বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, মাঘ ১৭ ১৪৩১, ৩০ রজব ১৪৪৬

ব্রেকিং

ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের পডকাস্ট: ছাত্ররা নিজেরাই দল গঠন করবে: ড. ইউনূস পদত্যাগ বা দল গঠনের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি: নাহিদ কোটা নিয়ে ৩ সিদ্ধান্ত উপদেষ্টা পরিষদের সীমানা নির্ধারণ আইনের ‘জটিলতা’ কাটাতে সংশোধন প্রস্তাব পাঠাবে ইসি বিচারপতি শাহেদ নূর উদ্দিনের পদত্যাগ বিশ্ব ইজতেমায় নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়েছে: র‌্যাব মহাপরিচালক আয়কর রিটার্ন জমার সময় বাড়ল আরও ১৬ দিন সাবেক এমপি মিজানের ৮ বছরের কারাদণ্ড জি কে শামীমের সম্পদের মামলায় রায় পিছিয়ে ১৭ ফেব্রুয়ারি ৫ আগস্টসহ বিভিন্ন আন্দোলনের পেছনের কারণ দুর্নীতি: দুদক চেয়ারম্যান ‘জঘন্যতম’ অভিবাসীদের গুয়ানতানামো বেতে পাঠাবেন ট্রাম্প আরও ৩ ইসরায়েলি জিম্মি মুক্ত, বিনিময়ে ছাড়া পাচ্ছে শতাধিক ফিলিস্তিনি

স্বাস্থ্য

শিশুর সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা ও বিকাশে মায়ের দুধের বিকল্প নেই

 প্রকাশিত: ১৮:৪১, ২৯ জানুয়ারি ২০২৫

শিশুর সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা ও বিকাশে মায়ের দুধের বিকল্প নেই

প্রথম সন্তানের মা হয়েছে রহিমা বেগম। রহিমা বেগম সন্তান প্রসব করেছে মা ও শিশু স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। এখানে সে নিয়মিত চেকআপ করেছে, ডাক্তার দেখিয়েছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার, নার্সদের কাছে নবজাত শিশু লালন-পালন বিষয়ে অনেক কিছু জেনেছে। শিশু জন্মের একঘন্টার মধ্যে শালদুধ খাইয়েছে। রহিমা জেনেছে শিশুকে শালদুধ খাওয়ানো কতটা জরুরি। এখানে প্রসূতি মায়েদের শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে উদ্ব্দ্ধু করা হয়। মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর নিয়ম-কানুন এবং ছয়মাস পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ানের জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়। পাশাপাশি শিশুকে গুঁড়া দুধ খাওয়ানোর ক্ষতিকর দিক সস্পর্কেও সচেতন করা হয়।

সন্তান জন্মদানের পর প্রথম হলুদ ও ঘন যে দুধ আসে, এটাই শালদুধ। পরিমাণে এটি অত্যন্ত কম হলেও নবজাতকের জন্য অত্যন্ত কার্যকর। শালদুধে শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় রোগ প্রতিরোধের সকল ধরণের উপাদান রয়েছে। শালদুধ পানে শিশুর অপরিণত অন্ত্র পরিপক্ক হয়। শিশুর জন্ডিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে। তাই শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোতে অবহেলা করা যাবে না। পরিবারের সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। চাকরিজীবী থেকে শুরু করে গৃহিণী প্রত্যেক মাকে তাঁদের সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারে আগ্রহী ও সচেতন করে তুলতে হবে।

মায়ের বুকের দুধ শিশুর সুস্থতার জন্য শ্রেষ্ঠ খাদ্য হিসেবে স্বীকৃত। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সন্দেহতীতভাবে প্রমাণিত যে মাতৃদুগ্ধ বিকল্প শিশুখাদ্য মায়ের দুধের সমকক্ষ হওয়ার বিন্দুমাত্র যোগ্যতা রাখে না। ১৯৮১ সালের মে মাসে বিশ্বস্বাস্থ্য সম্মেলনে ইন্টারন্যাশনাল কোড অব ব্রেস্ট সাবস্টিটিউট অনুমোদিত হয়। এর পর থেকে মায়ের দুধের গুরুত্ব বাড়ানোর লক্ষ্যে বিকল্প খাদ্যের প্রচার বন্ধে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা শুরু হয়। এরপরও অনেক মা অসচেতনতার কারণে দুধের বিকল্প হিসেবে প্রচলিত বেশ কিছু প্রক্রিয়াজাত খাবার শিশুকে খাওয়ান।

ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, শিশু জন্মের এক ঘন্টার মধ্যে মায়ের শালদুধ খাওয়ালে মৃত্যুঝুঁকি ৩১ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়।  

প্রতিটি মায়ের জন্য সন্তান জন্মদান একটি বিশেষ মুহূর্ত। মায়ের জন্য সবচেয়ে মানসিক প্রশান্তির মুহূর্তটিও হলো যখন তিনি সন্তানকে বুকের দুধ পান করান। এর মধ্য দিয়ে মা ও শিশুর মধ্যে একটি আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাদের মধ্যে শক্তিশালী বন্ধন তৈরি হয়। পাশপাশি জন্মের পর থেকে যেসব শিশু বিকল্প দুধ পান করে, মাতৃদুগ্ধ পানকারী শিশুর তুলনায় তাদের ডায়রিয়ায় আক্রান্তের হার ২৫ গুণ  এবং শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে মৃত্যুর আশঙ্কা চারগুণ বেশি। এতে সুষ্পষ্ট প্রমাণিত, জন্মের পর শিশুর জন্য মায়ের দুধ কতটা উপকারি।  

