মঙ্গলবার ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, পৌষ ২৪ ১৪৩১, ০৭ রজব ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

ভারতের ভিসা সীমিত, স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের সুযোগ কতটা?

 প্রকাশিত: ১০:৫৯, ৫ জানুয়ারি ২০২৫

ভারতের ভিসা সীমিত, স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের সুযোগ কতটা?

ক্ষমতার পালাবদলের পর বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক টানাপড়েনের কারণে অগাস্টের মাঝামাঝি থেকে ভারত ভিসা সীমিত করায় স্বাস্থ্যখাতে বাংলাদেশের জন্য বড় সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

তবে এ সুযোগ বাংলাদেশ কতখানি নিতে পারবে, তা নির্ভর করছে অনেক কিছুর ওপর; যেখানে বহুদিন ধরেই সেবার মান নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনদের নানা অভিযোগ রয়েছে।

তাই রোগীর স্বজন, স্বাস্থ্যখাতের উদ্যোক্তা ও সরকারি কর্তৃপক্ষ বলছে, ভিসা সীমিত করার ফল সৃষ্ট সুযোগ নিতে হলে সেবার মান বাড়ানোসহ বেশকিছু সংস্কার করতে হবে।

কয়েকজন রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, সঠিক রোগনির্ণয়ের সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় ওষুধ ও অযথা রোগনির্ণয়ের সুপারিশ বন্ধ করতে হবে। এছাড়া রোগীদের সঙ্গে চিকিৎসকদের আচরণে পরিবর্তন আনতে হবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এখন রোগীরা দেশেই থাকছে, তারা দেশে খরচ করছে। এটা একটা বড় সুযোগ।

বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকার স্বাস্থ্যখাতে সামর্থ্য বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছেও আবেদন করা হয়েছে যেন তারা চিকিৎসার খরচ কমিয়ে দেয়।

অতিরিক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধ লেখাসহ কয়েকটি বিষয়ে রোগীদের আক্ষেপের বিষয়ে ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, “বাংলাদেশের চিকিৎসকরা রোগীদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত পরীক্ষা করান– এটা একটা ধারণা।

“অতিরিক্ত পরীক্ষার যে কথাটা বলা হয় সেগুলো ক্যান্সার, ট্রান্সপ্লান্টের মত চিকিৎসায় হয়। পৃথিবীর যেখানেই যাক, অনেক পরীক্ষা করাতে হবে।”

বাংলাদেশ থেকে ক্যান্সার, হৃদরোগ, কিডনি রোগ, প্রজননস্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা নিতে ভারতে যান অনেক বাংলাদেশি নাগরিক। প্রতিবছর কত লোক ভারতে চিকিৎসা নিতে যায় তার সঠিক পরিসংখ্যান বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাওয়া যায়নি।

তবে ভারত সরকারের তথ্যের বরাতে দ্য প্রিন্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালে বাংলাদেশিদের জন্য প্রায় ১৬ লাখ ভিসা ইস্যু করেছিল ভারত। এর মধ্যে সাড়ে ৪ লাখ ছিল মেডিকেল ভিসা। অনেকে ভ্রমণ ভিসায় গিয়েও ভারতে চিকিৎসা করিয়ে আসেন। ফলে চিকিৎসা নেওয়া বাংলাদেশিদের প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি হওয়ারই কথা।

২০২৪ সালের অগাস্ট পর্যন্ত ১৫ ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশিদের জন্য ৮ লাখ ভিসা ইস্যু করা হয়েছিল। যার মধ্যে মেডিকেল ভিসা ছিল ২ লাখ।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ঘিরে সরকার পতন পরবর্তী প্রেক্ষাপটে মেডিকেল বা জরুরি ভিসা বাদে অন্য কোনো ভিসা দিচ্ছে না ভারত সরকার। মেডিকেল ভিসাও দেওয়া হচ্ছে সীমিত আকারে। এর মধ্যে আবার ৫ ভিসা আবেদন কেন্দ্রে সীমিত পরিসরে কাজ চলায় মেডিকেল ভিসাপ্রত্যাশীদের অনেকে পাচ্ছেন না ভিসা আবেদন জমা দেওয়ার অ্যাপয়েন্টমেন্ট।

