ব (ব্যবসা ও লেবার) লাভ করে। তার নাম অসকার স্ট্রস (Oscar Solomon Straus)।

লুই ব্র্যান্ডিস (Louis Dembitz Brandeis) প্রথম ইহুদী আইনবিদ, যাকে ১৯১৬ সালে সুপ্রিম কোর্টের জজ নিযুক্ত করা হয়। (এর আগে ১৮৫৩ সালে রাষ্ট্রপতি মিলার্ড মালফোর (Millard Fillmore) জোডা বেঞ্জামিনকে সুপ্রিম কোর্টের জজ হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু বিভিন্ন কারণে জোডা তা গ্রহণ করেনি।)

ফ্লোরান্স প্রাগ কুহান প্রথম ইহুদী নারী, যে ১৯২৫ সালে হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের সদস্য নির্বাচিত হয়। ১৯৩৪ সালে হেনরি মরগেন্থু (Henry Morgenthau ) আমেরিকার প্রথম ইহুদী অর্থমন্ত্রী হন।

১৯৬৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেট প্রধান লিন্ডন বি জনসন (Lyndon Baines Johnson)-এর বিপক্ষে রিপাবলিকান সিনেটর বেরি গোল্ডওয়াটার (Barry Morris Goldwater) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। বিমান বাহিনীর সাবেক জেনারেল গোল্ডওয়াটার খুব অল্প ভোটে রাষ্ট্রপতি হতে ব্যর্থ হয়। বাবা ইহুদী ধর্মবিশ্বাসে অটল থাকলেও গোল্ডওয়াটার ছিল মায়ের মতো অ্যাংলিক্যান (Anglican) চার্চের অনুসারী। আইনী বাধ্যবাধকতা না থাকলেও আজ পর্যন্ত খ্রিস্টান ছাড়া অন্য কেউ আমেরিকার রাষ্ট্রপতির শপথ গ্রহণ করতে পারেনি।

জেমস শ্লেসিঙ্গার (James Rodney Schlesinger) প্রথম ইহুদী রাজনীতিক, যে ১৯৭৩ সালে আমেরিকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করে। সে রাষ্ট্রপতি নিক্সন (Richard Milhous Nixon) ও ফোর্ডের (Gerald Rudolph Ford) আমলেও ২ বছর দায়িত্ব পালন করে।

রাষ্ট্রপতি নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক পরামর্শক ও পরবর্তী ফোর্ড আমলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার জার্মানি থেকে আমেরিকায় দেশান্তরিত হওয়া ইহুদী বংশোদ্ভূত হলেও এই পরিচয়টি তার পছন্দের ছিল না। ব্যক্তি মতাদর্শের পরিবর্তে কার্যত দায়িত্ব পালনকারী কূটনীতিক হিসেবেই বেশ পরিচিত ছিল। যদিও ইহুদী ও ইসরাইলী লবিস্টরাও তার কোনো কোনো নীতি অপছন্দ করেছে।

এডওয়ার্ড লেভি (Edward Hirsch Levi ) ১৯৭৫ সালে মার্কিন প্রশাসনের প্রথম ইহুদী এটর্নি জেনারেল নির্বাচিত হয়। আধুনিক আমেরিকার রাজনীতির সক্রিয় নারীদের মধ্যে ডায়েনি ফেইনস্টেইন (Dianne Emiel Feinstein)-এর নাম সবার শীর্ষে। প্রথমবারের মতো ১৯৭৭ সালে আমেরিকার কোনো বড় প্রদেশ সান ফ্রান্সিসকোর মেয়র নিযুক্ত হয় এবং পরপর দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করে। ১৯৯২ সালে ডায়েনি ও বারবারা বক্সার (Barbara Sue Boxer) কেলিফোর্নিয়া থেকে প্রথম নারী সিনেটর হিসেবে নির্বাচিত হয়। তাদের উভয়েই ছিল মধ্যবিত্ত ইহুদী পরিবারের।

ডায়েনি ধারাবাহিক ৩১ বছর সিনেটর ছিল। এ সময়ে সে পরিবেশ সংরক্ষণ, মাদক নিয়ন্ত্রণ এবং সাম্প্রদায়িক নির্যাতন, মানব পাচার ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদনের বিরুদ্ধে কার্যকরী আইন প্রণয়নে কাজ করে। সিআইএর নজরদারিতে থাকা বন্দিশিবির ও বন্দি নির্যাতনের ওপর ৬ বছরের এক গবেষণাধর্মী প্রতিবেদন প্রস্তুত করে। যার ফলে তথ্য বের করার জন্য বন্দিদের ওপর নির্যাতন বন্ধের জন্য সিআইএকে চাপ দেওয়া হয়।

