পরীক্ষামূলক ‘রেফারেল’ দুই-তিন মাসের মধ্যে
জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিতে গুরুত্ব দেওয়া হলেও দেশের স্বাস্থ্যখাতে রেফারেল পদ্ধতি আগে কখনো চালু করা সম্ভব হয়নি। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তিন দফা উদ্যোগ নিয়েও করা যায়নি।
ক্ষমতার পালাবদলের পর আবার সেই রেফারেল পদ্ধতি চালুর উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সেজন্য একটি প্রকল্পের আওতায় করা হবে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সেখানে থাকবে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী।
মেডিকেল কলেজ, ইনস্টিটিউট বা বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোয় রোগীদের অপ্রয়োজনীয় ভিড় কমিয়ে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা এবং শৃঙ্খলা ফেরাতে ‘রেফারেল’ পদ্ধতি বাস্তবায়নের উদ্যোগের কথা বলছে সরকার।
এ ব্যবস্থা চালু হলে ঢাকায় মেডিকেল কলেজ, ইনস্টিটিউট বা বিশেষায়িত হাসপাতালে যাওয়ার আগে রোগীদের যেতে হবে স্থানীয় স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। সেখানকার চিকিৎসক রোগীকে দেখবেন, ব্যবস্থাপত্র দেবেন, প্রয়োজন হলে রোগীকে বড় হাসপাতালে ‘রেফার’ করবেন।
আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামের কিছু এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে রেফারেল পদ্ধতি চালু হবে বলেছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ২০২৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর ঢাকায় একটি বৈঠকে ‘রেফারেল’ চালুর বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয়। এরপর বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করেছেন তারা।
রেফারেল পদ্ধতি কী?
রেফারেল পদ্ধতির অধীনে একজন রোগী প্রথমে নিকটবর্তী সরকারি বা বেসরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যাবেন। যদি প্রয়োজন হয়, সেই স্বাস্থ্যকেন্দ্র রোগীকে একটি হাসপাতালে পাঠাবে যেখানে আরও উন্নত চিকিৎসা আছে, জনবল ও যন্ত্রপাতি আছে।
আর বড় হাসপাতালগুলো ছোট হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে পাঠানো রোগীদের চিকিৎসা দেবে। তবে গুরুতর রোগী হলেই চিকিৎসা দেবে, না হলে সেখানেই ফেরত পাঠাবে।
সুষ্ঠুভাবে রোগী ব্যবস্থাপনা ও উন্নত চিকিৎসার জন্য রেফারেল পদ্ধতি ব্যবহার হয়। এই পদ্ধতি অনুযায়ী, শুধু যার দরকার, সেই রোগীকেই এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়। পৃথিবীর অনেক দেশে এই পদ্ধতি চালু আছে। এসব দেশে চাইলেই কেউ যে কোনো হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেন না।
যেভাবে হবে বাস্তবায়ন
ঢাকায় রেফারেল পদ্ধতি কীভাবে চালু হবে তার একটি ধারণা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী সায়েদুর রহমান। একটি বেসরকারি সংস্থা ঢাকায় জিপিভিত্তিক (জেনারেল ফিজিশিয়ান) চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে। এই মডেলেই রেফারেল পদ্ধতি কাজ করবে।
এ পদ্ধতিতে রোগীরা সেবা নিতে সরাসরি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসে বা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আগে থেকে সিরিয়াল নিতে পারবেন। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসে জাতীয় পরিচয়পত্র, মোবাইল নম্বর দিয়ে নিবন্ধন করাবেন। নিবন্ধনের পর একজন প্যারামেডিক রোগীকে প্রাথমিক পরীক্ষানিরীক্ষা করে সেসব তথ্য সফটওয়্যারের মাধ্যমে কম্পিউটারে সংরক্ষণ করবেন।