রোগীদের ভারতে যাওয়ার কারণ কী

কয়েকজন রোগীর স্বজন বলেছেন, বাংলাদেশে চিকিৎসকরা ভালোভাবে ‘মনোযোগ’ দিয়ে রোগী দেখেন না, রোগীর কথা ‘শোনেন না’। অনেকক্ষেত্রেই সঠিক রোগ ‘নির্ণয় করতে পারেন না’, ‘অপ্রয়োজনীয়’ ওষুধ লেখেন। এসব কারণে যাদের সামর্থ্য আছে, তারা ভারতমুখী হচ্ছেন।

নরসিংদীর মাধবদীর কাপড় ব্যবসায়ী মাসুম বিল্লাহ চৌধুরী তার নিজের বাবা, শ্বশুর আর ছোটভাইয়ের চিকিৎসা করাতে কয়েকবার বিদেশে গেছেন। সবচেয়ে বেশি গেছেন ভারতে। প্রতিবারই গেলে আড়াই থেকে তিন হাজার ডলার খরচ হয় তার।

মাসুম বিল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে বিদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার কিছু পার্থক্য আছে। বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন আনতে পারলে রোগীরা বিদেশমুখী হত না।

তিনি বলেন, “বিদেশে ডায়াগনোসিস (রোগনির্ণয়) ভালো, রোগীদের সমস্যা দীর্ঘ সময় নিয়ে শোনেন, আচরণ ভালো।

“ভারত ভিসা দিচ্ছে না, এটা আমাদের জন্য বড় একটা সুযোগ। কিন্তু এই সুযোগ কাজে লাগাতে হলে চিকিৎসকদের আচরণ ভালো করতে হবে। ওষুধ কোম্পানির কমিশন খাওয়া, অযথা রোগ নির্ণয়ের সুপারিশ করা বন্ধ করতে হবে।”

পুরান ঢাকার নিহার রঞ্জন ধর নামে আরেক ব্যবসায়ী বলেন, “বাংলাদেশের চিকিৎসকদের চিকিৎসায় অবহেলা, অতিরিক্ত বিল ধরা, অপ্রয়োজনীয় খরচের কারণে বিদেশে যেতে হয়।

“আমার মেয়ের হার্টে সমস্যা ছিল। ঢাকার একটি বড় হাসপাতালের চিকিৎসক বলেছিলেন দ্রুতই সার্জারি করতে হবে। খরচ হবে ৭-৮ লাখ টাকা। আমার ভিসা ছিল, তাই ওকে নিয়ে দ্রুত ভারতের চেন্নাই যাই। তারা কোনো সার্জারি করেনি, ওষুধ খেয়েই সে ঠিক হয়ে গেছে। এখন বলেন, আমি কই যাব? আমাদের এখানে প্রপারলি ট্রিটমেন্ট করলে কেউ বিদেশে যেত না।”

গত ২১ ডিসেম্বর রাজধানীর সিরডাপ মিলায়তনে ‘চিকিৎসা সেবায় বিদেশমুখীতা: আমাদের উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব সারওয়ার বারীও বলেন, ‘আস্থাহীনতার কারণে’ বিপুল সংখ্যক মানুষ চিকিৎসা নিতে বিদেশ ছোটে।

অনুষ্ঠানে আইসিডিডিআরবি’র গবেষক আহমেদ এহসানুর রহমান বলেন, ক্যান্সার, কিডনি রোগ, হৃদরোগ, চোখের রোগের মত ১২ রোগের চিকিৎসায় ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ ১৯টির বেশি দেশে প্রতি বছর চিকিৎসা নিতে যান ৮ লাখের বেশি মানুষ; তাদের ৫১ শতাংশই ভারতে যান।

তার উপস্থাপন করা তথ্য অনুযায়ী, বিদেশগামী রোগীদের ৫৩ শতাংশ মূলত রোগনির্ণয় বা চেকআপের জন্য বিদেশ যান।

বাংলাদেশের সামনে ‘বড় সুযোগ’