সে সিনেটের গোয়েন্দা ও বিচার বিভাগীয় কমিটির নেতৃত্বও প্রদান করে এবং মার্কিন ইসরাইল পাবলিক এফেয়ার্স কমিটিতেও (ইপক) কার্যকর ভূমিকা পালন করে। তবে ইরানের সাথে ঐতিহাসিক পারমাণবিক চুক্তি সম্পাদনে প্রতিনিধিত্ব করে। ২০২৩ সালে ৯০ বছর বয়সে ডায়েনি ফেইনস্টেইন মৃত্যুবরণ করে। সে ছিল সবচেয়ে বেশি সময় সিনেটে থাকা প্রথম রাজনীতিবিদ।

রুথ গিন্সবার্গ (Joan Ruth Bader Ginsburg) প্রথম ইহুদী নারী আইনবিদ, যে ১৯৯৩ সালে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের জজ নিযুক্ত হয়।

সিনেটর জো লিবারম্যান (Joe Lieberman) ২০০০-এর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী এলগোর (Albert Arnold Gore Jr.)-এর উপ-রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী ছিল। সেবার রিপাবলিকান প্রার্থী জর্জ বুশকে (George W. Bush) টেকনিক্যালি বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। নতুবা জো লিবারম্যান হত সেদেশের প্রথম নির্বাচিত উপ-রাষ্ট্রপতি। জো লিবারম্যান ছিল কট্টর ইসরাইলপন্থী। ১৯৯৫ সালে মার্কিন কংগ্রেসে জেরুজালেম অ্যাম্বেসি অ্যাক্ট (Jerusalem Embassy Act) পাশ করানোর পেছনে মূল ভূমিকা পালন করে। এই অ্যাক্টের মাধ্যমে মূলত মার্কিন দূতাবাস তেলআবিব থেকে সরিয়ে জেরুজালেমে স্থানান্তর করার বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে সুপারিশ করা হয়। অবশেষে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প (Donald John Trump)  ২০ বছর পর এই সুপারিশ বাস্তবায়ন করে। গত (২০২৪) মার্চে ৮২ বছর বয়সে জো লিবারম্যানের মৃত্যু হয়।

এয়ার্ক কেন্টর ছিল ২০১১-২০১৪ পর্যন্ত হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভস-এ রিপাবলিকান নেতা। কংগ্রেসের কোনো হাউজে সে-ই ছিল প্রথম ইহুদী সংসদীয় নেতা।

চুক শুমার (Charles Ellis Schumer) ২৩ বছর যাবৎ মার্কিন সিনেটে নিউইয়র্ক-এর প্রতিনিধিত্ব করছে। যে ছিল রাশিয়া থেকে দেশান্তরিত হয়ে নিউইয়র্কে বসবাসকারী একটি ইহুদী পরিবারের কর্ণধার। ২০১৭ সালে সিনেটে ডেমোক্রেট ককাসের নেতৃত্ব দেয়। আর ২০২২ সালে ডেমোক্রেট পার্টি সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর হাউজের প্রধান নিযুক্ত হয়। তার সর্বস্ব ছিল ইসরাইলের প্রতি উৎসর্গিত। সেখানে যে-ই ক্ষমতায় আসুক না কেন।

এ ছাড়া আরো ৩ জন ব্যক্তি আছে, যারা ইহুদী বংশোদ্ভূত এবং আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিতে তাদের বিশেষ প্রভাব রয়েছে।

আমেরিকার প্রথম ইহুদী পররাষ্ট্রমন্ত্রী

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীতে সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব কোন্ কূটনীতিকের— এমন প্রশ্নের উত্তরে যে নামটি মাথায় আসে তা হল হেনরি কিসিঞ্জার (Henry Alfred Kissinger)।

কিসিঞ্জারের জন্ম একটি জার্মান ইহুদী পরিবারে। ১৯৩৮ সালে হিটলারের ইহুদী-নিধন নীতির কারণে তার পরিবার বাধ্য হয়ে আমেরিকায় দেশান্তরিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কিসিঞ্জার সেনা সার্জেন্ট হিসেবে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে দায়িত্ব পালন করে।

যুদ্ধ শেষে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ডক্টরেট সম্পন্ন করে। এরপর সেখানেই পারমাণবিক সমরাস্ত্র ও পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে অধ্যাপনা শুরু করে। এ সময় সে অনেক থিংকট্যাঙ্ক ও সরকারি কর্মকর্তার কাছ থেকে শাস্ত্রীয় ও বিশ্লেষণধর্মী দিকনির্দেশনা লাভ করে। ১৯৬৯ সালে রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন তাকে জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ের পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেন। আর পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়। নভেম্বর ১৯৭৫ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ফোর্ড (Gerald Rudolph Ford)-এর শাসনামলেও এই দায়িত্ব পালন করে।