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষায় দেখা গেছে, মায়ের দুধ না খাওয়ানোর কারণে শিশুর স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন রোগে প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ২ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশে এই ক্ষতির পরিমাণ বছরে প্রায় ৫৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। এটি উন্নয়নশীল দেশের বার্ষিক প্রবৃদ্ধিতে (জিডিপি) নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। একটি সুস্থ-সবল

স্বনির্ভর জাতি গঠনে ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে মায়ের দুধ খাওয়ানোর কোন বিকল্প নেই।

মাতৃদুগ্ধ শিশুর মস্তিস্কের গঠন ও বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। মায়ের বুকের দুধ পানকারী শিশুদের জন্ম পরবর্তী নানা ধরনের ইনফেকশন হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। শিশুর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। মায়ের বুকের দুধে ভিটামিন ‘এ’ থাকায় শিশু অন্ধত্বের শিকার হয় না। ক্যালসিয়ামের শোষণ বাড়িয়ে দিয়ে হাড়ের গঠন মজবুত করে। মায়ের বুকের দুধে রয়েছে বিশেষ ফ্যাটি এসিড, যা শিশুর বুদ্ধিদীপ্ততা ও দৃষ্টিশক্তি বাড়ায়। মায়ের দুধ পান করালে ডায়াবেটিস টাইপ-১ এবং উচ্চরক্তচাপ হওয়ার আশঙ্কাও কমে যায়। মায়ের দুধে প্রায় ১০০ ধরণের উপাদান রয়েছে, যার প্রতিটি উপাদানই শিশুর জন্য অত্যন্ত উপকারী।

প্যাকেটজাত দুধ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্লাস্টিকের বোতলে খাওয়ানো হয়। প্লাস্টিক শিশু স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কৌটাজাত দুধে মায়ের দুধের তুলনায় শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর উপাদান অনেক কম, ফলে শিশুর ডায়রিয়াসহ অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। বিকল্প দুধে লৌহজাতীয় পদার্থ (আয়রন) কম থাকায় শিশু রক্তস্বল্পতায় ভোগে। বুকের দুধ অপেক্ষা বিকল্প দুধের পুষ্টি উপাদানগুলো শিশুর শরীরে সহজে শোষিত হয় না, ফলে শিশু অপুষ্টির শিকার হয়। কৌটার দুধ সহজে হজম হয় না, ফলে শিশু কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগে। তাছাড়া বিকল্প দুধের বড় সমস্যা হলো এটি ব্যয়বহুল, সঠিক নিয়মে খাওয়াতে হলে মাসে প্রচুর খরচ হয়, যা অনেক পরিবারের পক্ষে বহন করা সম্ভব হয় না।

মাতৃদুগ্ধ বিকল্প শিশুখাদ্য উৎপাদন ও বিপণন নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বেশ কিছু নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। বুকের দুধ খাওয়ানোর হার বাড়ানো ও বিকল্প শিশুখাদ্য খাওয়ানোর হার কমাতে সরকারও অনেকদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মাতৃদুগ্ধ বিকল্প (বিপণন নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ রহিত করে ইতোমধ্যে মাতৃদুগ্ধ বিকল্প, শিশুখাদ্য, বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তৃতকৃত শিশুর বাড়তি খাদ্য ও তা ব্যবহারে সরঞ্জামাদি (বিপণন নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়েছে।

আইনে গর্ভবতী এবং দুগ্ধদানকারী মায়েদের শিশু জন্মের এক ঘন্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানো, ছয় মাস পর্যন্ত শুধুই বুকের দুধ খাওয়ানো, দুইবছর বয়স পর্যন্ত বুকের দুধের পাশাপাশি ঘরে তৈরি বাড়তি খাবার খাওয়ানোর উপকারিতা জানানোর কথা বলা হয়েছে। এছাড়া শিশুকে ফর্মুলা খাবার খাওয়ানোর কুফলসহ অভিভাবকদের শিশুর খাদ্য ও পুষ্টি সম্পর্কিত সচেতনতা তৈরিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলা হয়েছে।

আইনে ফর্মুলা খাবার বা মাতৃদুগ্ধের বিকল্প যেকোনো শিশুখাদ্য সম্পর্কে প্রকাশ্যে প্রচারণা এবং বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিপণন নিয়ন্ত্রণ ধারা ১২(১) অনুযায়ী এই আইনের কোনো ধারা লঙ্ঘন করলে তা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। এজন্য তিনবছর কারাদণ্ড এবং অনুর্ধ পাঁচ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।

মাতৃদুগ্ধ শুধু পুষ্টির উৎস নয়, শিশু স্বাস্থ্যের সুষম বিকাশের জন্য এটি অপরিহার্য। মায়ের সুস্থতার জন্যও এটি সমান উপকারী। শিশুর সুস্বাস্থ্য এবং রোগমুক্ত জীবনের জন্য মায়ের বুকের দুধের বিকল্প নেই।

মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর উপকারিতা ও সুফল সম্পর্কে সকলকে সচেতন করে তুলতে হবে। আমাদের সকলের সচেতনতা ও প্রচেষ্টাই পারে ভবিষ্যতের সুস্থ শিশুর বেড়ে ওঠা ও বিকাশ নিশ্চিত করতে।