ভারতের ভিসা কড়াকড়ির কারণে বাংলাদেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগী ‘কিছুটা’ বাড়ার কথা বলেছেন বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এম এ মুবিন খান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ভারত বাংলাদেশি রোগীদের জন্য একটি জনপ্রিয় চিকিৎসা গন্তব্য। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভিসা বা যাতায়াত সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জের কারণে অনেকে দেশেই চিকিৎসা নিতে বাধ্য হয়েছেন।”

ভারতের ভিসা বন্ধ করে দেওয়া দেশের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে একটি সুযোগ হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে। তবে এজন্য কিছু সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন মুবিন খান।

তিনি বলেন, “দক্ষ চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেওয়া, বিভিন্ন বিশেষায়িত সেবা যেমন ক্যান্সার, হৃদরোগ এবং নিউরোসার্জারি কেন্দ্র স্থাপন ও সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্পন্ন চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হবে। আন্তর্জাতিক মানের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার লক্ষ্যে আধুনিক হাসপাতাল স্থাপন এবং বিদ্যমান হাসপাতালগুলোর সম্প্রসারণও দরকার।”

স্কয়ার হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী এশাম ইবনে ইউসুফ সিদ্দিকি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিদেশে যারা চিকিৎসা নিতে যায় তাদের ৯৫ শতাংশেরই যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।

“৫ শতাংশ যেতে পারেন, যাদের রোগ নির্ণয়ে বা চিকিৎসায় টেকনোলজি, যন্ত্রপাতি বা এক্সপার্টিজ (দক্ষ চিকিৎসক) বাংলাদেশে নেই।”

বাংলাদেশে উচ্চ প্রযুক্তির চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমরা দেখেছি একটা সাধারণ কার্ডিয়াক সার্জারি, এনজিওগ্রামের জন্য লোকজন ভারতে যায়। এটা বাংলাদেশে অহরহ হচ্ছে।”

এশাম ইবনে ইউসুফের মতে, বাংলাদেশের চিকিৎসকদের চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষমতা নিয়ে ‘কোনো সন্দেহ নেই’। তবে তাদের ‘কাউন্সেলিং করার দক্ষতা কম’।

“ইন্ডিয়াতে ডাক্তারদের কাউন্সেলিং শেখায়, এ ক্ষেত্রে আমাদের এখানে ঘাটতি আছে বলে আমার মনে হয়। আমাদের চিকিৎসকরা ট্রিটমেন্ট ঠিকই দিচ্ছেন, কিন্তু বিষয়টি সুন্দর করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন না।”

দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিশেষায়িত চিকিৎসার সুযোগ কিছুটা হলেও বেড়েছে। ক্যান্সার চিকিৎসায় ঢাকায় রয়েছে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। বিভাগীয় পর্যায়েও হাসপাতাল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

প্রান্তিক মানুষের জটিল রোগের উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল’ করা হয়েছে।

তবে ক্যান্সার, হৃদরোগ, কিডনিরোগসহ জটিল রোগ চিকিৎসার সুযোগ অনেকটাই ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে।

ক্যান্সার ও হৃদরোগ চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত কেন্দ্র গড়ে উঠেছে বেসরকারি পর্যায়ে। কয়েকটি বেসরকারি ক্যান্সার হাসপাতাল হয়েছে।

ইউনিভার্সাল হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. আশীষ কুমার সাহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উন্নত বিশ্বে আছে, এমন সব চিকিৎসাসুবিধা এখন বাংলাদেশে আছে। বাংলাদেশে ভালো চিকিৎসা হয়, তা প্রমাণ হয়েছে কোভিডের সময়।

“সে সময় ভারত কেন, পৃথিবীর কোথাও যাওয়ার সুযোগ ছিল না, সব চিকিৎসা আমাদের দেশেই হয়েছে। আমেরিকা, ইংল্যান্ডে যেসব কার্ডিয়াক অস্ত্রোপচারসহ যাবতীয় চিকিৎসা হয় সেগুলো বাংলাদেশেও হয়। অন্যান্য রোগের চিকিৎসাও ভালো। আমার মনে হয়, বিদেশমুখীতার কারণ আমাদের মানসিক দৈন্য।”

আশীষ সাহা বলেন, বাংলাদেশে কিডনি, বোনম্যারো ও লিভার ট্রান্সপ্লান্ট, বোন অ্যান্ড জয়েন্টস ট্রান্সপ্লান্টও হচ্ছে। খরচ রোগীদের ‘নাগালের মধ্যেই’।