সেখান থেকে রোগীকে পাঠানো হবে চিকিৎসকের কাছে। তিনি রোগের ধরন অনুযায়ী ব্যবস্থাপত্র দেবেন। অথবা বিশেষজ্ঞ কোনো চিকিৎসক দেখাতে হলে সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে রেফার করবেন।
সায়েদুর রহমান বলেন, রোগী প্রথমে যে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যাবেন সেই ‘পয়েন্ট অব রেফারেল’ তৈরি করতে হবে সবার আগে। এজন্য মেডিকেল কলেজ বা বড় হাসপাতালগুলোর আশপাশের কয়েকটি ওয়ার্ডের জন্য একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র করা হবে। প্রকল্পের আওতায় গড়ে তোলা প্রতিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চারজন চিকিৎসক থাকবেন। চিকিৎসকদের দুজন নারী, দুজন পুরুষ। তারা সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সেবা দেবেন।
“এই ধরনের ক্লিনিকগুলোকে পুরো শহরে বিস্তৃত করার আগে রেফারেল পদ্ধতিটা চালু করা যাবে না। জিপি বেইজড রেফারেল সিস্টেম চালু করার জন্য আমরা প্রাথমিকভাবে একটা বা দুইটা বড় হাসপাতালের চারপাশে ক্যাচমেন্ট এরিয়ায় একটা নেটওয়ার্ক করার চিন্তা করছি।”
তিনি বলেন, একটি প্রকল্পের আওতায় স্বাস্থ্য কেন্দ্রের জনবল নেওয়া হবে।
“আমাদের সরকারি চিকিৎসক কম। ফলে ক্যাডার সার্ভিসে যারা আছেন, তাদের দিয়ে এই কার্যক্রম চালানো হবে না। আবার নতুন করে সরকারি চিকিৎসক নেওয়াও সময়সাপেক্ষ। এ কারণে আমরা আলাদা একটা জেনারেল প্র্যাকটিশনার সার্ভিস তৈরি করব।”
সায়েদুর রহমান বলেন, প্রকল্পটি চালুর সঙ্গে আর্থিক বিষয় জড়িত। সেটার মূল্যায়ন হচ্ছে। শুরুতে ঢাকা ও চট্টগ্রামে রেফারেল পদ্ধতি চালু করা হবে।
“ঢাকায় আড়াই কোটি মানুষের বাস, চট্টগ্রামে ৫০ লাখ। এজন্য অন্তত বড় শহরগুলোয় রেফারেল আমরা পাইলটিং করব। আশা করছি তিন মাসের মধ্যে হয়তো পাইলটিং করে দেখাতে পারব, এটা হবেই।”
২০১৪ সালে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে রংপুর বিভাগে রেফারেল পদ্ধতি চালুর উদ্যোগের কথা বলেছিলেন। কিন্তু প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক, সহায়ক স্বাস্থ্যকর্মী ও অন্য সব সহায়তার ঘাটতির কারণে তা সম্ভব হয়নি। এরপর ২০১৬ ও ১০১৯ সালে উদ্যোগ নিলেও বাস্তবায়ন করা যায়নি।
সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সায়েদুর রহমান বলেন, “আগের বিষয়টি নিয়ে আমরা ভাবছি না। নতুন করে শুরু করছি।”
রেফারেল হলে কী সুবিধা
ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন বিশেষায়িত হাসপাতালে ঢাকার বাইরে থেকে আসা রোগীদের ভিড় সবসময় লেগেই থাকে। চিকিৎসকরা বলছেন, হাসপাতালে যারা আসছেন তাদের অনেকেরই স্থানীয় পর্যায়ের হাসপাতালে চিকিৎসা নিলেই হত।
বাংলাদেশে শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহমুদুল হক ২ জানুয়ারি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাদের হাসপাতালের জরুরি বিভাগ, বহির্বিভাগে যেসব শিশু আসে তাদের এক তৃতীয়াংশের এখানে আসা কোনো প্রয়োজন ছিল না।
“কিছু রোগী আউটডোরে চলে আসে যাদের না আসলেও চলে। আবার যেসব রোগী হাসপাতালে ভর্তি করার মত, জরুরিভিত্তিতে আইসিইউ লাগবে, সেসব রোগীও রেফার হয়ে এলে ভালো। কারণ বেড না থাকলে রোগীটাকে ভর্তি নেওয়া যায় না। রেফার হয়ে এলে রোগীর ভোগান্তি কম হয়।”
জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি ২০১১ এ কার্যকর রেফারেল পদ্ধতির মাধ্যমে শহর ও গ্রামের জটিলতর রোগীদের পরবর্তী ধাপে চিকিৎসার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে।
কিন্তু, সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৫৯ শতাংশ রোগী নিজে থেকে চিকিৎসার জন্য এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে যান। রেফারেল পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা নেই ৫৮ শতাংশ রোগীর।