কিসিঞ্জার জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক পরামর্শক ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে পারমাণবিক অস্ত্রের মজুদ কমানো ও পারস্পরিক নিরাপত্তার বিষয়ে সফল পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

কমিউনিস্ট চীন-এর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। অক্টোবর ১৯৭৩-এর যুদ্ধের পর আরব-ইসরাইলের মধ্যকার শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মধ্যস্থতা করে। এর ফলে ইসরাইল মিশরকে সিনাই উপত্যকা ফিরিয়ে দেয় এবং মিশর ও ইসরাইলের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়।

এপ্রিল ১৯৭৫-এ ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষ হয়। হেনরি কিসিঞ্জার ও ভিয়েতনামের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লি ডাক থো (Lê Đức Thọ) যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল লাভ করে।

যদিও কিসিঞ্জারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে যে, তার নীতির কারণে কম্পোডিয়া ও লাউস-এর ওপর অমানবিক বোমা হামলা হয়েছে। এছাড়া চিলির নির্বাচিত সমাজবাদী সরকার আয়েন্দকে অপসারণ ও সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে সে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার রাষ্ট্রগুলোতে সামরিক একনায়কদের সমর্থন ও সহযোগিতা করে। পূর্ব তিমুরে ইন্দোনেশিয়ার আগ্রাসনেও সমর্থন জানায়।

১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ইয়াহইয়া সরকারের সেনা-নীতির সমর্থন জানায়। কারণ ইয়াহইয়া সরকার আমেরিকা ও চীনকে নিকটবর্তী করার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। যদিও কংগ্রেস পারমাণবিক পরিকল্পনা গ্রহণের কারণে ভুট্টোকে খুব অপছন্দ করত। এমনকি ভুট্টোকে পারমাণবিক পরিকল্পনা থেকে ফিরে না এলে কঠোর হুঁশিয়ারিও দিয়েছিল।

বলা হয়ে থাকে, কিসিঞ্জারের রক্তপিপাসু রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণনাশের কারণ হয়েছে। কিসিঞ্জারের পর তার কূটনৈতিক শাগরিদরা এটিকে আরো বিস্তৃত করেছে।

অবসর গ্রহণের পর বিভিন্ন সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাকে পরামর্শ সেবা প্রদানের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করে কিসিঞ্জার এসোসিয়েটস নামের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। আমেরিকার ১২জন রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ সেবা প্রদান করেছে। বিশ্ব রাজনীতি বিষয়ে প্রায় এক ডজন বই-পুস্তক উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে যায়। নভেম্বর ২০২৩-এ ১০০ বছর বয়সে কিসিঞ্জার মৃত্যুবরণ করে।

কিসিঞ্জার কি ইসরাইলপন্থী ছিল?

এর উত্তর হল, হাঁ এবং না। তার মৃত্যুতে ইসরাইলের সংবাদ মাধ্যম ‘জেরুজালেম পোস্ট’-এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধ অনুযায়ী সে নিজের ইহুদী পরিচয়কে বড় করে দেখাত না। ১৯৯২ সালে প্রকাশিত নিজের আত্মজীবনীর লেখক ওয়ালটার এজাক্সনকে কিসিঞ্জার বলে, ‘আমার ইহুদী হওয়া একটি জন্মগত আকস্মিকতা। অন্য কোনো পরিবারে জন্মগ্রহণ করলে আমি হয়তো ইহুদীবিদ্বেষীই হতাম। ২ হাজার বছর ধরে যারা নানা প্রতিকূলতার শিকার তাদের তো অবশ্যই কোনো ভুল রয়েছে।

১৯৭৫ সালে কিসিঞ্জার জার্মানিতে পিতৃভিটা পরিদর্শনে গিয়েছিল। তখন নাৎসি ‘হলোকাস্ট’-এর কথা একবারও উচ্চারণ করেনি। তার এমন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ইসরাইলের এশওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর রুবায়ি নূর মানলাম বলেন, ইহুদীজাতির এমন লোকের সাথে কোনো ধরনের সম্পর্ক রাখা উচিত নয়।

ইসরাইল এস্টাবলিশমেন্ট নিশ্চিত যে, ১৯৭৩-এর অক্টোবরে মিশর ও সিরিয়া যখন ইসরাইলের ওপর অতর্কিত হামলা করে বসে, কিসিঞ্জার তার কিছুদিন পর ইসরাইলকে সেনা সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রণালয়ের নথিপত্রগুলো ২০১০ সালে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। প্রকাশিত একটি নথিতে ১৯৭৩-এর অক্টোবরে আমেরিকায় নিযুক্ত সোভিয়েত কূটনীতিক আনাতুলি ডোবরিনকে কিসিঞ্জার বলেছে, আরব কিংবা ইসরাইল কোনো একটিরই নিরঙ্কুশ বিজয় মধ্যপ্রাচ্যের জন্য ক্ষতিকর।

সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন রাশিয়ার ইহুদীদেরকে দেশত্যাগের আদেশ জারি করেছিল। আমেরিকার কংগ্রেস সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ব্যবসাকে রাশিয়ান ইহুদীদের স্থানান্তরের সাথে শর্তযুক্ত করার জন্য জ্যাকসন ওয়ান্ক আন্তর্জাতিক বাণিজ্যনীতি পরিবর্তনের মঞ্জুরি প্রদান করে। হেনরি কিসিঞ্জার এ মঞ্জুরির বিরোধিতা করে বলে, রাশিয়ার ইহুদীদের স্থানান্তর আমাদের পররাষ্ট্রনীতির বিষয় নয়। রাষ্ট্রপতি নিক্সনকে কিসিঞ্জার বলেছে, রাশিয়া যদি তাদের ইহুদীদেরকে গ্যাস চেম্বারেও রাখে, তবে এটি একটি মানবাধিকার বিষয় তো হতে পারে, কিন্তু আমেরিকার উদ্বেগের বিষয় নয়।

কিসিঞ্জার সম্পর্কে কথিত আছে, রাজনীতি ও কূটনীতিকে মানবিক মৌলিক মর্যাদার সাথে যুক্ত করার পরিবর্তে সে শুধু রাষ্ট্র ও রাজনীতির স্বার্থ দেখতেই অভ্যস্ত ছিল। তার গৃহীত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নীতি এ দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রচ্ছন্ন প্রমাণ।

রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব থেকে অবসরগ্রহণের পর কিসিঞ্জারের মাঝে ইহুদী-সত্তা ধীরে ধীরে জাগ্রত হতে শুরু করে। ১৯৭৭ সালে বলে বসে, ইসরাইলের নিরাপত্তা বিধান সকল স্বাধীন মানুষের সম্মিলিত দায়িত্ব। মৃত্যুর তিন মাস আগে ইসরাইলের সংবাদ মাধ্যম মারেফকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলে, আমি একজন ইহুদী। এই বিবেচনায় ইহুদী জাতি ও ইসরাইলের বেঁচে থাকা আমার ব্যক্তিগত অগ্রাধিকার।

কিসিঞ্জারের দৃষ্টিভঙ্গির এই পরিবর্তনকে ইসরাইলী স্টাবলিশমেন্টও অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিয়েছে। ২০১২ সালে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী শামউন পিরিজ ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্য অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ হেনরি কিসিঞ্জারকে রাষ্ট্রপতি পদকে ভূষিত করে। ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক ইহুদী কংগ্রেস হেনরি কিসিঞ্জারের অসাধারণ প্রতিভা ও যোগ্যতার স্বীকৃতি হিসেবে তাকে সাম্রাজ্যবাদের প্রতিষ্ঠাতার নামে প্রচলিত থিওডর হারজেল এওয়ার্ড প্রদান করে। এ প্রেক্ষিতে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী আইজেক হারজুগ ইসরাইলের প্রতি সহানুভূতি ও আন্তরিকতার জন্য হেনরি কিসিঞ্জারের ভূয়সী প্রশংসা করে।

অবশ্য সবচেয়ে বড় ইহুদী সম্মান জেনিসিস প্রাইজ হেনরি কিসিঞ্জার লাভ করতে পারেননি। জেনেসিস প্রাইজ হল আমেরিকার সংবাদমাধ্যম টাইম ম্যাগাজিনের ভাষ্যমতে ইহুদীদের নোবেল পুরস্কারতুল্য। পুরস্কারটির নীতি নির্ধারণী কমিটির সদস্যরা এর কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, কিসিঞ্জারের গৃহীত নীতিমালার মধ্যে মানবিকতা ও মমতার ঘাটতি আছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ইসরাইলের জন্য সে বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি ব্লিঙ্কেন-এর মতো অনেক কিছুই করতে পারত, কিন্তু সে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে; ফলে সে ইহুদীদের সবচেয়ে সম্মানিত পুরস্কার লাভের যোগ্য নয়।

 

[ওয়াসআতুল্লাহ খান। সিনিয়র সাংবাদিক এবং বিবিসি উর্দূ ও এক্সপ্রেস নিউজ নেটওয়ার্ক-এর নিয়মিত কলাম লেখক। যার প্রতিটি লেখাই বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যবহুল। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় এক্সপ্রেস নিউজ থেকে তার তিনটি লেখা মাসিক আলকাউসার-এর পাঠকদের খেদমতে পেশ করা হল। লেখাগুলো বাংলায় অনুবাদ করেছেন, মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ফাহাদ]

আলকাউসার