তার মতে, বাংলাদেশের চিকিৎসকদের প্রতি রোগীদের আস্থা ফেরাতে সবার আগে রেফারেল সিস্টেম চালু করতে হবে।

“এই পদ্ধতিতে চাইলে যে কেউ যেকোনো চিকিৎসককে দেখাতে পারবেন না। সবার আগে জেনারেল ফিজিশিয়ানকে দেখাতে হবে। তিনি রোগীকে দেখে বলে দিবেন রোগী কোন চিকিৎসকের কাছে যাবে। আমাদের এখানে কিছু চিকিৎসককে দেখানোর জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়। তখন এটা থাকবে না।”

ল্যাবএইড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এ এম শামীম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ভারত ভিসা বন্ধ করার পর তাদের হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। ভারত যেতে না দিলেও সেই রোগীদের চিকিৎসা দেশেই দেওয়া সম্ভব।

“সেটা ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত হবে। আসলে ভারতে যারা যায়, তাদের বেশিরভাগই সেকেন্ড অপিনিয়নের জন্য যায়। আরেকটা অংশ যশোর, খুলনা বেল্টের মানুষ। তারা ঢাকায় না এসে বর্ডার পার হয়ে ভারতে চলে যায়।”

বেসরকারি পর্যায়ে টার্শিয়ারি কেয়ারের (জটিল রোগের চিকিৎসায় সম্পূর্ণ বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা) জন্য ২০ হাজার শয্যা আছে, তার ২০ শতাংশের মতো খালি থাকে। ভারতে দৈনিক ৮০০ থেকে এক হাজার রোগী যায়। আমাদের এখানে যে শয্যা খালি থাকে সেখানেই এদের চিকিৎসা সম্ভব বলে মনে করেন ডা. শামীম।

সুযোগ কাজে লাগাতে যা করতে হবে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মো. আবদুল হামিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাংলাদেশের চিকিৎসকদের প্রতি রোগীদের আস্থাহীনতা, অবকাঠামোর অপ্রতুলতা রোগীদের বিদেশমুখী করেছে। এজন্য এসব জায়গায় সংস্কার করতে হবে।

“চিকিৎসকদের কাছে রোগীদের প্রত্যাশা বেশি। ভালো আচরণ, পর্যাপ্ত সময় নিয়ে রোগী দেখা, রোগীর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবেন। ব্যবস্থাপত্র দেওয়ার পর সেটা রোগীকে ভালো করে বুঝিয়ে দিতে হবে। শুধু ডাক্তার না, পুরো সিস্টেমটাকে পেশেন্ট ফ্রেন্ডলি করতে হবে।”

রোগ নির্ণয়ের মান বাড়ানো, চিকিৎসায় সরকার-বেসরকারি অংশীদারত্ব, রোগীদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার ও কিডনি কমিশন গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন এই বিশেষজ্ঞ।

“আমাদের এখানে রোগ নির্ণয়ের মানে ঘাটতি আছে, সেটা বাড়াতে হবে। ক্যান্সারসহ কিছু চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় জনবল নাই, স্বল্প সময়ে ট্রেনিং দিয়ে এটা বাড়াতে হবে। সরকারি হাসপাতালগুলোর সঙ্গে বেসরকারি হাসপাতালের পার্টনারশিপ তৈরি করতে হবে।”

তিনি বলেন, “ঢাকা মেডিকেল কলেজে দুপুরের পর কিছু সেবা বন্ধ থাকে, কিন্তু রোগী আসা বন্ধ হয় না। সরকার রেট নির্ধারণ করে দেবে, রোগীরা সে অনুযায়ী প্রাইভেট হাসপাতাল থেকে পরীক্ষা করিয়ে আনবে।”

কিডনি চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা বিষয়ে হামিদ বলেন, “বাংলাদেশে অনেকে আইনের কারণে কিডনি দিতে পারে না। কিন্তু দেশের বাইরে গিয়ে ঠিকই কিডনি দেয়, গ্রহণ করে। সমস্যাটি সমাধানে ন্যাশনাল কিডনি কমিশন করার দরকার। সেখানে দাতা-গ্রহীতা নিবন্ধন করবে, এর একটা মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। যাদের কিডনি প্রয়োজন তারা কিডনি নেবেন।”

সেবার মান বাড়াতে কী উদ্যোগ?