গবেষণার জন্য ২০২২ সালে বাংলাদেশের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বেসরকারি ডেল্টা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৮২২ জন রোগীর তথ্য নেওয়া হয়।
বাংলাদেশে রেফারেল পদ্ধতি কীভাবে কাজ করছে তা দেখতে ‘পেশেন্ট সেলফ-রেফারাল প্যাটার্নস ইন আ ডেভেলপিং কান্ট্রি: ক্যারেক্টারস্টিকস, প্রিভেলেন্স, অ্যান্ড প্রেডিক্টরস’ শিরোনামে গবেষণাটি করা হয়েছিল। ১৬ জন গবেষকের করা গবেষণা প্রবন্ধটি ২০২৪ সালের ২১ মে আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা স্প্রিঙ্গার নেচারের বিএমসি হেলথ সার্ভিসেস রিসার্চ সাময়িকীর অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত হয়।
গবেষক দলের সদস্য ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের গ্লোবাল হেলথ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌফিক জোয়ারদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সারা পৃথিবীতেই রেফারেল পদ্ধতি খুব জরুরি। তা না হলে চিকিৎসার মান নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, সময়মত চিকিৎসাসেবা পৌঁছানো যায় না।
“সাধারণ জ্বর সর্দিকাশি নিয়ে যদি কোনো রোগী এই বিষয়ে সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে সরাসরি চলে যান তাহলে হল না। এতে যেটা হয়, ওই সময় ওই চিকিৎসককে যার বেশি দরকার সেই রোগীকে তিনি দেখতে পারবেন না। ফলে যার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল, সেই রোগী সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হল।”
তিনি বলেন, ‘রেফারেল’ চালু করতে হলে প্রাথমিক পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবার মান বাড়াতে হবে।
“উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে একটি রোগী যদি গিয়ে সেবা না পায়, আস্থা না পায় তাহলে সে জেলা পর্যায়ে বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাবে। রেফারেল চালু করা যেমন জরুরি তেমনি প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার মান নিশ্চিত করাও জরুরি।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবদুল হামিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘রেফারেল’ চালু করা হবে খুবই ভালো উদ্যোগ। তবে সেটা চালুর আগে প্রাথমিক পর্যায়ে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যকেন্দ্র নিশ্চিত করতে হবে যেন মানুষ তার কাঙ্ক্ষিত সেবা পায়।
“এখানে কন্ডিশন দুটো-আমার বাড়ির কাছে যে হাসপাতাল তা কোয়ালিটিসম্পন্ন হতে হবে এবং সেখান থেকে আমাকে যে হাসপাতালে পাঠানো হবে সেখানে যেন রেফারড রোগী হিসেবে সেবাটা পাই।
“যেখানে পাঠানো হচ্ছে সেখানে যেন আমাকে নতুন রোগী হিসেবে দেখা না হয়। হাসপাতালগুলোয় রেফারড রোগীর জন্য আলাদা লাইন করে দিতে হবে। রোগীরা যখন দেখবে রেফারেল নিয়ে গেলে প্রায়োরিটি দেয় তাহলে রোগীরা উৎসাহিত হবে।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০২৪ সালের জুন মাসে প্রকাশিত হেলথ বুলেটিনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বিএমডিসি রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের সংখ্যা ১ লাখ ৪২ হাজার, তাদের মধ্যে ১৩ হাজার ৫৮৮ জন ব্যাচেলর অব ডেন্টাল সার্জারি-বিডিএস ডিগ্রিধারী, বাকিরা ব্যাচেলর অব মেডিসিন, ব্যাচেলর অব সার্জারি- এমবিবিএস।
সরকারি হিসেবে ১২০৪ জনের জন্য একজন চিকিৎসক রয়েছেন। সরকারি চিকিৎসকের সংখ্যা ২৯ হাজার ৭৪৩ জন, সে হিসাবে প্রতি ৫৭৪৯ জনের জন্য একজন সরকারি চিকিৎসক আছেন।