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা খুব একটা পিছিয়ে নেই। তারপরও বিদেশমুখী হওয়ার অনেক কারণ, যার কিছুটা ‘মনস্তাত্বিক’।

“শুধু ভারত নয়, অনেক দেশেই লোকজন যাচ্ছে। যেতেই পারেন, এটা তাদের অধিকার। তবে আমাদের যে সক্ষমতা আছে, সেটা করোনাভাইরাস মহামারীর সময় দেখা গেছে। সে সময় শুধু ভারত নয়, কোনো দেশেই যাওয়া যায়নি। সে সময় আমাদের দেশের চিকিৎসকরাই রোগীদের চিকিৎসা দিয়েছে।”

তিনি বলেন, কিছু সীমাবদ্ধতা থাকার পরও বাংলাদেশ চিকিৎসায় অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে আছে। বেসরকারি চিকিৎসাখাতও উন্নত হয়েছে।

“এক বা দুই সপ্তাহে এই উন্নতি দেখানো সম্ভব নয়। এরজন্য সময় লাগবে। আমারও বিষয়টি জাতীয়ভাবে ইতিবাচকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছি। চিকিৎসকদের নির্দেশনা দিচ্ছি তারা যেন রোগীদের প্রতি আরেকটু দরদি হয়।”

তিনি বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে সিন্ডিকেট করে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে বিধ্বস্ত করা হয়েছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা একেবারে ভেঙে দিয়েছে। আমরা এগুলো ঠিক করার চেষ্টা করছি।”

ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশ পরিচালনায় দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাত সংস্কারে ১১টি কমিশন গঠন করেছে। এর মধ্যে একটি হল- জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খানের নেতৃত্বাধীন স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন।

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বেশিরভাগ রোগী হৃদরোগ, ক্যান্সার, কিডনিসহ নানা ধরনের ট্রান্সপ্লান্ট এবং ইনফার্টিলিটি-এই চারটি রোগ নিয়ে বিদেশ যাচ্ছে।

গত ১৫ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালের প্রতিনিধি, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এসব রোগের চিকিৎসা দেশেই সহজলভ্য, কম খরচে যেন পাওয়া যায় সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

“সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সামর্থ্য বাড়ানোর জন্য আমরা বলেছি, এটা অবশ্যই প্রফিটের জন্য নয়। এসব রোগের চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট যেসব প্রকল্প চলমান আছে সেগুলোর গতি বাড়াতে বলা হয়েছে।

“রাষ্ট্রের আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনায় এইসব রোগের ওষুধ যন্ত্রপাতি আমদানিতে কর অব্যাহতি দেওয়া হবে।”

সায়েদুর রহমান বলেন, “সমস্যা সমাধানে প্রটোকলভিত্তিক চিকিৎসাকে উৎসাহিত করছি। যেমন ক্যান্সারের চিকিৎসায় সারা বিশ্বে একইরকম ওষুধ ব্যবহার হবে। অতিরিক্ত ওষুধ লেখার ব্যাপার থাকবে না।”

রোগীদের কাউন্সেলিং করতে না পারার বিষয়ে ল্যাবএইডের ডা. শামীম বলেন, তারা এ সমস্যা সমাধানে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে ‘আস্থা’ নামে একটি প্রকল্প নিয়েছেন।

আগামী জানুয়ারি থেকে স্বাস্থ্যকর্মীদের কাউন্সেলিং চর্চা শুরুর কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ আমাদের ৪০টি স্থাপনায় এই ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছি।

“তাদের কাজ হবে বড় কোনো রোগের চিকিৎসার জন্য যারা আসেন তাদের ডিটেইল বোঝানো। যাতে উনারা নিজেরা সেটিসফায়েড থাকেন যে, উনার কী হয়েছে এবং কী চিকিৎসা হতে যাচ্ছে। চিকিৎসার পর করণীয় কী, সুস্থতা কতটা হল- রোগীদের এই বিষয়গুলো বুঝিয়ে দেবেন তারা।”